Skip to main content

হরিলীলামৃত ছাপানোর ইতিহাস বিভ্রান্তিকর কেন? লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

 


হরিলীলামৃত ছাপানোর ইতিহাস  বিভ্রান্তিকর কেন?

এটা কি কারো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয়েছে?

লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়

    মতুয়াধর্ম দর্শনের প্রধান আকর গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ কিভাবে ছাপানো হয়েছিল, সেকথার বিস্তারিত উল্লেখ আছে দ্বিতীয় আকর গ্রন্থ, ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’-এ। কিন্তু তৃতীয় আকর গ্রন্থ ‘সোনার মানুষ গোপাল সাধু’-এর সঙ্গে ২য় আকর গ্রন্থের ‘হরিলীলামৃত ছাপানোর ঘটনার অনেক বৈপরিত্য দেখা যায়। যদিও ২য় ও ৩য় আকর গ্রন্থের কবি একজন। আচার্য মহানন্দ হালদার।  যাইহোক আসুন আমরা এই বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণের চেষ্টা করি।

     ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’- কবি মহানন্দ হালদার- ১ম প্রকাশ ১৯৪৩ সাল। আমার কাছে আছে সংস্করণ ২০০৯ সাল, এই গ্রন্থের পৃ. ৩৩৭-৩৩৮ অনুসারে আমরা দেখতে পাই।  

প্রভু তবে ডাক দিয়া কহে হরিবরে।

“চলে যাও কলিকাতা গ্রন্থ ছাপিবারে।।

সুধন্য, গোপাল আর তুমি একজন।

তিন জনে এক সঙ্গে করহ গমন।।”

প্রভুর আজ্ঞাতে তিনে তখনি ছুটিল!

পরদিনে কলিকাতা উপস্থিত হ’ল।।

পাণ্ডুলিপি প্রেসে দিলে গণ্ডগোল হয়।

প্রেস’য়ালা বলে “ইহা ছাপা নাহি যায়।।”

কারণ জিজ্ঞাসা করে সুধন্য কুমার।

প্রেস বলে “এক স্থানে আপত্তি আমার।।

নমঃশূদ্র ঘরে এল স্বয়ং ভগবান।

এই কথা ছাপিবারে নাহি বলে প্রাণ”।।

বহু তর্কাতর্কি পরে তবে রাজী হ’ল।

ছলে বলে কিছু টাকা বেশী নিয়া নিল।।

ছিদাম মুদির লেনে ছিল এক প্রেস।

এতদিনে তাহা বুঝি হইয়াছে শেষ।।

“শাস্ত্র প্রচার প্রেস” নাম বলি কয়।

দুই মাসে ছাপানর কার্য শেষ হয়।।

তের’শ তেইশ সালে গ্রন্থ ছাপা হ’ল।

প্রতিখণ্ড তিনটাকা মূল্য রেখে দিল।।

 

 

আর এই একই কবি অর্থাৎ আচার্য মহানন্দ হালদার রচিত গ্রন্থ “সোনার মানুষ গোপাল সাধু”১ম প্রকাশ ১৯৯২, আমার কাছে আছে ২য় সংস্করণ ২০০৮, এই গ্রন্থে (অখণ্ড সংস্করণ) পৃ. ৪৩৭ ও ৪৩৯ তে দেখতে পাই-

                         “তুমি যাবে হরিবর,      আর যাক যজ্ঞেশ্বর,

      আরো সাথে লইবে গোপালে।।” পৃ.৩৩৭

“অর্থ শুধু কথা নয়,     এ গ্রন্থে যা’ লেখা রয়,

    ছাপালে তা’ হ’তে হবে খুন।।”

              ***********

“মোদের রয়েছে জানা,       ধর্মগ্রন্থ এইখানা,

     তাতে দোষ ভেবে হারা দিশে।।”

ছাপাখানা ছিল যার,    খুলে বলি পরিস্কার,

     “কারণ ত’ তোমরা জান না।

লেখা আছে এই গ্রন্থে, কলিযুগ শেষপ্রান্তে,

    অবতার করেছে কল্পনা।।

তা’ আবার কোনঘরে,      টানিয়াছে সে ঈশ্বরে,

      অতি ক্ষুদ্র নমঃশূদ্র ঘরে।

এই কথা যদি ছাপি,   এক হ’ব মহাপাপী,

    অপরাধী হ’ব তার পরে।।

অন্য অন্য জাতি সব,    করে মহা কলরব,

     আমাকে ধরিবে সবে বেড়ে।

           ***************

সাতদিন পরে বুঝে,     অর্থ তার পায় খুঁজে,

            কিবা করে উপায় এখন?

মুকুন্দ মল্লিক ধন্য,      নমঃশূদ্র অগ্রগণ্য,

            তাঁর কাছে করিল গমন।।

সব কথা বলে তাঁরে,  জিজ্ঞাসিল কি প্রকারে,

            ছাপা হবে লীলা গ্রন্থখানা।

      *****************

যাহা হোক একখানে,     ছিদাম মুদির লেনে,

            ছাপাখানা আছে একখান।

নামেতে শাস্ত্র প্রচার,     ছাপাখানা হয় যার,

     জানি তিনি জাতিতে খ্রীষ্টান।।

 সেইখানে গেলে পরে, মনে বলে হতে পারে,

      চেষ্টা করে দেখুন সেথায়।

খ্রীষ্টানেরা কেহ আর,      ধারে না এসব ধার,

        কাজ করে যদি টাকা পায়।।’’

সেইখানে লেখা দিতে,      মালিক সন্তুষ্ট চিত্তে,

       পাণ্ডুলিপি করিল গ্রহণ।

মুল্যাদি সাব্যস্ত হলে,    তিনজনে হরিবলে,

      ওড়াকান্দি ফিরিল তখন।।

গ্রন্থ ছাপা হ’ল শেষ,    মতুয়ার মনোক্লেশ,

      দূর হ’ল প্রভুর কৃপায়।   (পৃ. ৪৩৯)

আমরা প্রথমে দেখতে পাচ্ছি-

   (১)গুরুচাঁদ ঠাকুর হরিবর সরকার, সুধন্য ও গোপালকে বই ছাপানোর জন্য যেতে বলছেন। কিন্তু পরের বইতে দেখতে পাচ্ছি- হরিবরের সঙ্গে যজ্ঞেশ্বর ও গোপালকে নিয়ে যেতে বলছেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। তো সুধন্য ও যজ্ঞেশ্বরকে নিয়ে একটা বিভ্রান্তি ঘটছে। যদিও এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

   (২)                      তের’শ তেইশ সালে গ্রন্থ ছাপা হ’ল।

প্রতিখণ্ড তিনটাকা মূল্য রেখে দিল।।

কিন্তু ১৩২৩ সালের ছাপানো গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই মূল্য ধার্য করা হয়েছে ২ টাকা।

 

(৩)                        বহু তর্কাতর্কি পরে তবে রাজী হ’ল।

ছলে বলে কিছু টাকা বেশী নিয়া নিল।।

প্রথম বইতে, বই ছাপানোর জন্য অনেক তর্কাতর্কির পরে কিছু টাকা বেশি নিয়ে বই ছাপাতে  রাজী হওয়ার কথা পাই।  কিন্তু দ্বিতীয় বইতে এই ধরণের কোনো সম্ভাবনারও উল্লেখ দেখতে পাইনা। বরং-

খ্রীষ্টানেরা কেহ আর,      ধারে না এসব ধার,

        কাজ করে যদি টাকা পায়।।’’

সেইখানে লেখা দিতে,      মালিক সন্তুষ্ট চিত্তে,

       পাণ্ডুলিপি করিল গ্রহণ।

দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বইতে- মুকুন্দ মল্লিকের নির্দেশ মতো ছিদাম মুদি লেনের ‘শাস্ত্র প্রচার’ ছাপা খানায় গেলেন। যার মালিক হচ্ছেন খ্রিস্টান। তাই, বইতে কি লেখা আছে সেটা নিয়ে তাদের  কোনো মাথা ব্যথা নেই। ছাপানোর টাকা পেলেই হলো।

 যাহা হোক একখানে,     ছিদাম মুদির লেনে,

            ছাপাখানা আছে একখান।

নামেতে শাস্ত্র প্রচার,     ছাপাখানা হয় যার,

     জানি তিনি জাতিতে খ্রীষ্টান।।

 

     প্রথম গ্রন্থ ছাপা হয় ১৯৪৩ সালে। যেটাকে মতুয়া আকর গ্রন্থ হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে। আর এই গ্রন্থ ছাপানো হয়েছে বিশেষ নিয়ন্ত্রন ও নির্দেশনের মাধ্যমে আর গ্রন্থ সত্ত্বও কবির নিজের   নেইকিন্তু পরের গ্রন্থ কবি মহানন্দ হালদারের একান্ত ব্যক্তিগত। তাই এখানে কিন্তু আমরা এই  বিভ্রান্তির জন্য কিছু নির্দেশনের গন্ধ পাচ্ছি ১ম বইতে। যেটা সাধারণ মতুয়া অনুরাগীদের মানসিক  একটা প্রেসার দেওয়া হয়েছে। যেটা আমারও মতুয়া দর্শনে অবগাহন করার সময় মনে হয়েছিল। এসব কথা এই জন্য বলছি- কারণ, প্রমাণ্য সূত্রে জানাগেছে- পরবর্তিতে ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ যেটা ছাপা হয়েছে সেখানে বংশলতা দেওয়া আছে। যেটা প্রথম সংস্করণে নেই। আর ওই বংশলতা হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্বজদের ‘মৈথিলী ব্রাহ্মণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। যার বাস্তব প্রমাণও পাওয়া গেছে। এবং এটাও করা হয়েছে  মতুয়াদের মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করার জন্য। সঙ্গে আরোও কিছু উদ্দেশ্যও থাকাটা অসম্ভব নাও হতে পারে।

     এবার পাঠকগণকে এই বিভ্রান্তির সম্পর্কে অনুধাবন করতে হবে। এর ফলে সঠিক মতুয়াধর্ম দর্শন প্রচারের ক্ষেত্রে কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়েছে। আর এর ফলে কি বিশেষ কারো কারো বিশেষ সুবিধা হয়েছে??

 

 

 

Comments

  1. মন্তব্যসহ লেখা আরো ব্যাপক এবং গভীর বিশ্লষন দরকার ।

    ReplyDelete

Post a Comment