বুদ্ধ – হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের দর্শনের সমন্বয়
লেখক
-জগদীশচন্দ্র রায়
১.“বুদ্ধ”
শব্দের অর্থ লব্ধ-জ্ঞান। ----অবিদ্যার ধ্বংসই দুঃখমোচনের একমাত্র উপায়—এই মহাতত্ত্ব তিনি (বুদ্ধ) উপলব্ধি করিলেন। পৃথিবীর
যত দুঃখ তাহা এই অবিদ্যার ডালপালা হইতে জাত; অবিদ্যা-তরুর ক্রমবিকাশ এইরূপ;
অবিদ্যা হইতে সংস্কার, সংস্কার হইতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান হইতে নামরূপ, নামরূপ হইতে
ষড়ায়তন, ষড়ায়তন হইতে স্পর্শ, স্পর্শ হইতে বেদনা, বেদনা হইতে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা হইতে
উপাদান, উপাদান হইতে ভব, ভব হইতে জাতি, জাতি হইতে জরামৃত্যু, শোক, পরিদেব, দৌমনস্য,
উপায়নের উৎপত্তি হইয়া থাকে। আত্যন্তিক দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা।
“অবিদ্যা ধ্বংসের আটটি উপায় গৌতম বুদ্ধ
নির্দেশ করেছেন-সম্যক, দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্, সম্যক্ কর্মান্ত, সম্যক্ আজীব, সম্যক্
ব্যায়াম, সম্যক্ স্মৃতি ও সম্যক্ সমাধি—এই আটটি উপায়ের নাম আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। গৌতম
অবিদ্যার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্যক উপলব্ধি করে বলেছেন, “এই দুঃখের গৃহ, কে
নির্ম্মাণ করিয়াছে তাহাকে আমি ধরিয়া ফেলিয়াছি। এখন সেই নির্ম্মাতা আর গৃহ রচনা করিতে পারিবে না। অবিদ্যাজাত কামনাই এই দুঃখের ঘর
বারংবার রচনা করিয়াছে।” (তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’
১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন। পৃঃ ১০০/১০১)
এই
বিষয়ে মহাত্মা জ্যোতিরাও বলেছেন-
বিদ্যাবিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে
মতিবিনা নীতি (আদর্শ) গেছে
নীতিবিনা গতি (দিশা) গেছে
গতিবিনা বিত্ত (সম্পত্তি) গেছে
বিত্তবিনা শূদ্রের পতন হয়েছে
এতো সব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।
আর
গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন- “খাও বা না
খাও তা’তে কোন দুঃখ নাই।
বিদ্যাধর্ম, বিদ্যাকর্ম, অন্য সব ছার।।
বাঁচ বা না বাঁচ, প্রাণে বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন হ’লে বড় তার মূল্য নাই।।
-গুরুচাঁদ
চরিত- পৃঃ ১০৮
বালক বালিকা দোঁহে পাঠশালে দাও।
লোকে বলে “মা’র গুণে ভালো হয় ছাও।।” গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ
৫২৯
২.
একদা ভরদ্বাজ নামক এক বণিকের গৃহে বুদ্ধ ভিক্ষুবেশে মুষ্টিভিক্ষা করিতে গিয়াছিলেন।
বণিক্ তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিল- “তুমি সুস্থদেহ, অন্যের শ্রমলব্ধ শস্য
লইতে আসিয়াছ কেন? আমি তোমাকে কিছু জমি দিতেছি,
তুমি উহা হইতে শস্য উৎপন্ন করিয়া জীবিকা অর্জ্জন করিতে শিখ।”
বুদ্ধদেব
বলিলেন, “আমি কৃষিকার্য্যই করি, তবে আপনাদের কৃষির সহিত আমার কৃষির একটু
তফাৎ আছে। মানুষের মনই আমার জমি, যত্ন ও উৎসাহ দুটি বলদ, লাঙ্গলের ফাল বিনয়, জ্ঞান
হল্ (হাল) এবং বিশ্বাসই আমার বীজ। এই বীজ হইতে নির্ব্বাণ-ফল উৎপন্ন হয়।”
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র
সেন। পৃঃ ১০১)
এ
ক্ষেত্রে আমরা শ্রীশ্রীহরি লীলামৃতে দেখতে পাই-
অফলা জমিতে আমি সুফল ফলাই।।
যশোমন্ত পুত্র আমি নাম হরিচাঁদ।
এবার করিব যত পতিত আবাদ।।
এদেশে আবাদী তোরা চিনিলি না কেহ।
মাটি যে অফলা থাকে এ বড় সন্দেহ।।
পতিত আবাদ জন্য আশা এ দেশেতে।
কি ফল ফলিবে টের পাবি ভবিষ্যতে।।
খাটি মাটি হ’লে ফল না হয় বিফল।
ভক্তি করে ডাকে তারে দেই প্রেমফল।।
যে ফল চাহিবি তোরা সে ফল পাইবি।
কল্প-বৃক্ষমূলে যদি প্রার্থনা করিবি।।
(শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ ৫০)
যশোমন্ত পুত্র আমি নাম হরিচাঁদ।
এবার করিব যত পতিত আবাদ।।
এদেশে আবাদী তোরা চিনিলি না কেহ।
মাটি যে অফলা থাকে এ বড় সন্দেহ।।
পতিত আবাদ জন্য আশা এ দেশেতে।
কি ফল ফলিবে টের পাবি ভবিষ্যতে।।
খাটি মাটি হ’লে ফল না হয় বিফল।
ভক্তি করে ডাকে তারে দেই প্রেমফল।।
যে ফল চাহিবি তোরা সে ফল পাইবি।
কল্প-বৃক্ষমূলে যদি প্রার্থনা করিবি।।
(শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ ৫০)
এখানে ‘পতিত আবাদ জন্য
আশা এ দেশেতে’- এই পতিত কি শুধু পতিত জমি? না। তবে এই পতিত মানে অজ্ঞানতার
অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকা কে বোঝানো হয়েছে। তার থেকে মুক্তি দেবার জন্য জ্ঞানের আলোর
কিরণ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি কাজ করেছেন। তাহলে কি বুদ্ধের কথার সঙ্গে প্রায় হু
বহু মিলে যাচ্ছে না?
৩. বৌদ্ধধর্ম্মের যে
বিরাট শক্তি উত্তরকালে জগতের ১/৩ (এক তৃতীয়াংশ) গ্রাস করিয়া অপর ২/৩ (দুই তৃতীয়াংশ) অংশের নিকটও আত্মপ্রকাশ
পূর্ব্বক তাহাও স্বকীয় প্রভাবান্বিত করিয়াছিল, তাহার মূলে ছিল সঙ্ঘশক্তি। (তথ্যঃ-
‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড, লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন। পৃঃ ১০৩)
মতুয়া ধর্মের মূলও
কিন্তু ঐ সংঘশক্তি। যার জন্য মতুয়াদের কাছে শঙ্ঘশক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তাই গুরুচাঁদ
চরিতে আমরা দেখেতে পাই-
শক্তি না দেখিলে কেউ করে না সম্মান।
শক্তিশালী হ’তে সবে হও যত্নবান।। পৃ. ৫৭৩
৪. বুদ্ধ
গৃহাশ্রমকে নিন্দা করেন নাই, কিন্তু ভিক্ষুকে গৃহস্থ হইতে উচ্চতর সম্মান দিয়াছেন।
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র
সেন। পৃঃ ১০৫)
পৃথিবীর সংখ্যা গরিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠী
সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করতে পারবে না বা সবকিছু ছেড়ে অরণ্য বা গুহায় চলে যেতে পারবে
না। যাই হোক, মহান ও বিশুদ্ধ বুদ্ধমতবাদ হয়ত বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে অর্থহীন
হয়ে যেত; যদি তারা আজকের এই বিশ্বে তাদের দৈনন্দিন জীবনে তা অনুসরণ করতে না
পারতেন। কিন্তু, যদি আপনি বুদ্ধমতবাদের চেতনা সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন (শুধু
আক্ষরিক অর্থে নয়), আপনি, নিশ্চিতভাবে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপ্ন করেও তা অনুসরণ ও
অনুশীলন করতে পারবেন।
বুদ্ধশিক্ষা অনুসরণ করতে হলে জীবন থেকে অবসর নিতে
হবে, -এমন প্রচলিত ধারণাটি ভুল।
যদি কোনো ব্যক্তি তার চারপাশের মানুষদের খেয়াল
না করে, শুধু তার নিজস্ব সুখ ও মুক্তির চিন্তায় মগ্ন থেকে সারাটা জীবন নির্জন স্থানে
কাটিয়ে দেন, তবে তা অবশ্যই ভালোবাসা, সহানুভূতি ও পরসেবার উপর প্রতিষ্টিত
বুদ্ধশিক্ষায় নিয়োজিত থাকা নয়। (তথ্য -ভাষান্তরে
বুদ্ধভাবনা – জয়দেব কর। পৃ. ৪৩-৪৪)
মতুয়া ধর্মেও আমরা দেখতে পাই, গৃহ ধর্মকে প্রাধান্য
দেওয়া হয়েছে।
যার জন্য বল হয়েছে-
গৃহধর্ম্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয়।
বাণপ্রস্থ পরমহংস তার তুল্য নয়।।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত পৃ. ৩২)
আবার আছে-
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয়।
সেই সে পরম
সাধু জানিবে নিশ্চয়।। (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
পৃ. ৩২)
করিবে গ্রহধর্ম্ম লয়ে নিজ নারী।
গৃহে থেকে ন্যাসী বাণপ্রস্থী ব্রহ্মচারী।।
গৃহধর্ম্ম গৃহকর্ম্ম করিবে সফল।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল।।
(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত পৃ. ৮)
৫. দেহ
ভিন্ন পাপ পুণ্যাদি সমস্ত কর্ম্মের ফলভোগী কোন আত্মাদি নাই। এই মিথ্যা-ভূত অখিল
সংসারে জীবগণ মোহবশতঃ এই সলক অনুভব করিয়া আসিতেছে। যখন মাতা-পিতা হইতে পুত্র উৎপন্ন হইতেছে, আর সেই কুম্ভকারাদি
কর্ত্তৃক যখন নিরন্তর ঘটাদি উৎপাদিত হইতেছে, তখন সৃষ্টির জন্য ভাবনা কি আছে? অর্থাৎ সৃষ্টি কিরূপে হয়, তাহাতো চক্ষুর
সম্মুখেই দেখিতেছ, এজন্য পৃথক
সৃষ্টিকর্ত্তা স্বীকার করিবার প্রয়োজন কি? (তথ্যঃ- ‘বৃহৎ
বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন। পৃঃ ১১৩)
মতুয়া
ধর্মেও আমরা এই ব্যাখ্যারই প্রতিফলন দেখতে পাই-
মাটি দিয়ে গড়া দেহ
মাটিতেই লয়।
দেহ হতে দেহ তাই
প্রকৃতি গড়ায়।।
এবে শুন কেবা কান্দে
কিসের মায়ায়।
ব্রহ্মের বিকারে
সৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ড যে হয়।।
ব্রহ্মের বিকার ভাগ হ'ল পঞ্চ ক্রমে।
ক্ষিতি
অপঃ তেজঃ মরুদ্বোম্পঞ্চ নামে।।
ব্রহ্ম
ধরে 'আত্মা' নাম তত্ত্বে
দেহ কয়।
উভয়ে
মিলন হ'লে জীব সৃষ্টি হয়।।
ভূত'ত আধার মাত্র দেহ নাম ধরে।
চিৎ
শক্তি আত্মা আছে তাই চলে ফিরে।।
-গুরুচাঁদ
চরিত- পৃষ্ঠা নং 354/355
প্রকৃতি পাঁচটি উপাদানে
গঠিত। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম। প্রকৃতির এই পাঁচটি উপাদানের চারটি উপাদানে
গঠিত হয় জীব। ব্যোম বা মহাশূন্য জীব সৃষ্টির জন্য সরাসরি প্রয়োজন হয়না। প্রকৃতির এই
চারটি উপাদানের আনুপাতিক মিশ্রণে প্রথমে জীবের উদ্ভব হয়। বিবর্তনের মাধ্যমে কোটি
কোটি বছর পরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে। এই প্রাণীর মধ্যে সব থেকে বুদ্ধিমান
প্রাণী হচ্ছে মানব। এই মানব বা যে কোনো প্রাণী, পুরুষ ও নারীর শুক্রানু ও
ডিম্বানুর উপযুক্ত ‘উভয়ে মিলন হ'লে জীব
সৃষ্টি হয়’। জীবের মধ্যে চেতনার সঞ্চার
হয়। সেই চেতনাকে কেউ ব্রহ্ম বলেন। আবার কেউ আত্মাও বলেন।
ব্রহ্ম ধরে 'আত্মা'নাম তত্ত্বে দেহ কয়।
উভয়ে মিলন হ'লে জীব সৃষ্টি
হয়।।
অর্থাৎ পিতামাতার
চেতনার মিলনের ফলে জীবের সৃষ্টি হয়। সেই চেতনাকে ব্রহ্ম বা আত্মা বলা হয়। যে চেতনা
দেহের মধ্যে সদা অনুভুত হয়। আবার বলা হয়েছে -
তুমি-স্থুল আমি-সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন।।
দেহ আত্মা মোরা দোঁহে মূলে নহি ভিন্ন।।
-(শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, পৃঃ ৭৩,প্রকাশ,২০০৯,
ঠাকুর নগর)
এখানেও আমরা দেখতে পাই
‘তুমি স্থুল’ অর্থাৎ শরীর বা দেহ হচ্ছে স্থুল। ‘আমি সূক্ষ্ম’ আমি এখানে চেতনা। এই
শরীর ও চেতনা উভয়ে একত্রে অবস্থান করে। একের অবশানে অন্যের ও অবশান বা মৃত্যু।
অর্থাৎ শরীরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দেহের মধ্যে অবস্থিত চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু
ঘটে। আর এই অবশানের পর আবার উপাদানগুলি স্ব স্ব স্থানে বিলিন হয়ে যায়।
তবে ভাবুক মানুষের মনের
মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা জাগৃত না হলে এই সহজ তত্ত্ব তাঁরা বুঝতে চাইবেন না। তাঁরা
ব্রাহ্মন্যবাদী চিন্তা ধারার ভাইরাসকেই সব সময় কার্যকরী করার চেষ্টা করবেন। যদিও
সামান্য একটু বিচার করলেই এই চরম সত্যকে বোঝা যায়। কারণ, জীবের সৃষ্টির জন্য যেমন
প্রকৃতি নির্ভর। তেমনি বেঁচে থাকার জন্য ও সর্বক্ষণ প্রকৃতি নির্ভর। সেটা হচ্ছে-
খাদ্য, পানীয়, বায়ু ও ক্ষণিজ পদার্থ বা মৃত্যিকা।
৬. বুদ্ধের নির্দ্দিষ্ট অষ্টাঙ্গিক মার্গ সাধনার
সহজ উপায়,-- উহাতে সম্যক্ সঙ্কল্প, সম্যক্ বাক্, - প্রজ্ঞাবন্ধ, সম্যক্
ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক্ সমাধি- সমাধিস্কন্ধ এবং সম্যক্ বাক্য, সম্যক্
কম্মান্ত ও সম্যক্ আজীব- নীলঙ্কন্দের অন্তর্গত। এই অষ্ট মার্গ ছাড়া দশটি নিষেধ-
বিধির উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ-
১. পানাতিপাত-
প্রাণীহত্যা হইতে বিরতি।
২. অনিন্নাদান- অদত্তা
দান বা চুরি।
৩. কামেসুমিচ্ছাহার-
মিথ্যা কামাচার।
৪. মুসাবাদ- মিথ্যা কথা
বলা।
৫. পিসুনবাদ- ভেদ বাক্য।
৬.করুদবাদ- কর্কশ কথা
বলা।
৭. সম্মপ্পলাপ—নির্থক
কথা বলা।
৮. অভিজ্ ঝা- পরদ্রব্যে
লোভ।
৯. ব্যাপাদ – মানসিক
হিংসা।
১০. মিচ্ছাদিট্ঠি- বিপরীত
জ্ঞান।”
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন। পৃঃ ১১৭)
মতুয়া ধর্ম-দর্শনে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ
ঠাকুর, সমাজ ও জীবন দর্শনের যে প্রকৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা শূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে
রয়েছে ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ও ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’ গ্রন্থে। গভীরভাবে এই দু’টি
গ্রন্থ অধ্যয়ন করলে সমাজ জীবন ও ব্যক্তিজীবনের যে দর্শন পাই তা বৌদ্ধ দর্শনের
পঞ্চশীল, অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও বাইশ প্রতিজ্ঞার সমতুল্য।যথা-
(১) গার্হস্থ্য ধর্ম পালন, এক নারী ব্রহ্মচারী।
(২) সত্য কথা বলা।
(৩) পর নারীকে মাতৃ জ্ঞান করা, মিথ্যা না বলা,পর দুঃখে দুখী হওয়া এবং
দুঃখীকে সহযোগিতা দান করা।
(৪) খাও বা না খাও সন্তানকে শিক্ষিত করো।
(৫) হাতে কাম, মুখে নাম।
(৬) গৃহধর্ম ও গৃহকর্ম করা।
(৭) কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়া।
(৮) জীবের প্রতি দয়া করা ও মানুষের প্রতি নিষ্ঠা রাখা।
(৯) উদ্ধার কর্তাকে(হরিচাঁদ)ঈশ্বর মনে করা।
(১০) কর্ম ও ধর্মের সমন্বয় সাধন।
(১১) পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা ও দেহমনশুদ্ধ রাখা।
(১২)চারিত্রিক সংযম রাখা।
মতুয়া দর্শনে নির্দেশিত এইসব গুণের অধিকারী
একজন গৃহীকে হয়ে ওঠা আসল কথা। উপরে
উল্লেখীত করণীয় নির্দেশগুলো ছাড়া এরকম আরো বেশ কিছু নির্দেশ বা উপদেশ আছে লীলামৃত
ও গুরুচাঁদ চরিতের পাতায় পাতায়।
এই আদেশের সঙ্গে কিছু নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া
হল। তার মধ্যে কয়েকটি হলোঃ-
(১)ভিন্ন গুরু ও ভিন্ন
দল না করা।
(২) নারী দিয়ে অঙ্গ সেবা
না করা।
(৩)বাল্য বিবাহ না
দেওয়া।
(৪)মিথ্যা না কথা বলা।
(৫)মদ গাঁজা না খাওয়া
এবং চুরি না করা ।
(৬) তাস-দাবা-জুয়া খেলা
সব ছেড়ে দিতে হবে।
(৭) কাউকে (অলিকতার
প্রতি) ভয় করার দরকার নেই।
(৮) জাতিভেদ প্রথা না
মানা।
(৯) সাধন, ভজন, দীক্ষা, তীর্থ পর্যটন
প্রভৃতি আচার সর্বস্বতা পরিত্যাগ করাঃ
(১০)বুদ্ধিহীন সরলতা ত্যাগ
করা।
এছাড়া বৈদিকতার বিধান ও
আচার বিচারকে না মানতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই
আদেশ ও নিষেধগুলো পালন করার নির্দেশ এইজন্য দেওয়া হ'ল যাতে মানুষ তার মনুষত্বকে খুঁজে পায়। অলীকতার পিছনে বোকার মত ঘুরে না বেড়ায় ।
Comments
Post a Comment