Skip to main content

মতুয়া নামের উৎপত্তি। লেখক – জগদীশ রায়

 


মতুয়া নামের উৎপত্তি (১)

লেখক – জগদীশ রায়

শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত -এর ৬৬ পৃষ্ঠায় “ভক্তগণের মতুয়া খ্যাতিববরণ”(১ম সংস্করণ) -এ দেখতে পাই, 

ওঢ়াকাঁদি রাউৎখামার মল্লকাঁদি।

   ভ্রমণ করেন হরিচাঁদ গুণনিধি।।

   সঙ্গে ভক্তগণ ফিরে পরম আনন্দে।

   নাম সংকীর্ত্তন গান হ’তেছে স্বচ্ছন্দে।।

 

হেন কালে তিন জন ব্রাহ্মণ আসিল।

সভামধ্যে আসিয়া তাহারা দাণ্ডাইল।।

সবে বলে বসুন বিছানা আছে অই।

তারা বলে হরিচাঁদ প্রভু তিনি কই।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

এরকম সময় তিন জন ব্রাহ্মণ সভায় উপস্থিত হয়। তারা জানতে চায় ‘ঠাকুর’ কে? সভার লোকেরা ঠাকুরকে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু এই তিনি জনের কেউই ঠাকুরকে প্রণাম করছে না দেখে সভার থেকে বলা হয় যে, ‘ঠাকুর দেখিলে পরে প্রণামিতে হয়।’ তারপর এক এক করে দুজনে প্রণাম করে। কিন্তু অন্য জন্য দাঁড়িয়েই থাকে। তখন তার ঘাড় ধরে জোর করে প্রণাম করতে বাধ্য করানো হয়। কিন্তু এই ঘটনা দেখে – ‘সভাসদ বিপ্র যত রাগান্বিত হ’ল।’ আর এই খবর জানার পর গ্রামের অনেক লোকই রেগে যায়। তখন তারা ঠাকুরের সম্পর্কে বিভিন্ন কটু কথা বলতে শুরু করে। তারা বলে – এই ঠাকুর যা শুরু করেছে এসবই সামাজিকভাবে অবৈধ। এরা কোনো বিধি মানে না। তাই সকলে আজ হতে প্রতিজ্ঞা করতে হবে – এদের সঙ্গে কোনো সমাজিক কাজ করা চলবে না।

অবৈধ সকল কাজ বিধি নাহি মানে।

সমাজের বাধ্য নয় এই কয় জনে।।

শুন সবে প্রতিজ্ঞা করিনু আজ হ’তে।

ইহাদের সঙ্গে না করিব সামাজিতে।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

সামাজিকতা কেন করবে না? কারণ, এরা দেবতা ও ব্রাহ্মণ মানে না। এরা সারাদিন কিসব হরি হরি বলতে থাকে। এদের মত ও পথ সম্পুর্ণ আলাদা।

নাহি মানে দেব দ্বিজ আলাহিদা পথ।

ইহারা হ’য়েছে এক হরিবলা মত।।

আহারাদি না করিব ইহাদের সঙ্গ।

অদ্য হ’তে গ্রাম ভাব করিলাম ভঙ্গ।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

এদের সঙ্গে খাওয়া যাবে না। তাই হরি বোলারা আর গ্রামের অন্যরা আলাদা। তাছাড়া এরা কোনো বেদের বিধান বা নিয়ম কানুন মানে না। সারাদিন শুধু হরিবোল বলে লাফাতে থাকে।

মতুয়া হইল এরা কি ধন পাইয়া।

বেদবিধি না মানে ফিরেছে লাফাইয়া।। হরিলীলামৃত১ম সংস্করণ পৃ. ৮১

 

মেতে যায় হরি বলে ভঙ্গী ক’ব কত।

হরি বলে মেতে থাকে ও বেটারা “মতো”।।

বেদ-বিধি নাহি মানে না মানে ব্রাহ্মণ।

নিশ্চয় করিতে হবে এ দলে শাসন।।  হরিলীলামৃত ঠাকুর নগর, ১০ম সংস্করণ পৃ. ৯৪

 

এরা যে কতো ভঙ্গী করে নাচা নাচি করে সেটা বলে শেষ করা যাবে না। এদেরকে শুধু  আলাদা করে রাখলেই হবে না। এদেরকে শাসনও করতে হবে।  

     শুধু তাই নয়, তারা এই হরিবোলাদের দেখলে উপহাস করা শুরু করে। অর্থাৎ ঘৃণা জনক টিটকারি দিতে থাকে। তারা বলে এরা সব পাগল হয়ে গেছে। এদের কোনো কাণ্ড জ্ঞান নেই।

   এই হরিবোলাদের মতো মতো বলে উপহাস করা হয়। কেউ আবার বলে এরা জাতি নাশা মতুয়া। তাই ধীরে ধীরে সারা দেশে কেউ যদি হরিনামে মত্ত হয় তাকে উপহাস করে মতো মতো বলা হয়।

হরিবোলা দেখে উপহাস করে কত।

সবে বলে ও বেটারা হরি বোলা ম’তো।।

কেহ বলে জাতি নাশা সকল মতুয়া।

দেশ ভরি শব্দ হ’ল মতুয়া মতুয়া।।

অন্য কেহ যদি হয় হরিনামে রত।

সবে করে উপহাস অই বেটা ম’তো।।(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

 

   এইভাবে এই হরিবোলাদের উপাধি হয়ে গেল ‘মতুয়া’।

অন্য অন্য গ্রাম আড়োকাঁদি ওঢ়াকাঁদি।

সে হইতে হ’য়ে গেল মতুয়া উপাধি।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

 

হরিবোলাদের নিয়ে এই ভাবে টিটকারি, উপহাস দেখে তখন পতিত পাবন হরিচাঁদ দেখলেন আমার ভক্তগণকে যখন এইভাবে তিরস্কার শুনতে হচ্ছে তাহলে আমরা আর এই ব্রাহ্মণ্যবাদের কবলে থাকব না। তাই তিনি ঘোষণা করলেন-

তাহা শুনি ডেকে বলে প্রভু হরিচাঁদ।

ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা মতুয়া আখ্যান।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৬৭)

-অর্থাৎ আমরা ভিন্ন সম্প্রদায়। আমাদের ধর্ম মতুয়া ধর্ম।

 

পাঠ ও শ্রোতারা দেখছেন, আমি কোটেশনগুলোর একই পৃষ্ঠা ক্রমাঙ্ক দিয়েছি। কেন? কারণ, মতুয়াদের উৎপত্তির এই ইতিহাস লীলামৃতের পরবর্তী সংস্করণে নেই। সেখানে মনগড়া কাহিনির অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। (উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন ২০০৯ এ ঠাকুর নগর ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠায়।)

 

এখানে প্রশ্ন আসে তাহলে মতুয়া কারা?

উপরের তথ্য থেকে আমরা এককথায় বলতে পারি, যারা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ মানে না তারাই মতুয়া।

প্রশ্ন আসে এটা কি আলাদা ধর্ম?

যাদের ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। যাদের মতো মতো বলে উপহাস বা টিটকারী করা হতো। তারা নিশ্চয় সেই ধর্মের অঙ্গ হতে পারে না। তাই এটা সম্পূর্ণ বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ বর্জিত আলাদা ধর্ম। এবিষয়ে শুনুন বিরাট বৈরাগ্য কী বলেন-


 

মতুয়া নামের উৎপত্তি (২) 

গুরুচাঁদ চরিত এর ১৮৪ পৃষ্ঠায় ‘ডক্টর মীডের সহিত প্রভুর ভাবালাপ ও ডক্ট মীডের চিন্তা’ –  বিষয়ে আমরা দেখতে পাই-গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে মীড সাহেব প্রথমবার আসেন। সাক্ষাৎ করেন। কথায় কথায় হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তদেরকে দেখিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন –

সবার কাঙ্গাল বেশ এক-বস্ত্রধারী।

অথচ নহে’ত কেহ কড়ার ভিখারী।।

তেজদীপ্ত অঙ্গ হ’তে জ্যোতিঃ বাহিরায়।

মেষ-শিশু-সম যেন চাহে নিরুপায়।।

দীর্ঘ কেশ শ্মশ্রু বলিষ্ঠ গঠন।

হীন বলে তার মধ্যে নহে কোন জন।

-গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেন, সকলেই দারিদ্রের মধ্যে কাঙ্গাল অবস্থায় এক বস্ত্রে কোনোমতে জীবন ধারন করছে। তবে এতো কষ্টে থেকেও এরা কিন্তু কেউ ভিক্ষা করে না। এদের শরীরের গঠন দেখে বোঝা যায় যে, এদের ভিতরে একটা তেজদীপ্ত জ্যোতি বেরিয়ে আসছে। যদিও এরা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মেষ শিশুর মত হয়ে আছে। এদেরকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য নাপিত চুল কাটে না। তাই লম্বা লম্বা চুল। সমাজ এদের হীন মনে করলেও এরা কিন্ত নিজদের কখনও হীন মনে করে না।

আলোচনা শেষে ফলাহার করে মীড সাহেব তাঁর তাঁবুতে চলে যান। কিন্তু সন্ধার সময় তিনি অনেক লোকের আওয়াজ শুনতে পান। আর শিঙ্গা শাঁখের আওয়াজও পান। তখন তিনি তার খান্‌সামার কাছে এই শব্দের কারণ জানতে চান।  তখন খানসামা বলেন-

“হুজুরের গোচারার্থে নিবেদন করি।

মতুয়ারা উচ্চশব্দে বলিতেছে হরি।।

অর্থাৎ এই শব্দ মতুয়ারা করছেন। একথা শুনে তখন মীড সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করেন-

বল মতুয়া কাহারা?’ – অর্থাৎ তিনি মতুয়া কারা সেসম্পর্কে জানতে চান। তখন-

ভৃত্য বলে “হরিচান্দের ভক্ত যাহারা।

ঠাকুর বাড়ী যারা দাঁড়াইয়া ছিল।

দীর্ঘ কেশ দীনবেশ আঁখি ছল ছল।।”

-অর্থাৎ আপনি আজ ঠাকুর বাড়িতে যাঁদের দেখেছেন- চুল লম্বা চোখ ছল ছল করছিল অতি দারিদ্র অবস্থায় এরা কোনো মতে বেঁচে আছে। এরাই ‘মতুয়া’। এরাই ঠাকুরের গান করছেন।

তখন – সাহেব বলিছে “কেন মতুয়া উপাধি।

        ভক্ত কেন নাহি বল ভক্ত ওরা যদি?”

ওঁদের কনে মতুয়া বলছেন? ভক্ত কেন বলছেন না? ওরাতো কারো অনুরাগী।

তখন – ভৃত্য বলে “শুনিয়াছি এই পরিচয়।

        হরিনামে তারা সবে মাতোয়ারা হয়।।

        জ্ঞান শূন্য হরিনামে করয় কীর্ত্তন।

মাতোয়ারা তাই “ম’তো বলে সর্ব্বজন।।” -গুরুচাঁদ চরিত পৃ. ১৮৭

ভৃত্য তখন বলেন  ‘আমি শুনেছি যে,  হরিনামে তাঁরা মেতে থাকেন। যখন তারা একত্রে এই হরিনামে মত্ত হন তখন তাঁদের আর কোনো শোক দুঃখ থাকে না। আত্মহারা হয়ে যান। তার জন্য সকলে এঁদেরকে মতুয়া বলে সম্বোধন করে।

এ সম্পর্কে আমরা দেখে নেই –মতুয়া শব্দের ব্যখ্যা --- কাঞ্জিলালের কাছ থেকে।

 



 

প্রশ্ন আসে শুধু কি নমঃশূদ্ররাই মতুয়া না কি অন্যান্যরাও?

শুধু নমঃশূদ্র নয়      যারা যারা দুঃখী রয়

     সবে মিলি একসাথে করে ধর্ম্ম-যুদ্ধ।

তেলী মালী কুম্ভকার   জোলা তাঁতী মালাকার

     ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য আর আর নবশাখ।

ব্যথিত মুসলমান     হ’ল কত আগুয়ান

   হরিচাঁদে পেয়ে তারা বলে ‘মোরা এক’।।

তাঁর ভাবে ভাব ধরা তাঁর প্রেমে মাতোয়ারা

    “মতুয়া” উপাধি কয় সে ভাব দেখিয়া।। গু.চ. ১২৬

শুধু নমঃশূদ্ররা নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যারা যারা দুঃখী। যাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়ে। সে হোক না তেলী মালী কুম্বকার জোলা তাঁতী মালাকার সম্প্রদায়ের অথবা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য বা নবশাখ বর্ণের। অথবা ব্যথিত মুসলমান ধর্মের লোক। যাঁরাই হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুরাগী সকলেই একত্রিত। কেউ ভিন্ন নয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভাবনায় ভাবিত হয়ে তিনি যে জাত-পাত মুক্ত প্রেমের আদর্শের আবদ্ধ করছেন, যাঁরা তাঁর এই দর্শনে মাতোরা হয়েছেন তাঁরা সকলেই “মতুয়া”।

তাই এইভাবে -

প্রেম অনুরাগে সব ভকত জুটিল।

“মতুয়া” বলিয়া দেশে ঘোষণা হইল।। লীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃ. ৫৯ 

_________________________

 

 

 

 

Comments