Skip to main content

বাংলায় সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের অবদান। লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

 





বিষয়ঃ- বাংলায় সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের অবদান।

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

     ভূমিকাঃ- বাংলার সাম্যবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হচ্ছেন, মধ্য মণি। কারণ, বাংলায় বৌদ্ধ শাসক, পাল রাজাদের শাসন চলেছিল প্রায় সাড়ে চারশো (৭৫০-১১৬২)   বছর ধরে। সেই শাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শুরু হয় ব্রাহ্মণ্য শাসন ব্যবস্থা। যার প্রমুখ হচ্ছে বল্লাল সেন। তার শাসনকালে বাংলার বৌদ্ধদের উপর নেমে আসে কঠোর অত্যাচার। সেই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে পালিয়ে জঙ্গলে এসে বসবাস করতে বাধ্য হয় এক সময়ের প্রতাপশালী বৌদ্ধগণ। তাঁরা ধর্মহীনে পরিণত হন। তারপর হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ধর্ম  আন্দোলন এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলনে পতিতরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত  করার স্থান দখল করে। সেই স্থান বা ফাউন্ডেশনের উপর যে রাজনৈতিক বৃক্ষের বিজ রোপন করা হয়েছিল সেটাকে পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের বৃক্ষ হিসাবে দাঁড় করেন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে  বাংলার মূলনিবাসীরা। সেই বৃক্ষকে আরো বিস্তারিত  করার জন্য মহাপ্রাণের অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ বলিদানে সমর্থ হলেন বাবা সাহেব আম্বেদকরকে সংবিধান সভায় পাঠাতে। বাবা সাহেব সংবিধানের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের (Representation) সুযোগ করেদিলেন সমগ্র ভারতের  পিছিয়ে রাখা মানুষদের। সে জন্যই এই হরিচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলন থেকে বাবা সাহেবের সংবিধানে প্রতিনিধিত্বের (Representation)  ব্যবস্থা পর্যন্ত যে আন্দোলন সেই আন্দোলনের  মধ্য মণি হচ্ছেন মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ।

          এই আন্দোলনের ধারায় কারো অবদানই কম নয়। এক জনকে বাদ দিয়ে অন্য জনকে তুলে ধরা সম্ভবও নয়।  যদিও এই আন্দোলনরূপী গাছের ফুল ফল যারা উপভোগ করছেন তাদের একটা বিরাট অংশ চাইছেন গাছটাকেই স্বমূলে ধ্বংস করতে। তারা নতুন বল্লাল সেনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই গাছকে উপড়ে ফেলতে চাইছেন; যেটা পাল শাসনকালের শেষদিকে ঘটেছিল। এখন আপনাদেরই ভাবতে হবে কী করবেন? বল্লাল সেন যেমন বাংলার মূলনিবাসীদের বিতাড়িত করে পতিত করেছিল। বর্তমানে সংরক্ষণকে সমাপ্ত করা হচ্ছে, আর সঙ্গে নেমে আসছে NRC-National Register of Citizens এর কোপ।  এই হচ্ছে এই আন্দোলন রূপী গাছের  বিষয়। এবার বিস্তারিত ভাবে প্রবেশ করা যাক সেই আন্দোলন সম্পর্কে। 

     হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে নিয়ে  যান বাংলার আম্বেদকর মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথা মন্ডল। তিনি বাল্যকাল থেকেই সংগ্রামী ছিলেন।  দারিদ্রতা,  ব্রাহ্মণ্যবাদ, অশিক্ষা, কুসংস্কার ইত্যাদি প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি নিজেকে সমাজের সামনে তুলে ধরেন। তিন বলেন,

“ব্রাহ্মণের পদধূলি গ্রহণ এবং মন্দিরে প্রবেশের দ্বারা আপনাদের কোনও উপকার ও দুঃখ-কষ্ট লাঘব হইবে না। কে আপনাদের দুঃখ-কষ্টের অবসান করিবে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে সমান অধিকার প্রদান করিবে, তাহাই চিন্তা করিতে হইবে।” (তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ২য় খন্ড। লেখকঃ- জগদীশচন্দ্র মন্ডল)। 

তিনি আরো বলেছেন, আত্মীয় ও বন্ধু যতই প্রিয় হউক জাতির বৃহত্তর স্বার্থ তদপেক্ষা প্রিয়তর-এ কথা সর্বদা স্মরণে রাখিবেন। জাতীয় স্বার্থকে বলি দিয়া আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের খাতিরে যদি কেউ ভুল পথে চালিত হন তবে তিনি জাতির ঘোরতর শত্রুতা করিবেন।”

-(তথ্য- মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ২য় খন্ড। লেখকঃ- জগদীশচন্দ্র মন্ডল। প্রৃষ্ঠা নং- ১৫৪ )  

আর এই মহামানবকে নিয়ে থিসিস করেছেন নাগপুরের ডঃ সঞ্জয় গাজভিয়েতাঁর সেই গ্রন্থের নাম দিয়েছেন- “সাংবিধানিক ভারতের নির্মাতা বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল

     আবার নাগপুর ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক ডঃ প্রদীপ আগলাবে বলেছেন-

 “বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সামাজিক রাজনৈতিক শৈক্ষনিক ধার্মিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার জন্য ঐতিহাসিক আর ক্রান্তিকারী কাজ করেছেন; সেই মহান ক্রান্তিকারী কাজ করার জন্য যে মহামানব বাবাসাহেবকে সহযোগীতা করেছেন, সেই মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের  বদান খুব  মহত্ত্বপূর্ণ। যদি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের এই সহযোগীতা বাবাসাহেব না পেতেন, তাহলে তিনি সংবিধান তৈরি করতে পারতেন না। এটা ঐতিহাসিক সত্য। আর বাবাসাহেব যদি সংবিধান সভায় যেতে না পারতেন তাহলে এই দেশের সংবিধান ব্রাহ্মণদের পক্ষেই লেখা হততাই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আম্বেদকরের আন্দোলনে যে সহযোগীতা করেছেন এবং মূলনিবাসীদের উদ্ধারের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা অসাধারণ কাজ

 মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের জীবনের বিভিন্ন সংগ্রামী কাজের মধ্যে আমি সর্বাধিক গুরুত্ব দেই দুটো কাজকে; যে কাজ দুটো বিশেষ করে দেশের পিছিয়ে রাখা সকল মানুষের উদ্ধারের জন্য তিনি করেছেন সেই কাজ হচ্ছে-

 (১) ডা. বাবা সাহেব আম্বদেকরকে সংবিধান সভায় পাঠানো।

 (২) লকুর কমিটির রিপোর্টকে কার্যকরী হতে না দিয়ে সমগ্র নমঃশূদ্র, দাস, রাজবংশী ও সুড়ি বা সাহাদের তফশিলিদের মধ্যে রাখা।

     কিন্তু তাঁর এই অসামান্য অবদানের গুরুত্বকে তাঁর নিজের লোকরা উপলব্ধি করতে না পারলেও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সেটাকে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে। যার জন্য বাবাসাহেবকে যে যশোর, খুলনা বরিশাল ফরিদপুর জেলা থেকে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত করেছিলেন সেই অংশকে ভারতের বাইরে রাখার জন্য শুরু হলো চক্রান্ত।

     হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ঘোষণা করল ‘দেশভাগ হোক না হোক বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে।” কারণ?

  প্রথম কারণঃ- বাংলা প্রান্তে মুসলিম এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেনির(বিশেষ করে নমঃশুদ্র) লোকদের সংখ্যা সর্বাধিক ছিল। সেখানে মুসলিম লীগের সরকার ছিল। যদি বাংলার বিভাজন না হয়  তাহলে মুসলিম আর পিছিয়ে পড়া শ্রেনিশাসন ব্যবস্থা চিরস্থায়ী হবে। সেখানে উচ্চবর্ণীয়দের কোন অধিকার থাকবে না। 

দ্বিতীয় কারণঃ- বাংলার খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, বরিশাল এই এলাকা থেকে বাবাসাহেবকে নির্বাচিত করে সংবিধান সভায় পাঠানো হয়। তাই বাংলা বিভাজন করে বাবাসাহেব যে ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন সেখান থেকে বাবাসাহেবের সদস্য পদ খারিজ করার উদ্দেশ্যে বাংলা ভাগ করে ছিল 
তৃতীয় কারণঃ-  যে নমঃ(শুদ্র)রা বাবাসাহেবকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছেলেন তাদেরকে সাজা দেওয়ার জন্য যাতে তারা আজীবন মুসলমানদের আধীন থাকে, এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলা ভাগ করেছিল 

আর একটা কারণ, সেটা আপনারা মানুন আর নাইবা মানুন; সেটা হচ্ছে-

 মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হচ্ছেন বাংলার আম্বেদকর। তাঁর ক্ষমতা কত সুদূর প্রসারী ও শক্তিশালী, সেটা তাঁর থেকে উপকার প্রাপ্তরা কতটা বুঝেছেন বলা মুশকিল। তবে উচ্চবর্ণীয়রা সেটা হাড়ে হাড়ে  বুঝতে পেরে ছিলেন বাখার গঞ্জ কেন্দ্রের জয় থেকে শুরু করে বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠানো পর্যন্ত। যার জন্য তারা সর্বদা মহাপ্রাণের লাগামকে নিজেদের কন্ট্রোলের বাইরে না যেতে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আর তারজন্য সব সময় যোগেন্দ্রনাথে বিরুদ্ধে নিজের জাতির লোক দিয়ে যেমন বিরোধীতা করিয়েছে, তেমনি তারা বুঝতে পেরেছিল, বাংলা ভাগ না হলে কোন দিনই উচ্চবর্নীয়দের কব্জায় বাংলার শাসন ক্ষমতা আসবে না। তাই গোদের উপর বিষ ফোড়াটাকে স্বমূলে নির্মুল করার জন্য বাংলা ভাগ করা তাদের কাছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এখানে আর একটা কথা বলে রাখি ঐ সময়ে নেতাজীর অন্তর্ধান হওয়া উচ্চবর্ণীয়দের বাংলা ভাগ করার কাজটি সুগম হয়।   

     এই দিকে গান্ধীজি আর এক চক্রান্ত করে জানালেন, “দেশ বিভাগ যদি হয়, তবে আমার মৃতদেহের উপর দিয়েই তা হবে। আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ কিছুতেই দেশ  বিভাগে সম্মতি দেব না”  সেই গান্ধীর উপস্থিতিতে ১৯৪২ সালে ১৫ই জুন, কংগ্রেসের অধিবেশনে দেশভাগের প্রস্তাব গৃহীত হল। কংগ্রেস অধিবেশনে এ প্রস্তাব সমর্থন করলেন স্বয়ং গান্ধী। (তথ্যঃ-  মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ ৩য় খণ্ড, লেখক- জগদীশ চন্দ্র মন্ডল পৃ.১২/১৩) 

     মহাপ্রাণ শত চেষ্টা করেও বাংলা ভাগকের বন্ধ করতে পারলেন না। কিন্তু বাবা সাহেবকে বাংলা থেকে সংবিধান সভার জন্য নির্বাচিত করার ফলে দেশ ভাগের জন্য বাবা সাহেবের সদস্য পদ রদ হলেও কংগ্রেস বাধ্য হয়ে বাবা সাহেবকে পুনরায় নির্বাচিত করতে। আর বাবাসাহেব সংবিধানে সমস্ত পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষদের জন্য সংরক্ষণের মাধ্যমে দিলেন সাংবিধানিক রক্ষা কবচএই কারণে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গাত্রদাহ শতগুণ বৃদ্ধি পেল। তাই শুরু হল অত্যাচার। যে মানুষদের সংগ্রামের ফলে একটা জাতি জেগে উঠেছিল, তাদের স্বমূলে বিনাশ করার জন্য দেশভাগের বলি স্বরূপ তাদের পাঠানো হলো উড়িষ্যার কালাহাণ্ডি, মহারাষ্ট্রের গড়চিলোরী, আন্দামান, নৈতিতাল ইত্যাদি গহন জঙ্গলে। যার ফলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেল অনাহারে। পশুর মতো জীবন যাপন করতে বাধ্যে হলো তারা। তবে এই জাতির একটাই গুণ এরা সহজে ধ্বংস হয়না। তাই ধীরে ধীরে গড়ে তুলল আবার বাসোপযোগী ব্যবস্থা। তারা ভুলে যায়নি গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলনকে। তাই তারা সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলল। আর বাবাসাহেরের দেওয়া সাংবিধানিক রক্ষা কবচ সংরক্ষণের জন্য সুযোগ পেল শিক্ষা গ্রহণ ও সরকারী চাকরিতে। অতি কষ্টে হলেও ধীরে ধীরে তারা ফিরে পেতে চলেছিল পুরানো অধিকারকে।

    মহাপ্রাণের এই নিঃস্বার্থ বলিদানকে ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্তান্তে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। আর এই কাজে সামিল হয়েছে তাঁরই স্বজাতির লোকেরা। তাদের জবাব দিয়ে যোগেন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ ভাষণে (5th October 1968, Helencha, 24 parganas-N.) জানিয়েছন –   


(
জীবনের শেষ ভাষণ)

      "হে আমার হিন্দু মুসলমান ভাইবোনেরা। প্রথমে সকলকে আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানাই। আমি বাগদহ কেন্দ্রে পূর্বেও দাঁড়িয়েছি। হেরেও গিয়েছি। নির্বাচনী লড়াইয়ে হার জিত আছে। হেরেছি বলে আমি দুঃখীতও নই, ভেঙ্গেও পড়িনি। কারণ আমি চার বার মন্ত্রী হয়েছি। দুবার রাজ্যে, দুবার কেন্দ্রে। একবার মন্ত্রী হলে অনেকেই বাড়ি, গাড়, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স করে থাকেন। আমি চার বার মন্ত্রী হয়েও নিজের জন্য কিছুই করিনি। সারা জীবন অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি  এবং প্রতিকারের চেষ্টা করেছি।

    যুগ যুগ ধরে অনুন্নত অবহেলিত নিপিড়িত জনগোষ্টি যাঁরা সামাজিক ও আর্থিক অবস্থায় দূর্বল ও পিছিয়ে রয়েছেন। শিক্ষার আলো পাননি। শিক্ষার অভাবে চাকুরীতে অধিকার ছিল না। তাদের জন্য সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করেছি। তারা যদি শিক্ষিত হয়, চাকুরী পায় তাহলে তাদের আর্থিক ও সামাজিক উন্নতি হবে। এতে তাদের প্রতি যে হিংসা বিদ্বেশ ও অস্পৃশ্যতার অভিশাপ আছে তা থেকে মুক্ত হবে।

    বর্ণহিন্দু ভাইয়েরা সামাজিক আর্থিক শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে উন্নত আছেন। তাদের ভাগের কিছুই ক্ষতি হয়নি। তাদের ভাগের অংশও কেউ কেড়ে নেইনি। পিছড়ে বর্গের লোকেদের কোটা মাফিক সামান্য কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সংরক্ষণ বা রিজার্ভেশনের জন্য সংগ্রাম করেছি। 

    একটা নিদির্ষ্ট সীমা রেখা থেকে যদি সবল ও দূর্বলের প্রতিযোগিতা হয় তবে, দূর্বল ব্যক্তি কোনক্রমেই লক্ষ্য স্থানে পৌঁছতে পারবে না। তাই তাদের কোটা মাফিক বিশেষ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এতে অন্যায় কোথায়? এর ফলে বর্ণবিদ্বেশ হিংসা নিন্দা কমবে। সামাজিক সার্বিক সাম্য আসবে।

     যে হরিজনদের প্রতি উপদেশ বাণী দিয়ে গান্ধীজি হয়েছেন মহাত্মা, আর আমি সে কাজ কার্যে পরিত করতে গিয়ে হয়েছি দুরাত্মা ও সাম্প্রদায়িক। ইহাই অদৃষ্টের পরিহাস।

     যখনই কোন বর্ণহিন্দু ভাই আমার কাছে কোন চাকুরী বা কোন সুযোগ, সুবিধার জন্য গিয়েছেন, আমি অগ্রভাগে তাদের কাজ করে দিয়েছি। কারণ কেহ যেন বলতে না পারেন মন্ডল তার নিজের জাতের লোক ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের কাজ করে না।

    বর্ণ হিন্দু ভাইয়েদের কাছে আমার অনুরোধ আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। দেশ ভাগের জন্য আমাকে দায়ী করা হয়। মন্ডল দেশ ভাগ করেছে। সে সম্বন্ধে বলি, দেশ ভাগের ব্যাপারে আমার কোন ক্ষমতা ছিল না। কংগ্রেস কমিটি  ও মুসলিম লীগ উভয় পার্টির নেতাগণ মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বৃটিশ সরকারের কাছে স্বাধীনতার দাবি জানায়। বৃটিশ সরকার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয়ের দেশ ভাগের দাবি মেনে ভারত ও পাকিস্থানের জন্য পৃথকভাবে স্বাধীনতা দেয়। তাই ভারত ভাগ করে ভারত ও পাকিস্থান পৃথক রাষ্ট্র তৈরি হয়। তবুও দেশ ভাগের জন্য আমাকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয় কেন?

    আমি যোগেন মন্ডল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করেছি। এ জন্য আমাকে বহু কটুক্তি শুনতে হয়েছে। যেমন “বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যোগেন মন্ডলের ওকালতি।” আমি বুঝেছি বঙ্গ ভঙ্গ হলে হিন্দু মুসলমান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে অশিক্ষিত ও গরীব যারা সামান্য চাষ আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের ভাগ্যে চরম দূর্দশা নেমে আসবে। তখন কংগ্রেস ও কমিউনিষ্ট পার্টি বঙ্গ ভঙ্গ সমর্থন করে আমাকে গালমন্দ করেছেন।

     দেশ ভাগের পরে আমি পূর্ববঙ্গে কেন গেলাম?

এই প্রশ্নের উত্তর বহু জন সভায় বহুবার দিয়েছি। দেশ ভাগ যখন অবধারিত হয়ে গেল তখন আমার নেতা ডঃ বি. আর. আম্বেদকরের সাথে আলোচনা করি এবং পরামর্শ নেই। তিনি বলেন, “মিঃ মন্ডল কংগ্রেস ও লীগের দেশ ভাগের প্রস্তাব বৃটিশ সরকার নেমে নিয়েছেন। আমাদের কথা শোনেননি। এক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি? কাজেই তুমি পূর্ব বঙ্গে যাও। দেখো পূর্ব বঙ্গে বহু অনুন্নত হিন্দু থেকে যেতে বাধ্য হবেন। তুমি গিয়ে তাদের সেবা করো।” তাই আমি পূর্ববঙ্গে যাই। আমাকে লীগ মন্ত্রীসভায় আইন মন্ত্রী পদে বহাল করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, আর ১৯৫০ সালে পুনরায় ভারতে আসি। আমি পাকিস্থানে করাচি থাকাকালীন পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হল। ঢাকা, ত্রিপুর্‌ নোয়াখালী, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় হিন্দুদের উপর চরম অত্যাচার, খুন, হত্যাকান্ড চলতে লাগল। অসহায় হিন্দুরা আমাকে বহু চিঠিপত্র টেলিগ্রাম করাচিতে পাঠাতে লাগল। পাক সরকার কৌশলগত ভাবে আমাকে জানতে দেয়নি। যখনই আমি জানতে পারলাম তখনই পূর্ববঙ্গে ছুটে গিয়ে অসহায় হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছি। দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে বহু জনসভা করে বক্তৃতা দিয়ে তাদের শান্তনা দিয়েছি। আমার অনেক বক্তৃতার অংশই  শাসকগোষ্ঠির কাছে দেশদ্রোহিতার রূপ নিয়েছিল। আমি করাচি পৌঁছানোর আগেই আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্টের পাহাড় জমে গেছে।

   ইত্যাদি বহু ঘটনার পরে যখন বুঝতে পারলাম পাকিস্থানে হিন্দুদের বসবাস নিরাপদ নহে। পাকিস্থান থেকে সংখ্যালঘুদের কল্যাণের জন্য যত দাবিই করেছি, পাক সরকার তা মানেনি। কথা দিয়েও কথা রাখেনি। যে হিন্দুদের কল্যাণের জন্য পাকিস্থানে গিয়েছি তাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকার করতে না পারলে সেখানে থাকা উচিত হবে না বিবেচনা করেই ভারতে চলে আসি। ভারতে এসে অল্প কয়েকদিন পরেই আমার সমস্ত অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে পাক সরকার প্রধান মঃ লিয়াকৎ আলীর কাছে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিয়েছি। সমস্ত হিন্দু ভাইদের ভারতে আসার আহ্বান জানিয়েছি। আমার পদত্যাগ পত্রের কপি বাংলা ইংরেজি বহু সংবাদ পত্রেই প্রকাশিত হয়েছে।

     আমি ভারতে আসার পরেও তিন বছর ভারত ও পাকিস্থানের যাতায়াতের দরজা খোলা ছিল। কেন এখনও পূর্ব বঙ্গে হিন্দুরা রয়েছেন? ইহার কারণ ঐ উক্ত একই বঙ্গভঙ্গের অভিশাপ।

     বাগদাবাসী ঘোষ কপালিক মাহিষ্য ভাইদের কাছে আমার আবেদন আপনারাতো গান্ধীজির কথায় একই হিন্দুদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই বলে তাঁর সাথে পঙতি ভোজের মাধ্যমে জল চলের সামিল হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষায় ও চাকুরী ক্ষেত্রে আমাদের চেয়েও পিছে পড়ে আছেন। আসুন আমাকে ভোট দিন। আপনাদের উন্নতির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।

    মুসলমান ভাইদের বলছি- আপনারা আমাকে ভোট দিবেন না কেন? আপনারা ও আমরা  আমাদের অবহেলিত ভাইদের একই জমির পাশাপাশি চাষ আবাদ করি। চাষবাসের গল্প করি। একই জমির আলে বসে নাস্তা খাই। আপনাদের ও আমাদের অবস্থা একই প্রকার। সে জন্যই আমি লীগ মন্ত্রী সভায় যোগদান করি। তার জন্য আমাকে “যোগেন আলী মোল্লা” খেতাব নিতে হয়েছে। লীগ মন্ত্রী সভায় হিন্দু মন্ত্রীও ছিলেন, যেমন ফজলুল হক মন্ত্রী সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ছিলেন। তাকে বলা হত “শ্যামাহক মন্ত্রী সভা”। তারা কেউই মোল্লা পদবীতে ভূষিত হননি। আপনারা আমাকে ভোট দিন। আপনাদের কল্যানের জন্যও  চেষ্টা করবো। আমি জয়ী হতে পারলে হিন্দু মুসলমান জাতিধর্ম নির্বিশেষে জন সেবা করবো। ইাই আমার বাসনা।

     পুনরায় বলি আমি চার চার বার মন্ত্রী হয়েও জনহিতকর কাজ ছাড়া নিজের জন্য কিছু করিনি। এক ভদ্রলোকের সৌজন্য বশতঃ থাকার জন্য আমাকে একটা ঘর দিয়েছেন। সামান্য একটা এম. এল. এ. হলেই ধন্য হব মনে করিনা। জনহিতকর কর্মই আমার জীবনের ব্রত। কিছু ক্ষমতা না পেলে কিছু করা যায় না। তাই আমাকে ভোট দিয়ে জয়ী করে আইন সভায় পাঠান।

    সকলকেই আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা জানিয়ে বক্তব্য শেষ করছি।”    

(তথ্য সংগ্রহ –লেখক- মুকুন্দ লাল সমাদ্দার, মহাপ্রাণের আন্দোলনের সঙ্গী, হেলেঞ্চা নিবাসী।)


উপসংহারঃ-  কিন্তু হরি-গুরুচাঁদ, মহাপ্রাণ ও বাবা সাহেবের আন্দোলন প্রসুত  অধিকারকে হরণ করার জন্য শুরু হয়, সংরক্ষণ সমাপ্তিকরণ ও ২০০৩ সালের কালা কানুন, নাগরীক সংশোধন বিল। সেই বিল আরো কঠোর হয়ে উঠল আজকের দিনে। শুরু হল NRC National Register of Citizens যেখানে ঘোষণা করে হয়েছে, যারা ভারতে এসেছে অন্য দেশ থেকে আর তারা যদি বৈধভাবে নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে তাহলে তারাতো বেনাগরিক, এমনকি তাদের সন্তানরাও বেনাগরিক। আমরা জানি, ইন্টার নেশানাল নাগরিকত্বের নিয়মানুসারে যদি প্লেনে যাতায়াত কালে কোন বাচ্চা জন্ম গ্রহণ করে, তবে যেই দেশের উপর দিয়ে সে সময়ে প্লেন যাচ্ছিল সেই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী। আর এখানে বলা হচ্ছে, পিতা মাতা যদি বৈধ নাগরিক না হয় তাহলে তাদের সন্তানরাও অবৈধ নাগরকি। যারা ভারত বর্ষে বিগত ৫০/৬০ বছর ধরে বসবাস করছে স্থায়ীভাবে আর তারা সকলে বেনাগরিক বলে পরিগণিত হচ্ছে। এর থেকে মর্মান্তিক পরিস্থিত আর কী হতে পারে?

          এইভাবে বাংলার সমতাবাদী আন্দোলনকে পুনরায় ধ্বংস করে দেবার চেষ্টা শুরু হয়েছ। হায়নারা সর্বদা লালা ঝরাচ্ছে তাদের দাঁত বসানোর জন্য। শুধুবাংলা নয়, ভারতের সমস্ত মূলনিবাসীদের পুনরায় গোলাম বানানোর গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু গোলামী থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের সংগঠিত হয়ে কঠোর সংগ্রাম চালাতে হবে। যদিও হায়না ও কুনকী হাতিতে ভরেগেছে সর্বদা। তাই একই মন্ত্র নিতে হবে সমাজ জাতি ও দেশের কল্যাণের জন্য DO OR DIE করো অথবা মরো

                                 -----------------------------

Comments