*হরিনামের রথ*
লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়
মতুয়াদের মধ্যেও ‘রথ’ এর
সংস্কৃতির নিদর্শন খুঁজে পাচ্ছি। লিখিত নয়, সামাজিকভাবে প্রচলিত। তবে এই রথ বৈদিক মতের তিথি অনুসারে
চালানো হলেও এর মাহাত্ত্ব কিন্তু বৈদিক নয়। আসুন এ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা যাক।
প্রথমেই জানাই, বাংলাদেশের Jagoran Patrika -এর সম্পাদক ও মতুয়া গবেষক Shashanka Bar মহাশয় এই বিষয়ে তাঁর টিম
নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে খোঁজ পেয়েছেন – ‘বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার শ্রীপুর গ্রামে দশরথ বর
(বিশ্বাস) নামে একজন মহা হরিভক্ত বাস করতেন। একদিন তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর হরিচাঁদকে
সুসজ্জিত রথে চড়িয়ে ভ্রমণ করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর বাড়ির লোকজন তাঁকে ১৬
চাকার একটি বৃহৎ রথ গড়িয়ে দেন। এরপর রথযাত্রার দিন সেই রথটিকে তিনি ‘হরিনামের রথ’
বলেই নাকি চালিত করেছিলেন!
‘আদি রথটি ১২৮৪ বঙ্গাব্দে (ইং ১৮৭৭ সালে) নির্মিত হয়েছিলো। তবে সেই ঐতিহাসিক রথটিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিলো। পরে সেই রথের আদলে নতুন আর একটি রথ তৈরি করা হয়।’
এই অনুসন্ধানী টিম সেখানকার
রথের যে ছবি দিয়েছেন, সেটা
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমার আলোচনা এই রথের ছবির সূত্র ধরে করতে চাই। তারপূর্বে আর
একটি কথা জানাতে চাই,
আপনারা অনেকেই জানেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘রথ সংক্রান্ত’ যে কথা
লিখেছেন, তার মহত্ত্ব হচ্ছে- রথের চাকা হচ্ছে প্রগতির চাকা। যে
রথের দড়ি ধরে সমাজের বঞ্চিতরা টানলেই সেই প্রগতি হয়। এখানে আমরা আরো একটি
প্রসঙ্গের উল্লেখ করতে পারি, সেটাও
‘চক্র’। যার নাম ‘ধম্মচক্র’। অর্থাৎ সমতা, স্বতন্ত্রতা, বন্ধুতা ও ন্যায় এর প্রগতির চাকা। যে চাকার
নিদর্শন আমরা ভারতের জাতীয় পতাকায় দেখতে পাই ‘অশোক চক্র’ হিসাবে।
এই ‘রথের চাকা’, ‘রথের দড়ি’ বা ‘ধম্মচক্র’ বা ‘অশোক চক্র’ সবকিছুর মূল হচ্ছে- ‘প্রগতি’। এই প্রগতি হচ্ছে- সমস্ত অসমতাকে দূর করে সমতার প্রগতি।
মতুয়া মতে আমরা যে রথের নিদর্শন পাই সেটাও সেই প্রগতির নির্দেশনা। এই
নির্দেশনার জন্যই সমাজে অসমতার প্রাচীর ভেদ করে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর এনেছেন
‘প্রগতির দর্শন’। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি- ‘রথে বসে আছেন- পতিত পাবন
হরিচাঁদ ঠাকুর ও
শান্তিমাতা।’
এই রথের দড়ি ধরে টানছেন মতুয়া আদর্শে অনুপ্রাণিত ভক্তগণ। অর্থাৎ হরিচাঁদ
ঠাকুরের ‘সত্য প্রেম ও পবিত্রতা’র বাণীকে দেশ থেকে দেশান্তরে পৌঁছে দেবার জন্য
দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এই মতুয়া
অনুরাগীরা।
এই রথের মাহাত্ত্বকে আমি
এইভাবেই মনে করছি। এর সঙ্গে বৈদিক ভাবনার রথের কোনো সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। এটা ‘বৈদিক রথের
দিনে’ বিকল্প ব্যবস্থা। যেটা গুরুচাঁদ ঠাকুরও কালীপূজার দিনে বিকল্প ব্যবস্থা
হিসাবে ঐ দিনে ‘ঠাকুর উতসব’ –এর প্রচলন করেছিলেন লক্ষ্মীখালীতে ১৯০৮ সালে।
প্রশ্ন হচ্ছে- হরিচাঁদ ঠাকুর
ও গুরুচাঁদ ঠাকুর পতীতদের উদ্ধার করে সামাজিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, রাজনৈতিক
ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই সুফলও অনুরাগীরা উপভোগ করছেন। কিন্তু এই
অনুরাগীদের দিশা আজ কোন দিকে? তাঁরা
কি দিক্ভ্রান্ত?
নাকি লালসা গ্রস্থ? তাঁরা কেন পদে পদে আদর্শ চ্যুত হয়ে বৈদিকতার
জ্বালে ফেঁসে যাচ্ছে?
আজ সময় চলে যাচ্ছে এই দর্শনের
চাকাকে সঠিক দিশায় টেনে নিয়ে যাবার জন্য নতুন প্রজন্মকে সঠিক বিবেকবান হয়ে
সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার। চাকার দড়িটা যাদের হাতে থাকবে তাঁদেরই কিন্তু এই দায়িত্ব
গ্রহণ করতে হবে। ‘আদর্শ বা দর্শন নিয়েতো হরি-গুরুচাঁদ বসে আছেন; কিন্তু আপনারা সেটাকে কোথায় টেনে নিয়ে
যাচ্ছেন? ডুবাতে না জাগাতে?
_(ফটো ও তথ্য সংগ্রহ- সৌজন্যে - Jagoran Patrika )
____________
বৌদ্ধ দর্শনে রথের সন্ধান করেছেন প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্র প্রসাদ সিং
Comments
Post a Comment