বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে মতুয়া সাহিত্য এখনো পর্যন্ত ব্রাত্য কেন?
লেখক- জগদীশচন্দ্র
রায়
সাহিত্য হচ্ছে কোন সমাজ বা কোনো বিষয়ের দর্পণ। সেই দর্পণে বিষয়ের ছবি প্রতিফলিত
হয়। যেটা সমাজকে দিশা নির্দেশ করে প্রগতির জন্য। মতুয়া সাহিত্যও এমন একটি বিষয় যেটা
বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে সমাজকে দিশা নির্দেশ করেছে। তবে আমি এখানে এটাও বলব, মতুয়া সাহিত্য
শুধু দিশা নির্দেশই করেনি। প্রয়োজনে সংগ্রাম করার কথাও বলেছে। তবে সেই সংগ্রাম হবে
শান্তিপূর্ণ। সংগ্রামের রং হচ্ছে লাল। আর শান্তির প্রতীক হচ্ছে সাদা। মতুয়া পতাকার
রঙ লাল আর তিন পাশে যে বেড়ি সেটা সাদা। আবার তিন কোনের অর্থ হচ্ছে, সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা।
মতুয়া সাহিত্যের আকর গ্রন্থ হিসাবে আমরা ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ ও ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত’ পাই। এই গ্রন্থ দ্বয়ের মধ্যে সামাজের
পিছিয়ে রাখা মানুষদের পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মীয় ও অন্যান্য বিষয়ের
প্রতি উত্তরণের দিশা দেখানো হয়েছে। এখানে সব চেয়ে বড় কথা লেখক বা কবির কল্পনা নয়, বাস্তব
ঘটনাকেই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুর সারা জীবন সমাজের মঙ্গলের
জন্য উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি। তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন।
তাঁরা সমাজের বিভিন্ন সমস্যার প্রতি সংগ্রাম করে ইতিহাস গড়েছেন। সেটাই পরে লিখিত আকারে
সাহিত্যের রূপ পেয়েছে।
আকর গ্রন্থ দুটোকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ধর্মীয় গ্রন্থ বললেও এগুলো অন্যান্য ধর্ম
গ্রন্থের মতো নয়। লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই, কবি শুরুতে যে বন্দনা করেছেন, সেখানে কোনো
দেবদেবীর স্থান নেই। সেখানে মানবের বন্দনা করা হয়েছে। মানুষের জয়গান করা হয়েছে। এরকম
দৃষ্টান্ত হয়তো বিশ্বের অন্যকোন ধর্মগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানেই হচ্ছে মূল
পার্থক্য অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থের সঙ্গে। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে দেবতার বাণী দেওয়া হয়েছে।
এখানে মানুষকে সমাজের প্রতিকূলতাকে কীভাবে সংগ্রামে করে জয় করতে হবে সেটা প্রত্যক্ষভাবে
করে দেখানো হয়ে। এই বিশাল দুটি সমুদ্র থেকে আমি মাত্র দুফোটা জল তুলে তার সাহিত্য গূণের
ঝলক তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রতিটি গ্রন্থে, লেখক বা কবির মনোভাবই ফুটে ওঠে। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে
এখানে তার থেকেও বেশি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে বাস্তবকে। যেটা মানুষকে প্রগতির ক্ষেত্রে
উৎসাহ দেখিয়েছে। যার জন্য আমরা গুরুচাঁদ চরিতে দেখতে পাই,
খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
চেলে পিলে শিক্ষা দাও
এই আমি চাই।। (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১৪৪)
এখানে পেটের ক্ষুধাকে প্রাধান্য না দিয়ে অশিক্ষার
ক্ষুধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ, অশিক্ষিত ব্যক্তি অন্ধের থেকেও নিকৃষ্টতর। আর
এই কথা কোনো বিশেষ জাত, ধর্ম বা বর্ণের লোককে বলা হয়নি। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে
শিক্ষার আলো পেতে পারে সেই কথাই বলা হয়েছে।
আমরা লীলামৃতে দেখতে পাই,
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা
ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।। (শ্রীশ্রীলীলামৃত পৃঃ ১১)
এখানেও বিশ্বের সকল জীবের প্রতি দয়া দেখানোর কথা বলা হয়েছে। মানুষের প্রতি নিষ্ঠা
বা বিশ্বাস ও ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ,
উচু, নীচু ইত্যাদি ভেদাভেদের ঊর্ধে উঠে এক মানব জাতির কথা বলা হয়েছে। এটা ছাড়া বাকি
সব তথা কথিত ধর্মীয় আচার ব্যবহার, রীতি নীতি ইত্যাদিকে ভ্রষ্টা বা মিথ্যা বলা হয়েছে।
এখানেই হচ্ছে মতুয়া সাহিত্যের বৈশিষ্টের পরিচয়। যেটা অন্যত্র খূঁজে পাওয়া মুশকিল।
আমি আগেই বলেছি, এটা ধর্মীয় হলেও অন্যান্য গ্রন্থের থেকে ভিন্ন। তাই এর সাহিত্য
গূণও ভিন্ন স্বাদের। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে বিশেষ কোনো ভগবানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু
মতুয়া সাহিত্যে এর ব্যাখা দেওয়া হয়েছে সেই মানবের জয়গানে।
তাই লীলামৃতে আমরা দেখত পাই- যে যাহারে
ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর। (শ্রীশ্রীলীলামৃত পৃঃ ১)
আপনি যাকে ভক্তি করবেন, তাকেই ঈশ্বর জ্ঞানে
দেখার কথা বলা হয়েছে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কাকে ভক্তি করবেন? যিনি আপনার সার্বিক
মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন। যার উপকার বিনা আপনার অস্তিত্ব থাকে না। যিনি আপনার বা আপনাদের
জন্যই জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁকেই ভক্তি করবেন এং ঈশ্বর মনে করবেন? নাকি কোনো অদৃশ্য
অলৌকিকতাকে অন্ধভাবে মেনে নিয়ে তার ভক্তি করবেন? এর আরো স্পষ্ট ব্যাখা আমরা গুরুচাঁদ
চরিতে দেখতে পাই-
বিশ্বভরে
এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে
যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।। গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫২৯
এখানে ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে
কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরা হয়েছে। এই নিপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে
পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ
মন্ডল, বাবা সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর,
পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা সাবিত্রীবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে,
ফতেমা শেখ, বেগম রোকেয়া ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই-
যেমন- মার্টিন লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা ইত্যাদি।
এই মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই
মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা উদ্ধার কর্তা। কর্মের মধ্য দিয়ে এঁদের জ্ঞান-আদর্শের পূজা করতে হবে।
লীলামৃতে আমরা নারী প্রগতির নিদর্শন দেখতে পাই মহিলা কাছারীর মাধ্যমে।
প্রভু
বলে তবে তোরা আয় সব নারী।
মিলাইব
হাইকোর্ট মহিলা কাছারী।। (লীলামৃত পৃঃ ১১০)
এখানে মহিলাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার এক
বাস্তব নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। যেখানে মহিলাকেই প্রধান বিচারক হিসাবে অধিষ্ঠিত করা
হয়েছে।
গুরুচাঁদ চরিতেও আমরা দেখতে পাই শিক্ষা
ক্ষেত্রে নারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
তাই, নারী শিক্ষা তরে প্রভু আপন
আলয়।
‘শান্তি-সত্যভামা’ নামে স্কুল গড়ি’ দেয়।। (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫৪৬)
বর্তমান ব্রাহ্মণ্যবাদীদের যেভাবে প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে, যার স্রোতধারায় বেশিরভাগ
মানষ জ্ঞান শূণ্য হয়ে অন্ধকুসংস্কারে ভেসে চলেছে। সেই অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা গুরুচাঁদ
চরিতে দেখতে পাই, কুসংস্কার আছে
যত দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর
ঘরে ঘরে। (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১১৯)
আবার যে ব্রাহ্মণ তাঁর ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করে চলেছে সর্বত্র। সেই
ব্রাহ্মণদের উপর বলা হয়েছে-
ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।
‘ব্রাহ্মণ প্রধান’ মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র। (গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২৩)
ব্রাহ্মণদের রচিত গ্রন্থকে ‘বিজ্ঞাপন যন্ত্র’ বলা হয়েছে।
এর থেকে স্পষ্ট উল্লেখ আর কী হতে পারে? তবুও মানুষ সেই অলীকের পিছনে ছুটে চলেছে!
মতুয়া সংক্রান্ত
গ্রন্থে এরকম অসংখ্য সমাজ জাগরণের নিদর্শন আমরা দেখতে পাই। তাই, এসব শুধু ধর্ম গ্রন্থ
নয়, সমাজ জাগরণের হাতিয়ার। মানুষের দিশা নির্দেশের সোপান। এসব বিষয় শুধু মতুয়া সাহিত্যে
নয়, বাংলা সাহিত্যের শিখরে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকার কথা। দুঃখের বিষয়, সাহিত্য ক্ষেত্রে
নক্ষত্র তো দূরের কথা তাঁরাও নয়, শুধু কোথাও কোথাও প্রদীপ হয়ে মিট মিট হয়ে জ্বলছে।
কেন?
অবশেষে এই প্রশ্নটাই রেখে যাই, মতুয়া ভক্তবৃন্দরা যেমন হরি-গুরুচাঁদকে শুধু
ধর্মীয় ভাবধারায়ই বেশি আবদ্ধ করে রেখেছে। যার ফলে এর বিস্তার আজও গণ্ডী বদ্ধ রয়েগেছে।
কারণ, যাদের সার্বিক সংগ্রামকে শুধু ধর্মের মধ্যে ধরে রাখা হয়েছে; তেমনি সাহিত্য ক্ষেত্রেও
এর বিস্তার নৈ নৈব চ। কারণ সেই একই। এতো বড় বিশাল কর্মকাণ্ডকে প্রস্ফুটিত করে তুলে
না ধরে আমরাই এই মহামানবদের প্রতি পরোক্ষভাবে অবিচার করছি। আর একটা কারণ অবশ্যই আছে,
সেটা হচ্ছে, বেশিরভাগ সাহিত্য ক্ষেত্র তথা কথিত বর্ণবাদীদের কব্জায়। সেখানে অচ্ছুতের
স্থান পাওয়ার আশাকরাও প্রায় বৃথা। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বাবাসাহেব আম্বেদকর ভারতের
সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজ করেছেন। সংবিধানে অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু তিনি জন্মগতভাবে
অস্পৃশ্য হওয়ায় সকলের নেতা হতে পারেননি। হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরও এর ব্যাতিক্রম নয়। তাই
এই গুরুদায়িত্ব আমাদেরই গ্রহণ করে এই মতুয়া সাহিত্য সম্ভারকে দেশ তথা বিশ্বের দরবারে
পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই মতুয়া সাহিত্য সমাবেশ স্বার্থক হবে। তা
না হলে শুধু ফর্মালিটি হবে।
Comments
Post a Comment