Skip to main content

হরিচাঁদ ঠাকুর স্মরণে


*হরিচাঁদ ঠাকুর স্মরণে* 
(১১ মার্চ হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ‘হরিচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও সাম্যবাদী দর্শন’ -লেখক- প্রদীপ কুমার বিশ্বাস, -এর ৬৯-৭১ পৃষ্টা থেকে তুলে ধরলাম)  
গৃহধর্মে সু-আদর্শ সব দে’য়া হ’ল।
দেহগৃহ শুচিকার্য্য জীবে কি বুঝিল?
দেহমন নহে শুচি গৃহধর্ম্ম করে।
ছিদ্রযুক্ত তরী সম ডুবে যে সাগরে।।
দেহমন সর্ব্বক্ষণ রাখিতে পবিত্র।
শিখাইতে হবে জীবে সেই মূলসূত্র।।
                                                                                                               (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত পৃ.৭৩, দশম সংস্করণ)  
     সুমহান গৃহধর্মের সমস্ত আদর্শের কথা হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন। তবু হরিচাঁদ ঠাকুর আক্ষেপ করে বা মনের দুঃখে বললেন, গৃহধর্ম ও ব্যক্তির ব্যক্তিজীবন সমস্ত তিনি বলেছেন, তবু সহজ সরল মানুষ তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। সত্য, প্রেম, পবিত্রতার তিন দর্শন দেহমনে ধারণ করে গৃহধর্ম পালনের কথাই হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন। সত্য পথে চলার কথা বলেছেন, জাতিভেদ বর্জন করে সমস্ত মানুষের প্রতি প্রেম বা ভালোবাসার কথা বলেছেন। সমস্ত রকম ব্যভিচারী ইন্দ্রিয়সুখ বর্জন করার মাধ্যমে দেহকে পবিত্র তথা ব্যাধিমুক্ত রাখার কথাই হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন। তবুও মানবসমাজ অসত্য, হিংসা, অনিয়মিত জীবনযাত্রার মাধ্যমে সাগর অর্থাৎ অন্ধকারময় অনিশ্চিত পথে এগিয়ে চলেছেন।

    হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অগণিত ভক্তদের মাধ্যমে মানুষকে আলোকময় জীবনে ফিরিয়ে আনার গুরুদায়ীত্ব দিলেন। ঠাকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর পিতার দেওয়া আদর্শ ও নির্দেশ পরবর্তী সময়ে পালনের মাধ্যমে মতুয়াদর্শনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার মহান দায়িত্ব পালন করেন। হরিচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে গুরুচাঁদ ঠাকুর গৃহধর্ম ও গৃহধর্মের ধারক গৃহীকে জীবের কল্যাণের মূলসূত্রের পথপ্রদর্শক ছিলেন। এখানে মূল মানে শিকড় আর সূত্র মানে পদ্ধতি। পৃথিবীর সার্বিক কল্যাণের প্রকৃত সত্য হল গৃহী (মূল) এবং গৃহধর্ম হল সূত্র বা পদ্ধতি। অর্থাৎ যতবড়ো বৃক্ষ হোক না কেন, মূল বা শিকড় ছাড়া বাঁচাতে পারে না। তেমনি গৃহীকে বা গৃহীর সহযোগিতা ভিন্ন  মানবসভ্যতা এগিয়ে চলতে পারে না। গৃহী (মূল বা শিকড়) তাঁর গৃহধর্মের (সূত্র বা পদ্ধতি) সুমহান আদর্শ বা   দর্শনের মাধ্যমে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। তাই এখানে হরিচাঁদ ঠাকুরের “মূলসূত্র” হচ্ছে গৃহী এবং গৃহধর্ম। হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া ধর্ম-দর্শনের প্রধান স্তম্ভ হচ্ছে গৃহী ও গৃহধর্ম। এই প্রকৃত সত্য যাঁরা না বোঝেন তাঁরা সুমহান মানবসভ্যতাকে সাগরে নিক্ষেপ করছেন। আর ওই সাগর থেকে মানবসভ্যতাকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন হরিচাঁদ-দর্শন।
এমত অবস্থায় হরিচাঁদ ঠাকুর দৃঢ়কন্ঠে আবার বলেছেন-
শুদ্ধাচারী বীজমন্ত্রী, নামে জপে মালা।
একা একা যেতে চায় সমুদ্রেতে ভেলা।।
গুরুরূপে ব্যবসায়ী কানে দেয় মন্ত্র।
 প্রাণহীন দেহ যেন জুড়ে দেয় যন্ত্র।।
এ সব সামান্য কূপ সব ডুবে যাবে।
হরিপ্রেম প্লাবনেতে জীব মুক্তি পাবে।। (পৃ. ঐ)
    এখানে ব্যঙ্গাত্মক অর্থে “শুদ্ধাচারী” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে শুদ্ধাচারী মানে ভেকধারীদের বোঝানো হয়েছে। ভেকধারীরা বাহ্যিক বস্ত্র পরিধান করে, তিলক কেটে, মালা গলায় নিয়ে সাধুরূপী অসাধু সেজেছেন। “বীজমন্ত্রী” মানে কৃষ্ণমন্ত্রের প্রচারক। সমুদ্রে ভেলা নিয়ে পাড়ি দেওয়া মানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ ভেকধারী কৃষ্ণমন্ত্রে বিশ্বাসী চেতনাহীন সম্প্রদায় নিজেরা সমুদ্রে অর্থাৎ অন্ধকার পথে এগিয়ে চলেছেন। শুধু তাই নয়, সরল বিশ্বাসী শিক্ষা-চেতনায় পিছিয়ে পড়া মানবসমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করছেন।
    এমত পরিস্থিতিতে হরিচাঁদ ঠাকুর অবাস্তব বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। বৈদিকধর্মের বিরুদ্ধে অভিমত দিলেন-
 গুরুরূপে ব্যবসায়ী কানে দেয় মন্ত্র।
প্রাণহীণ দেহ যেন জুড়ে দেয় যন্ত্র।।
   অর্থাৎ বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্যধর্মের গুরু সেজে কানে মন্ত্র দেওয়া হরিচাঁদ ঠাকুর ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করেছেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেমন আসল দ্রব্য বলে নকল দ্রব্য বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে অর্থ উপার্জন করে; তেমনি এখানেও হরিচাঁদ ঠাকুর গুরুরূপী কানে  মন্ত্রদাতাদের অসাধু ব্যবসায়ীর সাথে তুলনা করে তাদের প্রতারক বলেছেন। অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মবব্যস্থাকে প্রতারক ব্যবস্থা বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বৈদিক বা আর্য- ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে এরকম প্রকাশ্য বিদ্রোহ হরিচাঁদ ঠাকুর ছাড়া অন্য কোনো ধর্মপ্রবর্তক করেননি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মতুয়াদের বৃহদংশ হরিচাঁদ-দর্শন সঠিকভাবে অনুধাবন করতে  পারলেন না। যার ফলস্বরূপ মুক্তির দর্শন ‘হরিচাঁদ-দর্শন’ না মেনে মতুয়ারা শোষণ, বঞ্চনার বৈদিক তথা হিন্দুধর্মের অন্ধকার চোরাকুঠুরিতে আবদ্ধ রয়েছেন। দেহে প্রাণ না থাকলে মানুষকে  মৃত বলা হয়। অর্থাৎ গুরুদের ওইসব মন্ত্র মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে না। মৃতদেহে যেমন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা যায় না, তেমনি কানে মন্ত্র দেওয়া মানুষের কোনো কাজে লাগে না। বরং ওই পদ্ধতি মানুষের জীবনে ক্ষতিকারক অঙ্গের মতো বিষময় হয়ে ওঠে।
এ সব সামান্য কূপ সব ডুবে যাবে।
হরিপ্রেম প্লাবনেতে জীব মুক্তি পাবে।। (পৃ. ঐ)
    মহাজ্ঞানী কলমচী তারকচন্দ্র সরকার বৈদিকধর্মের বিধানকে কূপ অর্থাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্দমাক্ত জলাশয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। “হরিপ্রেম” নামক সাম্যবাদী হরিচাঁদ-দর্শনে বৈদিকধর্মের সমস্ত অবাস্তব বিধান “ডুবে যাবে” অর্থাৎ চাপা পড়ে যাবে। ফলস্বরূপ বৈদিকধর্মের অন্ধকার থেকে  মানবসমাজ তথা ভারতের মূলনিবাসী অস্পৃশ্যসমাজ হরিচাঁদ-দর্শনের আলোয় চেতনাপ্রাপ্ত হয়ে  বঞ্চনা-শোষণের থেকে মুক্তি পাবে। হরিচাঁদ-দর্শন সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে সুবৃহৎ মুক্তির দর্শন।

Comments