লেখক
–জগদীশচন্দ্র রায়
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর,
গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপস্থিতিতে
লক্ষ্মীখালীতে বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীজনদের নিয়ে এক বিরাট জাগরণী সভা হয়। সেই
সভায় –
প্রভু
বলে “শোন সবে নমঃশূদ্রগণ।
ধর্ম্ম
শক্তি বিনা জাতি জাগেনা কখন।। (গু. চ.পৃঃ ৫২৯)
তিনি
নমঃশূদ্রদের জানান,জাতিকে জাগাতে হলে ধর্ম্মের শক্তির দরকার আছে। এই শক্তির মাধ্যমেই মানুষকে একতাবদ্ধ করা যাবে। তবে তিনি ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে
গ্রহণ করলেও ধর্ম বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেননি। মানুষকে জাগ্রত করার শিক্ষার মধ্যে
নিয়ে যাবার জন্য, বৈষম্য দূর করার জন্য ধর্মকে এক ধরনের ভাষা অর্থাৎ প্রকাশের
মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
মতুয়াদেরকে কাঁর পূজা করতে হবে আর কার পূজা করবেনা;
সে বিষয়ে তিনি এক অমোঘ বাণী দেন। যে বাণীকে প্রত্যেক মতুয়া অনুরাগীদের ভেবে
দেখা দরকার।
দেবতা-মন্দির
সবে গড়’ ঘরে ঘরে।
নিত্য
পূজা কর সেথা সরল অন্তরে।।
এইখানে
আমি বলি’ এক সমাচার।
দেবতা-মন্দিরে
পূজা করিবে কাহার?
বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।। (গু. চ. পৃঃ ৫২৯)
পাঠকগণ
খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করুণ, গুরুচাঁদ ঠাকুর ঘরে ঘরে দেবতার মন্দির গড়ার কথা বলছেন।
কিন্তু তিনি আবার প্রশ্ন করছেন যে, সেই মন্দিরে কাঁর পূজা করা হবে? তিনি
নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে
দৃপ্তকন্ঠে এক অমোঘ নির্দেশ দিয়েছেন যে, “এই মন্দিরে এমন ঈশ্বরকে স্থাপন করে পূজা
করবে, যে ঈশ্বর সারা বিশ্বময় বিরাজ করছে। যে ঈশ্বর মানুষকে তাদের প্রতি অন্যায়,
অত্যাচার, সামাজিক ধর্মীয় বিষয়ে জাতিভেদ ও সমস্ত অসমানতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠে
সংগ্রাম করেছেন। এইসব সমস্যা থেকে পিড়ীতদের উদ্ধার করেছেন। সেই ঈশ্বরের পূজা করতে
হবে।” তবে সেই পূজা কেমন করে হবে? সেই মন্দির কেমন হবে? এখানে মন্দির অর্থ কিন্তু
শুধু মূর্তি স্থাপনের জন্য নয়; শুধু ঘট ফুল পাতা ইত্যাদি প্রচলিত পূজাচার নয়।
এখানে মন্দিরের আর একটি বৃহত্তর অর্থ হচ্ছে মন মন্দির, শিক্ষার উপকরণের মন্দির। যে
মন মন্দির সুশিক্ষার উপকরণে পরিপূর্ণ হবে। যে মন্দিরের অর্ঘ দেশ সমাজ ও জাতির
মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে। প্রগতির ক্ষেত্রে
জাগরণ ঘটাবে। যার জন্য তিনি বলেছেন-
‘বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যা’রে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।’
এখানে
ঈশ্বরের ব্যাখ্যাটাকে কিন্তু গতানুগতিকতার ঊর্ধে গিয়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরে বলা
হয়েছে যে, যে যাহাকে উদ্ধার করে সে
তার ঈশ্বর। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে কোন অলীক কেউ নন। ঈশ্বর হচ্ছেন উদ্ধার কর্তা। আর এই
উদ্ধার কর্তাকেই লোকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন।
তো এই নীপীড়িত বঞ্চিতদের উদ্ধার কর্তার কথা
যদি বলতে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাই- মহামানব গৌতম বুদ্ধ, হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ
ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা
সাহেব ড. ভীম রাও আম্বেদকর, পেরিয়ার, গুরু নানক, গুরু রবিদাস, মাতা
সাবিত্রিবাই ফুলে, মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে ইত্যাদি। আবার বিশ্বের অন্যান্য দেশেও
এরকম দেখতে পাই- যেমন- মার্টিন লুথার, জন আব্রাহাম লিঙ্কন, নেলসন মেন্ডেলা
ইত্যাদি।
এই
মহামানবেরা নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষদের
অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাই এই মহামানবেরা এই অর্থে ঈশ্বর বা
উদ্ধার কর্থা।
তোমাদের
এই কুলে হরি অবতার।
দয়া
করে নমঃশূদ্রে করিল উদ্ধার।।
তাঁর
পূজা কর সবে তাঁর ভক্ত হও।
নিজ
ঘরে ভগবান ফেলে কোথা যাও? (পৃঃ ৫২৯)
তোমাদের ঈশ্বর বা অবতার যা-ই বলোনা কেন, তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠকুর। তিনিই
তোমাদের উদ্ধার কর্তা। তাই তোমরা তাঁর পূজা কর। তবে এই পূজা শুধুমাত্র ফুল, বেল
পাতা, চিনি, বাতাসার নয়; এই পূজা হরিচাঁদ ঠাকুরের কর্ম ও আদর্শের পূজা। যে পূজার
ফলে জাতি, সমাজ ও দেশের মঙ্গল হবে। কিন্তু মতুয়ারা নিজেদের ভগবানকে চিনতে না পেরে
হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই যে সব ‘বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি’ বলে ঘোষণা করেছেন,
সেসব নিজে মেতে আছেন। আর হরি-গুরুচাঁদকেও তাদের মধ্যে গুলিয়ে দিচ্ছেন। সেজন্য
গুরুচাঁদ ঠাকুর তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন - তোমরা তোমাদের নিজের ঘরের ভগবানকে
ফেলে রেখে অন্য কোথায় যেতে চাইছো? এতো স্পষ্ট করে বলার পরেও আজ মতুয়ারা বিপথগামী
কেন??
_____________
নিজের মনমত লেখা।
ReplyDelete