গুরুচাঁদ চরিতে প্রতিফলিত শিক্ষা দর্শনের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উল্লেখ্যে কবি মহানন্দ হালদাররের কৃতিত্ব। লেখক – জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই)
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই)
‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত’ মতুয়াধর্মের আকর গ্রন্থটিতে কবি মহানন্দ হালদার গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবন চরিতের
মধ্য দিয়ে সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা ও মানব
বিকাশের জন্য যেসকল উপকরণের প্রয়োজন, সেসব থেকে বঞ্চিতদেরকে মুক্তির দিশা দেখিয়ে অন্ধত্ব
থেকে আলোর উন্মোচন ঘটিয়েছেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর যেমন আমৃত্যু সমাজ জাগরণের জন্য নিবেদিত
প্রাণ ছিলেন। মানব কল্যাণই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। তাঁর কাছে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে
সকল মানুষই ছিল সমান। এসব বিষয়ের উপর কবি যেভাবে তাঁর প্রতীভার পরিচয় দিয়েছেন সেটা
এক কথায় অনবদ্য।
আমরা দেখে নেবো কবি
যেভাবে ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’-এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার দর্শনকে তুলে ধরছেন। সেই শিক্ষা কি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক না কি সঙ্গে
সামাজিকও? অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজন কতোটা? এই সব বিষয় নিয়ে
কবি কিভাবে বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন তার লেখনীর মাধ্যমে সেটারও বিশ্লেষণের চেষ্টা
করব।
আমরা জানি, শিক্ষা
হচ্ছে একটা জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষাহীন মানুষ পশুর সমান। মানুষের শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে
খাদ্য যেমন আবশ্যক তেমনি মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা স্বরূপ খাদ্য অতি
আবশ্যক। যার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর পিতৃ আজ্ঞাকে শিরোধার্য করে নিজে পুথিগত বিদ্যায়
স্বল্প শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা সমাজে এই শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে
দেবার জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। সেই সংগ্রামের মূল স্লোগান হয় -
খাও বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি
চাই”।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৪
খেতে না পাওয়ার অভাব থেকে অশিক্ষার অভাবকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, খাদ্য কষ্টের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেও শিক্ষা স্বরূপ
খাদ্য থেকে যদি কেউ বঞ্চিত থাকে তাহলে সে
যন্ত্রনা কারো একার নয়, সেটা দেশ ও সমাজের প্রগতির ক্ষেত্রে অন্তরায় স্বরূপ। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের শিক্ষিত করতে হবে।
প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও এই অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে কবি এই যে, যে উক্তি তুলে ধরেছেন,
এটা কিন্তু সার্বজনীন। এখানে কোনো বিশেষ জাতি
বা ধর্মের মানুষের জন্য এই উক্তি নয়। অর্থাৎ কবি তাঁর বুদ্ধিদীপ্ততার মাধ্যমে এই বিশ্বজনীন
উক্তিকে তুলে ধরেছেন। আমরা পরবর্তি সকল উক্তিতেও এই বিশ্বজনীনতার প্রকাশ দেখতে পাবো।
যদিও কিছু সংকীর্ণ মানসিকতার লোকে কবির এই মহত্বতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পেরে হরিচাঁদ
ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবন ও কর্মধারাকে একটা জাতি ও ধর্মের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করার
চেষ্টায় লিপ্ত আছে। কিন্তু আমরা প্রতি ছত্রে দেখতে পাই কবি তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থের
মাধ্যমে শুধু গুরুচাঁদ ঠাকুরকেই নয়, তাঁর কর্মকে আরো প্রাধান্য দিয়েছেন। ব্যক্তি তাঁর
নামে নয়, তাঁর কর্মের মাধ্যমেই উদ্ভাসিত হয়ে আছে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো।
আমি আগেই জানিয়েছি,
গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর পিতৃ আজ্ঞাকে শিরোধার্য করেই তাঁর জীবনের কর্মধারাকে নির্ধারিত
করেছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই-
শুনেছি পিতার কাছে আমি বহুবার
নারী পুরুষ পাবে সম অধিকার।।
সমাজে পুরুষ পাবে যেই অধিকার।
নারীও পাইবে তাহা করিলে বিচার।।
তিনি বলেন, আমি আমার পিতার কাছে অনেক বার শুনেছি যে, নারী
পূরুষদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ করা যাবেনা। উভয়ে সমান অধিকার পাবে। অর্থাৎ পুরুষ যে
অধিকার পাবে নারীও সেই অধিকার সমানভাবে পাবে। অর্থাৎ তাঁর এই শিক্ষা আন্দোলনের সুবিধা শুধু পুরুষেরা পাবে
সেটা নয়। নারীরাও সব দিক থেকে সমান অধিকার পাবে। কেন? কারণ, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায়
নারীকে শিক্ষা তথা অন্যান্য মানবিক বিকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দী করে রেখেছে
অশিক্ষা ও কুসংস্কারের জ্বালে। কবি নারীদের বন্দী দশা থেকে মুক্তির দরজা উন্মুক্ত করেদিলেন
গুরুচাঁদ ঠাকুরের কর্ম পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। এখানেও আমরা দেখতে পাই সেই বিশ্বজনীনতার
জ্যোতির প্রতিফলন।
গুরুচাঁদ ঠাকুর নারী-পুরুষের বৈষম্যকে দূর
করার জন্য ঘোষণা করেন-
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে
ভাল হয় ছাও”।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫২৯
ছেলে মেয়ে উভয়কে শিক্ষা অর্জনের জন্য স্কুলে পাঠাতে হবে।
বিশেষ করে নারী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। কারণ, ‘মা’ যদি শিক্ষিত হন, তাহলে তার গুণে
সন্তানও ভাল হবে।
এই সব ঘোষণা
করেই কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। তারজন্য নিজেই ১৮৮০ সালে
নিজের বাড়িতেই প্রথমে পাঠশালা স্থাপন করে শিক্ষা দানের মত মহৎ কাজ শুরু করেন। যে
পাঠশালা হল বাংলায় পিছিয়ে রাখা সমাজের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নিজগৃহ
পরে প্রভু করে পাঠশালা।
দেশবাসী
ছাত্র আসি করিল জটেলা।। -গুরুঁচাদ চরিত- পৃঃ
১০২
তারপর
কয়েকমাস পরে রঘুনাথ সরকার নামক একজন শিক্ষক স্বেচ্ছায় শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ
করেন। আর ১৮৮০ (১২৮৭ বাংলা) সালে নভেম্বর মাসে চৌধুরী বাড়িতে
পাঠশালা তৈরী করা হয়।
বার’শ
সাতাশি সনে অঘ্রাণ মাসেতে,
পাঠশালা
হ’ল সৃষ্টি চৌধুরী বাটীতে।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ
১০৮
নারী শিক্ষার জন্যেও তিনি -
নারী শিক্ষা
তরে প্রভু আপন আলয়।
- নামে
স্কুর গড়ে দেয়।।’শান্তি-সত্যভামা গুরুচাঁদ চরিত পৃ.৫৪৬
‘শান্তি-সত্যভামা’ (শান্তি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের মা,
আর সত্যভামা-গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবন সঙ্গীনী) নামে একটা আলাদা বিদ্যালয়ের স্থাপন
করেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলনের সহভাগী
হতে চেয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গিরিশ বসু ইচ্ছা
প্রকাশ করেন একটা চিকিৎসালয় গড়ে দেবার। কিন্তু তাঁকে গুরুচাঁদ ঠাকুর বোঝান শারীরিক
ব্যাধির থেকেও ভয়ংকর হচ্ছে অজ্ঞানতার ব্যাধি।
অজ্ঞান-ব্যাধিতে ভরা আছে এই দেশ।
জ্ঞানের আলোকে ব্যাধি তুমি কর শেষ।।
উচ্চ বিদ্যালয় এই দেশে কোথা নাই।
উচ্চ বিদ্যালয় কর এই ভিক্ষা চাই”। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩৭
কতো বড় উদার ও শিক্ষা সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে এই কথার মধ্যে
দিয়ে। গুরুচাঁদ ঠাকুর সমাজের অশিক্ষার অন্ধকার দূর করার জন্য কিভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন
সেটাকে কবি অতিসুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
তবে গিরিশ বসুর এই প্রতুশ্রুতিকে কিভাবে তৎকালীন ব্রাহ্মণ
তথা উচ্চবর্ণীয়রা বাস্তবায়িত করতে না দিয়ে নিজেদের গ্রামেই সেই স্কুল প্রতিষ্ঠা করে
নেয় তার এক বাস্তব ও জাতি-ধর্মীয় ঘৃণ্যতার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই সেখানে।
কৃষিকর্ম করে যারা সেই ভাবে র’বে।
বিদ্যা পেলে কৃষিকর্ম বল কে করিবে?
লেখাপড়া নাহি জানে বোকা অতিশয়।
শিক্ষিত হ’লে এরা মোদের হবে
দায়।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪১
স্কুল যদি পায় তারা বিদ্বান হইবে।
আমাদের মান বাপু কভু না রহিবে।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৩৯
শিক্ষা নিবে ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণ যত।
তারা যাতে শিক্ষা পায়, কর সেই মতো।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ
১৪২
প্রশ্ন আসে
কেন এই জাতি-ধর্মের বৈষম্য? আমরা জানি অনুপ্রবেশকারী আর্য তথা ব্রাহ্মণরা জাতিপ্রথার
জনক। জাতিব্যবস্থা হচ্ছে উচ্চবর্ণীয় হয়ে থাকার সবথেকে বড় হাতিয়ার। তারা সকলের উপরে
থাকার জন্য নীচের জাতির লোকদের শিক্ষা সম্পত্তি ও অস্ত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।
আর অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন নিয়মকে ধর্মের দোয়াই দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের কারাগারে বন্দি করে
মানসিক গোলাম বানিয়ে রেখেছে আজও। মানবিক বিকাশের উপকরণই হচ্ছে উক্ত তিনটি অধিকার। সেই
অধিকার যদি কেউ দিতে চায় তাহলেতো তাদের গাত্রদাহ
হবেই। যারজন্য সেটা বন্ধ করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টার ত্রুটি রাখে না।
গুরুচাঁদ ঠাকুর
পূর্বভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা গিরিশ বসুর ইচ্ছাকে সঠিকভাবে পূর্ণ করতে দেবে না। তাই তিনি সমাজ জাগানোর জন্য
বলেন কারো প্রতীক্ষায় না থেকে নিজে যেটা পারো সেটা আগে কর। অর্থাৎ-
উচ্চ বিদ্যালয় যদি করিতে
না পার।
যাহা পার তাহা কর কাজে
কেন হার’? -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪২
তিনি সমাজকে
জাগানোর জন্য সকলকে স্কুল করার জন্য উৎসাহীত করতে থাকেন
বিদ্যা
ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যাধর্ম্ম,
বিদ্যাকর্ম্ম, অন্যসব ছার।
বাঁচ বা না বাঁচ, প্রাণে বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন
হ’লে বড় তার মূল্য নাই।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.
১০৮
এইভাবে বিদ্যা অর্জনকে তিনি
সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই যে শিক্ষার আন্দোলনের ব্যাপ্তি,
সেটাকে কবি এতো গভীরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মনে
হয়ে তিনি নিজেই যেন অন্তরের অন্তরে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনার সঙ্গে একাকার হয়েগেছেন।
যার ফলশ্রুতি রূপদান করেছে লেখার মাধ্যমে। আমরা দেখতে পাই খ্রিস্টান মিশরনারী ডাঃ সিসিল
সিলাস মীড ধর্ম প্রচারের জন্য যখন গুরুচাঁদ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখনও তিনি মীড
সাহেবকে বোঝান যে,
অশিক্ষা- আঁধারে
আছে যেবা পড়ে
তারে ধর্ম দে’য়া মিছে।।
মোর জাতি তায় যদি শিক্ষা পায়
কেবা জানে ভবিষ্যত।
শিক্ষিত হইলে তাহারা সকলে
নি’তে পারে তব মত।।
আদি প্রয়োজন বলে মোর মন
শিক্ষাহীনে শিক্ষাদান।
-গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৬১
গুরুচাঁদ
ঠাকুরের এই বাস্তব যুক্তিকে মীড সাহেব মেন নেন। আর তিনিও শিক্ষার আন্দোলনের একজন সৈনিক
হন। পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলন, চণ্ডাল গালি মোচন,
বিধবা বিবাহ ও শিক্ষিত বেকারদের চাকরীর ব্যবস্থা সবকিছু করার ক্ষেত্রে উপদেষ্টার ভুমিকা
গ্রহণ করেন মীড সাহেব।
গুরুচাঁদ ঠাকুর
আজীবন তাঁর এই আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যান। আমরা বর্তমানে বাংলার
দশম শ্রেণির ‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ বইতে দেখতে পাই –“তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২ টি বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠিত হয়”। তিনি সমাজের সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তিলাভের
উপায়কেও বলেছেন বিদ্যান হলে সকল দুঃখের নিবারণ হবে। চির সুখি হওয়া যাবে।
তাই বলি
ভাই মুক্তি যদি চাই
বিদ্যান হইতে হবে।
পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ
চির সুখি হবে ভবে।। -গুরুচাঁদ চরিত . ১৩০
শিক্ষা দর্শনের মূল্যবোধ ও নৈতিকতাঃ-
শিক্ষা চেতনা আনে বিজ্ঞ জনে
কয়।
চেতনায় বিপ্লব আনে
নাহিতো সংশয়।।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া
উচিত -শত্যকে শোধন করা; আর
সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংঘর্ষ করা। মতুয়া ধর্মে পতাকার তিন
কোনের অর্থ হচ্ছে- সত্য, প্রেম ও
পবিত্রতা। পতাকার লাল রঙ হচ্ছে বিপ্লবের প্রতীক। সাদা বেড়ি হচ্ছে- শান্তির প্রতীক।
অর্থাৎ বিপ্লব করতে হবে, কিন্তু সেটা সান্তি
বজায় রেখে, নিয়মনীতি ও আদর্শকে মেনে, দেশ ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য। এতো
কথা বলার উদ্দেশ্য - শিক্ষা
আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব। শিক্ষিত হওয়া এক জিনিস, আর
জাগৃত হওয়া কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। শিক্ষিত আমরা অবশ্যই। কিন্তু যে
লিখিত জিনিস পড়ে তাকে ‘লেখা’ পড়া বলা হয়। আর যে লিখিত বস্তুর থেকে তার ভীতরের অর্থ বের করে, তাকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। অর্থাৎ
BETWEEN THE LINE AND
BEHIND THE LINE যে পড়ে তাকে বুদ্ধিজীবী বলে। কারণ, লেখা জিনিস তো যেকেউ পড়তে
পারে। কিন্তু তার অন্তর্নিহীত অর্থ যে খুঁজে বের করে সে হচ্ছে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীদের কর্ম সম্পর্কে
বাবাসাহেব আম্বেদকর তাঁর Annihilation
of Caste গ্রন্থে বলেছেন যে, “প্রত্যেক দেশে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি
শাসক শ্রেণি না হলেও সব চেয়ে প্রভাবশালী শ্রেণি হয়। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির দূর দৃষ্টি
আছে। তাঁরা উপদেশ দিতে এবং নেতৃত্ব দিতে পারেন। যেকোন দেশের সাধারণ জনগণ বিচারশীল
জীবন ব্যতীত করেনা। এই ধরনের জনগণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অনুকরণ ও অনুসরণ করে। একথা
বলার মধ্যে কোন অতিরঞ্জন নেই যে, যে কোন দেশের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ সেই
দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উপর নির্ভর করে। যদি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৎ, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হন, তাহলে
সংকটকালে সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নেতৃত্বের উপর আস্থা স্থাপন করা যায়।”
উপরের কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, গুরুচাঁদ
ঠাকুর যে শিক্ষার আন্দোলন করেছিলেন, সেই আন্দোলনের ফলে কেমন শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরি হবে,
তারা সমাজ ও দেশের জন্য কী করবে? তিনি শুধুমাত্র পুথিগত শিক্ষার আন্দোলন করেননি। তিনি একজন প্রকৃত মানুষ গড়ার আন্দোলন করেছিলেন। মানুষের যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকবে তেমনি তাকে সামাজিক শিক্ষায়ও সুশিক্ষিত
হতে হবে। তবেই সেই শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ফুটে উঠবে।
গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষায় স্বল্প শিক্ষিত হলেও সামাজিক শিক্ষায় ছিলেন সুশিক্ষিত। সেজন্য তিনি সমাজের
ব্রাহ্মণ্যবাদের অবক্ষয়কে জনগণের কাছে তুলে ধরেন। তিনি কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার
আহ্বান জানান-
কুসংস্কার আছে যত
দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা
শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ১১৯
কুসংস্কার মুক্ত হওয়ার জন্য ঘরে ঘরে বিদ্যা অর্জনের ডাক
দেন। সেই কুসংস্কারগুলো কেমন? তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যে, তোমরা যে ব্রাহ্মণ্যবাদী
তথাকথিত গ্রন্থকে ধর্ম গ্রন্থ বলে মনে করছ, সেগুলো তোমাকে আরো নীচ করে রাখার ও মানসিক
গোলাম বানিয়ে রাখার বিজ্ঞাপন যন্ত্র স্বরূপ। সেগুলো ব্রাহ্মণরা তাদের জাতি হিসাবে উচ্চ
দেখানোর জন্যই লিখেছে। আর তোমাদের বানিয়েছে দাস, দস্যু, চণ্ডাল ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘ব্রাহ্মণরাই কুসংস্কারের
পৃষ্ঠপোষক। কুসংস্কার ঘনীভূত করে তুলতে তারাই ইন্ধন যোগায়। কারণ, কুসংস্কার ও
গোঁড়ামি তাদের ধনার্জন ও মর্যাদার উৎস। ধর্মের গূঢ় রহস্য তাদের করায়ত্ত, এমন
ধারণার বশবর্তী হয়ে লোকে তাদের শ্রদ্ধাভক্তি করে এবং দান-দক্ষিণা দ্বারা তাদের
সম্পদশালী করে তোলে।’ (তথ্য-অন্বেষণ-১ম খণ্ড, শিপ্রা বিশ্বাস পৃ.২২২/২২৩)
তাই তিনি বলেন –
ব্রাহ্মণ রচিত যত অভিনব
গ্রন্থ।
‘ব্রাহ্মণ প্রধান’
মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ২৩
গুরুচাঁদ ঠাকুর
এই কথা কিন্তু শুধুমাত্র বলার জন্যই বলেননি। সকলকে বোঝানোর জন্য বলেছেন। কারণ, তিনি
এই ব্যবস্থার গভীরে গিয়ে এসব অনুধাবন করতে পেরেছেন। গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই কথার যৌক্তিকতার
মিল খুঁজে পাই- দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ২য় খন্ড, পৃ. ৬৭৩ তে। সেখানে দেখতে পাই- “বৌদ্ধ-যুগের
অবসানে উচ্চশ্রেণীর অপ্লসংখ্যক লোক ও জনসাধারণের মধ্যে একটা ব্যবচ্ছেদ-রেখা টানা
হইল। বৌদ্ধ-যুগের ব্রাহ্মণ সুঙ্গবংশীয় পুষ্যমিত্রের সময়ে শাস্ত্রগুলি ফিরিয়া
লেখা হইয়াছিল এবং ব্রাহ্মণকে দেবতাদের
তুল্য কিংবা তদপেক্ষাও উচ্চে আসন দেওয়া হইয়াছিল; এই সময়ে প্রাচীন স্মৃতিকারদিগের
উপর অবাধভাবে হাত চালাইয়া ব্রাহ্মণদের গৌরবান্বিত করা হইয়াছিল। বঙ্গের
ব্রাহ্মণেরা তাঁহাদের উপাধি পরিবর্ত্তন করিয়া অপরাপর শ্রেণী হইতে একেবারে
স্বতন্ত্র হইয়া দেবতার আসন গ্রহণ
করিয়াছেন।”
শুধুমাত্র গ্রন্থ লিখে শ্রেষ্ঠত্ব নয়, সেটাকে
বাস্তবায়িত করার জন্য-
কথা উপকথা কত সৃজন
করিল।
ঘাটে মাঠে গাছে পথে
দেবতা গড়িল। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ২২
বিভিন্ন কল্প কাহিনি লিখে
যত্র তত্র একটা কিছু তৈরি করে দেবতা নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। গুরুচাঁদ ঠাকুর
ব্রাহ্মণদের এসব শঠতাকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন বলেই তিনি সমাজের অশিক্ষার
অন্ধত্বকে দূর করার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। এরপর দেখুন ধর্ম ধব্জাধারীদের
কর্ম কাণ্ড সম্পর্কে-
ধর্ম্ম ধ্বজাধারী সাজি যত পুরোহিত।
ধর্ম্মকে পিষিয়া করে কার্য বিগর্হিত।।
মাতৃত্ব সতীত্ব কহে হাস্যকর নীতি।
নারীজাতি লয়ে করে পাপের বেসাতি।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ.২১
ধর্মের নাম দিয়ে ধর্মের ধব্জাধারী যতো পুরোহিত আছে, তারা
অধর্মের কাজই করছে। তারা মাতৃত্ব ও সতীত্ব নিয়ে অনেক নীতি কথা বলে, কিন্তু তাদের
নিয়েই পাপের বেসাতি করে। এই হচ্ছে ধর্মের ঠিকাদারদের আসল পরিচয়।
শুধু এটাই নয়; আমরা মতুয়া দর্শনে
ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের সম্পর্কে আরো দেখতে পাই-
কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ কোথায়
বৈষ্ণব।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভণ্ড সব।।
-লীলামৃত, ঠাকুরনগর, ১০ম
সংস্করণ পৃ. ৯৪
এখানে প্রকৃত ব্রাহ্মণ বা
বৈষ্ণবদের খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাটা নগণ্য। আর যাদের পাওয়া যাচ্ছে তারা
প্রায় সবাই স্বার্থবশে অর্থলোভী ও ভণ্ড।
গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণদের চরিত্রের
বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, তারা আমাদের হীন বা নিকৃষ্ট পশুর মতো সর্বদা ঘৃণা করে। কোনো
কারণে আমরা যদি ওদের জল স্পর্শ করি, তাহলে তারা আর সে জল গ্রহণ না করে আমাদের লোকদের
প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করে।
কিন্তু অর্থ দিলে নেয় কুতুহলে
মনে পায়
বড় হর্ষ।
জাতি গেছে জলে তাই ওরা জ্বলে
জলে ডুবে
জল খায়।।
যদি থাকে পৈতা স্বর্গে উঠা মৈ টা
লাগা-থাকে তার পায়।।
হোক্ ব্যভিচারী হলে পৈতা ধারী
সমাজে তাহার মান্য। গুরুচাঁদ চতির
পৃ. ১৬১
এখন কথা হচ্ছে এই যে যেসকল উদ্ধৃতির উল্লেখ করলাম এটার জন্য কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে
কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। আর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রোষানলে পড়ে তাঁকে প্রায় ১৩ বছর এক
ঘরে করে রাখা হয়েছিল। তবুও কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি।
ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থায় মানুষ একদিকে
যেমন মানসিক গোলামিতে জীবন যাপন করছে, অন্যদিকে এটাকে গড়ে তুলেছে সামাজিক ব্যবস্থার
মাধ্যমে শোষণের যন্ত্র হিসাবে। গুরুচাঁদ ঠাকুর এখানে জানিয়েছেন-
“বোকা জাতি নমঃশূদ্র নীতি নাহি জানে।
শ্রাদ্ধেতে বিবাহে ব্যয় করে অকারণে।।
ঘরে নাই অন্ন যার দেনা বহুতর।
পিতৃশ্রাদ্ধে করা চাই “দানের সাগর।।”
শ্রাদ্ধ নহে পেট-পূজা সাজাইয়া লয়।
এত যে কষ্টের কড়ি সব করে ক্ষয়।।
ব্রাহ্মণের কূট চক্রে নিজে ক্ষয় হয়। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৪৫৫
বৈদিক
ধর্মের ভীত হচ্ছে- পরকাল, আত্মা-পরমাত্মা, স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি। এসব এক
দিকে যেমন মানুষকে লোভী করে তোলে অন্যদিকে এসবকে উপেক্ষা করতে চাইলে ভয় দেখায়। যার
ফলে মানুষ এর থেকে মুক্তির জন্য নিজের সর্বস্ব দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। আর এসব
করানোর মাধ্যম হচ্ছে ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা রচিত তথাকথিত ধর্ম গ্রন্থ।
এই হাতিয়ারের দ্বারাই এই সব কর্ম করতে বাধ্য করে। আর এই ক্রিয়া করাতে গিয়ে যতো উপার্জন হয় সে সবই ঐ ব্রাহ্মণই
ভোগ করে। যার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর একে
বলেছেন ‘ব্রাহ্মণের কূটচক্র’। ব্রাহ্মণদের
কুটচক্র সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র কি বলেছেন দেখা যাক- “ধর্ম্মোপার্জ্জনের জন্য
কেবল পুরোহিত মহাশয়কে দাও, গুরুঠাকুরকে দাও, নিষ্কর্ম্মা, স্বার্থপর, লোভী,
কুকর্ম্মাসক্ত ভিক্ষোপজীবী ব্রাহ্মণদিগকে দাও, আপনার প্রাণপাতনে উপার্জ্জিত ধন সব
অপাত্রে ন্যস্ত কর। এইমূর্ত্তি ধর্ম্মের মূর্ত্তি
নহে- একটা পৈশাচিক কল্পনা। অথচ আমরা বাল্যকাল হইতে ইহাকে ধর্ম্ম নামে অভিহিত হইতে শুনিয়াছি
আসিতেছি।” (বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধর্ম
এবং সাহিত্য, বিবিধ প্রবন্ধ, কলিকাতা, ১৮৯২, হেয়ার প্রেস, পৃষ্ঠা নং ৭১৯-৭২০)। গুরুচাঁদ
ঠাকুর ব্রাহ্মণদের কূটচক্রকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলে এর থেকে মুক্ত
হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ব্রাহ্মণদের
কূট-চক্রে ফেঁসে যাও এই নিপীড়ি জাতিকে এক দিকে বোকা বললেও অন্য দিকে তিনি সতর্ক করে
দিয়েছেন যে,
বুদ্ধিহীন সরলতা আর নাহি চলে হেথা
কূট-বুদ্ধি বটে দরকার। গুরুচাঁদ চতির
পৃ. ৪৪৩
আবার তিনি সন্তানদের বিবাহের বিষয়ে বলেছেন-
বাল্যকালে
পুত্র কন্যা বিয়া নাহি দিবে।
পথ ঘাট ঘর
দ্বার পবিত্র রাখিবে।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ.
৫২৯
তেরশত ষোল সালে বারুণী
সময়।
বিধবা বিবাহ দিতে প্রভু
আজ্ঞা দেয়।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ২৬১
১৯১০ সালে মার্চ মাস নাগাদ (বাংলা ১৩১৬ সাল), বারুণীর সময়
অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন পালনের
মাসে (১১ই মার্চ) গুরুচাঁদ ঠাকুর পতিত জাতির মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন। আর
বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক
শিক্ষার সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, আত্মোন্নতির অগ্রভাগে শুধু শিক্ষা নয়, সঙ্গে ধন বা সম্পদের
যেমন দরকার তেমনি রাজ কাজেও অংশ গ্রহণ করা দরকার।
আত্মোন্নতি অগ্রভাগে প্রয়োজন তাই।
বিদ্যাচাই,
ধন চাই, রাজকার্য চাই।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৫৭৩
কারণ, শক্তির পরিচয়
দেখাতে না পারলে কেউ প্রশ্রয় দেবে না। তাই-
শক্তি না দেখিলে কেহ করেনা সম্মান।
শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান।। -গুরুচাঁদ
চরিত পৃ. ৫৭৩
জাতি, ধর্ম্ম যাহা কিছু উঠাইতে চাও।
রাজশক্তি থাকে যদি যাহা চাও পাও।। -গুরুচাঁদ
চরিত পৃ. ৩৪৯
মতুয়া ধর্মের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় এটা এক দিকে যেমন সার্বজনীন অন্যদিকে
এটা জাতি-ধর্মের ঊর্ধে।
এখানে কোনো বৈষম্য নেই। তাই আমরা দেখতে পাই –
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নাহি নমঃর একার।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ১৪৪
নরাকারে ভূমণ্ডলে যত জন আছে।
‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।
-গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ২০১
সামাজিক নীতি সব শোন ভক্তজন।
‘জাতিভেদ’ প্রথা নাহি মানিবে কখন।। - গুরুচাঁদ
চরিত পৃ. ৫৭০
মানুষে মানুষে বল ভিন্ন জাতি কোথা?
নরজাতি এক জাতি ভেদ করা বৃথা।।
-গুরুচাঁদ চরিত –পৃ. ৩৬০
মানুষ সবার শ্রেষ্ঠ ভেদাভেদ ইষ্টানিষ্ট
কর্মগুণে মান পায় জন্মগুণে নয়। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৭৩
আমরা ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-এও তিনটি মুখ্য বাণী দেখতে
পাই- ১) জীবে দয়া, ২) নামে রুচি ৩) মানুষেতে নিষ্ঠা। আর বাকি সব কিছু ভ্রষ্টা
বা মিথ্যা। এখানে মানুষকে সবার উপরে
স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন আসে কোন্ মানুষদের? যে মানুষের অন্তরে কোনো জাতিভেদ,
সামাজিক উঁচু-নীচু নেই, যিনি সকল মানুষের প্রতি দয়াবান, তাদেরই শ্রেষ্ঠতা দেওয়া
হয়েছে।
হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের যে দর্শন সেটা যদি তাঁদের অনুরাগীরা অর্ধেকটাও মেনে
চলতে পারতেন তাহলে এই আন্দোলন আরো দ্রুত সুদূর প্রসারী হতে পারত। জন্ম-মৃত্যু ও
অন্যান্য ক্রিয়া-কর্ম সম্পর্কে যে সকল উল্লেখ আছে সেটা যদি শুধু বইয়ের পাতায়ই থেকে
যায় তাহলে তার আর মূল্য কোথায়? এই মহামানবদ্বয় তো চেয়ে ছিলেন সেটা বাস্তব জীবনেই
পালিত হোক। যেমন নিচের কিছু কথা -
মাটি
দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়।
দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি
গড়ায়।।
ব্রহ্মের বিকার ভাগ হ’ল পঞ্চ ক্রমে।
ক্ষিতি
অপঃ তেজঃ মরুদ্বোম্পঞ্চ নামে।।
ব্রহ্ম
ধরে ‘আত্মা’ নাম তত্ত্বে
দেহ কয়।
উভয়ে
মিলন হ’লে জীব সৃষ্টি হয়।।
ভূত’ত আধার মাত্র দেহ নাম ধরে।
চিৎ
শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।
-গুরুচাঁদ চরিত- পৃষ্ঠা নং 354/355
প্রকৃতি
পাঁচটি উপাদানে গঠিত। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। প্রকৃতির এই পাঁচটি উপাদানের
চারটি উপাদানে গঠিত হয় জীব। ব্যোম বা মহাশূন্য জীব সৃষ্টির জন্য সরাসরি প্রয়োজন
হয়না। প্রকৃতির এই চারটি উপাদানের আনুপাতিক মিশ্রণে প্রথমে জীবের উদ্ভব হয়।
বিবর্তনের মাধ্যমে কোটি কোটি বছর পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রাণীর
মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে মানব। এই মানব বা যে কোনো প্রাণী, পুরুষ ও
নারীর শুক্রানু ও ডিম্বানুর উপযুক্ত ‘উভয়ে
মিলন হ’লে জীব সৃষ্টি হয়’।
জীবের মধ্যে চেতনার সঞ্চার হয়। সেই চেতনাকে কেউ ব্রহ্ম বলেন। আবার কেউ আত্মাও বলেন। পিতামাতার চেতনার
মিলনের ফলে জীবের সৃষ্টি হয়। সেই চেতনাকে ব্রহ্ম বা আত্মা বলা হয়। যে চেতনা দেহের
মধ্যে সদা অনুভুত হয়। পূর্বেই বলেছি, চার ভূতের যে আনুপাতিক মিলনের ফলে প্রাণীর
জন্ম হয়। সেই প্রাণী আকার বা দেহ নাম ধারণ করে। আর এই দেহের মধ্যে যে চিৎ শক্তি বা
চেতনা শক্তি আছে, তাকেই আত্মা বলা হয়েছে। যে চিৎশক্তি বা চেতনা শক্তি আমৃত্যু
নিরন্তর চেতনা প্রবাহকে জারি রাখে।
এই যে, গভীর অথচ
সম্পূর্ণ বিজ্ঞান মূলক কথা কবি তুলে ধরেছেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনায় মিশে গিয়ে
সেটার গুঢ়তত্ত্ব বোঝার সময় কি অতিবাহিতা হয়ে যাচ্ছে না। আমরা কেন এখনো অলীক
স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি?
এর পর যদি আমরা ভগবানের ব্যাখা দেখি, সেখানেও স্পষ্ট করে উল্লে খ করা হয়েছে-
বিশ্বভরে
এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে
যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।। গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫২৯
এখানে
ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা হয়েছে, যে যা’রে উদ্ধার
করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন।
ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। আর এই উদ্ধার কর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।
তোমাদের
এই কুলে হরি অবতার।
দয়া
করে নমঃশূদ্রে করিল উদ্ধার।।
তাঁর
পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।
নিজ
ঘরে ভগবান ফেলে কোথা যাও? গুরুচাঁদ
চরিত পৃঃ ৫২৯
তোমাদের ঈশ্বর বা অবতার বা উদ্ধার কর্তা যাই
বলোনা কেন তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুর। তোমরা তাঁর পূজা কর।
তবে এই পূজা শুধুমাত্র ফুল, বেলপাতা চিন, বাতাসার নয়। এই পূজার উপচার হবে সত্য, প্রেম পবিত্রতা। পরোউপকার।
চরিত্র গঠন। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের
কর্ম ও আদর্শের পূজা। যে
পূজার ফলে জাতি, সমাজ ও দেশের মঙ্গল হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মতুয়ারা নিজেদের ভগবানকে চিনতে না পেরে
বৈদিকতার জ্বালে ফেঁসে আছে। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই যে সব‘বেদ-বিধি শৌচাচার
নাহি মানি’ বলে ঘোষণা করেছেন, সেখানে বেশিরভাগ মতুয়া বৈদিকতা নিয়ে মেতে
আছেন। আর হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরকেও সেই বৈদিকরার মধ্যে গুলিয়ে দিচ্ছেন। যদিও
মতুয়া দর্শনে আছে, যে হরিচাঁদের নির্দেশ মেনে চলবে সে-‘না ডাক’ হরিকে হরি তোমাকে
ডাকিবে।’ - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৫৬৯
এতোটা স্পষ্ট করে সব কথা বলা ও কর্মের মাধ্যমে
দেখানোর ফলেও হরি-গুরুচাঁদের ধর্ম-দর্শনের অনুরাগীরা আজও বেশিরভাগ বিপথগামী! গুরুচাঁদ
ঠাকুর সারা জীবন পিছিয়ে পড়া সমাজের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করার পরও তিনি এক সময় অনেক
দুঃখের সঙ্গে জানিয়ে ছিলেন- “এতো সব সমাজ শিক্ষার কথা বলার পরেও যাদের প্রগতির
উদ্দেশ্যে এই নীতি কথাগুলো বললাম, করে দেখালাম কিন্তু তারা এতোই অজ্ঞানী যে, শত্রু
কে? আর মিত্রকে? সেটাই চিনলো না!
শয়ন ভোজন আর পুত্রকন্যা- জন্ম।
তোদের জীবনে মাত্র দেখি এই ধর্ম্ম।।
ইতর পশুরা আছে বেঁচে যেই ভাবে।
তোরাও তাদের মত
কাজে কি স্বভাবে।।
এমন জীবনে বল বেঁচে কিবা ফল?
আকারে মানুষ বটে পশু একদল।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ ২২১
মানুষ যদি কোনো কিছু না বোঝে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যায়।
কিন্তু সেটা যদি বোঝানোর পরও একই ভুল করে তাহলে সমস্যা আরো গভীর হয়। ধর্মহীন
পতিত জাতিকে উদ্ধার করার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর ধর্ম দিলেন। তাদের বৈদিকবাদী কবল থেকে
মুক্ত হওয়ার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর সারা জীবন সংগ্রাম করলেন। শিক্ষার আন্দোলন করলেন।
বিভিন্ন সমাজ সংস্কার নিজে হাতে করে দেখালেন। সারা জীবন এই অবহেলীতদের চেতনার
জাগরণ ঘটানোর জন্য কঠোর সংগ্রাম করে একটা পর্যায়ে তোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু
যাদের জন্য এই সংগ্রাম, তাদের চেতনা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল। তাই
গুরুচাঁদ ঠাকুর অতি দুঃখে বলতে বাধ্য হলেন- “আমি যে কাজ করলাম সারা জীবন,
তাতে একগাছ ছাতাও ফেলতে পারলাম না” অর্থাৎ অশিক্ষার অন্ধকার, বৈদিকবাদের
শৃঙ্খল যেভাবে সমাজকে আকড়ে আছে জগদ্দল পাথরের মতো তার থেকে মুক্ত করতে পারলেন না। শরীরের
ময়লাকে গ্রাম্য ভাষায় ‘ছাতা’ বলা হয়। কিন্তু যাদের শুধু শরীর নয়, মাথায়
অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার ও বৈদিকতার অলীক গল্পের ময়লা জমেছে সেটা তুলে ফেলা সবচেয়ে কঠিন কাজ।
যার জন্য গভীর দুঃখের সঙ্গে ঠাকুর বলতে বাধ্য হলেন, “তোরাতো পশুর মতো শয়ন, ভোজন
আর সন্তান উৎপাদন করিস। তোদের এইভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ হবে! তোরা মানুষ হয়ে জন্ম
নিয়ে যদি পশুর পর্যায়েই থাকতে চাস তাহলে আর বেঁচে থাকার কোনো দরকার আছে কি?”
এই কথাগুলো বর্তমান দিনেও কম প্রযোজ্য নয়। কারণ, বিশেষ করে বেশিরভাগ মতুয়ারা
হরি-গুরুচাঁদের নাম নিলেও তাদের প্রদর্শিত
পথে চলে না। তাদের নির্দেশিত কাজ করেনা। তারা হরি-গুরুচাঁদকে মানে কিন্তু তাঁদের নির্দেশিত পথে চলে না।
হরি-গুরুচাঁদ ধর্মহীন পতীতদের নতুন ধর্ম
দিয়ে ছিলেন সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য। সেটা আন্দোলনের জন্য একটা সোপান বা হাতিয়ার মাত্র।
তাঁরা ধর্ম বিশ্বাসের উপর দাঁড়ান নি। মানুষকে জাগ্রত করার জন্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার
সাথে সাথে সামাজিক শিক্ষা দিয়ে মূল্যবোধ জাগানোর
জন্য। সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য তাঁরা ধর্মকে এক ধরনের ভাষা বা প্রকাশের মাধ্যম
হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই বলে ছিলেন,
ধর্ম্ম শক্তি বিনা জাতি জাগেনা কখন।।” গুরুচাঁদ চতির পৃঃ ৫২৯
কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ মতুয়া
ধর্ম-দর্শনের অনুরাগীরা ধর্মটাকে বৈদিক ঘরানায় আকড়ে ধরে আছে। তার থেকে এরা বাইরে আসারও
চেষ্টা করছে না। যারফলে যাকিছু দেখা যাচ্ছে সেটা শুধু বাহ্যিকতা। অন্তর্নিহিত ভাবনার
প্রকাশ বা প্রসার যৎ সামান্য।
কবি মহানন্দ
হালদাররের কৃতিত্বের মূল্যায়ন-
একজন লেখক বা কবি তিনি যখন লেখেন সেই লেখার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনার প্রবেশ
হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যদিও এখানে ব্যক্তিগত ভাবনার থেকে একটা জাতির সামগ্রিক ইতিহাস তুলে
ধরা এক অনন্য সাধারণ কৃতিত্ব। গুরুচাঁদ ঠাকুর এমনই একজন ব্যক্তি যিনি অন্যদের থেকে
অনেকাংশেই আলাদা। সেই আলাদা ব্যক্তিকে তাঁর মতো করে তুলে ধরা এক দুঃসাধ্য কাজ।
‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’ এক মহাসমূদ্র। সেই সমুদ্রকে যিনি তাঁর অক্লান্ত
শারীরিক ও মানসিক বুদ্ধিদীপ্ত শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছেন; একটা জাতির সাবমেরিন হয়ে
জেগে ওঠার ক্ষেত্রে সে কৃতিত্বের মূল্যায়ন আমার মতো অতি সাধারণের পক্ষে কাঠ ঠোকরা হয়ে বিশাল
বৃক্ষের সামান্য ছিদ্র করা মাত্র।
গুরুচাঁদ ঠাকুর সারাজীবন জাতি ও সমাজকে জাগানোর জন্য যেভাবে সমস্ত প্রতিকূলতাকে
অতিক্রম করে উদ্দেশ্যের প্রতি অটল থেকেছেন,
কিন্তু পড়ন্ত বিকালে এসে বলতে বাধ্য হয়েছেন ‘এক গাছ ছাতাও (ময়লা) ফেলতে পারলাম না।’
তাহলে ভাবতে হবে সমাজে কিভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী জঞ্জাল কংক্রিট হয়ে আছে। গুরুচাঁদ ঠাকুরের
সে ভাবনাও ফুটে উঠেছে এই মানবী কবির লেখনীতে। সেখানে আমরা দেখতে পাই,
আজি যারা তপশীলী জাতি সাজিয়াছে।
শিক্ষা ছাড়া উন্নতি কি সম্ভব
হয়েছে।।
শিক্ষার প্রেরণা তারা কোথা হতে
পায়।
আদি-গুরু গুরুচাঁদ আদি-শিক্ষা
দেয়।।
আত্মশক্তি-পরিচয় নহে হীন বল।
‘তপশীলী’ বলি যারা আছে এক দল।।
বিশ্বের সভায় যারা পেয়েছে আসন।
তারা কি করেছে মনে সে চিন্তা কখন?
তপশীল-জাতি মধ্যে যা’ কিছু হয়েছে।
হরিচাঁদ-কল্পবৃক্ষে সকলি
ফলেছে।। -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১৪৫
আমার সামান্য
ভাবনায় একটা জিনিস ঘুরপাক খায়; সেটা হচ্ছে অতি দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে ভুক্ষা পেটে অনিদ্রায়
থেকেও যে মাতাপিতা সন্তানকে গড়ে তোলেন বড় করেন, সেই সন্তান বড় কিছু হলে তার নামই প্রচার
হয়। সেই পিতামাতার খোঁজ যেমন কেউ রাখেনা তেমনি যে মহাকবি আচার্য মহানন্দ হালদার
এই ‘গুরুচাঁদ চরিত’কে সন্তানের মতো গড়ে তুলেছেন তাঁর খোঁজ আমরা কয় জনে রাখি। আমি বলতে
চাচ্ছি তাঁর এই অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে আমরা কয় জনে স্বরণ করি বা তাঁর স্মৃতি
চারণা করি? শুধু মহানন্দ হালদারই নন; পিছিয়ে রাখা সমাজকে জাগানোর জন্য যাঁরাই বিভিন্নভাবে তাদের অবদান রেখে গেছেন
বা এখনো রাখছেন তাদের কৃতিত্বের কতটা মূল্যায়ন করি আমরা? আমাদের এই ভুল অতি দ্রুত শুধরে
নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
প্রত্যেক লেখকের
লেখার মধ্যে যেমন ব্যক্তিগত ভাবনার অনুপ্রবেশ অবশ্যম্ভাবী তেমনি কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি
থাকাটাও স্বাভাবিক। গুরুচাঁদ চরিত কিন্তু সম্পূর্ণভাবে কবি নিজের নিয়ন্ত্রানাধীনে লিখতে
পারেননি। সেটা অন্যের বা অন্যদের হাতে ছিল। তাই অনেক কিছুর অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন
কবি। যেটা কখনো কখনো পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়।
এক্ষেত্রে
যদি আমরা লীলামৃতের কবি তারক সরকারের একটা স্বীকারোক্তিকে মেনে চলি তাহলে সব সমস্যার
সমাধান হয়ে যায়। যেটা হচ্ছে –
শ্রোতাগণ হংসবৎ দোষ ছাড়ি গুণ যত
দুগ্ধবৎ করুন গ্রহণ।
পৃ. ৩৯
অর্থাৎ পংকিলতার মধ্যে থেকেও হাঁসের গায়ে যেমন সেটা লেগে
থাকতে পারে না বা হাঁসের মতো পংকিলতা মুক্ত
হয়ে নোংরা জলটাকে ফেলে দিয়ে শুধুমাত্র দুধটাকে চুষে নিন। অর্থাৎ লেখনীর মধ্যে যে সব
অসামঞ্জস্যপূর্ণতা চোখে পড়ছে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে জাতি ও সমাজ জাগরণের উপাদানগুলোকে
দুধের মতো তুলে নিন। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা
নিজেরাই পংকিলতা মুক্ত হতে পারিনি। তাই দুধকে কিভাবে চুষে নিতে হবে সেটা বুঝিনা। কারণ,
আমরা বৈদিকতার পংকিলতার নেশায় ডুবে এখনো বুদ হয়ে আছি। এর থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হলে
নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে ঘোলা জলে হাবু ডুবু খেতে থাকতে হবে। আর নিজের দোষ
অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে।
_____________________________
Comments
Post a Comment