Skip to main content

হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলন ও বর্তমান মতুয়া আন্দোলন জগদীশচন্দ্র রায়

 


হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলন

বর্তমান মতুয়া আন্দোলন

জগদীশচন্দ্র রায়

 আমার এই লেখা পড়ে  প্রথমেই আপনাদের কাছে বিতর্কিত মনে হ’তে পারে। যদিও আমার উদ্দেশ্য বিতর্ক সৃষ্টি করা নয়; আমার উপলব্ধিতে একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। তাই আজ ঘুরিয়ে নয়, সরাসরি কিছু কথা বলতে চাই। তার আগে বলতে চাই আমি বাংলার মতুয়া আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি অর্থাৎ Phycally যুক্ত নই। তাই আমার ধারণা সঠিক নাও হ’তে পারে। তবে আমার সামান্য জ্ঞান অনুসারে একথা বলতে যাচ্ছি সামাজিক দায়িত্বের জন্য।

সমাজে মতুয়া তথা পিছিয়ে রাখাদের প্রতি প্রতিনিয়ত অমানবিক অত্যাচার হচ্ছে বিভিন্নভাবে। তার প্রতিবাদে কিছু দিনে একটা সংগঠিত ভাব চোখে পড়ছে। পীড়িতের পাশে দাঁড়ানো ভীষণ  দরকার। তা না হ’লে আন্দোলন দানা বাধবে না।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে সংগঠন কেমন হবে? নেতা কেমন হবেন? আন্দোলন কিভাবে কোন নির্দেশন ও নিয়ন্ত্রনে চলবে?

যাঁরা কোনো সংগঠনের উচ্চপদে আছেন তাঁরা কি পরিকল্পিতভাবে সঙ্গের মাধ্যমে আন্দোলনকে এগিয়ে নেবেন? না কি শুধু ব্যানারের পিছনে প্রথম মুখটাই থাকবে? ব্যানারের পিছনে প্রথম মুখ থাকাটাকে আমি খারাপ বলছি না। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সর্বকাজে সে সব মুখ থাকা দরকার নয় কি? না কি শুধু ফটো তোলার সময়?

প্রকৃত নেতৃত্বকে কিন্তু জনগণই সামনে তুলে ধরেন; তাঁকে নিজেকে সামনে আসতে হয় না।  

এবার কথা হচ্ছে, সংগঠনের নিয়ন্ত্রন ও নির্দেশন কি সংগঠনিকভাবে হচ্ছে? না কি এর পিছনে কোনো অদৃশ্য হাত সব সময় কাজ করছে?

বেশকিছু নেতার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা উদ্দেশ্যকে পিছনে রেখে নিজেকে সামনে  তুলে ধরতেই ব্যস্ত। এটা নেতার ক্ষেত্রে উপযুক্ত হতে পারে; কিন্তু নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কখনোই নয়।

 নেতৃত্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও সমাজের প্রতি নিবেদিতে প্রাণ হওয়া দরকার। তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে অন্তর না থাকাটাই ভালো। কারো কারো মধ্যে সেটা আছে মানছি; কিন্তু সেটা ভীষণ নগন্ন।

আপনারাতো জানেন গুরুচাঁদ ঠাকুর গান্ধীজির স্বদেশী আন্দোলনে যোগদানের আহ্বানকে থুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে দৃপ্তকন্ঠে জানিয়ে ছিলেন- গান্ধীজি এইভাবে আন্দোলন হয় না। আন্দোলন করতে হলে যাদের নিয়ে আন্দোলন করতে চান, আগে তাদের ভাই বলে কোলে তুলে নিতে হবে। না কি অস্পৃশ্য বলে ঘৃণাভরে দূরে ঠেলে দেবেন?

এরকম দৃড় সংকল্পবদ্ধ তেজস্বী নেতৃত্ব এখনও আমি দেখতে পাচ্ছি না। যাদের দেখতে পাচ্ছি,  তাঁরা তো আচল পেতে বসে আছেন। কবে কেউ কৃপা করে তাদেরকে ডেকে নিয়ে নেতা বানাবেন।

এবার একটা কথা গভীরভাবে ভাবুন তো; কারা আমাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে? কারা আমাদের সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে ও করছে? কারা আপনাকে অস্পৃশ্য, অশিক্ষিত, মানসিক গোলাম বানিয়া রেখেছে? কারা আমাদের উত্তরোণের ক্ষেত্রে বাধাদান করছে? এরকম হাজারো প্রশ্ন আছে। কিন্তু তার একটাই উত্তর। সেটা হচ্ছে- এই সব কিছুর মূলে দায়ী হচ্ছে ব্রাহ্মণ ও তার মতবাদ। অর্থাৎ ব্রাহ্মণবাদ। (ব্যাতিক্রম ২/১ জন ব্রাহ্মণ থাকতে পারে। তবে সামগ্রিক ক্ষেত্র হিসাবে বাবা সাহেব বলেছেন,-“প্রগতিশীল ব্রাহ্মণ ও পুরোহিত ব্রাহ্মণ, একই শরীরের দুটো বাহু”- Annihilataion of Caste.)  

এবার কথা হচ্ছে, যে আমার সমস্ত প্রগতিকে রুদ্ধ করে রেখেছে, সে কি মন থেকে আমার ভালো কিছু করতে পারে কখনো? কখনো নয়। যদি করে, সেটা তার স্বার্থের জন্য। তাহলে একটা কথা শুনুন। পিছিয়ে রাখাদের আন্দোলনের ধারে কাছেও যদি ব্রাহ্মণের ছায়া পড়ে সে আন্দোলন  কিছুতেই success হবেনা। হতে পারেনা। হতে দেবেনা।

 তার জন্য আমাদের কি করতে হবে? তার জন্য-

“সূর্যোদয় পূর্ব আকাশে ঘটে ছিল ১৮১২ সালে, হরিচাঁদ। ১৯৩২ এ সেই সূর্যালোক পশ্চিম প্রান্তকে স্পর্শ করেছিল, ড. আম্বদেকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ বাংলার মতুয়ার। ১৯৪১ এ জাগিয়ে তুল্ল দক্ষিণ ভারত। তামিলনাদের ইরোদে জন্মগ্রহণ ক’রে কোটিপতি ব্যবসায়ীর পুত্র শূদ্র, থান্থাই পেরিয়ার রামস্বামী নায়াক্কার ঘোষণা করলেন, ব্রাহ্মণ্য বাদের সমূল উৎপাটনের জন্য চাই এক ‘অব্রাহ্মণ রাজনৈতিক দল’ Non-brahmin Political Party. মনুবাদীদের হাঁড় কাপানো এই উদ্দেশ্য নিয়ে, আমরা ১৯৪৫ সালে মাদ্রাজে মুসলিমলীগের ২৫তম বাৎসরিক অধিবেশনের মঞ্চে দেখতে পাই, জিন্না-পেরিয়ার আম্বদেকর আলোচনা রত। ভারতবর্ষের কনভার্টেড মুসলমান, মূলভারতীর ব্যাকওয়ার্ড এবং অস্পৃশ্যদের সম্মিলিত অ-ব্রাহ্মণ রাজনৈতিক দল।”( তথ্য সূত্র-হরি-গুরুচাঁদ – বাংলার চণ্ডাল ভারতবর্ষের বহুজন অভ্যুত্থান- লেখক- স্বপন কুমার বিশ্বাস পৃষ্ঠা নং ১৫০)   

হ্যা, এটাই একমাত্র রাস্তা বলে আমি মনে করি।

শুধু একটা উদাহরণ নয়; উল্লেখিত বই থেকে (পৃঃ নং ১২৭-১২৮) আরো দু’টি উদাহরণ তুলে   দিচ্ছি।

(১) “গুরুচাঁদ ঠাকুর তার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতায় ভারতীয় তথা বাংলার সমাজ সংস্কৃতির বাস্তবতার পরিস্থিতিতে, অত্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। Will henceforth work hand in hand with the Muhammadan brethren. মুসলমান ভাইদের সঙ্গে হাতে হাত ধরে তারা রাজনীতি করবে। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটা রক্তের টানও বটে। ব্রাহ্মোণেরা বিদেশী আর্য। বাংলার মুসলমানরা ধর্মান্তরিত পোদ-চন্ডাল (নমঃশূদ্র)। হিন্দুদের দ্বারা দুজনেই সমানভাবে উৎপীড়িত।”  

(২) “Pakisthan or Partition of India” গ্রন্থে, ভারতবর্ষের অস্পৃশ্য মানুষের রাজনৈতিক  অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পিছড়ে ও মুসলিম ঐক্যের রাস্তা বলে অভিমত দান করেন ড. বি. আর। আম্বেদকরঃ If Hindu Raj docs become a fact, it will no doubt, be the greatest calamity for this country..... Hindu Mahasabha and Hindu Raj are the inescapable nemesis which the Muslims have brought upon themselves by having a Muslim League…. No partition, but the abolition of Muslim League and the formation of a mixed party of Hindus and Muslim is the only effective way of burying the ghost of Hindu Raj…. There are many lower order of the Hindu society whose economic, political and social needs are the same as those of the majority of the Muslim and they would be far more interested to be with the Muslim for achieving common ends:

অর্থাৎ - হিন্দুরাজ যদি বাস্তবায়িত হয় তবে তা দেশের পক্ষে হবে বিধবংসী। মুসলীম লীগ  তৈরি করে মুসলমানরা হিন্দুমহাসবা ও হিন্দুরাজকে তাদের নিয়তি হিসাবে ডেকে এনেছে। দেশ ভাগ নয়, হিন্দুরাজকে কবর দেবার একমাত্র পথ, মুসলীমলীগ খতম করা ও হিন্দু মুসলমানের একটি পার্টি তৈরি করা, হিন্দুদের মধ্যে যারা নিচুজাত তারা মেজরিটি মুসলমানদেরই মতন,  সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যার শিকার। তারা হিন্দুদের থেকে মুসলমানদের সঙ্গে রাজনৈতিক গাঁটছড়া বাঁধতে বেশী উৎসাহী।(Dr. B. R. Ambdekar (W & S) Vol. 8 P-258-359)

এবার আমাদের সংগঠিতভাবে ভেবে দেখার একান্ত প্রয়োজন আমাদের কিভাবে কাজ করা দরকার। অনেক তো নেতাগীরি হোল। এখন অন্তত বিভেদ ভুলে গিয়ে সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যাক, যদি এই পিছিয়ে রাখাদের উত্তরোণ ঘটাতে চান, তাহলে আমার মনে হয় এটাই একমাত্র রাস্তা।

_________________

 

 

 

Comments