লীলামৃতের বন্দনা প্রসঙ্গে।
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
এই বন্দনা কী? কেন করা হয়?
কার বন্দনা?
বন্দনা-
এখানে কোনো
দেব-দেবীর বন্দনা করা হয়নি। প্রথাগত নত মস্তকে প্রণাম করা হয়নি। এখানে মানবের
বন্দনা করা হয়েছে। মানবের জয় গান করা হয়েছে। আর এই মানব কিন্তু একজন নয়। এখানে সমষ্টি বা গোষ্ঠী শক্তির জয়গান করা হয়েছে।
একটা জিনিস লক্ষ্য
করুন, এখানে পূজা বা প্রার্থনা বলা হয়নি। বন্দনা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি যদি এই বন্দনার ব্যাখ্যা এরকম মনে করি কেমন হয়-
ধরুন, আমরা যদি এই বন্দনা স্থলে কোনো মূর্তি বা ফটো রেখে
আগরবাতি জ্বালিয়ে ও ফুল দিয়ে সাজাই ও মোমবাতিও জ্বালাই তার অর্থ কি আমরা এই ভাবে
করতে পারি-
আমরা হাত জোড় করে মহামানবদের প্রতি কোনো প্রার্থনা করছি না। এটাকে আমরা “বন্ধনা” বলছি।
প্রার্থনার অর্থ কিছু চাওয়া (request), আর বন্দনার অর্থ, অভিবাদন করা স্তুতি করা। বন্দনা করে আমরা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি। তাঁরা যেটা করেছেন ও বলেছেন, সেই বিষয়কে উপলব্ধি করার জন্য চিন্তন-মনন করি। বারবার সেই কথাগুলো উচ্চারণ করি, যাতে সেই আদর্শ থেকে পথ ভ্রষ্ট না হই।
আবার আমরা যদি আগরবাতি জ্বালাই সেটা কিন্তু কোনো দেবতাকে প্রশন্ন করার জন্য নয়। আগরবাতি যেমন নিজে জ্বলে এবং সুগন্ধ
বিতরণ করে; সেই রকম আমাদের মানবিকতার সুগন্ধ বিতরণ করা। এই
ভাবনার প্রতীক হচ্ছে আগরবাতি।
মোমবাতি কিন্তু প্রদ্বীপ (সল্তে ও তেল যুক্ত) নয়, প্রদ্বীপে তেল দেওয়া হয় দেবতাকে
প্রশন্ন করার জন্য। আমরা মোমবাতি
এই জন্য জ্বালাই যে, সেটা
যেমন নিঃস্বার্থভাবে নিজে জ্বলে এবং আলো দেয়, কোন প্রকার
ক্ষতি করে না; তেমনি আমাদের জীবন যেন অন্য মানুষকে জাগাতে সাহায্য করে, আমাদের দ্বারা অন্যের জ্ঞানের আলোর প্রকাশ ঘটে। এই উদ্দেশ্যে
আমরা মোমবাতি প্রজ্বলন করি।
আমরা দেবতাকে প্রশন্ন করার জন্য ফুল অর্পণ করি না। তবে ফুল যেমন তার সল্পায়ুতে মানুষের মনকে প্রফুল্লিত করে তোলে, সুগন্ধ বিতরণ করে, আনন্দ প্রদান করে। আর সময়ের অন্তরালে নষ্ট হয়ে যায়; তেমনি আমাদের এই
মানব জীবনও মানুষের উপকারের জন্য সমর্পিত হোক এই আশা করে আমরা ফুল দেই।
আমরা তাঁদেরকে পূজা নয়, তাঁদের অসীম উপকারকে শ্রদ্দা জানাই। এঁরা আমাদের কাছে মহামানব। আমাদের
দেবতা নয়। আমরা তাঁদের বন্দনা করি, পূজা বা প্রার্থনা করি না।
আমরা যে বন্দনা করি, সেই বন্দনার অর্থ হচ্ছে- মহামানবদের
উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা। এখানে কোন মানত করা হয় না কিছু পাওয়ার আশায়।
তাঁদের কাছে কিছু চাওয়া হয় না কোন সংকট থেকে মুক্তি লাভের আশায়। এখানে কোন যজ্ঞ
করা হয় না। আর কোন জীবকে ক্রুরভাবে বলি দেওয়া হয় না কোন দেবতাকে প্রশন্ন করার
জন্য। আমরা আমাদের মহামানবদের বন্দনা করি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদান করার জন্য।

Comments
Post a Comment