আপনি কি আত্মার শান্তি কামনা করেন? জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করেন?
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
     আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই কেউ মারা গেলে তার উদ্দেশ্যে বলা হয়- ‘আত্মার শান্তি
কামনা করি’। প্রশ্ন হচ্ছে এই আত্মা কী? মৃত্যুর পরে কি সত্যি সত্যি তার
কোনো অস্তিত্ব থাকে? 
     আবার জন্মান্তরের কথাও আমরা শুনতে পাই। সেটা কী? প্রথমেই জানাই এই মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব এবং জন্মান্তরের কথা বিশেষ করে
বৈদিক ধর্মে দেখতে পাই।
তবে মতুয়া মতে মৃত্যুর পরে আত্মার কোনো অস্তিত্ব আছে
কি? 
আর বুদ্ধের মতে জন্মান্তর বলতে কি বোঝানো হয়েছেন?
আসুন তাহলে জেনে নেই এই বিষয়ের বিশ্লেষণ; আমার লেখা বই “গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও মুক্তির দিশা” – থেকে। 
মতুয়া দর্শনে দেহ তত্ত্বের ব্যাখ্যাঃ-
এই বিষয়ের প্রথমেই জানিয়ে দেই যে, এই দেহতত্ত্ব কিন্তু বৈদিক ভাবনার নয়। এটা মতুয়া দর্শনের হলেও এটা বৈজ্ঞানিক ও
সার্বজনীন ব্যাখ্যা। এখানে বৈদিকতার কোনো স্থান নেই।
মাটি
দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়।
দেহ
হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।।
এবে
শুন কেবা কান্দে কিসের মায়ায়।
ব্রহ্মের
বিকারে সৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ড যে হয়।।
ব্রহ্মের
বিকার ভাগ হ’ল পঞ্চ ক্রমে।
ক্ষিতি
অপঃ তেজঃ মরুদ্বোম্পঞ্চ নামে।।
ব্রহ্ম
ধরে ‘আত্মা’ নাম
তত্ত্বে দেহ কয়।
উভয়ে
মিলন হ’লে জীব
সৃষ্টি হয়।।
ভূত’ত আধার মাত্র দেহ নাম
ধরে।
চিৎ
শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।
-গুরুচাঁদ চরিত-
পৃষ্ঠা নং 354/355
    মতুয়া ধর্ম দর্শনের আকর গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ ও ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’–এ এমনভাবে কিছু মণি-মুক্তা
সাজানো আছে, যেটাকে খুঁজতে হলে এর গহ্বরে
প্রবেশ করতে হবে দক্ষ ডুবুরির মতো। যে কথা লীলামৃতে কবি তারক সরকার
বলেছেন-
শ্রোতাগণ হংসবৎ,     দোষ ছাড়ি গুণ যত
     দুগ্ধবৎ করুণ গ্রহণ। শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত -পৃঃ ৩৯
এবার আমরা উপরের কথাগুলির ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
     প্রকৃতি পাঁচটি উপাদানে গঠিত। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। প্রকৃতির এই
পাঁচটি উপাদানের চারটি উপাদানে গঠিত হয় জীব। ব্যোম বা মহাশূন্য জীব সৃষ্টির জন্য
সরাসরি প্রয়োজন হয়না। প্রকৃতির এই চারটি উপাদানের আনুপাতিক মিশ্রণে প্রথমে জীবের
উদ্ভব হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে কোটি কোটি বছর পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। এই
প্রাণীর মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে মানব। এই মানব বা যে কোনো প্রাণী, পুরুষ ও নারীর শুক্রানু ও ডিম্বানুর উপযুক্ত ‘উভয়ে মিলন হ’লে জীব সৃষ্টি হয়’। জীবের মধ্যে চেতনার সঞ্চার হয়। সেই চেতনাকে কেউ
ব্রহ্ম বলেন। আবার কেউ আত্মাও বলেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কবি এখানে বলেছেন- 
মাটি দিয়ে গড়া দেহ মাটিতেই লয়।
দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।।
    সেটা কিভাবে ঘটছে? তাহলে আসুন সেই
ব্যাখ্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। আমি প্রথমেই জানিয়েছি প্রকৃতির পাঁচটি উপাদান
বা পঞ্চ ভুতের চার ভুত লাগে জীব সৃষ্টির জন্য। যার মধ্যে ক্ষিতি বা মাটিও আছে।
একটু গভীরভাবে ভাবলে আমরা দেখতে পাই- শক্তির উৎস হচ্ছে ‘তেজ’ বা সূর্য। এই সূর্য
থেকেই প্রতিটি প্রাণী বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। প্রশ্ন আসে
কিভাবে? পাঠকগণ আপনারা
মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান বইতে জেনে থাকবেন উদ্ভিদ তার খাদ্য উৎপন্ন করে
সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ায় পাতার
মাধ্যমে। তার থেকেই সূর্যের শক্তি সঞ্চারিত হয় উদ্ভিদের মধ্যে। পশু বা প্রাণীরা
বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সেই উদ্ভিজ্জ গ্রহণ করে। তখন
শক্তিটা উদ্ভিজ্জ থেকে পশু বা প্রাণীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এই হচ্ছে শক্তির সঞ্চারণ
প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পশু বা প্রাণীরা বেঁচে থাকে। তারপর প্রকৃতির
নিয়মেই আবার এক সময় মারা যায় বা চেতনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য
প্রথম উপাদান দেখলাম ‘তেজ’ বা শক্তি। দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে- ‘মরুৎ’ বা বায়ু।
প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য বায়ু একান্ত আবশ্যক। তৃতীয় উপাদান হচ্ছে- ‘অপ্’
বা জল। প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য জলও আবশ্যক। এবার প্রশ্ন আসতে পারে তিনটি উপাদান
সম্পর্কে তো জানলাম কিন্তু চতুর্থ উপাদান ‘ক্ষিতি’ বা মাটি আমাদের সঙ্গে কীভাবে
জড়িয়ে আছে?
    কোনো প্রাণীর মৃত্যু হলে আমরা দেখতে পাই বা বুঝতে পারি, যে সব উপাদানের ফলে প্রাণীর উদ্ভব হয়েছিল, মৃত্যুর পরে আবার স্ব স্ব উপাদানে মিলিত হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বায়ু বন্ধ
হয়ে যায়। শরীরে প্রকৃতির মতোই চার ভাগের তিন ভাগ জল আছে। সেই জল শরীর দাহ করা বা
কবর দেওয়ার ফলে ধীরে ধীরে চলে যায়। আর পড়ে থাকে শুধু মাংস ও হাড়। সেই মাংস বা হাড়
এক সময়ে মাটিতে মিশে যায়। অর্থাৎ প্রাণীর শরীরে যে মাংস ও হাড় সেসব বাস্তবে মাটিরই
অংশ। তাই কবি এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ভাবনা ও বিচার বুদ্ধির সমন্বয় রেখে প্রকৃতির
বৈজ্ঞানিক নিয়মকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যার জন্য বলেছেন- ‘মাটি দিয়ে গড়া দেহ
মাটিতেই লয়। দেহ হতে দেহ তাই প্রকৃতি গড়ায়।।’
 
     পরে আমরা দেখতে পাই- আমরা যে মায়ার জ্বালে জড়িয়ে আছি, সেই মায়ার জ্বালটা হচ্ছে- পিতামাতার থেকে সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তিতে এই একই
সূত্র চলতে থাকে। যে সূত্রের সঙ্গে এই মায়ার জ্বালও নিবিড় ভাবে যুক্ত আছে।
ব্রহ্ম ধরে ‘আত্মা’ নাম তত্ত্বে দেহ কয়।
উভয়ে মিলন হ’লে জীব সৃষ্টি হয়।।  
     অর্থাৎ পিতামাতার চেতনার (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু)
মিলনের ফলে জীবের সৃষ্টি হয়। সেই চেতনাকে ব্রহ্ম বা আত্মা বলা হয়। যে চেতনা দেহের
মধ্যে সদা অনুভুত হয়। আবার বলা হয়েছে, 
ভূত’ত আধার মাত্র দেহ নাম ধরে। 
চিৎ শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।
    পূর্বেই বলেছি, চার ভূতের যে আনুপাতিক মিলনের
ফলে প্রাণীর জন্ম হয়। সেই প্রাণী আকার বা দেহ নাম ধারণ করে। আর এই দেহের মধ্যে
যে চিৎ শক্তি বা চেতনা শক্তি আছে, তাকেই আত্মা বলা
হয়েছে। যে চিৎশক্তি বা চেতনা শক্তি আমৃত্যু নিরন্তর চেতনা প্রবাহকে জারি রাখে।
এ বিষয়ে আমরা লীলামৃতে ও দেখতে পাই-
তুমি-স্থুল আমি-সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন।।
দেহ আত্মা মোরা দোঁহে মূলে নহি ভিন্ন।।
-(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত,
পৃঃ ৭৩, প্রকাশ, ২০০৯, ঠাকুর নগর)
    এখানেও আমরা দেখতে পাই ‘তুমি স্থুল’ অর্থাৎ শরীর বা দেহ হচ্ছে স্থুল। ‘আমি
সূক্ষ্ম’ আমি এখানে চেতনা। এই শরীর ও চেতনা উভয়ে একত্রে অবস্থান করে। একের অবশানে
অন্যের ও অবশান বা মৃত্যু। অর্থাৎ শরীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেহের মধ্যে অবস্থিত
চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। আর এই অবশানের পর আবার উপাদানগুলি স্ব স্ব স্থানে
বিলিন হয়ে যায়।
     তবে ভাবুক মানুষের মনের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা জাগৃত না হলে এই সহজ তত্ত্ব
তাঁরা বুঝতে চাইবেন না। তাঁরা ব্রাহ্মন্যবাদী চিন্তা ধারার ভাইরাসকেই সব সময়
কার্যকরী করার চেষ্টা করবেন। যদিও সামান্য একটু বিচার করলেই এই চরম সত্যকে বোঝা
যায়। কারণ, জীবের সৃষ্টির জন্য যেমন
প্রকৃতি নির্ভর। তেমনি বেঁচে থাকার জন্য ও সর্বক্ষণ প্রকৃতি নির্ভর। সেটা হচ্ছে-
খাদ্য, পানীয়, বায়ু ও ক্ষনিজ
পদার্থ বা মৃত্যিকা।
    গুরুচাঁদ ঠাকুরের তৃতীয় পুত্র উপেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুতে পুত্র শোকে
মুহ্যমান সত্যভামা যখন মৃত পুত্রকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে
বিলাপ করছিলেন। তখন ঠাকুর বলেন-
“মরা শব লাগি কান্দ’ ওরে জ্ঞানহীনা।
দেহ ছেড়ে গেলে প্রাণ কখনো ফিরে না।। 
মরণ জানিবে ধ্রুব দেহধারীর পক্ষে।”-গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ৩৪৬
     বৈদিক গ্রন্থানুসারে মৃত্যু, শুধু শরীরের।
জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করার মতো। কর্ম অনুযায়ী স্বর্গ বা নরকে
স্থান হয়। আত্মার কোনো বিনাশ হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাই যদি হয় তবে কেন মৃতের উদ্দেশে ঘটা করে জিনিসপত্র দান, মন্ত্রপাঠ? আসলে এসবই বৈদিকবাদীদের ধর্মীয়
ব্যাবসা। গুরুচাঁদ ঠাকুর এই বৈদিক ধর্মীয় ব্যাবসাকে বলেছেন- ‘কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব। স্বার্থ বসে অর্থ লোভী যতো ভন্ড সব।’
     পরিবারের যেকেউ মারা গেলে সেটা বড় একটা শোকের ছায়া নিয়ে আসে। কিন্তু যদি
কেউ একবার মারা যায়, সে আর ফিরে আসেনা। এটাই
প্রকৃতির নিয়ম। তাই তিনি স্বীয় পুত্রের অকাল মৃত্যুতে জীবন সাথীকে শান্তনা দিয়ে
জানিয়েছেন, জীনব মৃত্যু এটা ধ্রুব সত্য। জন্মিলে তো একদিন তাকে
মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে।
ধরিয়া মানব দেহ বাঁচিয়া রহেনা কেহ,
বিধাতার এই নীতি না হবে লঙ্ঘন।।
অসম্ভব কথা এই দেহ ধরে মৃত্যু নেই
মৃত্যুর অধীনে মাত্র জীব দেহ ধরে।
মরণ পরম সত্য মৃত্যু বুকে এই তত্ত্ব
অনিত্য সংসারে সব সৃষ্টির বিকারে।। গু. চ. পৃঃ ৬৮
    জন্ম মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম। কেউ জন্ম গ্রহণ করলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রকৃতির এই নিয়মকে কেউ কোনো প্রকারেই লঙ্ঘন করতে
পারেনা।  
গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই কথার বলার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জীবন সঙ্গীনীর জন্যই নয়। সমস্ত মানবজাতিকে জন্ম মৃত্যুর প্রাকৃতিক নিয়মকে বোঝার জন্য। আর এই নিয়মের বাইরের কথা যারা বলে অর্থ উপার্জন করে তাদের ভণ্ডামীকে বোঝার জন্য। যদিও গুরুচাঁদ ঠাকুরের এই চিরন্তন ও বৈজ্ঞানিক ভাবনাকে এখনো মানুষেরা বুঝলো না। কারণ তারা পুথিগত শিক্ষা পেলেও চেতনা জাগরণের শিক্ষা থেকে অনেক দূরে। এখনো তারা বৈদিকতার জ্বালে ফেঁসে আছে।
এবার বুদ্ধ দর্শনের জন্মান্তর সম্পর্কেঃ-
     অনেকেই বলেন, বুদ্ধ দর্শনে জন্মান্তরকে মেনে নেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে সেটা কীভাবে? তার ব্যাখ্যা কী?
     বুদ্ধ দর্শনে যে জন্মান্তরবাদের কথা বলা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক। বুদ্ধ মৃত্যুর পরে আত্মাকে মেনে নেননি। তিনি
বলেছেন- পিতা-মাতা থেকে যে সন্তানের জন্ম হয়, গাছ, পাতা বা বিভিন্ন উদ্ভিদের থেকে যে অঙ্গজ নতুন গাছের জন্ম হয় সেটাকে তিনি
জন্মান্তর বলেছেন। আবার বীজ থেকে যেমন গাছের জন্ম হয়, সেটাকে তিনি জন্মান্তর বলেছেন। বৈদিক  জন্মান্তরবাদকে তিনি কোনোরূপ প্রশ্রয় দেননি।
একটু ভাবুন, সঠিক জ্ঞানের উপলব্ধি
পাওয়া যাবে।     
    এই লেখা পড়ার পর সিদ্ধান্ত নিন এর পরে কোনো মৃত ব্যাক্তির আত্মার শান্তি
কামনা করবেন কি? না কি তার স্মৃতির প্রতি
শ্রদ্ধা জানাবেন? বৈদিক জন্মান্তরকে কি ত্যাগ করবেন? না কি অলৌকিকতাকে এখনো বয়ে নিয়ে
বেড়াবেন? এরপরেও এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই করবেন। সাধ্যমতো
উত্তর দিতে চেষ্টা করব।
_______
Comments
Post a Comment