Skip to main content

মনে রাখা দরকার সূক্ষ্ম সনাতন মতুয়া ধর্মের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মের কিছু শব্দসাদৃশ্য আছে মাত্র কিন্তু মর্মার্থে হুবহু এক নয়।

 


শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। রচয়িতা-

 শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর

সম্পাদক- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার   

  প্রকাশক / সম্পাদকের বিনীত নিবেদন -থেকে কিছু অংশ তুলে দিলাম।

 

     মতুয়া ধর্মে ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মীয় শব্দের সাদৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু মতুয়া ধর্মে সে সব শব্দের মর্মার্থ আলাদা। যেমন ঈশ্বর, হরি, অবতার, ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্মা, প্রজাপতি, দক্ষ, মহেশ্বর, শিব, হরিবল, হরিবোল, গণেশ, দুর্গা, লক্ষ্মী, ক্ষীরোদশায়ী, জন্মান্তর, পরলোক, বিষ্ণু, মহাবিষ্ণু, নন্দ, বারুণী, রথ, রাস, গঙ্গা, কালী, সরস্বতী, দেব, দেবতা, দেবী, যজ্ঞ, কলি, পাগল, গুরু, উপদেষ্টা, ধরা, মরা, দীক্ষা, মুনি, ঋষি, দণ্ড, অলৌকিক, বুদ্ধ, পদ্মবন, যম, ধর্ম, সনাতন, ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার সূক্ষ্ম সনাতন মতুয়া ধর্মের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মের কিছু শব্দসাদৃশ্য আছে মাত্র কিন্তু মর্মার্থে হুবহু এক নয়। বাইরে থেকে দেখতে similar but not the same. এই বাহ্যিক সাদৃশ্য দেখে মতুয়া এবং অমতুয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। স্বাদে, গুণে, ব্যবহারে, চিন্তায়, প্রয়োগে, মতুয়া ধর্ম দর্শন ও সমাজব্যবস্থার ফল আলাদা। উদাহরণ - শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ বলেছেন ‘আকাশে ঈশ্বর খুঁজতে যেয়ো না, ঈশ্বর আকাশে থাকে না, ঈশ্বর খোঁজ মানুষের মধ্যে। শ্ৰীশ্ৰী হরিলীলামৃত গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠায় আছে.....

যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।

ভক্তিযোগে সেই তার স্বয়ং অবতার ॥

 কে কাকে ভক্তি করবে? যে কাউকে হেয় করে, অপমান করে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, ধ্বংস করে, নিঃস্ব রিক্ত করে তাকে, না যে তাকে সার্বিক বিকাশে সাহায্য করে তাকে? তা শ্ৰীশ্ৰী গুরুচাঁদ চরিতের ৫৭২ পৃষ্ঠায় পরিষ্কার করে বলা হলঃ-

 বিশ্ব ভরে এই নীতি দেখি পরম্পর ।

 যে র্যারে উদ্ধার করে, সে তার ঈশ্বর ॥” –

ঈশ্বর এবং হরি সম্বন্ধে অন্যভাবে শ্ৰীশ্ৰী হরিলীলামৃত গ্রন্থের প্রথম পৃষ্ঠাতেই বলা হল- '

  সকল হরণ করে তারে বলি হরি

     এখানে হরি বা ঈশ্বরের প্রাকৃতিক এবং সামাজিক মহামানবীয় দুটি রূপ মনে ভেসে ওঠে। জগতের সকল কিছু কে হরণ করতে পারে? সে একমাত্র প্রকৃতি ও মহাকাল। এটা বিজ্ঞানভিত্তিক, সার্বজনীন সত্য। সামাজিকভাবে তিনিই সকলের মন হরণ করতে পারেন যার দর্শন, ব্যবহার, আদর্শ, প্রেম ভালবাসা, সমাজ বিধান, কাউকে ছোট না করে সকলের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, সর্ব বিষয়ে সম্যক বিকাশে সাহায্য করে। সকলেই প্রকৃতি থেকে বিকশিত, সকলের মধ্যেই প্রকৃতির অংশ আছে। জ্ঞাত, অজ্ঞাত, দৃশ্য বা অদৃশ্য সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিকে একত্রে হরি বা ঈশ্বর কল্পনা করা হয়। কেউ কেউ তাতে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে স্রষ্টা বা প্ৰভু বা সৃষ্টিকর্তা বলে। সে হিসাবে সকলেই হরি। অংশের তারতম্য থাকে। মানুষেতেই তার পূর্ণ বিকাশ। এই বিশ্ব প্রকৃতির তত্ত্ব রহস্য যে মহামানব পূর্ণরূপে জানেন এবং জগৎ কল্যাণে নিয়ন্ত্রণ ও পক্ষপাতহীন প্রয়োগ করতে পারেন, সকলের সম্যক বিকাশ ঘটাতে পারেন, তিনিই বাস্তব জগতের সকলের মন হরণ করতে পারেন, প্রত্যেকেই তাকে আপন আপন ইষ্ট ভেবে পরিতৃপ্তি পায়, স্বস্তিতে থাকে। সকলকে তিনি পূর্ণ আনন্দ দিতে পারেন। তাই তিনি আসল হরি, পূর্ণানন্দ হরি, পূৰ্ণব্ৰহ্ম। এরূপ সকল গুণে গুণান্বিত নিষ্কলঙ্ক শ্ৰীশ্ৰী হরিচাদ ছিলেন তেমনই এক মহামানব। তার প্রভাবে, তার প্রাণসঞ্জীবনী ভাবতরঙ্গে মৃতপ্রায় জাতির প্রাণসঞ্চার হয়েছে। শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদে যাঁরা আত্মসমর্পণ   করেছিলেন তারা অমিত শক্তিশালী মহাপুরুষে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। আজও তা ঘটে। তিনি সেই আত্মসমর্পিত কর্মীবাহিনী নিয়ে তাঁর পতিত উদ্ধারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি   সর্বজনকল্যাণকারী বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য একটি অত্যুত্তম দর্শন দিয়েছেন, একটি সমাজব্যবস্থা দিয়েছেন, একটি সমাজ গঠন করেছিলেন, ধর্মহীন জাতিকে একটি অখণ্ড মানবতাবাদী ধর্ম দিয়েছেন, মতুয়া ধর্ম যার নামতাঁরই যোগ্য উত্তরসুর পুত্র শ্ৰীশ্ৰী গুরুচাঁদ ঠাকুর আরও সফলভাবে  তা অগ্রগামী করে নিয়ে গেছেন।

     আর এক সাক্ষাৎ ঈশ্বর আছেন, তাঁরা জন্মদাতা মাতা-পিতা, যাঁদের অবদানে সন্তানের বাঁচা-বাড়া-বিকাশ হয়।

     মতুয়া দর্শন, মতুয়া সমাজ ও মতুয়া ধর্মের সুগভীর তাৎপর্য ও এর মৌলিকত্ব মনে হয় অনেক মতুয়ার চেয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বেশী বুঝেছে। তাই তারা আতঙ্কিত হয়ে মতুয়া ধর্ম, দর্শন ও সমাজকে অঙ্কুরে বিনাশ করার জন্য সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়েছে। দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সর্ব প্রকারে ধ্বংস করার বহুমুখী চেষ্টা করেছে এবং সে চেষ্টা নরমে গরমে এখনও চলমান।

      ‘শ্ৰীশ্ৰী হরিলীলামৃত’ গ্রন্থের ৬৬-৬৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ভক্তগণের মতুয়া খ্যাতি বিবরণ থেকে তা জানা যায় ..... শ্ৰীধামের পশ্চিম পাশে ওড়াকান্দি গ্রামের দাস বাড়িতে হরিসভায় শ্ৰীশ্ৰী হরিচাদ পূর্ব পাশে পশ্চিমাভিমুখে বসেছিলেন। পশ্চিম দিকে বসেছিলেন ব্রাহ্মণমণ্ডলী, দক্ষিণ পাশে মতুয়া ভক্তমণ্ডলী, উত্তর পাশে নারীগণ বসেছিলেন । পুঃ ৬৭- পরে আরো ৩ জন ব্রাহ্মণ এসে শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদকে না চেনার ভান করে দ্বন্ধের সূচনা করে। ভক্তপ্রবর তপস্বী বৈরাগীর নির্দেশে কিশোর বয়সী একজন প্রণাম করে, মধ্যম বয়সী জন দাড়িযে প্রণাম করে, অপর কিশোর ব্রাহ্মণ স্থিরনেত্রে - ঠাকুরের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে থাকে। তার শরীর অসুস্থ। তপস্বী তার ‘গ্রীবা ধরি’ প্রভুপদে প্রণাম করায়। ভক্তপ্রবর মঙ্গল দাঁড়িয়ে হরিধ্বনি দিতে থাকে। তিন বার ঠাকুরের পদধূলি তার গায়ে  মেখে দিলে ব্রাহ্মণের দেহে যে ব্যাধি ছিল তা সেরে যায় মুহুর্তের মধ্যে।

 ব্যাধিমুক্ত হয়ে দ্বিজ সভাজনে কয়।

 অবতীর্ণ সামান্য মানুষ ইনি নয় ॥

এত বড় একটি ঘটনার পরেও তা স্বীকার করা ত দূরের কথা ব্রাহ্মণেরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। আসলে ত তারা দল বেঁধে গণ্ডগোল পাকাতেই এসেছিল মনে হয় । অমতুয়াদের ক্ষিপ্ত করে তুলল ।

ব্রাহ্মণে লইয়া করে বিরোধাচরণ।

ইহাদিগে কৃষ্ণভক্ত বলে কোনজন ॥...

অবৈধ সকল কাজ বিধি নাহি মানে।

 সমাজের বাধ্য নয় এই কয় জনে ॥.....

নাহি মানে দেব দ্বিজ আলাহিদা পথ।

  ইহারা হয়েছে এক হরিবোলা মত ॥...

সামাজিকেরা পর্যবেক্ষণ করে বললেন- মতুয়ারা দেব-দেবী মানে না, ব্রাহ্মণ মানে না, ব্রাহ্মণকে দিয়ে অব্রাহ্মণকে প্রণাম করায়, সমাজের প্রচলিত বিধিবিধান অর্থাৎ বেদবিধি মানে না, ব্রাহ্মণকে মানে না তাই কৃষ্ণভক্ত বলা যায় না- কারণ ব্রাহ্মণকে না মানলে চতুর্বর্ণ প্রথা অস্বীকার করা হয়,  যার ফলে চতুৰ্বর্ণের প্রবক্তা কৃষ্ণকেও অস্বীকার করা হয়, এঁরা হিন্দুদের শাস্ত্রবিধি মানে না, শাস্ত্রের  অনুশাসন মানে না, চতুরাশ্রমও বাতিল হয়ে যায় গার্হস্থ্যই প্রশস্ত, তাই এঁদের সকল কাজ হিন্দুধর্মীদের দৃষ্টিতে অবৈধ মনে হয়। এঁরা প্রচলিত হিন্দু সমাজ মানে না অর্থাৎ মতুয়াদের সমাজ আলাদা, হিন্দু সমাজ মতুয়াদের সাথে আহারাদি বন্ধ করে দিল, গ্রাম্যভাব ভঙ্গ করা হল, হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা করে দিল অর্থাৎ সামাজিকভাবে বয়কত বা ‘একঘরে’ করে দিল, এবং দল বেধেঁ [প্তজে –ঘাটে ‘মতুয়া’ ‘মতুয়া’ বলে উপহাস, টিটকারী ও অপমান করতে লাগল। গ্রামবাসী ভিন্ন দল হয়ে গেল এবং “সে অবধি হরিবোলা পৃথক সকল”। মতুয়াদের জান্ডজ্ঞানহীন পাগল বলে  ঘোষণা করল। মতুয়ারা জাতিনাশা অর্থাৎ হিন্দুজাতি নাশক বলে সিদ্ধাত্ত করল।

তাহা শুনি ডেকে বলে প্রভু হরিচাঁদ।

ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা মতুয়া' আখ্যান ৷

এ থেকেই প্রমাণ হয় শ্রীশ্রী হরিচাঁদ নিজ মুখে “মতুয়া”- ধর্মদর্শন ও সমাজকে ভিন্ন ধর্ম বলে ঘোষণা করেছিলেন।   

‘শ্ৰীশ্ৰী গুরুচাঁদ চরিত’-এর ১৪৮ পৃঃহরি ধর্ম হিন্দুগণ গ্রহণ করবে।" ১৫২ পৃষ্ঠায়হিন্দু  পরিচয়, শুধু গণনায়, অহিন্দু সকলখানে।” ; ১৫৩ পৃষ্ঠায়আকারে মানব, আছে বটে সব, বিচারে দাসের-দাস।”; পূঃ ৪৪৩-বুদ্ধিহীন সরলতা, আর নাহি চলে হেথা, কুট-বুদ্ধি বটে দরকার।"

      শ্ৰীশ্ৰী হরিঁচাদ ও তার মতুয়া ধর্ম-দৰ্শন অনাদর আর অবহেলায় প্রস্ফুটিত সর্বজনহিতকারী   সুফলপ্রদ এক পুষ্প স্বরূপ। বিনা যত্নে আর সর্বগ্রাসী সনাতন ধর্মীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও আভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি গুণে তা দিনদিন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে।

     মতুয়া ধর্ম, মতুয়া সমাজ ও মতুয়াদেরকে মতুয়া সম্প্রদায় বলে তার স্বাধীন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বমহিমায় শির উচু করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনাকে হেয় করে বহুমুখী কৌশলী প্রচার চলছে। কেউ কেউ একে “লোকধর্ম” বা “লোকায়ত ধর্ম” বলে তাচ্ছিল্যের তালিকায় ফেলে দিচ্ছেন। আঞ্চলিকতা আর সাম্প্রদায়িকতার ছাপ দিয়ে তাকে সংকীর্ণ এবং ‘মানসম্পন্ন নয়’ প্রমাণ করে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

    দার্শনিক অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন'-এ এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আছে। ভূমিকা পৃঃ ১৬ সংক্ষেপে- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত –

           (১) দেহাত্মবাদ খণ্ডনের বিবিধ প্রয়াস সত্ত্বেও বস্তুতপক্ষে বিরোধী দার্শনিকেরা        দেহাত্মবাদ নস্যাৎ করতে পারেন নি। পক্ষান্তরে, এই দেহাত্মবাদের মধ্যেই পরবর্তীকালের উন্নততর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সূচনা সুস্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়- যে-জ্ঞান লাভের পথে দেহাত্মবাদ-বিরোধীরা বস্তুতপক্ষে বহুবিধ কঠিন অন্তরায় সৃষ্টি করেছিলেন।

        (২) দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব প্রতিপাদনের উদ্দেশ্যে আত্মবাদীরা যতো প্রমাণ প্রদর্শন করেছেন, সেগুলি প্রকৃতপক্ষে প্রমাণাভাসমাত্র। অর্থাৎ, সেগুলির সাহায্যে দেহাতিরিক্ত আত্মার অস্তিত্ব প্রতিপন্ন হয় না

    দর্শনের বিখ্যাত অধ্যাপক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখিত ‘লোকায়ত দর্শন’ ও বেদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সুকুমারী ভট্টাচার্য লিখিতবেদে সংশয় ও নাস্তিক্য এবং প্রাচীন ভারত পুস্তক পর্যালোচনায় লোকায়তধর্ম উৎকৃষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। (দ্রঃপরিশিষ্ট-৩ এ পৃঃ৭৬৯-৭৭৪ পৃঃ ‘অনন্য শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের স্বতন্ত্র-স্বাধীন মতুয়াধর্ম’ প্রবন্ধের শেষাংশ)। “আস্তিক” মানে ঈশ্বর-বিশ্বাসী নয়, আস্তিক মানে বেদপন্থী। নাস্তিক মানে বেদ-বিরোধী... পাণিনির (৪/৪/৬০) মতে পরলোকে অবিশ্বাসী। মনু (২/১১)-তে বেদনিন্দক। অন্যমতে বেদের প্রামাণ্যতা, যজ্ঞ, আত্মা, পরলোক, ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলে আস্তিক, না থাকলে নাস্তিক। হিন্দুদের নানা সম্প্রদায়ের নানা শাস্ত্র এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিক্ষিপ্ত শাস্ত্র পরস্পরবিরুদ্ধ।

কিন্তু শাস্ত্রকার ও পণ্ডিতদের প্রচারে প্রচারে লোকায়ত ধর্ম-কে আজ নিকৃষ্ট বলে হেয় জ্ঞান করা হয়।

     যেহেতু, বেদ এবং উপনিষদে লোকায়ত ধর্মীর সমস্ত উপাদানই পাওয়া যায়, সুতরাং এক অর্থে সনাতন হিন্দু ধর্মকেও লোকায়ত ধর্ম বলা যায়। কিন্তু লোকায়ত ধর্ম প্রবক্তারা তা বলেন নি  কেন তা ভেবে দেখার বিষয়।

     বৌদ্ধ ধর্মে ত ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়নি, আত্মাও অস্বীকৃত। তাহলে কি বৌদ্ধ ধর্মও লোকায়ত ধর্ম হয়ে যায় না? অথচ হিন্দুরা গৌতম বুদ্ধকে তাদের এক অবতার বলে ঘোষণা করেছে। আবার এ কথাও ত সত্য যে হিন্দুদের ষড়যন্ত্রে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় সমূলে উচ্ছেদ হয়ে গেছে। শংকারাচার্য ঘোর বোউদ্ধ বিদ্বেষী, তাঁর মতে ওরা পাষন্ড। (রমেশ বসু-প্রবন্ধঃ বঙ্গভাষায় বৌদ্ধ স্মৃতিঃ গ্রন্থঃ বুদ্ধ ও বৌদ্ধঃ সংকলনঃ ডঃ বারদীবরণ ঘোষঃ করুণা প্রকাশনীঃ কলকাতা - পৃঃ৭৯ পাষণ্ড মানে ধৰ্ম্মাচাৰ্য্য। নিন্দা বা প্রশংসা হিসাবে এ শব্দ ব্যবহৃত হয় নাই। পরে এই শব্দটির অর্থ পরিবর্তন ও অবনতি হইয়া শুধুই বিরুদ্ধবাদীর প্রতি প্রযুক্ত হইতে থাকে) ইসলাম ধর্মে বেদ, যজ্ঞ, আত্মার পুনর্জন স্বীকৃত নয়। তা হলে লোকায়ত ধর্ম প্রবক্তাদের সংজ্ঞায় ইসলাম ধর্মও কি লোকায়ত ধর্ম?

    শুরুর দিকে প্রতিটি ধর্ম ও তার প্রবর্তক ঘৃণিত হয়েছে, অনুসারীর সংখ্যা খুবই অল্প ছিল, শত বাধার মুখে পড়েছে , পরে তা স্বীকৃতি পেয়েছে। সময়ের ব্যবধানে মিথ্যার মুখোশ খুলে যায়- সযত্ন প্রচেষ্টায় সত্য উজ্জ্বলভাবে প্রকট হয়। তাই মতুয়া ধৰ্মও সত্য সুন্দর আর মাধুর্যে ক্রমশ উজ্জ্বলতর হচ্ছে। মানবতার সৎ আদর্শে অটল থাকলে যথাসময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। ধীরে হলেও কালপরিক্রমায় যুগমানস, যুগের প্রয়োজন বদলায়। হুবহু পুরাতন সনাতন আর যুগবিবর্তনে খাপ খায় না। দিশেহারার মত গন্ধমাদন পর্বত মাথায় না বয়ে বিশল্যকরণীটি (মুল মর্ম বিষয়টি) বেছে নিতে হবে, যেটি সুহ্ম সনাতন।

     কেউ কেউ বলতে চান মতুয়া ধর্ম হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত একটা সম্প্রদায় মাত্র। কারণ হিন্দু ধর্ম কোন একক ধর্ম নয়, তা কতকগুলি সম্প্রদায়ের confederation বা সংঘ মাত্র, যেমন সৌর, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, বৈষ্ণব ইত্যাদি। কিন্তু হিন্দু ধর্মের মূলগ্রন্থ বেদের বিধান, শাস্ত্রাচার, চতুরাশ্রম, চতুর্বর্ণ প্রথা এবং আরো বহু বিধিবিধান মানে না যে মতুয়ারা তারা কিভাবে হিন্দু ধর্মের শাখা সম্প্রদায় বলে গণ্য হতে পারে? নামে, বেশে কিছু সদৃশ এবং হিন্দু পরিবেশে জন্মের কারণে? মহামতি গৌতম বুদ্ধও একই হিন্দু পরিবেশে জন্ম করলেও তিনি ও তার ধর্ম হিন্দু বলে পরিচিত হয়নি বরং স্বতন্ত্র স্বাধীন স্বকীয়তায় আরো বেশী উজ্জ্বল ও মহীয়ান হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেনবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত জীবনের দীর্ঘ সময় (৪০ বছর) পৌত্তলিক কোরাইশ বংশে জন্ম ও সেই পরিবেশে জীবন যাপন করেছিলেন বিশ্বনৰী হযরত মোহাম্মদ(সঃ)তাই বলে কি ইসলাম ধর্মকে হিন্দুধর্মের মত এক পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত একটি সম্প্রদায় বা ধর্ম বলা যাবে? জৈন, আজীবিক, শিখ প্রভৃতি ধর্ম সনাতন তথা হিন্দু ধর্মের গর্ভ থেকে উত্থিত হলেও আজ স্বতন্ত্র ধর্মের স্বীকৃতি পেয়েছে। উদ্ধৃত ধর্মগুলিকে লোকায়ত ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের অংশ বা অধীন বলে ত ঘোষণা করা হয় না! এই সব ধর্ম বেদ, যজ্ঞ, জন্মান্তর, পুনর্জন মানে না তবু তাকে ‘লোকায়ত ধর্ম’ বলে না কেন ? প্রাচীনতা ও অনুসারীর সংখ্যার মান্দন্ডে? হিন্দু সহ প্রাচীন সকল ধর্মই এক সময় নবীন   ছিল এবং তার অনুসারীর সংখ্যাও অতি নগণ্য ছিল। সে তুলনায় মতুয়া ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে, সংখ্যাটাও চোখে পড়ার মত। রাষ্ট্রীয় জনগণনার ছকে ধর্মের ঘরে মতুয়া লেখার সুযোগ ৱাখলেই তা দৃশ্যমান হবে। সারা ভারতে মতুয়ার সংখ্যা প্রায় সাত কোটি, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় আড়াই কোটি। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৭৫টি বিধানসভা কেন্দ্র মতুয়া ভোট-নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে (দ্রঃ- দৈনিক বর্তমান পত্রিকা, ৬ নভেম্বর, ২০১৪: বৃহস্পতিবার, ২০ কার্তিক, ১৪২১ বঙ্গাব্দ)বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশের মতুয়ার সংখ্যা যুক্ত হলে সংখ্যাটি আরও অনেক বেশিই হবে । তা হলে?

    পূর্বতন ধর্মগুলি যদি ‘লোকায়ত’ না হয় তবে তা কোন – ‘আয়ত’ ধর্ম ? অ-লোকায়ত? লোক মানে যদি মানুষ হয় অ-লোকায়ত মানে কি? ‘লোকায়ত ধর্ম’ বা ‘লোকধর্ম’ নামক সান্ধ্য শব্দের আড়ালে এর প্রয়োগকারীরা কি অর্থ বুঝাতে চান? উৎকৃষ্ট না নিকৃষ্ট? ‘লোকায়ত ধর্ম’ বা ‘লোকধর্ম’ প্রবক্তারা তা পরিষ্কার করে বলেন না কেন? শঙ্করাচার্যর বক্তব্য -প্রাকৃতজন এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্যবিশিষ্ট দেহমাত্রকেই আত্মা জ্ঞান করে।”... তারা কি ‘লোকায়ত ধর্ম’ বা ‘লোকধর্ম’ শব্দ দ্বারা ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ'- অভিধানেরপ্রাকৃত অর্থাৎ সাধারণ, সামান্য অসংস্কৃতবুদ্ধি, বিবেকশূন্য, বালসম; পামর, নীচ; নীচজন”-এর ধর্ম বুঝাতে চান? এ ধরণের মানুষ ত সকল ধর্মের মধ্যেই কম বেশী পাওয়া যায়; পাশাপাশি জ্ঞানী গুণী বিদ্বান সৎ সাধু মানুষও পাওয়া যায়। মতুয়া সমাজেও জ্ঞানী  গুণী বিদ্বান সৎ সাধু মানুষ আছেন; বরং সত্য, প্রেম, পবিত্রতা, সরলতা, সাম্য, মানবিকতা বেশীই পাওয়া যায়। তা হলে কেন মতুয়া ধর্মকে আলাদা ভাবে এই নামে পরিচিত করানো হয়?

    ‘লোকায়ত ধর্মশব্দের প্রবক্তাদের কেউ কেউ প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে বলতে চান Classic ধর্ম। ক্লাসিক শব্দের অর্থ সর্বোত্তম উচ্চশ্রেণীর, বিশুদ্ধ, দীর্ঘ ইতিহাসের জন্য সুবিদিত ও বিখ্যাত। মনুসংহিতার উপরি উক্ত সামান্য কয়েকটি শ্লোকে যা পাওয়া গেল তা কি সর্বোত্তম উচ্চ শ্রেণীর বলে মনে হয়? শুধু দীর্ঘ ইতিহাসের জন্য সুবিদিত ও বিখ্যাত হওয়াটা কি যুক্তি ও উপকারের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য ধরতে হবে? সময়ের হিসাবে এগুলি প্রবর্তনকালে ক্লাসিক ছিল না। শ্ৰীশ্ৰী হরিচাঁদের আবির্ভাব কাল থেকে এ পর্যন্ত ২০৩ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

 যুক্তিতে উৎকৃষ্ট হলেও ‘লোকায়তশব্দ প্রচার প্রাবল্যে প্রচলিত অর্থে নিকৃষ্টতার প্রতীক হয়ে গেছে তাই মতুয়া, মতুয়া ধর্ম, মতুয়া দর্শন এর বেলায় কারও দ্বারা গায়ে পড়ে লোকায়ত বিশেষণ যুক্ত না করাই বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি মতুয়া দিকনির্দেশনাকারী সুধীবৃন্দ ভেবে দেখবেন কি? কারণ যথাযথভাবে এর প্রতিবাদ বা সংশোধন না করলে এর সুদূরপ্রসারী স্থায়ী কু-ফল ফলতে পারে।

      ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা মতুয়া আখ্যান বাক্যের মূল অর্থ হল স্বতন্ত্র স্বাধীন মৌলিক দর্শনভূক্ত অখণ্ড মানব সমাজ (a distinct and totally separate school of Philosophy).

 ঈশ্বরের সন্ধান দিতে গিয়ে স্বামীজী তাঁর সারা জীবনের সাধনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বলেছেন -বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা  খুজিছ ঈশ্বর।

জীবে প্রেম করে যেইজন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর ॥

    তিনি ত আকাশের ঈশ্বরের কথা বলেন নি। এখানে প্রতিমা বা দেবদেবীর কথাও বলা হয়নি। এই মাটির পৃথিবীর জীব ও তার সেবাকেই ঈশ্বরসেবা বলেছেন। কাল্পনিক ঈশ্বরে বিশ্বাসের কথা এখানে নাই। তবু তাকে লোকায়তিক বলা হয় না। কিন্তু তিনি মানুষ আর অন্যান্য জীবজন্তু একাকার করে ফেলেছেন, এখানে মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলেন নি। '

     চণ্ডীদাস বলেছেনসবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই।অর্থাৎ ঈশ্বরও মানুষের উপরে নয়। রজকিনীকে ভালবাসলেও একই বর্ণের না হওয়ার কারণে তাঁকে না পাওয়ার বিরহে  এ কথা বলেছেন। কোন দর্শন হিসাবে অথবা সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে এ কথা বলেন নি। তাই মিলনে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে, মানুষে মানুষে মিলনের বাধাস্বরূপ যে বর্ণপ্রথা সেই বর্ণ প্রথা ও তার স্রষ্টার উদ্দেশ্যে তিনি এ কথা বলেছেন। পরোক্ষে বলেছেন বর্ণ প্রথা মানব সমাজের জন্য  অকল্যাণকর। মানব প্রেমে চিরস্থায়ী দুর্লঙ্ঘ বাধা হল বর্ণপ্রথা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনুষঙ্গ। এর সমূল উৎপাটন ছাড়া অখণ্ড মানবতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

     সত্যেন্দ্ৰ নাথ দত্ত তাঁরমানুষ জাতিকবিতায় বলেছেনগোত্র লইয়া গরুরা থাক, মানুষ  মিলুক মানুষ সাথ।এখানেও জাতি, বর্ণ, গোত্র নিন্দিতিত; সেই সাথে তার স্রষ্টাও কি বাদ যায়?

 মরমী সাধক লালন ফকির বলেছেন-অমাবস্যায় পূর্ণিমা হয়, শুভযোগ সে সময়ে উদয়যে  মুহুর্তেই শাস্ত্রের চালাকি ধরা পড়ে ও অজ্ঞানতার অমাবস্যা দূর হয়, সে মুহুর্তেই প্রকৃত জ্ঞানের পূর্ণিমা উদয় হয়, মানুষ প্রেমে আপুত হয়, তখনই শুভযোগ। পাছে লোকে কিছু বলে', দ্বিধা-দ্বন্দে, আভিজাত্যে, লোকলজ্জায়, সম্মুখে উপস্থিত প্রেমময়-সত্য-সুন্দরকে যে গ্রহণ করে না, বৃথাই তার সময় বয়ে যায়।

 

Comments