বুদ্ধ-হরিচাঁদ ও আম্বেদকর-এর
আন্দোলনের সম্পর্ক
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
মতুয়া আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা
প্রশ্ন প্রায়ই দেখতে পাই যে, মতুয়া আন্দোলনের সঙ্গে বুদ্ধকে এবং
আম্ববেদকরকে কেন সংযুক্ত করা হচ্ছে। বিষয়টাকে সাধারণ দৃশটিতে বিশ্লেষণ করলে
কিন্তু সঠিক তাৎপর্যকে অনুধাবন করা যাবে না। কারণ, যেকোন ঘটনার পিছনে যেমন কারণ থাকে, আর সেই কারণের
সঙ্গে জুড়ে থাকে তার অস্তিত্ত্বের প্রশ্ন। আর একটি কথা এই আলোচনার ভিতরে যত প্রবেশ করবেন, কিছু কিছু
পাঠকের মনে হতে পারে আমি ‘মতুয়া ধর্ম’ কে বৌদ্ধ ধম্মে রূপান্তরিত করার চেষ্টা
করছি। আমি যে যুক্তি ও তথ্য উপস্থাপন করেছি সেটার উদ্দেশ্য শুধু আপনাদের কাছে তুলে
ধরা। গ্রহণ বা বর্জন আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
আমরা
প্রথমেই দেখে নেই মতুয়া আন্দোলন বা হরি-গুরুচাঁদের
সঙ্গে বুদ্ধের কি সম্পর্ক আছে।
আমি প্রথমেই এই ধরনের প্রশ্ন কর্তাদের অনুরোধ করব যে, তাঁরা যেন যুক্তিবাদী মানসিকতা নিয়ে মতুয়া আদর্শকে বিচার বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন। আর এই বিচার বিশ্লেষণের জন্য তাদের ‘হরিলীলামৃত’কে গভীর ভাবে অধ্যায়ন করা দরকার। তা না হলে এই লেখা তাদের কাছে তেমন একটা সন্তোষজনক নাও হতে পারে। ‘লীলামৃত’-এর ১৫ পৃষ্ঠায়- ‘শ্রীশ্রীহরিঠাকুরের জন্ম বিবরণ’ (প্রথম সংস্করণ ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) -এ লেখা আছে –
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ
জন্য।
যশোমন্ত
গৃহে হরি হৈল অবর্তীণ ।।
অমরা এখানে দেখতে পাই যে, বুদ্ধের
কামনা কে পূর্ণ করার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর জন্ম গ্রহণ করেছেন বা অবতীর্ন হয়েছেন। আর্থাৎ
বুদ্ধ-ইজমের ভাবনায় বা বিচার ধারাকে পূর্ণ করার চেষ্টাটা অনেক ক্ষেত্রে হরিচাঁদ ঠাকুরের কর্মের মধ্য দিয়ে
ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ বুদ্ধিজমের
পরবর্তী stage
হচ্ছে মতুয়া-ইজম। মূল
হচ্ছে বুদ্ধ-ইজম। সেটাকে
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নবরূপায়ণ হচ্ছে মতুয়া-ইজম। কেন এই ভাবনা? হ্যা, এই ভাবনার
গভীরে প্রবেশের পূর্বে আমরা জেনে নেই বুদ্ধের
কামনা সম্পর্কে-
চরথং ভিখ্খবে
চারিক্কম্
বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়।
অন্তানু হিতায়, লোকানুকম্পায়।
আদি কল্যাণ, মধ্য কল্যাণ, অন্ত কল্যাণ।
বুদ্ধ
পাঁচ জন ভিক্ষুর সামনে এই গাথা বলেন। তাদের তিনি বলেন, হে ভিক্ষুগণ, তোমরা চলতে
চলতে ভিক্ষা করবে।
আর্থাৎ পায়ে হেটে ভিক্ষা করবে। আর এই চলার
সঙ্গে জনেজনে বহুজনদের কাছে গিয়ে প্রচার করবে, যে
বিচার ধারা প্রারম্ভে কল্যানকারী, মধ্যে
কল্যানকারী, আর অন্তেও কল্যানকারী হবে। আর যেটা অল্পজনের হিত্ সংরক্ষণকারী নয়। যেটা
হবে বহুজন হিতায় এবং বহুজন সুখায়।
আমরা মতুয়াইজমে দেখতে পাই –
জীবে দয়া, নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যতো সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।। (শ্রীশ্রী
হরিলীলামৃত ১ম প্রকাশ, পৃ. ১১)
এখানে
মানুষ তথা সমস্ত জীবের প্রতি দয়া করা, তাকে ভালোবাসা ও বিশ্বাস ভক্তি শ্রদ্ধার কথা
বলা হয়েছে। বাকি সব কিছুকে ভ্রষ্টা বলা হয়েছে।
আমরা আরও দেখতে পাই বুদ্ধের মূল আদর্শ হচ্ছে- সমতা, স্বতন্ত্রতা, বন্ধুতা ও
ন্যায়।
আর
মতুয়াইজমের মূল আদর্শ – সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা।
তো হরিচাঁদ
ঠাকুরও সেই আদর্শ বা কামনায় অনুপ্রানিত হয়েছিলেন যেটা কল্যাণকর, যেখানে কোন ভেদাভেদ নেই, নেই হিংসা-দ্বেষ। আর সেই
আদর্শকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা পরিবর্তন করে তিনি ‘বৌদ্ধধম্ম’-এর নবরূপায়ণ
করলেন ‘মতুয়াধর্ম’ নাম দিয়ে। এখানে আরও
একটি কথা থেকে যায়,
বুদ্ধের কামনাকে পূর্ণ করার কথা। অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুর ভাবনায় এটাও ছিল যে, বুদ্ধের
কামনা বা আদর্শ পূর্ণতা পায়নি। পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। সেই অপূর্ণতাকে তিনি পূর্ণ করতে চান।
তাই তার আবির্ভাব। এই
আবির্ভাব মানে জন্ম। কোন জন্ম? আদর্শের জন্ম। কার আদর্শ? বুদ্ধের আদর্শ। আর এই
অপূর্ণতাকে তিনি পূর্ণ করার জন্য বুদ্ধের বিচার ধারার প্রচারক ভিক্ষুদের ন্যায় মতুয়া প্রচারক নির্মাণ করেন। যাদেরকে
পাগল, গোঁসাই
নাম দেন। তবে
তিনি জানালেন, এই মতুয়া
ধর্ম প্রচারের জন্য সন্যাসী হতে হবেনা। তিনি গৃহ
ধর্মকে বেশি প্রাধান্য দিলেন। আর বললেন, হাতে কাম আর মুখে নাম করার
জন্য। কারণ
সেই সময়ের বেশিরভাগ অলস বৈষ্ণবরা বিনা পরিশ্রম করে শুধু নাম বিলিয়ে পরগাছা হয়ে চলত। যেটা সমাজ
তথা দেশের পক্ষে ছিল ক্ষতি কারক।
এবার আমরা দেখে নেই হরিচাঁদ ঠাকুর বুদ্ধ-ইজমকে
কেন নবরূপায়ণ করে মতুয়া-ইজম করলেন।
প্রথমেই আমি বলেছি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে
হরিচাঁদ ঠাকুর এটা করে ছিলেন। কিন্তু সেই সময়টা কি ছিল? সেই
ইতিহাসের মধ্যে লুকিয়ে আছে বুদ্ধ-ইজমের বীজ। যে বীজটার মধ্যে বুদ্ধ-
ইজমের সব গুণ নিহিত ছিল।
কিন্তু কালের বিবর্তনে যেমন অনেক প্রাণীও পরিবর্তীত হয়, তেমনি এই কালের বিবর্তনে
বিচারধারার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়। সেই অনুসারে বুদ্ধ-ইজমকে পরিবর্তিত করে মতুয়া-ইজম
করতে হয়েছিল হরিচাঁদ ঠাকুরকে।
এবার আসি সেই কালের বিবর্তন বা সেই ইতিহাস
সম্পর্কে।
আপনারা এটা নিশ্চয় জানেন যে, হরিচাঁদ ঠাকুরকে পতিত পাবন বলা হয়। পতিত এবং পাবন। দুটি
শব্দ। পতিত অর্থাৎ উপর থেকে নীচে পড়ে যাওয়া। আর পাবন অর্থাৎ উদ্ধার করা। পতিত পাবন অর্থাৎ নীচে পড়ে যাওয়াকে টেনে তোলা বা উদ্ধার করা। এবার কথা হচ্ছে- কে
বা কারা কীভাবে পড়ে গিয়েছিল ? কোথা থেকে পড়ে গিয়েছিল ? কে
বা কারা এই পড়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়ার কাজ
করেছিল ? কেন ফেলে দিয়েছিল ?
ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই বাংলায় প্রায় চারশ
বছর পাল রাজত্ব ছিল। আর এই পালরা ছিল বুদ্ধিষ্ট। তাই ‘গুরুচাঁদ চরিত’-এ আমরা
দেখতে পাই-
পালবংশ মহাতেজা বঙ্গদেশে যবে রাজা
বৌদ্ধ ধর্ম্ম আসিল এদেশে।
বৌদ্ধ রাজ-ধর্ম্ম মানি
বঙ্গবাসী যত প্রাণী।
বৌদ্ধ ধর্ম্মে দীক্ষা নিল শেষে।।
(পৃষ্ঠা নং ২৮ ,পঞ্চম সংস্করণ ২০০৯ )
আর এই পালরা কেমন ছিলেন?
পালরাজন্য অকুতোভয়
বীর্যবান।
অসুর মানব নমঃশূদ্রের
সন্তান।।
কাশ্যপের গোত্র এরা
সুদাসের জ্ঞাতি ।
অশোকের রক্তধারক নীতিতে
স্থিতি।। (হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত পৃঃ নং ১২১)
(নিচের বিষয়টা ভিষণ গুরুত্ব পুর্ণ। বিষয়টা পড়ে কারো কারো কাছে অবাক
লাগতে পারে। তাই এই বিষয়টার তথ্যমূলক বেশিরভাগ অংশ ‘‘অদল বদল এর ১৫ই
অগষ্ট সংখ্যার’’ সত্যরঞ্জন তালুকদারের লেখা “চন্ডাল নমশূদ্র এবং কাশ্যপগোত্র-তাদের পরিচয় কী’’ থেকে তুলে দিচ্ছি।)
আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রাচীন কাল থেকে
শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত বঙ্গে যে সংখ্যাবহুল জাতিটি বসবাস করছে তাদের
বর্তমান নাম নম:
শুদ্র।
‘বঙ্গে
ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশে যারা বাধা দিয়েছিল তারা বর্তমানের নম:শুদ্রদের
পূর্বপুরুষ ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারেনা। নম:শুদ্রদের
পূর্বপুরুষেরা গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল নৃপতিদের রাজত্বকালে
ব্রাহ্মণরা নম:শুদ্রদের
উপর অত্যাচার করার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি; কিন্তু বঙ্গে কর্ণাটকী ব্রাহ্মণ
সেন বংশের রাজত্ব স্থাপিত হলে ব্রাহ্মণরা সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে এবং সেই সময়ই সর্ব
প্রথম নম:রা
ব্রাহ্মণদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই সময় রাজা বল্লাল সেনের
আদেশে তার সৈন্যরা অহিংসমন্ত্রে দীক্ষিত বৌদ্ধদের ধরে ধরে নির্বিচারে হত্যা করেছিল,
কারণ তার ঘোষণা ছিল-বাঙলার সমস্ত বৌদ্ধরা হয়
ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করবে, নয়ত
মৃত্যুকেই বরণ করবে। এই সময়ে বহু বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্ম গ্রহণ করে প্রাণ রক্ষা করে
এবং সর্বনিম্ন শূদ্র বর্ণে স্থান পায়। পরবর্তীতে তারা মাহিষ্য, পৌন্ড্র
ইত্যাদি নামে চিহ্নিত হয়। বাকি বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাছে নতি স্বীকার
না করে কেউ যুদ্ধে প্রাণ দেন, কেউ পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। আবার
কেউ কেউ রাতারাতি মুসলমান হয়ে যান। সে
জন্য তাদের ‘শুনে মুসলমান’ বলা
হয়। তাঁরা আশ্রয় নেন বর্তমান কালের যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিহ
প্রভৃতি নদী-নালা, খাল-বিল, নলখাগড়ার
জঙ্গল পূর্ণ দুর্গম অঞ্চলে। অনেক বৌদ্ধ
ভিক্ষু প্রাণ বাঁচাতে তাঁদের পূঁথিপত্র নিয়ে পালিয়ে যান তিব্বতে। কেউ কেউ চীনেও
চলে যান। এই কারণে পরবর্তীকালে বাংলাভাষার আদি নিদর্শন বৌদ্ধসাহিত্য “চর্যাপদ”
আবিষ্কৃত হয় তিব্বতে । আর যারা যশোর, খুলনা, ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলে পালিয়ে
গিয়েছিলেন তাঁরাই পরবর্তীকালে নমঃজাতি বলে
পরিচিত হন। এই কারণেই বল্লাল সেন এবং তার বংশবদ ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এই নমঃজাতির
লোকদের প্রতি অর্থাৎ বৌদ্ধদের প্রতি ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁদের চন্ডাল নামে আখ্যায়িত
করে সমাজে জল-অচল অস্পৃশ্য বলে ঘোষণা
করে।’(*১) নম:দের প্রতি
এই অমানুষিক অত্যাচার চালানোর ফলে,
কেউ কেউ আবার পরে প্রাণ বাচাঁনোর ভয়ে
নিজস্ব ধর্ম এবং সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে, ব্রাহ্মণ্য
ধর্ম স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই-
নমঃজাতি প্রতি বাড়ে তীব্র
অত্যাচার
ধর্ম আচরণে নাহি রহে অধিকার।।
নিজধর্ম বৌদ্ধধর্ম নারে আচরিতে।
না পায় ঢুকিতে হিন্দু ধর্ম আঙিনাতে।। (হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত পৃঃ ১২৭)
এই
ঘটনা কোন মতেই খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে ঘটতে পারে না।
পরে কিছু নম:রা ব্রাহ্মণ্যধর্মে যোগ দিলে তারা ব্রাহ্মণদের
মুঠির মধ্যে এসে যায়।
তখন সুযোগ পেয়ে ব্রাহ্মণরা তাদের মনের
মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে সঞ্চিত বিষ নম:দের উপর বর্ষণ করতে শুরু করে। ব্রাহ্মণরা
নম:দেরকে
তাদের(ব্রাহ্মনদের) দ্বারা
প্রতিষ্ঠিত চতুর বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে বের করে দেয়।
নিজ ধর্ম হারিয়েছে আরো
বহুজাতি।
হিন্দুধর্ম মাঝে তারা পেয়ে
গেল স্থিতি।।
পাল রাজাদের জাতি নমঃজাতি
যারা।
ধর্মহীন হয়ে বঙ্গে পড়ে রল
তারা।। (হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত পৃঃ ১২৭)
আর এদের অর্থাৎ এই ধর্মহীনদের নাম দেয়
পতিত, অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ। গত আটশ বছর ধরে এই নম:রা পতিত
অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ অবস্থায় পতিত হওয়ার ফলে প্রতিহিংসাকারী ব্রাহ্মণদের অত্যাচার, অপমান, অবহেলা আঘাত
এবং অবরোধ সহ্য করতে করতে বঙ্গের একদা সংখ্যাবহুল এবং শক্তিশালী জাতিটি আজ করুন
অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
ব্রাহ্মণ্য
ধর্মের যাতা কলে প্রবেশের পূর্বে নম:দের ধর্ম কি ছিল সেটা পাল যুগের
ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে অতি সহজে বোঝা যায়।বর্তমান কালের পরিস্থিতিতে বিচার করে যদি একজন
হিন্দু তথা ব্রাহ্মণকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করার কথা মনে করা হয়, সেটা
যেমন কল্পনা করা সম্ভব নয়, যেহেতু সেখানকার অধিকাংশ জনগণ
ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তেমনি পশ্চিমবঙ্গে একজন বৌদ্ধ অথবা
খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীকে মুখ্যমন্ত্রী বানানোর কথা কল্পনা করাও অবাস্তব । বর্তমানে
যদি এই পরিস্থিতি হয় তাহলে অষ্টম শতাব্দীতে বাংলার জনগণ সর্বসম্মতিতে বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী ধর্মপালকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, সেটা
কোন মতেই সম্ভব হত না যদি সেই সময় সেখানকার অধিকাংশ জনগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী না
হতেন । এখানে
আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে যে গুপ্ত এবং সেন বংশ অস্ত্রবলে বঙ্গ দখল করেছিল। কিন্তু ধর্ম
পালকে বঙ্গের জনগণই রাজসিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এর থেকে প্রমানিত হয় যে সেই
সময় বঙ্গের বা বাঙলার অধিকাংশ জনগন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
অতি প্রাচিন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল
পর্যন্ত নম:রা
বাঙলার একটি সংখ্যা-বহুল
জাতি।
তাদের মধ্যে থেকে বহু সংখ্যক লোক ধর্মান্তরিত হয়ে যাওয়ার পরেও তারা পূর্ব এবং
পশ্চিম বাংলা মিলে হিন্দুদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। অষ্টম
শতাব্দীতে যদি বাঙলার অধিকাংশ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হন। তাহলে সেই সময় নম:দের ধর্ম, ‘‘বৌদ্ধ ধর্ম(ধম্ম)’’ ছাড়া অন্য
কিছুই হতে পারে না।
তাই আমরা একথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি যে হিন্দু ধর্মের খোঁয়াড়ে প্রবেশের পূর্বে
নম:রা
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। আর
বল্লাল সেনের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে স্বীকার
করে নিয়েছিল।
বল্লাল
সেনের অত্যাচারের কথা বংশ পরম্পরায় আটশ বছর পরে এখনও নম:দের
মস্তিষ্কে বিরাজ করছে। নম:রা মনে করে যে
বল্লাল সেন তাদের পূর্ব পুরুষকে ব্রাহ্মণ থেকে চন্ডাল বানিয়েছিল। এই ধারণা সম্পুর্ণ রুপে ভুল। বল্লাল সেনের তাদের(নম:) পূর্ব
পুরুষকে ব্রাহ্মণ থেকে নয়, বৌদ্ধ ধম্মের
সম্মানজনক স্থান থেকে বিচ্যুত করে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অসম্মান জনক স্থান স্বীকার
করে নিতে বাধ্য করেছিল। কোন পরাজিত জাতির এরকমই পরিনতি হয়।
ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বীসেন-রা বঙ্গে ছিল বহিরাগত। নম:রা যদি তাদের সঙ্গে একই ধর্মাবলম্বী হতেন তাহলে তাদের (নম:)
উপর অত্যাচার করে দূর-দূরান্তে তাড়িয়ে
দেওয়ার পিছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বল্লাল সেন পালবংশকে হটিয়ে বাঙলা দখল করেছিল। বল্লাল সেন বাঙলা দখল করে নম:দের সন্দেহের
চোখে দেখতে শুরু করেছিল। কারণ নম:রা পাল বংশের
সমর্থক ছিলেন।
পাল এবং নম:রা স্বধর্মবলম্বী ছিল, এই সন্দেহই বল্লাল সেনকে নম:দের প্রতি অত্যাচারী করে তুলেছিল। বল্লাল সেন বিদেশ
থেকে ব্রাহ্মণ ডেকে এনে এবং বঙ্গের কোনো কোনো জাতিকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজের দলে
টেনে সংখ্যা ভারী করেছিল।
আরও একটি কথা মনে রাখতে হবে যে গুপ্ত যুগে খুব সামান্য সংখ্যক
ব্রাহ্মণই বাংলায় প্রবেশ করেছিল। আর পাল রাজত্বের শেষদিন পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলে ব্রাহ্মণদের
কিংবা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করতে সমর্থ হয়নি। তাই সেই সময় বাংলার সব থেকে বড় জাতি
নম:রা
কোনমতেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুগামী হতে পারে না। হিউয়েন সাঙ্-এর ভ্রমন
কাহিনি (629- 645) খৃষ্টাব্দ
থেকে এটাও জানা যায় সেই সময় বাংলায় দেব মন্দির থাকলেও বৌদ্ধ বিহারের সংখ্যাই বেশি
ছিল।
তিনি বাঙলার সব জাগায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোক দেখেছিলেন । (*২)
এই আলোচনা
থেকে আমরা নির্দ্বিধায় এই সমাধানে আসতে পারি যে, নম:রা বা আজকের নম:শুদ্রদের পূর্বপুরুষরা বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বী ছিলেন। যে
কথা হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর উদ্ভাবনী দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বুদ্ধের কামনা কে পূর্ণ করার জন্য
ধর্মহীন পতিতদের স্বধম্মে প্রত্যাবর্তনের জন্য ধর্মহীন পতিত হওয়া থেকে উদ্ধার করার
জন্য মতুয়াধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন। এতক্ষণে আমরা জানার চেষ্টা করলাম
বুদ্ধের বা বৌদ্ধ ধম্মের সঙ্গে হরিচাঁদ ঠাকুর বা মতুয়া ধর্মের সম্পর্ক ।
এবার আমরা দেখে নেই বাবা সাহেবের সঙ্গেই বা কি সম্পর্ক আছে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর বা মতুয়া ধর্মের সঙ্গে।
বাবা সাহেব ১৯৩৫ সালে ঘোষণা করেন ‘আমি
হিন্দু হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছি। যেটা আমার
হাতে ছিল না। অর্থাৎ আমার কিছু করার ছিলনা। তবে আমি
হিন্দু হয়ে মৃত্যু বরণ করব না।’ আর তিনি ১৯৫৬ সালের অশোক
বিজয় দশমীর দিন বৌদ্ধ ধম্ম স্বীকার করেন
বা স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বধম্মে কেন বলছি? কারণ বাঙলার
নমঃদের যেমন ব্রাহ্মণরা ধর্মহীন করে পতিত
করে রেখে ছিল। তেমনি
ভারতবর্ষের বাকিদেরও অর্থাৎ যারা ব্রাহ্মণ্ধর্ম
স্বীকার করেননি তাদের
অস্পৃশ্য করে রেখে ছিল। এদের ও কোন ধর্ম ছিল না। কিন্তু পূর্বে এঁরা সকলে বৌদ্ধ
ধম্মের ছিলেন। তাই
সামগ্রিক ভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই পূর্বের বৌদ্ধরা পরবর্তিতে পতিত ও অস্পৃশ্যে পরিণত হন। বাবা সাহেব এই ইতিহাস খুব ভাল করে
জানতেন তাই তিনি স্বধম্মে প্রত্যাবর্তন
করেন এবং এই অস্পৃশ্যদের কে পূনঃরায় বৌদ্ধধম্ম স্বীকার করানোর প্রক্রিয়া শুরু করেন।
এবার
আমরা একটু অন্য ভাবে ভেবে দেখি। হরিচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনকে অগ্রগতি দেওয়ার কাজ করেন
গুরুচাঁদ ঠাকুর।
তিনি সব চেয়ে বেশি জোর দেন শিক্ষা আন্দোলনের উপর। যার ফলে সমাজের অবহেলিত লোকেরা মুক্তির আলো দেখতে পান, অনেক
সুফল উপভোগ করেন। তবে সেই আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করেন
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। তিনি তাঁর কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে বাবা সাহেবকে সংবিধান
সভায় পাঠাতে সক্ষম হন।
বাবা সাহেব সংবিধানের মাধ্যমে এই অবহেলিত, পতিত, অস্পৃশ্যদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে তাদের
উত্তরণের রাস্তাকে সুদূরপ্রসারী করেন। সাংবিধানিক
নিরাপত্তা দেন Scheduled
Caste, Scheduled Tribe এবং Other Backward Class নাম দিয়ে। যার ফলে এই
লোকেরা এই সাংবিধানিক সুবিধা গ্রহণ করে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রগতি করেছেন।
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, হরিচাঁদের আন্দোলন
কে অগ্রগতি দেন গুরুচাদ ঠাকুর।
গুরুচাঁদ ঠাকুরের
আন্দোলনকে আরো প্রসারিত করেন মহাপ্রাণ এবং এই আন্দোলনকে সাংবিধানিক ভাবে রক্ষা করার জন্য মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাবা
সাহেবকে সংবিধান সভায় পাঠান। আজও আমরা যারা শিক্ষায় ও চাকরিতে সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি, সেটা
এই সাংবিধানিক কারণে।
তো আমরা বিচার ধারা এবং বিচার ধারার
প্রগতির আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখ্তে পাচ্ছি যে, একটা সুদৃঢ় যোগসুত্র রয়েছে। কারো অবদান
অন্যের থেকে কম বা বেশি নয়। একটার সঙ্গে একটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটার অনুপস্থিতে অন্যটা ও লুপ্তপ্রায়। তাই আমরা
আন্দোলনের দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, হরি-গুরুচাঁদ
ঠাকুররের সঙ্গে যেমন বুদ্ধের আন্দোলন ও ধম্ম মিলেমিশে আছে, তেমনি এর
সঙ্গে জুড়ে আছে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের মাধ্যমে বাবা সাহেবকে সংবিধান সভায়
প্রেরণের সংগ্রাম। আর
এই সংবিধানের রক্ষা কবচ হচ্ছে সমস্ত আন্দোলনের ফসল। যে ফসল কে আমরা উপভোগই করে চলেছি- কাঁরা কীভাবে
আমাদের এই সুবিধা এনে দিলেন সেটা আজ আমরা
জানতেও আগ্রহী নই। উল্টা
সেই সব মহামানবদের অবদানকে একদিকে উপভোগ করছি আর অন্য দিকে তাঁদের কে অস্বীকার
করছি। এটা
একটা জাতির ক্ষেত্রে মারাত্ত্বক ক্ষতিকর। অচিরেই এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। তাই আশাকরি, আপনারা আপনাদের উদ্ধারের জন্য যে মহামানবরা আমরণ সংগ্রাম করেছেন, আপনারা তাঁদের
যোগ্য সম্মান দেবেন এবং তাদের প্রদর্শিত আদর্শকে অনুসরণ করে, pay back to the
society করে ঋণমুক্ত হওয়ার কাজে ব্রতি হবেন ।
----------------------------------------------------------------------------------
তথ্য সূত্রঃ
*১ অতীতের সন্ধানে- সুধীর রঞ্জন হালদার।
*২ ‘‘অদলবদল এর ১৫ই আগষ্টসংখ্যার’’ সত্যরঞ্জন তালুকদারের লেখা“চন্ডাল নমঃশূদ্র এবং কাশ্যপ গোত্র-তাদের পরিচয় কী ?
Comments
Post a Comment