তোমার বিদ্যাসাগর ও আমার বিদ্যাসাগর
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়
তুমি লিখেছো-
‘বিদ্যাসাগরের
মতো হিন্দু ধর্মের আরও কোনও সংস্কারক গত দুশ বছরে জন্মেছেন কি?
কারও কথা তো জানিনা।’
তোমার মতো আরো অনেকেই জানেন
না খবরটি।
কারণ, তোমার বিদ্যাসাগর ও
তুমি আন্তর্জাতিক।
আর আমার বিদ্যাসাগর ও আমি হয়ে
আছি আঞ্চলিক।
তোমার বিদ্যাসাগর কাজ
করেছিলেন তাঁর জাতির জন্য,
সেখানে প্রবেশাধীকার ছিল না
শূদ্রের জন্য।
তোমার বিদ্যাসাগর গড়ে ছিলেন
৩৫টি স্কুল,
প্রসার ঘটিয়েছিলেন নারী
শিক্ষায়।
আন্দোলন করেছিলেন বিধবা
বিবাহের।
আমার বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে
গড়ে উঠল ৩৯৫২টি স্কুল।
(*একথা বিশ্বাস না হলে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গ
মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দশম শ্রেণির বই
‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ সেখানে উল্লেখ আছে তাই।)
সার্বজনীন শিক্ষা ও নারী
শিক্ষার জন্য করলেন আন্দোলন।
আর ১৯১০ সালে করলেন বিধবা
বিবাহ প্রচলন।
স্কুল শিক্ষা শুধু নয়,
সামাজিক শিক্ষারও করলেন প্রবর্তন।
তোমার বিদ্যাসাগরকে যেমন
সমাজের ধর্মান্ধ উচ্চবর্গীয়দের সাথে
করতে হয়েছিল মোকাবিলা।
আমার বিদ্যাসাগরকেও তার
থেকে অধিক প্রতিবন্ধকতার
শিকার হয়ে লড়াই করতে হয়েছিল
একেলা।
কেন? সে কথা কি জানো?
ব্রাহ্মণের ফতোয়া ছিল-
শূদ্র পক্ষে তপ জপ ত্রেতাযুগে নাই।
শূদ্রকের মাথা কাটে রামচন্দ্র
তাই।।
নমঃশূদ্র অতি ক্ষুদ্র ক্ষীণ হয়ে
রবে।
বিদ্যাশিক্ষা তার পক্ষে কভু না
সম্ভবে।।
কৃষিকর্ম করে যারা সেই ভাবে র’বে।
বিদ্যা পেলে কৃষিকর্ম বল কে করিবে? -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪১
এরপর আরো শোন-
শিক্ষা নিবে ব্রাহ্মণাদি উচ্চ-বর্ণ
যত।
তারা যাতে শিক্ষা পায়, কর সেই মত।।
যেই-কর্ম যেবা জানে তারে তাই দাও।
কৃষক লাঙ্গল পাবে মাঝি পাবে নাও।।
নমঃশূদ্র-ভরা দেখি ঘৃতকান্দি গাঁও।
উলুবনে কেন বাপু মুক্তা
ছড়াও? -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪২
এসব কথা শুনে, আমার বিদ্যাসাগর
ঘোষণা করিল আর একবার।
“খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ
নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি
চাই।।” -গুরুচাঁদ
চরিত- পৃঃ ১৩৭
ছেলে মেয়েকে দিতে শিক্ষা
প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা।।
শুধু
নয় এই কথা, বুঝিয়া সকলের ব্যথা বলিলেন তিনি-
“তাই বলিভাই
মুক্তি যদি চাই
বিদ্বান হইতে
হবে।
পেলে বিদ্যাধন
দুঃখ নিবারণ
চিরসুখী হবে
ভবে।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩০
আরো
বলিলেন-
বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যা ধর্ম, বিদ্যা কর্ম,। অন্য সব ছার।।
বাঁচ বা না বাঁচ, প্রাণে বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন হ;লে বড় তার মূল্য নাই।। গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১০৮
এবার
শোনো তবে নারী শিক্ষার কথা-
আমার
বিদ্যাসাগর করিলেন ঘোষণা-
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে ভালো হয় ছাও।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৫২৯
তাই, ‘নারী শিক্ষা তরে প্রভু আপন আলয়।
(১৯৩২ সালে)
‘শান্তি-সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ে দেয়।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৫৪৬
এবার
শোনো বলি বিধবা বিবাহের
কথা
এ
কথা না জানার জন্য মনে পেয়োনাকো ব্যথা।
“তের শত ষোল সালে (ইং ১৯১০) বারুণী(মার্চ মাস) সময়।
বিধবা বিবাহ দিতে প্রভু আজ্ঞা দেয়।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ২৬১
এই জাতি পিছে নহে নারীর সম্মানে।।
বিধবা বিবাহ প্রথা এরা মান্য করে। -গুরুচাঁদ চরিতপৃ.২৫৭
গোপালের মত নিয়া শ্রীনাথ করিল বিয়া
আর বিয়া করে কতজন।
ফরিদপুর, খুলনা বরিশাল এক থানা
ত্রিশ জনে বিবাহ করিল। -গুরুচাঁদ চরিতপৃঃ ২৫৪
এইভাবে বিধবা বিবাহ শুরু
হয়েগেল।
তাই দেখে ব্রাহ্মণের বুকে
পড়িল বাজ।
এই প্রথা বন্ধ করতে
দেখালো ঝাঁঝ।
হেন কর্ম করে ঝাঁকে
ঝাঁকে।।
মতুয়াদের বাদ দাও
সমাজেতে নাহি নাও
খৃষ্টানের মত ব্যবহার।
কর তারে হুকা বন্ধ নাপিত ব্রাহ্মণ বন্ধ
এক সঙ্গে করো না আহার।।’-গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২৫৪
আমার
বিদ্যাসাগর নিম্ন বলে, শিক্ষার অধিকার হল খন্ডিৎ।
তাই
গেল মক্তবেতে, সেখানে পেল শুধু প্রাথমিক শিক্ষা।
উচ্চের
দরজায় পেলোনা উচ্চ শিক্ষা।
তারপরেও
এতো কিছুর জন্য করলেন দ্বীপ্তমান।
কিন্তু
কেন সে দীপশিখা পেলনা তোমাদের কাছে সম্মান?
জন্মগত
কারণ কি এখানে নয় প্রধান?
আমার
বিদ্যাসাগর এরকম করিলেন কতো কাজ।
সে
কথা না জানিলে তোমাদের হবে কি লাজ?
কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য
দিয়েছিলেন বার্তা।
“কুসংস্কার আছে
যত দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে।’ -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১১৯
ব্রাহ্মণ্যবাদ থেকে মুক্ত হতে করিলেন আহবান-
ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।
‘ব্রাহ্মণ
প্রধান’ মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।। গুরুচাঁদ
চরিত পৃ. ২৩
কথা উপকথা কত সৃজন করি।
ঘাটে মাঠে গাছে পথে
দেবতা গড়িল। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ২২
ধর্ম্ম
ধ্বজাধারী সাজি যত পুরোহিত।
ধর্ম্মকে
পিষিয়া করে কার্য বিগর্হিত।।
মাতৃত্ব
সতীত্ব কহে হাস্যকর নীতি।
নারীজাতি লয়ে
করে পাপের বেসাতি।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ.২১
কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে
অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।।
-লীলামৃত,
ঠাকুরনগর, ১০ম সংস্করণ পৃ. ৯৪
সমাজ সংস্কার তরে করিলেন আহবান-
বাল্যকালে পুত্র কন্যা বিয়া নাহি দিবে।
পথ ঘাট ঘর দ্বার পবিত্র রাখিবে।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.
৫২৯
কর্মগুণই শ্রেষ্ঠগুণ, জন্মগুণ নয়,
‘মানুষ সবার
শ্রেষ্ঠ ভেদাভেদ ইষ্টানিষ্ট
কর্মগুনে মান পায় জন্মগুণে নয়। - গুরুচাঁদ
চরিত পৃ. ৭৩
আমার বিদ্যাসাগরের পিতা হরিচাঁদ যাঁর
নাম
যিনি ছিলেন দিশা
দ্রষ্টা। তিনি বলিলেন-
জীবে দয়া, নামে
রুচি মানুষেতে নিষ্টা।
ইহা ছাড়া আর যতো সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
শ্রীশ্রী
হরিলীলামৃত পৃ. ১১
আরো বলিলেন-
কুকুরের উচ্ছিষ্ট
প্রসাদ পেলে খাই।
বেদ বিধি শৌচাচার
নাহি মানি তাই।।
(শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃ. ১০৪
আরো বলি শোন, আমার বিদ্যাসাগরের কথা
তিনি কোনো দিন জাতিভেদ মানিতেন না।
তিনি বলিতেন-
নরাকারে ভূমণ্ডলে
যত জন আছে।
‘একজাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।
গুরুচাঁদ চরিত
পৃ. ২০১
সামাজিক নীতি সব
শোন ভক্তজন।
‘জাতিভেদ’ প্রথা
নাহি মানিবে কখন। গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৫৭০
মানুষে মানুষ বল
ভিন্ন জাতি কোথা?
নরজাতি এক জাতি ভেদ
করা বৃথা।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.৩৬০ )
আমার
বিদ্যাসাগর গুরুচাঁদ নাম।
বাংলার
ফরিদপুরে ওড়াকান্দি ধাম।
যাঁর
কাছে গান্ধিজি পাঠিয়েছিলেন দেশবন্ধুকে
স্বদেশী
আন্দোলনে তাঁকে দলে নিতে।
গান্ধিকে পত্র লিখে জানালেন আমার গুরুচাঁদ
এটাতো
স্বদেশী আন্দোলন নয়, তোমাদের ফাঁদ।
'সঠিক
দরদ যদি জাগে তোমাদের মনে
অস্পৃশ্যতা
দূর করে ভাই বলে নাও কাছে টেনে।'
জন্ম যাঁর 13 মার্চ ১৮৪৬সালে। প্রয়াণ ২৬ ফেব্রুয়ারী
১৯৩৭
যাঁর
শ্রদ্ধাঞ্জলিতে সুভাষ বোস উপাধি দিলেন ‘মহামানব’।
এতো
ঘটনার পরেও তোমরা
জানলে
না আমার বিদ্যাসাগরের নাম
এটা
শুধু ঘৃণা নয়, তাঁর অপমান।
এসব
বিভেদের কথা নয়, অধিকারের কথা।
এর
জন্য বোঝা চাই সকলের ব্যথা।
তবেই
হবে সুন্দর এই ধরতী।
ফুটিবে
সমতা, সতন্ত্রতা ন্যায়ের প্রকৃতি।
আসুন
সবে মিলে হাতে হাত ধরি।
সুন্দর
এই পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে গড়ি।।
--------------
Comments
Post a Comment