Skip to main content

গুরুচাঁদ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

 


গুরুচাঁদ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

(আমার লেখা বই ‘গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজসংস্কার ও মুক্তির দিশা থেকে তুলে দিলাম বিষয়গুলো নাম্বারিং করে।)

বিষয়ঃ- ১) জন্ম, ২) শিক্ষা, ৩) বিবাহ,৪) ব্যাবসা, ৫) সার্বিক শিক্ষার দাবিতে বিদ্রোহঃ, ভারতের ৬) প্রথম ‘সাধারণ ধর্মঘট’ বা general strike ঃ-, ৭) চন্ডাল(নমঃ) বিদ্রোহ ও নারীর সম্মান, ৮) অনুন্নতদের জন্য প্রথম স্কুল স্থাপনঃ, ৯) পত্রিকা প্রকাশঃ-, ১০) মুসলমানদের মতো নমঃশূদ্রদের সম্পূর্ণ আলাদা সম্প্রদায় হিসাবে স্বীকৃতির দাবী পেশঃ ১১) তে-ভাগা আন্দোলনঃ-, ১২) অনুন্নত শ্রেণির জন্য শিক্ষা ও চাকরীতে সংরক্ষণঃ-, ১৩) স্বাধীনতা সম্পর্কে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কালজয়ী বক্তব্য প্রদানঃ-, ১৪) মহাপ্রয়াণঃ

 

১) জন্মঃ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম ১৮৪৬ সালের ১৩ই মার্চ; বর্তমান বাংলাদেশের ওড়াকান্দী গ্রামে।

পিতার নাম হরিচাঁদ ঠাকুর আর মাতা হচ্ছেন-শান্তি মাতা। ঠাকুরদার নাম যশোমন্ত ঠাকুর।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের বয়স যখন সাত বছর পূর্ণ হয়, তখন তাঁর পিতা হরিচাঁদ তাঁকে বোঝান যে, আমাদের সমাজে তো তেমন কোন বিদ্যা শিক্ষা নেই।তাই-

২) শিক্ষাঃ-

আমার প্রাণের ইচ্ছা তোমাকে পড়াই।

বিদ্যার অমূল্য মূল্য জগতে শিখাই।     -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৩৯

গুরুচাঁদ শিক্ষাগ্রহণের  রাজি হয়ে যান। পাঠশালার শিক্ষা গ্রহ করা জন্য পদ্মবিলার সাধু দশরথের কাছে শিক্ষা গ্রহণশুরু করেন।

এর পর মল্লকান্দী গ্রামে গোলকের বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এইভাবে  তিন বছর শিক্ষা গ্রহণের পরে তিনি ওড়াকান্দীতে ফিরে আসেন। কিন্তু ওড়াকান্দীতে কোন উচ্চবর্ণীয়দের স্কুলে ভর্তি হতে পারেননা। কারণ তিনি তো পতিত অস্পৃশ্য নিচু জাতির লোক। উচ্চবর্ণীয়রা তাঁকে শিক্ষার অধিকার কেন দেবে? তখন বাধ্য হয়ে তিনি মুসলমানদের মক্তবে ভর্তি হন।

ওড়াকান্দী মক্তবেতে প্রভুকে পাঠাল।

কিছুকাল তথাকারে শ্রীগুরু চরণ।

আরবি পারসী ভাষা করে অধ্যয়ন।।-গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৪০

সেখানে আর্‌বি, পার্‌সী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন মক্তবের শিক্ষা সমাপ্ত হলে উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে তাঁকে শিক্ষা গ্রহণ বন্ধ করতে হয়। তখন থেকে বাড়িতে থেকেই তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে জ্ঞানার্জন করতে শুরু করেন। 

৩) বিবাহঃ-এরপর সেই সময়ের নিয়মানুসারে দ্বাদশ বর্ষের কালে হ’ল পরিণয়। (গু.চ. পৃঃ ৫৬৪)  পিতামাতার ইচ্ছানুসারে গুরুচাঁদ ঠাকুর সত্যভামা কে বিবাহ করে সংসার ধর্ম শুরু করেন। পিতা গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর উপর সংসারের কর্তব্য পালন করার জন্য দায়িত্ব সপে দেন। তবে তিনি পুত্রকে পরামর্শ দেন এই বলে যে,সংসার ধর্ম করতে হলে সংজমী হতে হবে। অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে।

এরপর ধীরে ধীরে গুরুচাঁদ ঠাকুরের চার পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। পুত্রদের নাম যথাক্রমে শশিভূষণ, সুধন্য উপেন্দ্র ও সুরেন্দ্র। কন্যার নাম করুণাময়ী।

গুরুচাঁদ ঠাকুরের যখন ২১ বছর বয়স হয় তখন তাঁর প্রথম সন্তান শশিভূশণ  জন্মগ্রহণ করেন।

৪) ব্যবসাঃ-১৮৬৭ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্যবসা শুরু করেন।

    গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্যবসা-বাণিজ্য করে সংসার চালাতেন। সংসারে বেশ আয় উন্নতি হচ্ছিল। তিনি ১৮৭৯ সালে ২০ টাকা ট্যাক্স দেন সরকারকে একজন ব্যবসায়ী হিসাবে। তিনি গরিব লোকদেরকে ব্যবসা ও কৃষিকাজ করার জন্য অর্থ সাহায্য করতেন।

৫) সার্বিক শিক্ষার দাবিতে বিদ্রোহঃ-১৮৭২ সালে সার্বিক শিক্ষার দাবিতে বাংলায় গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে মতুয়াদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। সেইজন্য ইংরেজ সরকার নবপ্রবর্তিত ইংরেজী শিক্ষা সর্রস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। এই বিদ্রোহের ফলে অনুন্নত শ্রেণীর মানুষকে নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আহ্বান জানান হয়।

- (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ নং (VIIXIV)

৬) ভারতের প্রথম ‘সাধারণ ধর্মঘট’ বা general strikeঃ-

(1873) the Chandals made a general strike in the district (Faridpur), resolving not to serve anybody of the upper caste in whatever capacity, unless a better position among the Hindu caste than what they at present occupy was given to them.(W.W. Hunter:Ibid,p.285)চন্ডালেরা ফরিদপুর জেলায় সাধারণ ধর্মঘট করেছিল- তাদের দাবি সমাজে তাদের মর্যাদার আসন দিতে হবে। অন্যথায় উচ্চরর্ণের কোন প্রকারের কাজকর্ম করবে না।C. A. Kelly I C S এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যটি স্যার হান্টারকে লিখিত ভাবে জানান। (Hunter: Ibid p. 255) এখানে মাত্র এইটুকু জানিয়ে রাখি এটাই ভারতবর্ষের প্রথম ‘সাধারণ ধর্মঘট’ বা general strike.এই তথ্য লোকে হয়ত জানেনা, যারা জানে তারা তুলে ধরে না- কারণ উচ্চবর্ণের শোষণ ও দূর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে এই সাধারণ ধর্মঘটতাই প্রকৃত গুরুত্ব সহকারে এর পটভূমিকা তুলে ধরে, শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ঠাঁই দিলে উচ্চবর্ণের মুখের উজ্জ্বল প্রসাধন খসে পড়ার ভয়। দেবশিশুসুলভ অমলকানি চেহারার অন্তরালে ঢাকা আসল কদাকার রূপটা বেরিয়ে পড়বে।(তথ্যঃ- অন্বেষণ, ১ম খণ্ড, –শিপ্রা বিশ্বাস, পৃ.২৭৩-২৭৪)

৭) চন্ডাল(নমঃ) বিদ্রোহ ও নারীর সম্মান

আপনারা শাঁওতাল বিদ্রোহ ইতিহাসের পাতায় পড়েছেন। কিন্তু চন্ডাল বিদ্রোহের নাম কি শুনেছেন? আর যে বিদ্রোহের মূল ছিল নারীর সম্মান নিয়ে। ১৮৭২ সাল। হরিচাঁদ ঠাকুর তখন বর্তমান। তাঁর মহাপরিনির্বাণ ১৮৭৮। এই ১৮৭২ সাল বাংলার চন্ডালদের জন্য ঐতিহাসিক কাল। এই সময়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে মতুয়াদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সেই জন্য ব্রিটিশ সরকার নবপ্রবর্তিত ইংরাজী শিক্ষা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। (গুরুচাঁদ চরিত –XIV)

 এই বছরে আর একটা বড় বিদ্রোহ বা ট্রেডইউনিয়ন মুভমেন্টের সূত্রপাত- প্রথম স্ট্রাইক বা হরতাল হয়। এই হরতাল সম্পর্কে বা চন্ডাল বিদ্রোহ সম্পর্কেদেখতে পাই-

The first organized endeavour at self-affirmation started in Faridpur- Bakarganj region in late 1872, When in official documents they were still being referred to as Chandals. The movement had no political significance at that time and was only an effort madeby them to raise themselves in social scale among the Hindus’. The immediate occasion was the sradh or funeral ceremony of the father of a well-to-do Chandala headman of Village Amgram in Bakarganj. Disregarding the established norms of commensality, he invited his higher caste neighbours to attend the ceremony and dine in his house. The letter, at the investigation of the Kayasthas, refused to accept the invitation and the reasons cited were many. The women of this caste visited the marketplace without any sense of shame and their degraded status was even acknowledged by the government, as in the jails only the Chandala inmates were employed as scavengers for removing filth. A meeting of all the Chandala headmen was therefore, organized immediately and following resolutions were adopted: -

(1)   Women must not in furure visit haats (periodic rural marts) and bazaars; Service of no kind whatever be taken with the other castes…..

Their demand for equal treatment in jails was also duly communicated to the government officials visiting the locality.

সরকারী নথিপত্রে তখনও তারা চন্ডাল হিসাবে পরিচিত। ১৮৭২ সালে ফরিদপুর বাখরগঞ্জ অঞ্চলেই তাদের প্রতিষ্ঠার আত্ম ঘোষণা; প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়তখনও কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না এই আন্দোলনের পিছনে। মনুবাদী দেশে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা ঘোষণা করার জন্যই তখন তারা ঐক্যবদ্ধ। বাখরগঞ্জ এলাকার আমগ্রামের বর্দ্ধিষ্ণু পরিবারের গ্রাম্য ‘মাতুব্বর’ এক চন্ডালের পিতৃশ্রাদ্ধে; প্রচলিত ধারা উপেক্ষা করে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উচ্চজাত বা হিন্দু ‘কাবাব’ (কায়স্থ + ব্রাহ্মণ + বৈদ্য) প্রতিবেশীদের। স্থানীয় কায়স্থদের প্ররোচনায় বহু কারণ দর্শীয়ে এই শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে অস্বীকার করেছিল ‘ভদ্রলোকেরা’(কাবাব)। চন্ডাল রমনীরা হাট বাজারে মুক্তভাবে যাতায়াত করে। জেলখানায় ময়লা পরিষ্কারের কাজ করে---ইত্যাদি। চন্ডাল মাতুব্বরদের তৎক্ষণাৎ মিটিং করে—নিম্ন লিখিত নিদ্ধান্ত হয়।

(১) রমনীরা আর যথেচ্ছ হাটে-বাজারে যাবে না।

(২) স্বজাতি ভিন্ন কোন বে-জাতের বাড়ী কাজ করবে না।………জেলে ময়লা পরিষ্কারের কাজ না করারএবংসামাজিকমর্যাদার পাবার  জন্যও তারা সরকারের কাছেদাবি পেশ করে।”

    এই মহাসভার সিদ্ধান্তগুলিকে ঢাক পিটিয়ে হাটে এবং বাজারে বিশেষভাবে প্রচার করে দেওয়া হয়েছিল। বর্ণ-হিন্দুদের বাড়ীতে কাজ না করার সিদ্ধান্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম ট্রেডইউনিয়ন মুভমেন্টের সূত্রপাত-প্রথম স্ট্রাইক বা হরতাল। দরিদ্র এবং দিনমজদুর চন্ডালরা যাতে এই স্ট্রাইকের ফলে অনাহারে না ভোগে তার জন্য সংগঠনকারীরা সতর্ক ছিল। ঘোষণা করা হ’ল দুঃস্থ শ্রমিকদের আত্মীয় স্বজনরা কর্মহীন শ্রমিকদের দেখাশুনা করবে। যে সব দরিদ্র শ্রমিকের স্বজনও নেই তাদের দায়িত্ব গ্রহন করবে স্বয়ং চন্ডাল সমাজ। ঘোষণায় সিদ্ধান্ত সমুহ না মানলে তার প্রতি সামাজিক বয়কট চাপান হবে।

    দ্রুত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ফরিদপুর এবং কেন্দ্র তৈরি হয় গোপালগঞ্জ থানা অঞ্চলে। ফরিদপুরের তৎকালীন ডিস্ট্রিকট মেজিসট্রেট ১৮৭৩ সালের ৮ই এপ্রিল এই মহা বিদ্রোহের শক্তিশালী প্রভাবকে বর্ণনা করে ঢাকার কমিশনারকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাতে পাওয়া যায়- “So complete was the strike that the fields….untilled, the houses unthachhed, and not a Chandal in the service of Hindu or Mahamedan, or a Chandal women was seen in any market. The situation was so volatile in Muksudpur and Gopalganj that extra poloce had to be mobilized from the divisional headquarters for manitainintg peace and order.” অর্থাৎ জোর করে যেমন আজ কাল, কারখানা আর দোকানের ঝাঁপখোলার চেষ্টা হয় সেদিনও, চন্ডালদের জোর করে কাজ করানোর চেষ্টা করেছিল মনুবাদীরা। কোন কাজ হয়নিচন্ডালেরাই ঘৃণায় বর্জন করেছিল জাতবাদীদের হাতে রান্না করা খাবার। ‘কাবাবদের’ জোর জবরদস্তি ঠেকাতে বৃটিশ  পুলিশ, সাহায্য করেছিল কৃষকদের। সুরতাং ব্যর্থ হয়নি সহস্র বছর বাদে চন্ডালদের প্রথম গণআন্দোলন।

    নারীর মর্য্যাদার ক্ষেত্রেএই আন্দোলন প্রাচীন চন্ডাল সমাজের মহান ঐশ্বর্য্যময় এক  ঐতিহ্যের দ্বারোদ্ঘাটন করেহিন্দু ধর্ম-দর্শন তত্ত্বানুসারে নারী সর্বদা ও সর্বাবস্থায় পুরুষের অধীন। চন্ডাল সমাজে নারী পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্টিত ছিল। তারা পুরুষের কেবল নর্ম-সঙ্গিনী ছিল না; ছিল কর্ম-সঙ্গিনী। হরিচাঁদ তাদের করলেন ধর্ম-সঙ্গিনী। আধুনিক বিশ্বের সভ্যসমাজের নারীর মতন তারাও সেদিন যেত হাটে বাজারে, কর্মক্ষেত্রে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ মর্যাদায় আপন অধিকারে    চন্ডাল সমাজ সেদিন মতুয়া পতাকা তলে, মান হীনভাবে ব্রাহ্মণ্যসমাজে বেঁচে থাকার থেকে, জান (প্রাণ) ত্যাগ করাকে তুচ্ছ মনে করেছিল। 

( তথ্য; “হরি-গুরুচাঁদ –বাংলার চন্ডাল ও ভারতবর্ষের  বহুজন অভ্যুত্থান” -স্বপন কুমার বিশ্বাস পৃ.৯২-৯৪)

৮) অনুন্নতদের জন্য প্রথম স্কুল স্থাপনঃ-

১৮৮০ (১২৮৭ বাংলা) সালে নভেম্বর মাসে চৌধুরী বাড়িতে পাঠশালা তৈরী করা হয়।

১৮৮১ সালে খুলনা জেলার দত্তডাঙায় ঈশ্বর গাইনের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এক বিশাল জাগরণী সভার আয়োজন করা হয়এই সভায় গুরুচাঁদ ঠাকুর সভাপতিত্ব করেন।যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।আর এই মহাসম্মেলনের পরই কমিশনার (ততকালীন  আসাম) ৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ সালে নির্দেশ দেন যে, ‘চণ্ডালের’ পরিবর্তে ‘নমঃশূদ্র লিখতে হবে।

১৮৮১ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে খুলনা শহরে Namasudra Welfare Association গঠিত হয়। উক্ত সংগঠনের তৎকালীন ২২টি জেলার প্রতিনিধি যোগদান করেন। শিক্ষা ও জাগরণের এই সম্মেলনের পর সর্বত্র সর্বশিক্ষা অভিযানের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে

অস্ট্রেলিয়ান মিশনারি ডাঃ সি. এস. মীড্‌ (ডাঃ সিসিল সিলাস মীড্‌)যিনি খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারের  জন্য এবং দীন্‌ দরিদ্রদের সেবা করার জন্য ঘুরতে ঘুরতে বঙ্গদেশে আসেনআর ১৯০৬ সালে প্রথমে ফরিদপুরে  (জেলা) আসেন

১৯০৭ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ডাঃ মীড্‌ সাহেবের স্মরণাপন্ন হন। মীডের চেষ্টায় শশীভূষণ ঠাকুর অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে সর্বপ্রথম সাব-রেজিষ্টারের চাকরি আপান

শিক্ষিত হও সংগঠিত হও ও আন্দোলন করো। Educate Ogranise Agitate-

আমরা জানি এই শ্লোগানটি বাবা সাহেব আম্বেদকরের। কিন্তু তাঁরও বহু পূর্বে এই একই শ্লোগান দিয়েছিলেন শিক্ষার অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুর।

Educate- বিদ্যা হীন সমাজের কোন গতি নাই।

‘বিদ্যা শেখ বিদ্যা শেখ’ বলিলেন তাই।।

Ogranise-                ঘরে ঘরে আন্দোলন প্রয়োজন হল।

Agitate-সভা কর সভা কর’ প্রভুজী হাঁকিল।। গু. চ. পৃ. ১১৩

মহাকবি মহানন্দ হালদারের কাব্যের ছন্দেরমধ্যে দেখতে পাই-

(১) গুরুচাঁদ ঠাকুর ‘শিক্ষা’- আন্দোলন। (২) ‘সঙ্গ’ বা সংগঠনের নির্মাণ, যেটা পূর্বেই হরিচাঁদ ঠাকুর ‘মতুয়া’ নাম দিয়ে সকলকে সংগঠিত করেছিলেন।(৩) গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই সংগঠনের উপর দাঁড়িয়ে ‘সংঘর্ষ’- করার জন্য তৈরি করেছিলেন নমঃশূদ্র, মতুয়া তথা পিছিয়ে রাখা শ্রেণিকে

৯) পত্রিকা প্রকাশঃ-

কোনো বিপ্লবের আগে ছোটে বিপ্লবের দর্শনের বেগবাণ অশ্বদর্শনতত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ পত্রপত্রিকা। অস্পৃশ্য মূলভারতীয় সমাজের প্রথম সাংবাদিক ছিলেন মহান নায়ক গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি অস্পৃশ্য/চণ্ডালদের মধ্যে প্রথম শুরুকরেন সাংবাদিকতার সুত্রপাত। তাঁরই পরিচালনায়১৯০৭সালে শুর হয়, মাসিক পত্রিকা “নমঃশূদ্র সুহৃদ”।

জার্নালিষ্ট শ্রীগুরুচাঁদের প্রেরণা এবং পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯০৮ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় “নমশূদ্র পত্রিকা”। ১৯১৬ সালে আরো দুটি মাসিক পত্রিকা নমঃশূদ্র পত্রকারেরা প্রকাশ করেনএকটি ঢাকা থেকে “নমঃশূদ্র হিতৈষী” এবং অপরতি বাবু মুকুন্দ বিহারী মল্লিকের সম্পাদনায় কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘পতাকা’সম্পাদকীয়তে তিনি (মুকুন্দ বিহারী) লিখলেন-“ বৃটিশ রাজের কৃপায় যাহা একটু জ্ঞানকণা লাভ করিয়াছি, তাহার দ্বারাই এখন জানিতে সমর্থ হইয়াছি যে, আমরা কি ও আমাদের শক্তি কতটুকু। হিন্দু সমাজের অন্ধ হিন্দু রাজের  কৃপায় আমরা এতদিন ঘুমাইয়া ছিলাম। এখন জাতিভেদ জ্ঞান শূন্য, সমদর্শী বিপুল শক্তিশালী ব্রিটিশের কৃপায় জাগিলাম। ক্ষুদ্র চিত্ত ব্রাহ্মণ কৃত আইনের শাসন বাধ্য করিয়া আমাদের বাণী মন্দিরের চতুঃসীমানায়ও যাইতে দিতেন না। তোমার চিন্তা করিবার কি আছে? স্বয়ং বৃটিশ রাজ অশিক্ষিতের বন্ধু, দরিদ্রের চির সহায়, অনুন্নত জাতি সমুহের আশা-ভরসা। তিনি তোমার সহায় হইবেন।”

জার্নালিজমের যে সুত্রপাত গুরুচাঁদ করলেন, তা বহুমুখী প্রতিভা আর প্রকাশ নিয়ে উত্থান উন্মুখ চণ্ডাল তথা নমঃশূদ্র সমাজকে সচল চঞ্চল ও সমাজ রাজনীতি সচতেন করে তুল্ল।

‘নমঃশূদ্র মুক্তি সংগ্রামের মুখপত্র গুরুচাঁদের পত্রিকা ক্রমশঃ জনমানসে অধিকতর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।“In 1908 the circulation of Namasudra was 500, while that ‘Suhrid’ 550n in 1910, the year of the nationalist take over, the circulation of ‘Namasudra’ went down to 300 while that of ‘Suhrid’ to 450; but in 1911, the year of census while the circulation of Namasudra remined at 300 that of ‘Suhrid’ shot up to 700.”

‘জাতির উত্থানের সেই ঊষাকালে, যখন ছাপাখানা এবং পত্রিকা ছাপার সরঞ্জাম সেই জবড়জং  অবস্থা; যখন শিক্ষাহীন শূদ্র বহুজন সমাজ ইন্‌টেলেকচুয়াল আন্দোলনের অর্থ ভাল করে জানতেই পারেনি, সভ্যতার সেই প্রত্যুষে কি অসাধারণ রণ কৌশলী আর তুখোড় সংগঠক ছিলেন গুরুচাঁদ। অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা সমূহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, জাতি কল্যাণ কামনায় নিজ ব্যয়ে নমঃশূদ্র সুহৃদের সারকুলেশন ৭০০ বানিয়ে ছিলেন। ( তথ্য; “হরি-গুরুচাঁদ –বাংলার চন্ডাল ও ভারতবর্ষের  বহুজন অভ্যুত্থান” -স্বপন কুমার বিশ্বাস পৃ.১১১-১১২)

 

১৯০৮ সালে এই উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণের ফলে নমঃ তথা অন্যান্য নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটা সাড়া পড়ে যায়।

১৯০৮ সালে ওড়াকান্দীতে একটি নারী শিক্ষা ট্রেনিং স্কুলও স্থাপন করা হয়এই সময় প্রসূতি মা ও শিশু সেবার জন্য  মাতৃমঙ্গল  প্রতিষ্টান করা হয়

 

১০) মুসলমানদের মতো নমঃশূদ্রদের সম্পূর্ণ আলাদা সম্প্রদায় হিসাবে স্বীকৃতির দাবী পেশঃ-

আসাম ও পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র প্রতিনিধিবর্গ পূর্বঙ্গ ও আসামের লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে 1911 সালেরসেন্সাসের পূর্বে আবার স্মারকলিপি পেশ করলেন। বাংলার মহামান্য ছোটলাটের সামনে তারা দাবি জানালোঃ মুসলমানদের মতো আমাদের সম্পূর্ণ আলাদা সম্প্রদায় হিসাবে স্বীকৃতি দিনহিন্দু জাতি থেকে আমরা আলাদা। মুসলমানদের মতো আলাদা রাজনৈতিক সুযোগ- সুবিধা দিন। স্মারকপত্রের ভাষায়ঃ

5. We beg to add that, though our religious rites and their observances, and social customs are similar to those of the high caste Brahmins, we have not the slightest connection with any of the Hindu communities. We are not allowed to join them in their social and religious ceremonies. They have been continually looking down upon us with contempt and malice (অবমাননাকর এবং বিরক্তিকর); have kept us under subjection and total ignorance. We have been smarting under their yoke of bondage (দাসত্বের জোয়াল). It is absolutely absurd to anticipate that they would, in future, mix with us in social and religious performances. Thus we desire to be recognized by the Government as entirely a different community having separate claim to political privileges like Mahamedans.

উচ্চবর্ণের লোকেরা চিরকাল ঘৃণা, উপেক্ষা ও অবজ্ঞাভরে এই বিশাল জাতিকে শিক্ষাবঞ্চিত করে পদানত রেখেছ, এ তারই বিরুদ্ধে বিস্ফোরণ, বিক্ষোভ। সোজা ভাষায় এটা বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের জন্ম হিন্দুত্বের ভেদাভেদ-সৃষ্টিকারী দর্শন ও তত্ত্বের মূলকেন্দ্র। হিন্দুর বিবেকহীন স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে এ অমোঘ নির্ঘোষ

    হিন্দুধর্ম ও সমাজব্যবস্থার মূলকেন্দ্র থেকে প্রবাহিত ঘৃণা, অপমান, উৎপীড়ন, শোষণ ও নিগ্রহ থেকে নিজেদের বাঁচাতে নমঃশূদ্ররা সফল হয়নি। গণতান্ত্রিক উপায়ে 1882 সাল থেকে আবেদন, নিবেদন, ডেপুটেশন, স্মারকপত্র পেশ করেও কোনো সুফল পায়নি। এবার বাধ্য হয়ে তারা বিদ্রোহের পতাকা তুললো। তারা স্বাতন্ত্র্যের দাবি তোলে- দীর্ঘ ত্রিশ বছর বাদে।নমঃশূদ্রদের ক্ষোভ হিন্দু ভদ্রলোকদের বিরুদ্ধে। তাদের উদ্দেশ্যে স্মারকপত্রে দ্ব্যরথহীনভাবে বলা হলঃ

   They continually have been looking down upon us with contempt and malice; have kept us under subjection and total ignorance. We have been smarting under the yoke of their bondage.” পাথর ছুঁড়ে মারলে প্রতিদানে পুষ্পবর্ষণ আশা করা যায় না। ঘৃণার ফসল প্রেম ও শ্রদ্ধা হতে পারে না। অত্যাচার আনুগত্যের জন্মদান করে না। সে হবে প্রকৃতিবিরুদ্ধ। তথ্যঃ অন্বেষণ ১ম খণ্ড, শিপ্রা বিশ্বাস, পৃ.২৯২-২৯৩)

 

১১) তে-ভাগা আন্দোলনঃ-

বাংলার অধিকাংশ অনুন্নত শ্রেণীর মানুষ কৃষিজীবী। তাদের বেশিরভাগের আবার নিজস্ব চাষাবাদ যোগ্য জমি ছিল না। বর্ণহিন্দু জমিদার, জোতদার ও গাতিদারদের জমি তারা ভাগচাষ করতপূর্ববাংলায় এই ভাগচাষী-আন্দোলনকারীরা অধিকাংশই যশোর, খুলনা ও ফরিদপুরের নমঃশূদ্র। আর এরা ছিল বেশিরভাগ ধর্মভীরু এই অনুন্নত শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি মতুয়াদের ধর্মীয় সংগঠনের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনের এই আন্দোলন শুরু করেন। যশোর, খুলনা ও ফরিদপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষকদের জমির সেস্‌(কর) ধার্য করা হয়। যার ফলে “নগতে খাজনা আদায় প্রথা” এবং বর্গা প্রথা চালু হওয়ারপর “ধান-কড়ারী (Rice conditional) প্রথা” হিসাবে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত।তার ফলে জমির খাজনাও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে জমির বর্গাদারকে জমি চাষাবাদের জন্য কম ধান দেওয়া হত তাই জমি ভাগচাষী-বর্গাদারকে ফসলের কমভাগ দেওয়া হতফলে কৃষকদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ দেখা দেয়।

পাচঁ টাকা কর্জ করি কত অভাজন।

সুদের পাষাণ তলে ছেড়েছে জীবন।।

জমি গেছে জমা গেছে, গেছে অস্থাবর।

ঘর-হারা লক্ষ্মী-ছাড়া অবনী ভিতর।।-গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ (X)

গুরুচাঁদ ঠাকুর বাংলার এই সর্বহারা কৃষকদের দুর্দশা দেখে তাদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছিলেন। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে তাঁর নেতৃত্বে কৃষকেরা তে-ভাগা আন্দোলন শুরু করে এই প্রথার প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে মাঝে মধ্যেই তারা জমিদারের হাট বাজার লুট ও ভাঙচুর করত। পুলিশ এসে তাদের উপরও আক্রমণ করত। এইভাবে ক্রমে ক্রমে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের নমঃশূদ্ররা ইংরেজ প্রশাসনের কাছে আতঙ্ক হয়ে ওঠে। মুসলিম কৃষকদের সহায়তায় বর্গাজমি চাষের ক্ষেত্রেও আবার তারা নতুন দাবি তুলে আনে। জমিদারদের জানিয়ে দেয় যে, উৎপন্ন ফলসের দুই তৃতীয়াংশ ভাগ না দিলে তারা আর জমি চাষ করবেনা।

     তে-ভাগা আন্দোলনের বিস্তৃত বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায় তৎকালীন পূর্বপাকিস্থানের প্রাক্তন মন্ত্রী শরৎচন্দ্র মজুমদারের ‘রাইচরণ চরিত’ গ্রন্থে। যশোরের অন্যতম অস্পৃশ্য পতিত নমঃ কৃষক নেতা রাইচরণ বাবু ছিলেন এই তে-ভাগা আন্দোলনের পুরোভাগে। অনুমানিক ১৮৯৫ সালে যশোরের কালিয়া থানার অন্তর্গত হাড়িয়ার ঘোপ গ্রামে নিতাই মন্ডলের বাড়িতে অনুষ্ঠিত সুপরিকল্পিতএকটি ‘Uplift meeting’ থেকেই রাইচরণবাবু এই সানাহুজ কাজে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই মিটিং-এ ওড়াকান্দীর পক্ষ থেকে হাজির ছিলেন ঠাকুর গুরুচাঁদের স্নেহধন্য অন্যতম প্রতিনিধি কুটিশ্বর বিশ্বাস। এই মিটিং-এর পর রাইচরণবাবু তে-ভাগা আন্দোলনের জন্য প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন অত্যাচারী জমিদার ও জোরদারদের বিরুদ্ধে। আর এই কাজে পৌন্ড্র জাতির লোকেরা ও মুসলিম কৃষক সমাজ তাঁকে সহযোগীতা করেছিলেন। এরপরবাংলা ১৩১৪ সালে (ইংরাজী ১৯০৮ সালে) মনিরামপুর হতে সাড়ে পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে মনোহরপুর গ্রামে প্রথমত এবং তার কিছুদিন পর নিকতবর্তী পাড়দিয়া গ্রামে অস্পৃশ্য পতিত নমঃ ও মুসলমানদের অন্য একটি বৃহৎ কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সর্বসম্মতভাবে তে-ভাগা আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৯২২ সালের জন মাসে বরিশাল জেলার পিরোজপুরে গুরুচাঁদ ঠাকুরের সভাপতিত্বে এক বিশাল কৃষক সমাবেশে সর্বপ্রথম আমূল ভূমি সংস্কারের দাবী তোলা হয়। বাংলার কৃষকদের বিভিন্ন দাবী-দাওয়া নিয়ে তিনি বিভিন্ন জেলায় সভাসমিতি করেন। ১৯৩৩ সালে মেদিনীপুরের ঘাটালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে তিনি প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। সেজন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরকে তে-ভাগা আন্দোলনের জনক বলা হয়। তিনি ছিলেন একজন কৃষক দরদী ও দরিদ্র মানুষের মুক্তি আন্দোলনের দিশারী।

১২) অনুন্নত শ্রেণির জন্য শিক্ষা ও চাকরীতে সংরক্ষণঃ-

     ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে যুগনায়ক শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর ডাঃ সি.এস. মীডের সহায়তায় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসামের লেফটন্যান্ট গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলার পতিত তথা চণ্ডালদের শিক্ষা ও চাকুরী-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। এই সাক্ষাৎকারের পরে স্যার ল্যান্সলট হেয়ার একমাত্র সাবেক চণ্ডাল জাতি অধূনা নমঃশূদ্রদের শিক্ষা ও চাকুরীতে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।

   ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে ৩১শে অক্টোবর বাংলা প্রেসিডেন্সীর গভর্ণর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল লর্ড মিন্টর নিকট অনুন্নত শ্রেণীর লোকদের উন্নয়নের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। সেই খসড়া প্রস্তাবানুসারে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে বাংলায় ৩১টি অনুন্নত শ্রেণীর সম্প্রদায়কে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করা হয়। এই সংস্কারের আইনে বঙ্গীয় আইন সভায় অনুন্নত শ্রেণীর একজন নির্বাচিত এবং একজন মনোনীত প্রার্থীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। তখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রেসিডেন্সী বা প্রদেশে কোন বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু হয়নি। একমাত্র বাংলার এই ৩১টি সম্প্রদায়কে নিয়ে “বঙ্গীয় তপঃশীল ভূক্ত জাতি” আইন সৃষ্টি হয়। অনুনন্ত শ্রেণীর মানুষের শিক্ষা, চাকুরী ও আইন সভায় যে আসন সংরক্ষিত হয়েছিল, তার মূলে ছিলেন যুগনায়ক শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর এবং সংঘবদ্ধ মতুয়া আন্দোলন। ভারতবর্ষের মত বর্ণভিত্তিক বা সম্প্রদায় ভিত্তিক দেশে সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া কোন দাবী আদায় করা যায় না।

    ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার ঘোষণা অনুযায়ী পূর্ববঙ্গের তপশীলীভূক্ত জাতি সমূহের ছাত্রদের পড়াশুনার সুবিধার্থে কিছু সরকারী হোস্টেলের ববস্থা করা হয়। তার মধ্যে ওড়াকান্দী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরিশাল এবং ঢাকায় সরকারী অর্থা সাহায্যে হোস্টেল চালু করা হয়। ১৯১৫  খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে পূর্ববাংলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারী অফিসে অনুন্নত শ্রেণীর মানুষের জন্য জনসংরক্ষণ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হয়ে যায়। ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায় অনুরূপ একটি  হোস্টেল খোলা হয় এবং তার পরিচালন ভার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর  ন্যাস্ত হ্য। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে অনুন্নত শ্রেণীর এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রেসিডেন্সী বা প্রদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। এই ভাবে যুগনায়ক শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে মতুয়া আন্দোলনের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষের শিক্ষা, চাকুরী ও আইন সভায় সংরক্ষণ সৃষ্টি হয়। তিনি দিন-রাত জেগে কঠোর পরিশ্রম করে একটি পিছিয়ে পড়া চিরনিদ্রিত মানব গোষ্ঠীর মুক্তির পথ সুগম করে তুলেছিলেন। (তথ্য সংগ্রহ – শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত- আচার্য মহানন্দ হালদার। পৃ. VIII & IX)

১৯০৮ সালে নমঃশূদ্র জাতির মহাসম্মেলনে সঙ্কল্প গৃহীত হয় যে, যদি কোনো নমঃশূদ্র বিশ বছরের কম বয়সের ছেলে এবং দশ বছরের কম বয়সের মেয়ের বিয়ে দেয়, তাকে একঘরে করেরাখা হবে। (তথ্যঃ–অন্বেষণ- ১ম খণ্ড,শিপ্রা বিশ্বাস পৃ. ১৪৯)

১৯১০ সালে মার্চ মাস নাগাদ (বাংলা ১৩১৬ সাল), বারুনীর সময় অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন  পালনের মাসে (১৩ই মার্চ) গুরুচাঁদ ঠাকুর পতিত জাতির মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন। আর বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।

১৯১১ সালে চন্ডাল গালি মোচন, পরিবর্তে নমঃশূদ্র নাম সরকারী নথীতে অন্তর্ভুক্ত করান গুরুচাঁদ ঠাকুর। লোকগণনায় বাংলায় চন্ডালদের নমঃশূদ্র সম্প্রদায় হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের হাজার বছরের চন্ডাল গালি মোচন করা হয়।

১৯১২ সালে পঞ্চম জর্জ গুরুচাঁদ ঠাকুরকে সমাজ সেবার জন্য “দরবার মেডেল” উপহার দেন।

১৯২১ সালেগান্ধীজীর নির্দেশে চিত্তরঞ্জন দাস গুরুচাঁদ ঠাকুরকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর এর যোগ্য জবাব দেন ঐ আন্দোলনে যোগ না দেবার জন্য।

সত্যকথা দেশবন্ধু! করি নিবেদন।

এই পথে স্বাধীনতা আসেনা কখন।।

সমাজের অঙ্গে আছে যত দুর্বলতা।

আগে তাহা দূর করা আবশ্যক কথা।।  -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪১৪    

১৯২৩ সালে খুলনা জেলায় অনুন্নুত মানুষের উন্নয়নের জন্য যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গুরুচাঁদ ঠাকুর সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এই সম্মেলনে নমঃশূদ্ররা কীভাবে রাজনীতি করবেন, সেবিষয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর মতামত ব্যক্ত করেন।

 ১৯২৬ সালে “The Bengal Depressed Classes Association”গঠিত হয় খুলনা শহরের সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।

১৯৩১ সাল নাগাদ ঢাকা ডিভিশনে মূলত নমঃশূদ্র ছেলে-মেয়েদের পঠন পাঠনের নিমিত্ত গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে ১০৬৭টি বিশেষ বিদ্যালয় গড়া সম্ভব হয়েছিল।

১৯৩১ সাল নাগাদ পিছিয়ে রাখা সমাজের সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে ৫৬৯টি, সাঁওতাল বা আদিবাসী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বর্ধমান ডিভিশনে ২৪৬টি এবং  নমঃশূদ্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য ঢাকা ডিভিশনে ১০৬৭টি স্কুল স্থাপন করেন। তো দেখা যায় সর্বমোট ১৮৮২টি স্কুল স্থাপন করেন। আর ডাঃ সি. এস. মীডের সহায়তায় বৃটিশ সরকার দ্বারা এই স্কুলগুলিকে প্রথমে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষার স্কুল এবং পরে মিড্‌ল ইংলিশ স্কুলে অনুমোদন করানপরবর্তীতে এর মধ্য থেকে কিছু স্কুল উচ্চ ইংরাজী স্কুলে উন্নীত হয়।

 গুরুচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে গঠিত স্কুল সংখ্যাটা আমরা বর্তমান দশম শ্রেনির‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ –বইতে দেখতে পাই- তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।’

১৯৩২ সালে ওড়াকান্দীতে ‘হরি-গুরুচাঁদ মিশন’ প্রতিষ্ঠা করে সেই মিশনের সহায়তায় ওড়াকান্দীর তালতলায় নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৮১ সালে দত্তডাঙ্গা গুরুচাঁদ ঠাকুর জাতির জন্য যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তার পর থেকে পিছিয়ে রাখা শ্রেণির মধ্যে শিক্ষা আন্দোলনের যে জোয়ার বইতে শুরু করে, আর দিকে দিকে যে পাঠশালা তৈরী হতে থাকে সেই সব পাঠশালার মধ্যে বহু পাঠশালা ১৮৯০ সালের মধ্যে ইংরাজী ও উচ্চ ইংরাজী বিদ্যালয়ে পরিনত হয়। আর এই সব বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়

গুরুচাঁদ ঠাকুর সম্পর্কে ডঃ সি. এস. মীড্‌  বলেছেন- “GuruchandBabu is a leader of outstanding ability and of wide-spread influence. In the various activities of my missionary life he has made possible many things that without his backing could not have been carried through. With a liberality of thought, a courage and a foresightedness uncommon among men of the older orthodox school. He has sought the up lift of great namasudra caste. (গু.চ. পৃ. ৪১৭)

 

১৩) স্বাধীনতা সম্পর্কে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কালজয়ী বক্তব্য প্রদানঃ-

স্বাধীনতা যদি আসে,   তা’হতে কি শ্রেষ্ঠ আছে?

বুঝিনা যে এত অন্ধ নই

তবে যে নামিনা পথে,   বহু বাধা আছে তা’তে

এড়াইতে পারি বাধা কই? -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪২  

স্বাধীনতার থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি? স্বাধীনতার মহত্ত্ব যে বুঝিনা এত বড় অন্ধ আমি নই। তবে যে স্বাধীনতা আসবে সেটাকি দেশের সকল জনগণের জন্য? নাকি মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণীয়দের জন্য? বর্তমান পরিস্থিতিতে এই স্বাধীনতা আমাদের নিম্নবর্ণীয়দের জন্য সুফল ডেকে আনবেনা। সেটা সুবিধাবাদী উচ্চবর্ণীয়দেরই স্বাধীনতা হবে। আমরা আজ যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের যাতা কলে পিষে মরছি, অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে আছি, জাতব্যবস্থা  বর্ণব্যবস্থার শিকল আমাদেরকে যেভাবে প্রগতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে; স্বাধীনতার পরেও কিন্তু এর কোন পরিবর্তন হবেনা। যার জন্য আমি এই পথে নামতে পারছিনা। আমার বিবেক বাধা দান করেছে। আর সেই বাধাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারিনা

    আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, অনুন্নত জাতিগুলি এক সঙ্গে স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দিলেন। তারপর কি কাজ করবেন তারাঁ? তাঁরা কোন কাজ পারেন? আর ফলাফল কি হবে এঁদের? আমাদের লোকেরা ক’জন চাকরী করেন? ক’জন আদালতে ঘোরা ফেরা করেন? আমাদের লোকেরা প্রায় সকলেইতো বিদ্যালয়ের দোরগোরায় যেতে পারেননি। অর্থাৎ এঁরা প্রায় সকলেই শিক্ষার আলো থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছেন। সেই জন্য আমি বলছি-

তা’তে বলি এই নীতি      অনুন্নত যত জাতি

 তাহাদের পক্ষে নাহি খাটি। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩        

এই যে, আন্দোলনের নীতি, এই নীতিটা আমাদের অনুন্নত জাতির জন্য সঠিক নয়। আপনারা দেখুনতো, উচ্চবর্ণীয়রা স্কুল আদালতে ভরে আছে। এই নীতিটা তাদের সুবিধার জন্য। আরো আশ্চর্যের  কথা  হচ্ছে, উচ্চবর্ণীয়রা আমাদেরকে আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য বিভিন্নভাবে আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা কেউতো চাকরী ছেড়ে এই আন্দোলনের জন্য পথে নামেননি। তারাতো সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে বহাল আছেন।

এই সব দেখে দেখে     লও ভাই সবে শিখে

      কোন্‌ ভাবে চলিছে সংসার।

বুদ্ধিহীন সরলতা        আর নাহি চলে হেথা

কূট-বুদ্ধি বটে দরকার।।-গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩       

এই সব ঘটনা থেকে আপনাদের শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। কিভাবে সমাজ সংসার চালাতে হবে সেটা বুঝতে হবে। বর্তমান যে যুগ পড়েছে তাতে আর ঐ ‘বুদ্ধিহীন সরলতা’ নিয়ে বেচে থাকা যাবেনা। তার জন্য কিছু ‘কুট-বুদ্ধি  অর্থাৎ কৌশলের দরকার আছে।

স্বাধীনতা কথা ভাল,  নে’য়া ভাল দে’য়া ভাল

     ভাল তা’তে নাহিক সন্দেহ। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩         

‘স্বাধীনতা’ শব্দটি খুব ভাল এটা গ্রহণ করা যেমন ভাল, তেমনি কাউকে দেওয়াও ভাল। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আপনারা ছোট বেলায় পড়ে থাকবেন যে,

বাঘের গলার হাঁড়     টেনে যদি কর বা’র

      পুরস্কার এক মুঠা ছাই। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩         

বক বাঘের গলায় বেধে যাওয়া হাড় বের করে দিয়েছিল। কিন্তু পুরষ্কার স্বরূপ কিছুই পায়নি। বাঘ উল্টা ধম্‌কি দিয়ে বলেছিল-“তোর তো সাহস মন্দ নয়, আমি যে তোকে খেয়ে ফেলিনি এটাইতো তোর  সৌভাগ্য।” তো আমাদের লোকদেরও যে বকের মত অবস্থা হবেনা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলে তার কোন গ্যারান্টি আছে কি? তারা এমনও তো বলতে পারে যে, তোমরা নিচু জাতির লোক হয়ে আমাদেরর সঙ্গে আন্দোলন করতে পারছো, এর থেকে বেশি আর কি আশা করতে পারো? কারণ, আজ যারা এই আন্দোলন করছেন, সেটা সম্পূর্ণ তাদের স্বার্থের জন্য। সেখানে আপনাদের স্বার্থের জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। হাঁ, তারও প্রমান আপনাদের আমি দিচ্ছি-

স্বাধীনতা পাবে যবে     কাঁ’রা উপকৃত হ’বে

     সেই কথা পার কি বলিতে?

কর্ত্তা আজ যারা যারা    সে দিন একত্রে তারা

    রচনা কবিবে শাসন তন্ত্র।

রাজাদের সে সভায়    তোমাদের স্থান নয়

    তোমরাত’ শুধু বাদ্য যন্ত্র।

যুদ্ধকালে প্রয়োজন    বাদ্য যন্ত্র আগণন

যুদ্ধ শেষে কে করে সন্ধান? -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩          

বলুনতো এই স্বাধীনতা কাদের জন্য? এর থেকে কারা উপকৃত হবেন? এসব কথা আপনারা কেউ বলতে পারেন কি? আপনারা শুনেনিন এবং ভবিষ্যতেও আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। আজ যাঁরা এই আন্দোলনের কর্তা, স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরাই শাসনতন্ত্র রচনা করবেন তাদের সুবিধা মত। সেখানে আপনাদের স্থান রাজার রাজ সভায় বাদ্য যন্ত্রের মত। কারণ, যুদ্ধের সময় বাদ্য যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেই বাদ্য যন্ত্রের কথা কি কেউ মনে রাখেন? তবে হ্যা,

যদি থাক’ সেনাপতি   তবে হ’তে পারে গতি

     সেই গুণে তুমি আজ আন। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩          

আপনারা যদি কোন কাজে প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করে কাজ করতে পারেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন সেনাপতি সবকিছু আদেশ করেন, আপনাদেরও আদেশে দেবার মত অধিকার অর্জন করতে হবে। আর সেই অধিকার অর্জনের জন্য আপনাদের নিরন্ত্রর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

     তবে কথা হচ্ছে সেনাপতি হওয়ার জন্য যে গুণের অধিকারী হ’তে হয়; সেই গুণ আমাদের জাতির মধ্যে এখনও জেগে ওঠেনি। সবে “শিশু মাত্র জাগরণ-পথে।” যাঁরা যৌবনের পূর্ণতা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করা সম্ভব নয়। আপনাদের জাতি যখন পূর্ণ শক্তির যৌবনে ভরে উঠবে তখন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চলতে পারবেন।

আজ তা’তে কার্য নাই      তাই বলি শুন ভাই

      ভুলে যাও সে সব কাহিনী-গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩

আজ আমরা বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে শিশু তুল্য। তাই শিশু হয়ে যৌবনদিপ্ততা প্রকাশ করা ঠিক নয়। আপনাদের যৌবন আশার অপেক্ষা করুন। আর বর্তমান আন্দোলনের কথাকে ভুলে যান।

জাতির উন্নতি লাগি     হও সবে স্বার্থত্যাগী

দিবারাত্রি চিন্তা কর তাই।

জাতি ধর্ম, জাতি মান     জাতি মোর ভগবান

জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই।।

কিবা বিদ্যা, কিবা ধনে কিবা শিল্পে, কি বিজ্ঞানে

রাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে রাজ-কাজে।-গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩          

আমাদের জাতি প্রগতির ক্ষেত্রে এখনও শিশু। এই শিশু প্রগতিকে যৌবনে পদার্পণ করার জন্য আপনাদরা আজকে নবযৌবন প্রাপ্ত শিক্ষিত যুবকেরা। তাই আপনারা জাতির উন্নতির জন্য সকলে নিজস্বার্থকে ত্যাগ করে জাতির স্বার্থে দিবারাত্র চিন্তা করুন। আপনাদের কাজ হচ্ছে- জাতিই ধর্ম, আর জাতিই মান সম্মান। আর জাতিই ভগবান। জাতির উন্নতি ছাড়া আর কোন প্রকারের চিন্তা করার দরকার নেই।

আপনাদেরকে বিদ্যা, ধন, শিল্প, বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতির সর্ব ক্ষেত্রে থাকার জন্য কাজ করতে হবে, এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। জাতির এই উন্নতির জন্য নরনারী একসঙ্গে প্রত্যেক কাজ হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাবেন, আপনারা অলসতা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলুন। আর বজ্রকন্ঠে বলুন-

“আগে চল নাহি অবসর।” এগিয়ে চলো, আমাদের কাছে কোন অবসর নেই।-গুরুচাঁদ চরিতপৃঃ (VII) 

১৪) মহাপ্রয়ানঃ-১৯৩৭ সালে ৯১ বছর বয়সে ২৭ শে মার্চ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মহাপরিনির্বাণ হয়শিক্ষা আন্দোলনের এই অগ্রদূতের মহাপরিনির্বাণউপলক্ষ্যে কোলকাতার এলবার্ট হলে স্মৃতিসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। এই স্মৃতি সভায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে “মহামানব” হিসাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ নং (XIV)  

                              ________________________

 

 

Comments