কালী পূজার দিনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে গুরুচাঁদ ঠাকুর কী করতে বলেছিলেন? লেখক- জগদীশচদ্র রায় (মুম্বাই)
কালী পূজার দিনে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে
গুরুচাঁদ ঠাকুর কী করতে বলেছিলেন?
লেখক- জগদীশচদ্র রায় (মুম্বাই)
(আমার লেখা বই ‘গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ
সংস্কার ও মুক্তির দিশা’ থেকে তুলে দিলাম )
প্রায়ই শুন্তে পাই, গুরুচাঁদ ঠাকুর
লক্ষ্মীখালীতে কালী পূজা চালু করেছিলেন। তা হলে দেখা যাক, “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত” অনুসারে কি বর্ণনা আমরা পাই। সেখানে বাস্তবে কি হয়েছিল এবং বর্তমানে কি
হয় তার অনুসন্ধানে ব্রতী হওয়া যাক।
কবি মহানন্দ হালদার রচিত ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত’-এ বিষয়ের নামকরণ করা হয়েছে- “শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
কর্ত্তৃক লক্ষ্মীখালীতে কালীপূজা” (পৃ.৫২৬, ১ম প্রকাশ
১৯৪২)। আবার এই কবিরই অন্য গ্রন্থ ‘সোনার
মানুষ গোপাল সাধু’ (পৃ. ৫৬৭, ১ম প্রকাশ ১৯৯২)। বিষয়ের নামকরণ করা হয়েছে- ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের
লক্ষ্মীখালী উপস্থিতি ও কালীপূজার দিনে ঠাকুরোৎসব উদ্বোধন’।একই
কবির লেখা দুটো গ্রন্থে নামকরণের মধ্যে অনেক ভিন্নতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রথম
গ্রন্থ সকলের কাছে বেশি পরিচিত। কিন্তু নামকরণে বিভ্রান্তি দেখতে পাচ্ছি।
সেক্ষেত্রে ২য় গ্রন্থ পরে প্রকাশিত এবং নামকরণে স্পষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে। এবার
ঘটনার বাস্তবতার ব্যাখ্যা ও বিচার-বিশ্লেষণে প্রবেশ করা যাক।
গুরুচাঁদ ঠাকুর লক্ষ্মীখালীতে বিভিন্ন ভক্তদের
বাড়িতে যান। তিনি যেদিন গোপাল সাধু ও কাঞ্চন (গোপাল সাধুর জীবন সঙ্গীনী) মাতার
বাড়িতে সকাল বেলা উপস্থিত হন; সেদিন ছিল কালীপূজার
দিন। তাই, ঠাকুর বলেন-
“মোর মনে এই ইচ্ছা
হয়েছে গোপাল।
আয়োজন কর তাই সকাল
সকাল।।
আমরাও কালীপূজা করিব
আজিকে।
আমাদের পূজা মাতা
নিবেন পুলকে।।”
(শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত পৃঃ ৫২৬)
ঠাকুরের
কথা শুনে সকলে খুব আনন্দ পায়। কিন্তু –
কাঞ্চন জননী তা’তে তুলিলেন দ্বন্দ্ব।
মাতা কয় “এই কার্য
মনে নাহি লয়।।
মতো’ বাড়ী অন্য পূজা
কবে কোথা’ হয়?” (পৃঃ ঐ)
তারপর
মাতা কাঞ্চন আরো বলেন-
“কিন্তু কালীপূজা
মোরা কিছুতে না করি।
আমরা পুজিব মাত্র
গুরুচাঁদ হরি।।”
জননীর কথা শুনে
দ্বিগুণ আনন্দ।
কাটিলা জননী তবে
ভক্ত-মন-সন্দ।। (ঐ পৃঃ ৫২৭)
একটা বিষয় পাঠকগণ লক্ষ্য
করুন, কবির বর্ণনানুসারে আমরা দেখতে পাচ্ছি- গুরুচাঁদ ঠাকুর কালীপূজা করার নির্দেশ
দিলে একমাত্র মাতা কাঞ্চন জানাচ্ছেন,- “একথা আমি মেনে নিতে পারছিনা। মতুয়াদের বাড়িতে আবার কোন দিন অন্য
পূজা হয়েছে নাকি?” তাই তিনি বলেন, যে,“কালীপূজা আমরা কিছুতেই করব
না। আমরা শুধু পূজা করব হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে।” আসলে ঠাকুর এখানে ভক্তের মনের
দৃঢ়তার পরীক্ষা করলেন। সেটা হচ্ছে- ভক্ত যে ঠাকুরের অনৈতিক কথার প্রতি প্রশ্ন
তোলার সাহস দেখাতে পারেন তার পরীক্ষা। কাঞ্চন মাতার এই যুক্তি শুনে সকলে দ্বিগুণ
আনন্দ করে। আর ভক্তদের মনের সন্দেহ দূর হয়।
এখানে দুটো বৈপরিত্য ঘটছে। গুরুচাঁদ ঠাকুর
বললেন কালীপূজা করতে। আর কাঞ্চন মাতা বললেন- সেটা কিছুতেই করা সম্ভব নয়। এটা
মতুয়াদের বাড়িতে হয়না। মতুয়ারা শুধু হরি-গুরুচাঁদের পূজা করে।
তাহলে কি আমরা এটা ধরে নেব যে, গুরুচাঁদ
ঠাকুর যে কালীপূজা করতে বলছেন? আসলে সেটা কি কালীপূজাই ছিল? তিনি ভক্তদেরকে
পরীক্ষা করছেন মতুয়া ধর্ম দর্শনের প্রতি
তাদের আস্থা কতটা গভীর। দ্বিতীয় আর একটি কথাও আমরা ভাবতে পারি সেটা হচ্ছে,
আমরা কোনো দেব-দেবীর পূজার সময় যদি বলি- ‘মতুয়াদের এ সব করা ঠিক নয়।’ তখন
কেউ কেউ বলেন, ‘তাহলে এর কিছু বিকল্প দরকার। বিকল্প না পেলেতো মানুষ ঐ দেব-দেবী
বা বৈদিকবাদী আকর্ষণে আকৃষ্ট হবে।’ তাহলে আমরা ভাবতে পারি না কি, গুরুচাঁদ
ঠাকুর কালীপূজার দিনে বিকল্প ব্যবস্থা
করলেন?
(এখানে পাঠকগণের
জ্ঞাতার্থে জানাই, যে, এই লেখা লিখতে গিয়ে বিস্বস্ত সূত্রে জানলাম যে, সেই সময়
অর্থাৎ (১৩২৫ বঙ্গাব্দের ৯ ই কার্তিক/১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর,
বরিবার ছিল চিত্রা নক্ষত্র, অমাবস্যা তিথি। সূত্র- “শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র
সুধা”- সম্পাদক – ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার। পৃঃ ৩৯৩) লক্ষ্মীখালীতে জমিদার
বঙ্কিমচন্দ্র শিকারী (বর্তমানে তাঁরা সরকার) এর বাড়িতে প্রতিবছর কালীপূজা হতো।
তিনি নমঃ হলেও মতুয়া নন। তাই মতুয়াদের তিনি ভালোচোখে দেখতেন না। আর
তাঁর বাড়িতে মতুয়াদের প্রবেশাধীকার ছিলনা কালীপূজাতে। এটা গুরুচাঁদ ঠাকুর জানতে ও
বুঝতে পেরে তিনি বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে কালীপূজার দিনে “ঠাকুর উৎসব” এর
সূত্রপাত করেন। যেটা এখনো অব্যাহত। ওখানের মতুয়ারা কোনো কালীপূজা করেন না। এমনকি
গোপালচাঁদের বংশধরেরা হরি-গুরুচাঁদ ভিন্ন অন্য কোনো দেব-দেবীর পূজা করেননা।)
তারপর-
সন্ধ্যাকালে হ’ল মহা
নাম সংকীর্ত্তন।
আনন্দে মতুয়া সব করিল
নর্ত্তন।। (ঐ পৃঃ ৫২৭)
সন্ধ্যার সময় পূজা শুরু
হ’ল। কিন্তু কিভাবে? মহা নাম সংকীর্ত্তন করে। যে নাম সংকীর্ত্তনে প্রায় পাচঁ হাজার
ভক্তের সমাগম হয়। এবং এইভাবে নাম সংকীর্ত্তন করে সকলে খুব আনন্দ উপভোগ
করে। তারপর-
এদিকে দয়াল প্রভু
মন্দিরে বসিল।
আলোকে ঝলকে যে যামিনী
হাসিল।। (ঐ পৃঃ ৫২৭)
তাহলে আমরা কি দেখতে
পাচ্ছি? মাটির কালী প্রতিমা কিন্তু মন্দিরে স্থাপন করা হয়নি। সেখানে গুরুচাঁদ
ঠাকুর নিজেই মন্দিরে গিয়ে বসেন।
কবির কথা অনুসারে আমরা দেখতে পাই, ঠাকুর
পুরাণ কথা ভক্তগণকে বলছেন। কিন্তু সেই
পুরাণ কথা কি হ’তে পারে? এখানে কিন্তু বিদগ্ধ পাঠকগণকে ভাবতে হবে। এখানে কবির
দেওয়া বৈদিক বর্ণনাকে মেনে নেবেন? না কি গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও কর্ম থেকে
আমরা যেটা যুক্তিতে পাই সেটা? আমরা যেটা যুক্তিতে পাই সেটা হচ্ছে যে, তিনি
ভক্তগণকে পৌরাণিক কাহিনি শুনিয়েছেন এমনভাবে যে ভক্তগণ বুঝবেন ঐসব কাহিনি
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সুবিধার জন্যই তৈরী করেছে। তাই ভক্তগনকে ভক্তির মধ্যে মুক্তি খুঁজলে
চলবেনা। তাদের সন্তানদেরকে প্রকৃত শিক্ষায়
শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই মুক্তি আসবে। আমার যুক্তির সামঞ্জস্য পাই পরদিন ‘জাগরণী
উৎসব’-এর বর্ণনার মধ্যে দিয়ে। সেটা পরে আসছি। যাইহোক, মন্দিরে বসে গুরুচাঁদ ঠাকুর
ভক্তগণের উদ্দেশে সুদীর্ঘ আলোচনা করার পর-
প্রভু যবে করিলেন বাক্য সমাপন।
কাঞ্চন জননী পূজা করিল তখন।।
চরণ বরণ করি দুর্ব্বাদল দিল।
ধান্য-দুর্ব্বা এক সঙ্গে শিরেতে রাখিল।।
নয়নের জলে দেবী বয়ান ভাসায়।
‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে আর কিছু নাহি কয়।। (ঐ পৃঃ ৫২৮)
ঠাকুর উৎসবের প্রচলনঃ-
মাতা কাঞ্চনের পূজা সমাপ্ত
হলে গুরুচাঁদ ঠাকুর গোপাল সাধুকে ডেকে বলেন-
“এই পূজা ক’রো তুমি
প্রত্যেক বছরে।”
তদবধি লক্ষ্মীখালী
কালীপূজা দিনে।
“ঠাকুর উৎসব” করে
মিলি ভক্তগণে।। (ঐ পৃঃ ৫২৮)
আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? কালীপূজার দিনে
এইভাবে এক মহাজাগরণী উৎসব হয়। যে উসবের নাম “ঠাকুর উৎসব”। যেটা করতে
গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই থেকে কালীপূজার দিনে এই “ঠাকুর
উৎসব” হয়ে আসছে।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কালীপূজা কোথায়
হোল? কালীপূজার দিনে একটা বিকল্প মতুয়া
উৎসব হোল। যার নাম ‘ঠাকুর উৎসব’। কিন্তু তবুও আমরা শুনতে পাই
গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজেই লক্ষ্মীখালীতে কালীপূজা করিয়েছিলেন।
আশাকরি, এই লেখা থেকে পাঠকগণ বিষয় সম্পর্কে
সঠিক ধারণার রসদ পেলেন, গুরুচাঁদ ঠাকুর কালীপূজার রাত্রে ‘ঠাকুর উৎসব’
অর্থাৎ নাম সংকীর্ত্তন ও আলোচনা বা জাগরণী উৎসব করতে নির্দেশ দিয়েছেন সকল মতুয়া
অনুরাগীদের।
তার পরের দিন কি হোল?-
ঈশ্বরে
ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি কোন ঈশ্বরের পূজা করতে বলেছেন?
উপরের ঘটনার পরের দিন
অর্থাৎ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপস্থিতিতে লক্ষ্মীখালীতে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজনদের নিয়ে
এক বিরাট জাগরণী সভা হয়। যে সভায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। সেই সভায় –
প্রভু
বলে “শোন সবে নমঃশূদ্রগণ।
ধর্ম্ম
শক্তি বিনা জাতি জাগেনা কখন।।” (গু. চ.পৃঃ ৫২৯)
তিনি সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো
জাতিকে জাগাতে হলে ধর্মের প্রয়োজন আছে। ধর্ম শক্তির মাধ্যমেই সকলকে একতা বদ্ধ করতে
হবে। তিনি ধর্মকে সংগঠিত করার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করলেও ধর্মের অলীকবা
অযৌক্তিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেননি। মানুষকে জাগ্রত করার শিক্ষার মধ্যে
নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের
মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
এরপর তিনি জানান যে, এই
জাতির মঙ্গলের জন্য যা কিছু হয়েছে সবই হরিচাঁদ ঠাকুরের অবদান। আর তিনি যে কাজের
দায়িত্ব আমাকে সমর্পণ করেগেছেন সেই কাজই আমি প্রতিনিয়ত করে চলেছি। তাই আপনাদের
প্রধান কাজ হচ্ছে-
বিদ্যা ছাড়া এ জাতির
দুঃখ নাহি যা’বে।
গ্রামে গ্রামে
পাঠশালা কর তাই সবে।।
বালক বালিকা দোঁহে
পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে
ভাল হয় ছা’ও।। (পৃঃ ৫২৯)
তিনি সকলকে জাতির দুঃখ দূর করার জন্য বিদ্যা
অর্জনের উপর জোর দেন। আর গ্রামে গ্রামে পাঠশালা করার আহ্বান জানান। নারীকেও
শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেন। কারণ, মা’ শিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হবে। তিনি আরো
জানান, শুধু শিক্ষা অর্জনই নয়; তোমাদের ব্যবসা- বানিজ্যের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যেতে
হবে। কৃষিকার্যকে অবহেলা করা যাবেনা। আর মদ,গাঁজা খাওয়া ও জুয়া খেলার নিষেধ করেন।
চারিত্রিক স্বচ্ছতার কথা বলে সকলকে অনুপ্রাণিত করেন। এরপর-
মতুয়াদেরকে কার পূজা
করতে হবে আর কার পূজা করবেনা; সে বিষয়ে তিনি এক অমোঘ বাণী দেন। যে বাণীকে প্রত্যেক
মতুয়া অনুরাগীতথা সকল সমাজ চিন্তকদের ভেবে দেখা দরকার।যে বাণী শুধু মতুয়াদের জন্যই
নয় সমগ্র মানবজাতির প্রগতির জন্য একান্ত আবশ্যক।
দেবতা-মন্দির
সবে গড়’ ঘরে ঘরে।
নিত্য
পূজা কর সেথা সরল অন্তরে।।
এইখানে
আমি বলি’ এক সমাচার।
দেবতা-মন্দিরে
পূজা করিবে কাহার?
বিশ্বভরে
এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে
যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।। (গু. চ. পৃঃ ৫২৯)
পাঠকগণ খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করুণ, গুরুচাঁদ
ঠাকুর ঘরে ঘরে দেবতার মন্দির গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু তিনি আবার প্রশ্ন করছেন যে,
সেই মন্দিরে কাঁর পূজা করা হবে? তিনি নিজের
প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দৃপ্তকন্ঠে এক অমোঘ নির্দেশ দিয়েছেন যে, “এই
মন্দিরে এমন ঈশ্বরকে স্থাপন করে পূজা করবে, যে ঈশ্বর সারা বিশ্বময় বিরাজ করছে। যে
ঈশ্বর মানুষকে তাদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার, সামাজিক ধর্মীয় বিষয়ে জাতিভেদ ও
সমস্ত অসমানতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে সংগ্রাম করেছেন। এইসব সমস্যা থেকে পিড়ীতদের
উদ্ধার করেছেন। সেই ঈশ্বরের পূজা করতে হবে।” তবে সেই পূজা কেমন করে হবে? সেই
মন্দির কেমন হবে? এখানে মন্দির অর্থ কিন্তু শুধু মূর্তি স্থাপনের জন্য নয়; শুধু ঘট
ফুল পাতা ইত্যাদি প্রচলিত পূজাচার নয়। এখানে মন্দিরের আর একটি বৃহত্তর অর্থ হচ্ছে
মন মন্দির, শিক্ষার উপকরণের মন্দির। যে মন মন্দির সুশিক্ষার উপকরণে পরিপূর্ণ হবে।
যে মন্দিরের অর্ঘ দেশ সমাজ ও জাতির মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। প্রগতির ক্ষেত্রে জাগরণ ঘটাবে। যার জন্য তিনি
বলেছেন-
‘বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।’
এখানে
ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা
হয়েছে যে, যে যাহাকে উদ্ধার করে সে
তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। আর এই
উদ্ধার কর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।
তো এই নিপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তার কথা
যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ
ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা
সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা সাবিত্রীবাই
ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, ফতেমা শেখ, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি। আবার বিশ্বের
অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই- যেমন- মার্টিন লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন
মেন্ডেলা ইত্যাদি।
এই
মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের
অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা
উদ্ধার কর্তা।কর্মের মধ্য দিয়ে এঁদের জ্ঞান-আদর্শের পূজা করতে হবে।
মতুয়াদের
ভগবান কে?
তোমাদের
এই কুলে হরি অবতার।
দয়া
করে নমঃশূদ্রে করিল উদ্ধার।।
তাঁর
পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।
নিজ
ঘরে ভগবান ফেলে কোথা যাও? (পৃঃ ৫২৯)
তোমাদের ঈশ্বর বা অবতার বা উদ্ধার কর্তা যাই
বলোনা কেন তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুর।তোমরা তাঁর পূজা কর।
তবে এই পূজা শুধুমাত্র ফুল, বেলপাতা চিন, বাতাসার নয়। এই পূজার উপচার হবে সত্য,
প্রেম পবিত্রতা। পরোউপকার। চরিত্র গঠন। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। হরিচাঁদ
ঠাকুরের কর্ম ও আদর্শের পূজা। যে পূজার ফলে জাতি, সমাজ ও দেশের
মঙ্গল হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মতুয়ারা নিজেদের ভগবানকে চিনতে না পেরেবৈদিকতার জ্বালে
ফেঁসে আছে।হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই যে সব‘বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি’
বলে ঘোষণা করেছেন, সেখানে বেশিরভাগ মতুয়া
বৈদিকতা নিয়ে মেতে আছেন। আর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকেও সেই বৈদিকরার মধ্যে গুলিয়ে দিচ্ছেন। যদিও মতুয়া
দর্শনে আছে-যে হরিচাঁদের নির্দেশ মেনে
চলবে সে-‘না ডাক’ হরিকে হরি
তোমাকে ডাকিবে।’ -গু.চ. ৫৬৯
সেজন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর
তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন - তোমরা তোমাদের নিজের ঘরের ভগবানকে ফেলে রেখে অন্য
কোথায় যেতে চাইছো? এতো স্পষ্ট করে বলার পরেও আজ মতুয়ারা বিপথগামী কেন??
____________

Comments
Post a Comment