
মতুয়া
দর্শনের প্রতীক ও অশোক স্তম্ভ
লেখক –
প্রদীপ কুমার বিশ্বাস
একই সঙ্গে মতুয়া দর্শনের প্রতীক ও অশোক
স্তম্ভের তুলনা
প্রসঙ্গে সত্যান্বেষী পাঠক সমাজের বিস্ময়কর ভাবনা ও প্রশ্ন আসতে পারে। গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে বৌদ্ধদর্শনের মূর্তপ্রতীক অশোকস্তম্ভ ও মতুয়া দর্শন গ্রন্থ “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে সিংহ ও হাতির আলিঙ্গনরত মূর্তির দর্শনগত মিল রয়েছে।
প্রসঙ্গে সত্যান্বেষী পাঠক সমাজের বিস্ময়কর ভাবনা ও প্রশ্ন আসতে পারে। গভীরভাবে অধ্যায়ন করলে বৌদ্ধদর্শনের মূর্তপ্রতীক অশোকস্তম্ভ ও মতুয়া দর্শন গ্রন্থ “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্থে সিংহ ও হাতির আলিঙ্গনরত মূর্তির দর্শনগত মিল রয়েছে।
সিংহ ও হাতির আলিঙ্গনরত প্রতীকের মধ্যে
অন্তর্নিহিত রয়েছে মতুয়া দর্শনের প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগগত সূক্ষ্মনির্দেশিকা। সিংহ–হাতির
আলিঙ্গনরত সূক্ষ্মদর্শনের দিক বিশ্লেষণ করতে গেলে অশোকস্তম্ভের বিশ্লেষণ আবশ্যিক।
কেননা অশোকস্তম্ভ, মতুয়াদর্শনের প্রতীক সিংহ–হাতির আলিঙ্গন, দুইয়ের মধ্যে রয়েছে
বৌদ্ধদর্শন ও মতুয়া দর্শনের গভীর সমন্বয়।
বৌদ্ধ দর্শনের আদর্শে অশোকস্তম্ভে রয়েছে-
প্রেমশান্তি, প্রজাপালন, গ্রগতি, রাজ্য শাসনের দিক নির্দেশিকা। এক কথায় ধম্ম।
অশোকস্তম্ভ বলতে আমরা শুধুমাত্র প্রহরারত চারটি সিংহের মূর্তিকে মনে করি।
প্রকৃতপক্ষে সেটা নয়। স্তম্ভের সবার উপরে রয়েছে চারটি সিংহের মুখায়ব। অর্থাৎ
রাষ্ট্র রক্ষা, প্রজাপালনের সঙ্গে সাম্যের প্রতিষ্ঠায় রাজা বা শাসনকর্তাকে হতে হবে
সিংহের ন্যায় ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন। বন্যপ্রাণীকে
পরাহত করে বশে রাখবার জন্য সিংহ যে বীরবিক্রমে সাহসের সঙ্গে লড়াই করে, শাসনকর্তা
বা রাজাকেও হতে হবে অনুরূপ।
সিংহের নিচে রয়েছে চক্র (চাকা)। চক্রের
বৃত্তভাগে রয়েছে ঘোড়া, বলদ(গরু)। চক্র হল প্রগতির প্রতীক। আর এই প্রগতিরূপ চক্রকে
দ্রুততর হতে সাহায্য করবে ঘোড়া। আর বলদ (গরু) হল কৃষিনির্ভর ভারতের উৎপাদন ও
উন্নতির প্রতীক। অর্থাৎ কৃষি হল ভারতের সম্পদ উৎপাদনের মূলভিত্তি। আবার চক্রটি
রয়েছে জলজ পদ্মফুলের উপরে। অর্থাৎ প্রকৃতির অন্যতম সম্পদ জলের সমবন্টন। আর ফুল হল
প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, সম্মান প্রদর্শন ও অহিংসার প্রতীক। দুইয়ের সূক্ষ্ম
ভাবনায় জলজ পদ্মফুল। সিংহ, চক্র, বলদ, ঘোড়া, পদ্মফুল সমগ্রটাই রয়েছে হাতির পিঠে।
ধারক ও বহনকারী শক্তির প্রতীক হল হাতি। হাতি
ধীর, শান্ত, উদ্ভিদ বা তৃণ ভোজী। হাতি খাদ্যের
জন্য কোনো প্রাণীকে আক্রমন বা হত্যা করেনা। হাতির স্মৃতিশক্তি প্রখর। সে যা দেখে এবং শোনে সেটা আমৃত্যু মনে রাখে। প্রজননে হাতি
মাত্র একরারই সঙ্গম বা রতিক্রিয়া করে। দ্বিতীবার করেনা। বৃহদ দেহের সঙ্গে হাতির
প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করবার এটিও অন্যতম কারণ, তাই বন্য প্রাণীদের মধ্যে হাতি সবথেকে
কম ব্যাধিগ্রস্থ হয়। অর্থাৎ সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র শাসনে সমগ্র বিষয় ধারণ করবেন
হাতিরূপ রাজা।
বৌদ্ধ দর্শনের অর্থাৎ গৌতমবুদ্ধের সমাজ,
রাষ্ট্রগঠন, প্রজাপালন, সাম্য, প্রেম-ভালোবাসা, বাস্তব ভাবনার সমন্বয়ের সম্মিলিত
ভাবনার প্রতীক অশোকস্তম্ভ। যার স্রষ্টা বৌদ্ধ দর্শনের প্রয়োগ ও রূপকার সম্রাট
অশোক।
এবার আলোকপাত করা যাক মতুয়া দর্শনের প্রতীক
সিংহ ও হাতির আলিঙ্গনরত প্রতীকের মতুয়া দর্শন ভাবনা সম্পর্কে। বিশেষভাবে
মনে রাখা আবশ্যিক কোন প্রেক্ষাপটে, কি দর্শন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রতীক চিহ্নের
ব্যবহার বা অবতারণা করা হয়েছে।
মতুয়া দর্শনে সিংহ-হাতির আলঙ্গনরত প্রতীক চিত্রটির
ভুল- অপব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। মতুয়া দর্শনের শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
গ্রন্থে কৌশলি অবৈদিক হরিচাঁদ দর্শনের মর্মার্থ না বুঝে ঐসব ভুল বা অপব্যাখ্যা করা
হয়েছে। মতুয়া দর্শনকে কালিমালিপ্ত করতে, মনুবাদী-বৈদিক আর্যদের দাসত্ববৃত্তিতে
মতুয়া গবেষকদের দু/একজন সদাব্যস্ত। তার মধ্যে একজন হলেন নন্দদুলাল মহন্ত। তিনি তার “মতুয়া আন্দোলন ও দলিত জাগরণ” গ্রন্থের ১৭৩ নং পৃষ্ঠায় ভয়ঙ্করভাবে বিভ্রান্তিকর অপব্যাখ্যা করেছেন।
বইতে তিনি লিখেছেন- মতুয়াদের প্রতীক হল “একটি বৃত্তের মধ্যে একটি হস্তিকে একটি সিংহ
প্রবল বিক্রমে পরাভুত করছে। যার অর্থ হল কামরূপ মত্ত হস্তিকে ইন্দ্রিয় বশের সিং
পরাভূত করে জীবের কন্দরে অর্পিত প্রেমালোকে জগতকে আলোকিত করবে অন্তরের অনুরাগে।”
প্রকৃতপক্ষে অবৈদিক মতুয়া দর্শনে বিশ্বাসী
মতুয়া সমাজের প্রত্যেকের জীবন ও জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে এই চক্রান্তকারী
বিশ্লেষণী অর্থের প্রতিবাদ করা আবশ্যক। সিংহ–হাতির আলিঙ্গনরত প্রতীকের যে ব্যাখ্যা মহন্ত বাবু করেছেন, সেটা
হরিচাঁদ ঠাকুরের অবৈদিক মতুয়া দর্শনকে অবমাননা
করা এবং মনুবাদী শক্তির দাসত্ব করা। অথবা মতুয়া দর্শন ও শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের মর্মার্থ
না বোঝা অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকা একজন বিপদজনক ভয়ঙ্কর মতুয়া গবেষক পণ্ডিত।
ঐ ভয়ংঙ্কর গবেষক মতুয়া পণ্ডিত- এর অবগতির
জন্য জানাতে চাই ঋতুমতী সিংহীর সঙ্গে সিংহ
তিন দিন ধরে দৈনিক ৪০-৫০বার সঙ্গম (রতিক্রিয়া) করে। আর হাতি, হস্তিনীর সঙ্গে মাত্র
একবার (single time) সঙ্গম ( রতিক্রিয়া) করে। প্রাণী বিশারদদের কাছ
থেকে এর সত্যতা জেনে নেবেন। এর থেকে প্রমানিত কামরূপ মত্ত হাতি নয়; সেটি হল
সিংহ। ইন্দ্রিয় বশের প্রতীক প্রাণী সিংহ কখনই নয়; সেটি অবশ্যই হাতি।
এর থেকে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়
যে নন্দদুলাল মহান্তের ব্যাখ্যা সঠিক নয়। অবৈদিক মতুয়া দর্শনের সঙ্গে ঐ ব্যাখ্যা
সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তিমূলক।
শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত
গ্রন্থের এবং মতুয়াদর্শনের সিংহ–হাতির আলঙ্গনরত প্রতীকের দর্শনগত মূলভাবনাঃ-
হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়াদর্শন প্রকৃত অর্থে
অবৈদিক দর্শন। বৌদ্ধ দর্শনের সঙ্গে অবৈদিক মতুয়া দর্শন গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
মতুয়া দর্শনের সিংহ–হাতির আলিঙ্গনের প্রতীকী মর্মার্থ হল, হাতি অবৈদিক মতুয়া
দর্শনের ধারক বাহক। এক কথায় অবয়ব।
মতুয়া দর্শনে হিংসা, প্রতিহিংসা, আঘাত করা, নেই। অর্থাৎ হাতি শান্ত, ধীর,
শক্তিশালী, কিন্তু অন্য কোনো জীবকে আঘাত করেনা। সে তার আপন মনে বিচরণ করে। কিন্তু
হাতিকে কেউ বিব্রত বা আক্রমন করলে তবেই সে আত্মরক্ষার জন্য প্রতিবাদ করে। অন্যথায়
নয়। শুধুতাই নয়, হাতি বিশ্রাম না নিয়ে একটানা সাতদিন পথ চলতে পারে। মনুবাদী বৈদিক
আর্যধর্মের অবাস্তব পঙ্কলিতার মধ্যে বাস্তব সাম্যবাদী শান্তিকামী অবৈদিক মতুয়া
দর্শনকে দীর্ঘ পথও সময় পাড়ি দিতে হবে। যার প্রতীক হাতির সাতদিন একনাগাড়ে পথচলা।
অর্থাৎ হাতির জীবন শৈলীর উদাহরণ হল মতুয়া দর্শন।
আবার মতুয়া দর্শনের উপর, বৈদিক আর্য মনুবাদী
আক্রমন ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে অবৈদিক মতুয়া দর্শনকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে
মতুয়াভক্তদের সিংহের ন্যায় ক্ষীপ্রগতি সম্পন্ন হয়ে প্রতি আক্রমন করতে হবে। অর্থাৎ
আত্মরক্ষা ও দর্শন প্রতিষ্ঠায় প্রতি আক্রমন মতুয়া দর্শনে স্বীকৃত। সেই অর্থে মতুয়া
দর্শন প্রতিষ্টা ও অগ্রগতির প্রতীক হল সিংহ ও হাতির দ্বৌত শক্তির আলিঙ্গন বা
সম্মিলিত শক্তির মেল বন্ধন।
এক্ষেত্রে
মতুয়া ধর্ম দর্শনের পতাকা যদি লক্ষ করি তো দেখা যায় তিন কোনা পতাকার ভীতরে গাড়
লাল। যেটা বিপ্লবের প্রতীক। আর বাইরে সাদা বেড়ি দেওয়া। যেটা শান্তির প্রতীক। তো
এখানেও ঐ সিংহের ক্ষিপ্রতা ও দূরদর্শিতা এবং হাতির প্রবল শক্তি ও ধীর বা শান্ততা, বিপ্লবের
প্রতীক লাল ও শান্তির প্রতীক সাদা বেড়িকে
নির্দেশ করে।
তাই
মতুয়াদর্শনের প্রতীক সিংহ-হাতির আলিঙ্গন বা মেলবন্ধন অশোকস্তম্ভের বৌদ্ধ দর্শন
ভাবনার সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই। সম্রাট অশোক বৌদ্ধদর্শনের আদর্শে সমাজ ও
রাষ্ট্রের মধ্যে প্রজাকল্যান সাধনের বাস্তব রূপদান করেছিলেন। মতুয়া দর্শনে সেই
একইভাবে সাম্যের দর্শন প্রতিষ্ঠা করতে হবে তার প্রতীকি চিত্র সিংহ ও হাতির
পারস্পরিক সহযোগীতার আলিঙ্গন বা
মেলবন্ধন।
পাঠকবর্গের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।
___________________
ছবিটা খুব ভালো করে লক্ষ্য করুন। সিংহের মুখে হাতির মাথা। অর্থাৎ সিংহ হাতিকে আক্রমণ করেছে। সিংহ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতীক, হাতি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক। কোথায় পেলাম এ কথা? কল্কে পুরাণ। এই প্রতীক কে বা কারা কবে থেকে মতুয়া ধর্মের প্রতীক বানালো? সেটা যদি জানান। মতুয়াদের মধ্যে বৌদ্ধ ও আম্বেদকর বিরোধিতা প্রবল এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি ঝোঁক কি এই কারণে?
ReplyDelete