শিক্ষার আন্দোলন ও সমাজসংস্কারের অগ্রদূত গুরুচাঁদ ঠাকুর
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
জন্ম ও শিক্ষা গ্রহণঃ- গুরুচাঁদ ঠাকুরের জন্ম
১৮৪৬ সালের ১৩ই মার্চ; বর্তমান
বাংলাদেশের ওড়াকান্দী গ্রামে। পিতার নাম হরিচাঁদ ঠাকুর মাতা হচ্ছেন-শান্তি
মাতা। পাঠশালার শিক্ষা জন্য সাধু দশরথের ও গোলকের বাড়িতে থেকে শিক্ষা গ্রহণ
করেন। এইভাবে তিন বছর শিক্ষা গ্রহণের পরে তিনি ওড়াকান্দীতে ফিরে আসেন। ওড়াকান্দীতে
কোন উচ্চবর্ণীয়দের স্কুলে ভর্তি হতে পারেন
না। কারণ তিনি তো পতিত অস্পৃশ্য নিচু জাতির লোক। তখন বাধ্য হয়ে তিনি মুসলমানদের
মক্তবে ভর্তি হন। সেখানে আর্বি, পার্সী
ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। মক্তবের শিক্ষা সমাপ্ত হলে উচ্চ
শিক্ষার কোন সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে তাঁকে
শিক্ষা গ্রহণ বন্ধ করতে হয়।
শিক্ষার আন্দোলনঃ- গুরুচাঁদ
ঠাকুর একাধারে যেমন ছিলেন প্রথাগত (একাডেমিক) শিক্ষার প্রসারের অগ্রদূত। তেমনি
তিনি অন্য দিকে ছিলেন সামাজিক শিক্ষার ধারক ও বাহক। অর্থাৎ
Education for earning and education for
learning. গুধুমাত্র
একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সে প্রকৃত শিক্ষার অধিকারী হতে পারেনা; সঙ্গে
প্রয়োজন সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। তিনি চেয়েছিলেন শুধু পুথিগত শিক্ষায় নয়, সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত পূর্ণ মানুষ,
কুসংস্কার মুক্ত মানুষন গড়ে তুলতে। শিক্ষার প্রসারের জন্য তাঁর শ্লোগান
ছিল-
খাও
বা না খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
ছেলে পিলে শিক্ষা দেও এই আমি চাই।।
-গুরুচাঁদ
চরিত- পৃঃ ১৪৪
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন অশিক্ষা হচ্ছে মারণ রোগ। তার জন্য তিনি ঘোষণা করলেন, খেতে না পাওয়ার
অভাব থেকে অশিক্ষার অভাব আরো অনেক বড়। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতে সন্তানদের শিক্ষিত
করতে হবে। প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও অশিক্ষার অন্ধকারকে দূর করতে হবে।
বালক
বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে
বলে “মা’র গুণে ভাল হয় ছা’ও।। (পৃঃ ৫২৯)
তিনি সকলের জন্য বিদ্যা অর্জনের উপর জোর
দেন। আর গ্রামে গ্রামে পাঠশালা করার আহ্বান জানান। নারীকেও শিক্ষিত হওয়ার কথা
বলেন। কারণ, মা’ শিক্ষিত হলে সন্তানও শিক্ষিত হবে।
১৮৮০
(১২৮৭ বাংলা) সালে নভেম্বর মাসে অনুন্নত শ্রেণির জন্য ১ম পাঠশালা তৈরী করা হয়।
বিদ্যার
কারণে দান দানের প্রধান।
বিদ্যাহীন
নর দেখ পশুর সমান।। -গুরুচাঁদ
চরিত -৫৩০
যিনি বিদ্যা লাভ করেছেন, তিনি যদি অন্যকে
সেই বিদ্যা দান করেন তাহলে সেই দানের ফলে দেশ, সমাজ ও জাতির প্রগতি হবে। সমস্ত
বাঁধার অন্ধকার দূর হয়ে জ্ঞানের আলো ফুটে উঠবে। তিনি বিদ্যাহীন মানুষকে পশুর সঙ্গে
তুলনা করেছেন। শিক্ষিত হলে সমাজের অন্ধ ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য
সংগ্রাম করা যাবে। গোলামী থেকে মুক্ত হওয়া যাবে।
তিনি আরো বললনে- কুসংস্কার আছে যত দূর কর’ অবিরত
বিদ্যা শিক্ষা কর ঘরে ঘরে। গুরুচাঁদ
চরিত পৃ.১১৯
কুসংস্কার হচ্ছে সমাজের ক্ষতিকারক ভাইরাস। এই ভাইরাস থেকে প্রতি নিয়ত দূরে থাকতে হবে। আর তার জন্য ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো জ্বালাতে হবে। তাঁর এই শিক্ষার আন্দোলনের ফল স্বরূপ- আমরা বর্তমান দশম শ্রেনির ‘স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ’ –বইতে দেখতে পাই- ‘তাঁর উদ্যোগে ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।’
সংরক্ষণের ব্যবস্থাঃ- বাংলার
৩১টি সম্প্রদায়কে নিয়ে “বঙ্গীয় তপঃশীল ভূক্ত জাতি” আইন সৃষ্টি হয়।
অনুনন্ত শ্রেণীর মানুষের শিক্ষা, চাকুরী ও আইন সভায় যে আসন সংরক্ষিত হয়েছিল, তার
মূলে ছিলেন যুগনায়ক শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর এবং সংঘবদ্ধ মতুয়া আন্দোলন। ভারতবর্ষের
মত বর্ণভিত্তিক বা সম্প্রদায় ভিত্তিক দেশে সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া কোন দাবী আদায় করা
যায় না। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারী অফিসে অনুন্নত শ্রেণির মানুষের
জন্য জনসংরক্ষণ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু হয়ে যায়। ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতায়
অনুরূপ একটি হোস্টেল খোলা হয় এবং তার
পরিচালন ভার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর
ন্যাস্ত হ্য। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনে অনুন্নত
শ্রেণির এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।
সমাজ
সংস্কারঃ- তিনি বলেন,
শ্রদ্ধা হলে শ্রাদ্ধ হয় শাস্ত্রের প্রমাণ।
মূলতত্ত্ব নাহি জানে যতেক অজ্ঞান।।
-গুরুচাঁদ চরিত পৃ.
৪৫৪/৪৫৫
অর্থাৎ বৈদিক
প্রথায় মৃতের যে অনুষ্ঠান করা হয়ে যেটা আসলে পেটপূজা। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো
হচ্ছে আসল কাজ। সেটা সাধ্যমতো করা দরকার। কিন্তু অজ্ঞানতা বশত পূজারীর দ্বারা
ব্লাকমেলের শিকার হয়ে অকারণে অর্থ ব্যয় করে।
বাল্যকালে
পুত্র কন্যা বিয়া নাহি দিবে।
পথ
ঘাট ঘর দ্বার পবিত্র রাখিবে।। গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৫২৯
তিনি বাল্যকালে পুত্র কন্যাকে বিবাহ দিতে মানা করেন এবং পথ
ঘাট সব পরিস্কার রাখার নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে দেখতে পাই- ১৯০৮ সালে ঠিক হয়, কোনো নমঃশূদ্র বিশ বছরের কম বয়সের ছেলে এবং দশ
বছরের কম বয়সের মেয়ের বিবাহ দিতে পারবেনা। ১৯১০ সালে বিধবা বিবাহ প্রচলন
করেন। আর বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, “আমি জন্মগত কারণে নমঃ জাতির
মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও আমি তাদের, যারা
পদদলিত, পীড়িত, অত্যাচারিত, যাদের সব সময় দুঃখ-কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। যাদেরকে
দেখলে উচ্চবর্ণীয়রা অচ্ছুৎ বলে ঘৃণা করে।
যাদের পেটে খাবার নেই। শিক্ষার আলো যাদের মধ্যে পৌঁছায়নি। যাদের সহায় সম্বল বলে
কিছুই নেই। তারাই হচ্ছে আমার আপন জন।”
আত্মোন্নতি অগ্রভাগে প্রয়োজন তাই।
বিদ্যাচাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃ.
৫৭৩
শুধু
শিক্ষিও ও সম্পদ শালী হলেই হবে না। আপনাকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকেও দখল করতে হবে। কারণ,
সেখানেই শাসন ব্যবস্থার ও দেশের প্রগতির সব ক্ষমতা গচ্ছিত আছে। আপনাকে সেটাকে
পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হবে।
সকল মানুষ সমান ভেদাভেদ নেইঃ- মানুষ সবার শ্রেষ্ঠ ভেদাভেদ ইষ্টানিষ্ট
কর্মগুণে মান পায় জন্মগুণে নয়।
-গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৭৩
গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে, সকল মানুষই সমান। মানুষের মধ্যে
কোনো উচু নিচু ভেদাভেদ নেই; নেই কোনো জাতির বিচার। জন্ম নয়, কর্ম গুণই প্রধান। এই কথার
মধ্যে দিয়ে তিনি বৈদিকতার জাতিপ্রথাকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
নরাকারে ভূমণ্ডলে যত জন আছে।
‘এক জাতি’ বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।
-গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ২০১
এই
বিশ্বে যতো মানুষ আছে তারা সকলে আমার কাছে একজাতি। অর্থাৎ মানবজাতি বলে মান্যতা
পাবে।
বিশ্বভরে এই নীতি দেখি
পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে
তার ঈশ্বর।। (গু. চ. পৃঃ ৫২৯)
ঈশ্বর এখানে
কোন অলীক কেউ নন। তিনি হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। এই নিপীড়িত
বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তা হচ্ছেন,- মহামানব
গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ
ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা
সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা
সাবিত্রীবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে, ফতেমা শেখ, বেগম রোকেয়া, বিরসা মুণ্ডা,
সিধু-কানু ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এরকম দেখতে পাই- যেমন- মার্টিন
লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা ইত্যাদি।
১৯৩৭ সালে ৯১ বছর বয়সে ২৬ শে মার্চ গুরুচাঁদ ঠাকুরের মহাপরিনির্বাণ
হয়। স্মৃতি সভায় নেতাজী
সুভাষচন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে “মহামানব” হিসাবে শ্রদ্ধা নিবেদন
করেছিলেন।
Comments
Post a Comment