শুধুমাত্র জাতিগত কারনেই কি গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই শিক্ষা আন্দোলন ও সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের কথা ইতিহাসে স্থান পায়নি? লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
শুধুমাত্র জাতিগত কারনেই কি গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই শিক্ষা আন্দোলন ও সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের কথা ইতিহাসে স্থান পায়নি?
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
(আমার লেখা বই- 'গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন' থেকে তুলে দিলাম)
একবার ভেবে
দেখুন, একজন ধর্মগুরু (প্রকৃত পক্ষে সমাজ সংস্কারক) যিনি কিনা শিক্ষার আন্দোলন
করার জন্য তাঁর অনুগামীদের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই নির্দেশ শিরোধার্য করে গ্রামে
গ্রামে পাঠশালা নির্মাণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার প্রদীপ জ্বলতে শুরু করেছে। এটা কি এক
অভাবনীয় ঘটনা নয়? ভেবে দেখুন তো, আর কোন ধর্মগুরু এইভাবে অস্পৃশ্য পতিত
মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন
কিনা? এটা ইতিহাস বিরল ঘটনাগুলির মধ্যে অন্যতম ঘটনা নয় কি? যদিও এই ঘটনা
বর্ণবাদীদের দ্বারা রচিত ইতিহাসে তেমন করে এখনও স্থান পায়নি।
তবে আমরা ‘ডাঃ
অতুলচন্দ্র প্রধানের’ গবেষণা গ্রন্থে দেখতে পাই- In Bengal, even though the
Depressed class pupils found no difficulty in securing admission to common
schools during 1931, there existed 569 special schools for the backward class
in presidency division, 246 special schools for the Santhals in the Burdwan
division, and 1067 schools exclusively meant for the Namasudra children in
Dacca division. (তথ্য সূত্রঃ Atul
Chandra Pradhan, the Emergence of depress classes, Book land International, 126
Ashok Nagar, Bhubaneswar 751005, 1st Ed 1986, p.33)*৬
এখানে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? দেখতে পাচ্ছি
যে, গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুগামীদের সহায়তায় ১৯৩১ সাল নাগাদ পিছিয়ে রাখা সমাজের
সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে ৫৬৯টি, সাঁওতাল বা আদিবাসী ছেলেমেয়েদের
শিক্ষার জন্য বর্ধমান ডিভিশনে ২৪৬টি এবং
নমঃশূদ্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য ঢাকা ডিভিশনে ১০৬৭টি স্কুল
স্থাপন করেন। তো দেখা যায় সর্বমোট ১৮৮২টি স্কুল স্থাপন করেন। আর ডাঃ সি. এস. মীডের
সহায়তায় বৃটিশ সরকার দ্বারা এই স্কুলগুলিকে প্রথমে ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষার স্কুল
এবং পরে মিড্ল ইংলিশ স্কুলে অনুমোদন করান। আর পরবর্তিতে এর মধ্য থেকে কিছু
স্কুল উচ্চ ইংরাজী স্কুলে উন্নীত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা
আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতবড় ভূমিকা গ্রহণ করা সত্বেও ইতিহাসের পাতায় তাঁর কোন নাম নেই
কেন? সেটাকি শুধুমাত্র তাঁর জন্মগত জাত পরিচয়ের জন্য?
যেখানে ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫৭ সালের নভেম্বর
থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস পর্যন্ত এই সাত মাসে মাত্র ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করে তিনি
“বিদ্যাসাগর” উপাধীতে ভূষিত হয়েছেন। সেখানে
গুরুচাঁদের ক্ষেত্রে কি আমরা জাতি বৈষম্য লক্ষ্য করতে পারছি না?
একদিকে আমরা দেখতে পাই ১৮৫৮ সালের বৃটিশ
শিক্ষা নীতিকে ধোকা দিয়ে এই পতিত অস্পৃশ্য সমাজের ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে শিক্ষা
গ্রহণ করতে না পারে তার জন্য ১৮৭০ সালে অনুমোদিত স্কুলগুলিতে উচ্চবর্ণীয়রা সুকৌশলে
এই পিছিয়ে রাখা সমাজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেয়। আসলে
উচ্চবর্ণীয়রা কখনই চায় না যে, তাদের দ্বারা নিষ্পেষিত সমাজ শিক্ষার আলো পাক। যার
জন্য তারা বৃটিশদের নতুন শিক্ষা নীতির প্রয়োগ শুধুমাত্র কাগজে কলমে দেখাত। যেটা
বাস্তবে আদৌ ছিলনা। বৃটিশ শিক্ষানীতির প্রয়োগ ও তার ত্রুটি-বিচ্যুতির সঠিক সত্য
জানার জন্য সরকার Sir W.W. Hunter-এর নেতৃত্বে ১৮৮২ সালে একটা
শিক্ষা কমিশন বসান। যেটা Hunter কমিশন নামে খ্যাত।
কমিশন তার রিপর্টে জানান-“নিম্নবর্ণের শিশুদের স্কুলে ভর্তির সামাজিক ও ধর্মীয়
বাঁধা নিষেধ বর্তমান। নিম্নবর্ণের ছেলে-মেয়েরা পড়ার সুযোগ পায়না। এমনকি সরকারি স্কুলেও উচ্চ স্তরের
অফিসারদের বার বার চাপ প্রয়োগ বিনা তাদের ভর্তি করা হয়না। উচ্চবর্ণের অভিভাবকরা
চায় না তাদের ঘরের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিচু জাতের ছেলে মেয়েদের মধ্যে মেলামেশা
হোক।”*৭
তো Hunter সাহেবের এই
রিপোর্ট থেকে বুঝতে পারা যায় যে, উচ্চবর্ণীয়রা কখনই চায়ানা তাদের দ্বারা দাবিয়ে
রাখা নিম্নবর্ণীয়রা লেখাপড়া শিখুক।
গুরুচাঁদ ঠাকুর উচ্চবর্ণীয়দের এই ষড়যন্ত্রকে
খুব ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পোঁছে দেবার জন্য
১৯৩১ সাল নাগাদ প্রায় দু’হাজারের মত স্কুল স্থাপন করেছিলেন।
আমরা সন্দীপ দাশগুপ্তের লেখায়
(আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরী, ঐতিহাসিক কলম, তারিখ- ১৪/০৪/২০০২) দেখতে পাই তিনি
লিখেছেন,- “ইতিহাসে
অধরাদের তালিকায় এমন আরও নাম আছে।----- তথ্যের দিক থেকে একথাও উড়িয়ে দেওয়া গেল না,
গুরুচাঁদ ঠাকুর নামে কার্যত অজ্ঞাত অন্য
এক বাঙালির আন্দোলনেই পূর্ববঙ্গে হাজারেরও বেশি স্কুল হয়েছিল। এদের কারও কাজের
ব্যাপকতা হয়তো বহু কথিত দু’এক জন মহাজনের মত নয়। এটাও ঘটনা, অভাগাদের কাটতিও মন্দ।
যাদের কেউ চেনেই না তাদের পাদপ্রদীপে এনে কোনও কোনও গবেষকের লাভ নেই। বই ছাপা হলে
সব কপিই হয়তো পড়ে থাকবে। হয়তো--”*৮
সবচেয়ে
দুঃখ জনক বিষয় হচ্ছে, যাদের জন্য এই সব স্কুল নির্মাণ করা হয়েছিল যে সমাজের লোকদের
দ্বারা, পরবর্তিতে যে স্কুলগুলো সরকারী স্কুলে পরিনত হয়েছিল যে লোকদের অক্লান্ত
চেষ্টার ফলে, উচ্চবর্ণীয়দের ষড়যন্ত্রের ফলে সেইসব স্কুলে সেই পিছিয়ে রাখা সমাজের
ছেলে-মেয়েরা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত। এর থেকে বোঝা যায়, ব্রাহ্মণবাদ কত নিষ্ঠুর!
কত জাতিবাদী। কত প্রগতি প্রতিপন্থী। তারা কি করে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে উচ্চ স্থানে
বসাবে। কারণ তাদের নীতিটাইতো সমাজ হিত
কারক নয়। সেখানে একজন সমাজ হীতকারিকে কি করে সম্মান দেবে?
এসব তথ্য থেকে এটাই কি প্রমাণ হয়না যে জাতিগত
কারণেই গুরুচাঁদ ঠাকুরের এত বড় অবদানকে
ইতিহাসের পাতায় স্থান দেওয়া হয়নি?
Comments
Post a Comment