Skip to main content

মতুয়াদের ভগবান কে? ঈশ্বরের ব্যাখ্যা কী? তিনি কোন ঈশ্বরের পূজা করতে বলেছেন? লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

 


মতুয়াদের ভগবান কে? ঈশ্বরে ব্যাখ্যা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি কোন ঈশ্বরের পূজা করতে বলেছেন?

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

(আমার লেখা বই- ‘গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও মুক্তির দিশা’ বই থেকে তুলে দিলাম।)

    ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপস্থিতিতে  লক্ষ্মীখালীতে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজনদের নিয়ে এক বিরাট জাগরণী সভা হয়। যে সভায় প্রায় পাঁচ হাজার শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন।  সেই সভায় –

প্রভু বলে “শোন সবে নমঃশূদ্রগণ

ধর্ম্ম শক্তি বিনা জাতি জাগেনা কখন।।” (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫২৯)

  তিনি সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কোনো জাতিকে জাগাতে হলে ধর্মের প্রয়োজন আছে। ধর্ম শক্তির মাধ্যমেই সকলকে একতা বদ্ধ করতে হবে।তিনি ধর্মকে সংগঠিত করার হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করলেও ধর্মের অলীক বা অযৌক্তিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেননি। মানুষকে জাগ্রত করার শিক্ষার মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

     এরপর তিনি জানান যে, এই জাতির মঙ্গলের জন্য যা কিছু হয়েছে সবই হরিচাঁদ ঠাকুরের অবদান। আর তিনি যে কাজের দায়িত্ব আমাকে সমর্পণ করেগেছেন সেই কাজই আমি প্রতিনিয়ত করে চলেছি। তাই আপনাদের প্রধান কাজ হচ্ছে-

বিদ্যা ছাড়া এ জাতির দুঃখ নাহি যা’বে।

গ্রামে গ্রামে পাঠশালা কর তাই সবে।।

বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।

লোকে বলে “মা’র গুণে ভাল হয় ছা’ও।। (পৃঃ ৫২৯)

তিনি সকলকে জাতির দুঃখ দূর করার জন্য বিদ্যা অর্জনের উপর জোর দেনআর গ্রামে গ্রামে পাঠশালা করার আহ্বান জানান। নারীকেও শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেন। কারণ, মা’ শিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হবে। তিনি আরো জানান, শুধু শিক্ষা অর্জনই নয়; তোমাদের ব্যবসা- বানিজ্যের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যেতে হবে। কৃষিকার্যকে অবহেলা করা যাবেনা। আর মদ,গাঁজা খাওয়া ও জুয়া খেলার নিষেধ করেন। চারিত্রিক স্বচ্ছতার কথা বলে সকলকে অনুপ্রাণিত করেন।

 

 মতুয়ারা কার পূজা করতে হবে আর কার পূজা করবেনা

এরপর- মতুয়াদেরকে কার পূজা করতে হবে আর কার পূজা করবেনা; সে বিষয়ে তিনি এক অমোঘ বাণী দেন। যে বাণীকে প্রত্যেক মতুয়া অনুরাগী তথা সকল সমাজ চিন্তকদের ভেবে দেখা দরকার। যে বাণী শুধু মতুয়াদের জন্যই নয় সমগ্র মানবজাতির প্রগতির জন্য একান্ত আবশ্যক

দেবতা-মন্দির সবে গড়’ ঘরে ঘরে।

নিত্য পূজা কর সেথা সরল অন্তরে।।

এইখানে আমি বলি’ এক সমাচার।

দেবতা-মন্দিরে পূজা করিবে কাহার?

বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।

যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।। (গু. চ. পৃঃ ৫২৯)  

   পাঠকগণ খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করু, গুরুচাঁদ ঠাকুর ঘরে ঘরে দেবতার মন্দির গড়ার কথা বলছেন। কিন্তু তিনি আবার প্রশ্ন করছেন যে, সেই মন্দিরে কাঁর পূজা করতে হবে? তিনি নিজের  প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দৃপ্তকন্ঠে এক অমোঘ নির্দেশ দিয়েছেন যে, “এই মন্দিরে এমন ঈশ্বরকে স্থাপন করে পূজা করবে, যে ঈশ্বর সারা বিশ্বময় বিরাজ করছে। যে ঈশ্বর মানুষকে তাদের প্রতি অন্যায়, অত্যাচার, সামাজিক ধর্মীয় বিষয়ে জাতিভেদ ও সমস্ত অসমানতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে সংগ্রাম করেছেন। এইসব সমস্যা থেকে নিপীড়িতদের উদ্ধার করেছেন। সেই ঈশ্বরের পূজা করতে হবে।” তবে সেই পূজা কেমন করে হবে? সেই মন্দির কেমন হবে? এখানে মন্দির অর্থ কিন্তু শুধু মূর্তি স্থাপনের জন্য নয়; শুধু ঘট ফুল পাতা ইত্যাদি প্রচলিত পূজাচার নয়। এখানে মন্দিরের আর একটি বৃহত্তর অর্থ হচ্ছে মন মন্দির, শিক্ষার উপকরণের মন্দির। যে মন মন্দির সুশিক্ষার উপকরণে পরিপূর্ণ হবে। যে মন্দিরের অর্ঘ দেশ সমাজ ও জাতির মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে।  প্রগতির ক্ষেত্রে জাগরণ ঘটাবে। যার জন্য তিনি বলেছেন-

 ‘বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।

 যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।’

এখানে ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা হয়েছে  যে, যেযাহাকে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। আর এই উদ্ধার কর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন

      তো এই নিপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা  সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা সাবিত্রীবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, ফতেমা শেখ, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই- যেমন- মার্টিন লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা ইত্যাদি।

এই মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের  অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা উদ্ধার কর্তাকর্মের মধ্য দিয়ে এঁদের জ্ঞান-আদর্শের পূজা করতে হবে।

 মতুয়াদের ভগবান কে?

তোমাদের এই কুলে হরি অবতার।

দয়া করে নমঃশূদ্রে করিল উদ্ধার।।

তাঁর পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।

নিজ ঘরে ভগবান ফেলে কোথা যাও? (পৃঃ ৫২৯)   

     তোমাদের ঈশ্বর বা অবতার বা উদ্ধার কর্তা যাই বলোনা কেন তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তোমরা তাঁর পূজা কর। তবে এই পূজা শুধুমাত্র ফুল, বেলপাতা চিন, বাতাসার নয়। এই পূজার উপচার হবে সত্য, প্রেম পবিত্রতা। পরোউপকার। চরিত্র গঠন। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। হরিচাঁদ ঠাকুরের কর্ম ও আদর্শের পূজা যে পূজার ফলে জাতি, সমাজ ও দেশের মঙ্গল হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মতুয়ারা নিজেদের ভগবানকে চিনতে না পেরে বৈদিকতার জ্বালে ফেঁসে আছে। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই যেখানে‘বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি’ বলে ঘোষণা করেছেন, সেখানে বেশিরভাগ মতুয়া বৈদিকতা নিয়ে মেতে আছেন। আর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকেও সেই  বৈদিকরার মধ্যে গুলিয়ে দিচ্ছেন। যদিও মতুয়া দর্শনে আছে- যে হরিচাঁদের নির্দেশ মেনে  চলবে সে- ‘না ডাক’ হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।’ –(গু.চ.পৃ ১৪ ও ৫৬৯)

     সেজন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন - তোমরা তোমাদের নিজের ঘরের ভগবানকে ফেলে রেখে অন্য কোথায় যেতে চাইছো? এতো স্পষ্ট করে বলার পরেও আজ মতুয়ারা বিপথগামী কেন??

____________

 


Comments