Skip to main content

বুদ্ধ – হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের দর্শনের সমন্বয় লেখক - জগদীশচন্দ্র রায়





















বুদ্ধ – হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের দর্শনের সমন্বয়
জগদীশচন্দ্র রায় M. No. 9969368536 email ID roy.1474@gmail.com

    ১.“বুদ্ধ” শব্দের অর্থ লব্ধ-জ্ঞান। তিনি যে তত্ত্বের অধিগম-দ্বারা এই উপাধি গ্রহণ করেন, সেই তত্ত্বের পারিভাষিক “প্রতীতাসমুৎপাদ।  “অবিদ্যার ধ্বংসই দুঃখমোচনের একমাত্র উপায়—এই মহাতত্ত্ব তিনি (বুদ্ধ) উপলব্ধি করিলেন। পৃথিবীর যত দুঃখ তাহা এই অবিদ্যার ডালপালা হইতে জাত; অবিদ্যা-তরুর ক্রমবিকাশ এইরূপ অবিদ্যা হইতে সংস্কার, সংস্কার হইতে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান হইতে নামরূপ, নামরূপ হইতে ষড়ায়তন, ষড়ায়তন হইতে স্পর্শ, স্পর্শ হইতে বেদনা, বেদনা হইতে তৃষ্ণা, তৃষ্ণা হইতে উপাদান, উপাদান হইতে ভব, ভব হইতে জাতি, জাতি হইতে জরামৃত্যু, শোক, পরিদেব, দৌমনস্য, উপায়নের উৎপত্তি হইয়া থাকে। আত্যন্তিক দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা। 
   “অবিদ্যা ধ্বংসের আটটি উপায় ভগবান্‌ বুদ্ধ নির্দেশ করিয়াছেন-সম্যক, দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্‌, সম্যক্‌ কর্মান্ত, সম্যক্‌ আজীব, সম্যক্‌ ব্যায়াম, সম্যক্‌ স্মৃতি ও সম্যক্‌ সমাধি—এই আটটি  উপায়ের নাম আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। গৌতম অবিদ্যার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্যক উপলব্ধি করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “এই দুঃখের গৃহ, কে নির্ম্মাণ করিয়াছে তাহাকে আমি ধরিয়া ফেলিয়াছি। এখন সেই নির্ম্মাতা আর গৃহ রচনা করিতে পারিবে না।------ অবিদ্যাজাত কামনাই এই দুঃখের ঘর বারংবার রচনা করিয়াছে।”
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১০০/১০১)   
এই বিষয়ে মহাত্মা জ্যোতিরাও বলেছেন-
 বিদ্যাবিনা মতি (বুদ্ধি) গেছে
মতিবিনা নিতি (আদর্শ) গেছে
নিতিবিনা গতি (দিশা) গেছে
গতিবিনা বিত্ত (সম্পত্তি) গেছে
বিত্তবিনা শূদ্রের পতন হয়েছে
এতো সব অনর্থ একমাত্র অবিদ্যার জন্য হয়েছে।

আর গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-  বিদ্যা ছাড়া কথা নাই বিদ্যা কর সার।
বিদ্যাধর্ম, বিদ্যাকর্ম, অন্য সব ছার।।
বাঁচ বা না বাঁচ, প্রাণে বিদ্যাশিক্ষা চাই।
বিদ্যাহীন হ’লে বড় তার মূল্য নাই।।
বারে বারে বলি তাই স্বজাতির গণ।
শেখ বিদ্যা রাখ বিদ্যা করে প্রাণপণ”।।   -গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ১০৮ 

২. একদা ভরদ্বাজ নামক এক বণিকের গৃহে বুদ্ধ ভিক্ষুবেশে মুষ্টিভিক্ষা করিতে গিয়াছিলেন। বণিক্‌ তাঁহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিল- “তুমি সুস্থদেহ, অন্যের শ্রমলব্ধ শস্য লইতে  আসিয়াছ কেন/ আমি তোমাকে কিছু জমি দিতেছি, তুমি উহা হইতে শস্য উৎপন্ন করিয়া জীবিকা অর্জ্জন করিতে শিখ।”
    বুদ্ধদেব বলিলেন, “আমি কৃষিকার্য্যই করি, তবে আপনাদের কৃষির সহিত আমার কৃষির একটু তফাৎ আছে। মানুষের মনই আমার জমি, যত্ন ও উৎসাহ দুটি বলদ, লাঙ্গলের ফাল বিনয়, জ্ঞান হল (হাল) এবং বিশ্বাসই আমার বীজ। এই বীজ হইতে নির্ব্বাণ-ফল উৎপন্ন হয়।”
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১০১)   

এ ক্ষেত্রে আমরা শ্রীশ্রীহরি লীলামৃতে দেখতে পাই-
অফলা জমিতে আমি সুফল ফলাই।।
যশোমন্ত পুত্র আমি নাম হরিচাঁদ।
এবার করিব যত পতিত আবাদ।।
এদেশে আবাদী তোরা চিনিলি না কেহ।
মাটী যে অফলা থাকে এ বড় সন্দেহ।।
পতিত আবাদ জন্য আশা এ দেশেতে।
কি ফল ফলিবে টের পাবি ভবিষ্যতে।।
খাটি মাটি হলে ফল নাহয় বিফল।
ভক্তি করে ডাকে তারে দেই প্রেমফল।।
যে ফল চাহিবি তোরা সে ফল পাইবি।
কল্প-বৃক্ষমূলে যদি প্রার্থনা করিবি।।
সফলা নগরী রই যে চাহে যে ফল।
বিফল না হয় ফল সে পায় সে ফল।।
বীজ আন বুনি ধান ফল পাবি শেষে। (শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ ৫০)

 ৩. বৌদ্ধধর্ম্মের যে বিরাট শক্তি উত্তরকালে জগতের ১/৩(এক তৃতীয়াংশ) গ্রাস করিয়া (দেখুন ভাষা প্রয়োগ ‘গ্রাস’ এখানে বিস্তার বা প্রসার কথা না দিয়ে ‘গ্রাস’ শব্দের প্রয়োগ কি মানসিকতা প্রকাশ করে?) অপর ২/৩ (দুই তৃতীয়াংশ) অংশের নিকটও আত্মপ্রকশ পূর্ব্বক তাহাও স্বকীয় প্রভাবান্বিত করিয়াছিল, তাহার মূলে ছিল সঙ্ঘশক্তি।
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১০৩)   

 ৪. বুদ্ধ গৃহাশ্রমকে নিন্দা করেন নাই, কিন্তু ভিক্ষুকে গৃহস্থ হইতে উচ্চতর সম্মান দিয়াছেন।
(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১০৫)   

  ৫. দেহ ভিন্ন পাপ পুণ্যাদি সমস্ত কর্ম্মের ফলভোগী কোন আত্মাদি নাই। এই মিথ্যা-ভূত অখিল সংসারে জীবগণ মোহবশতঃ এই সলক অনুভব করিয়া আসিতেছেম যখন মাতা-পিতা হইতে পুত্র উৎপন্ন হইতেছে, আর সেই কুম্ভকারাদি কর্ত্তৃক যখন নিরন্তর ঘটাদি উৎপাদিত হইতেছে, তখন সৃষ্টির জন্য ভাবনা কি আছে?  অর্থা সৃষ্টি কিরূপে হয়, তাহাতো চক্ষুর সম্মুখেই দেখিটেক, এজন্য পৃথক্‌ সৃষ্টিকর্ত্তা স্বীকার করিবার প্রয়োজন কি? (তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১১৩)   
 
 ৬. বুদ্ধের নির্দ্দিষ্ট অষ্টাঙ্গিক মার্গ সাধনার সহজ উপায়,-- উহাতে সম্যক্‌ সঙ্কল্প, সম্যক্‌ বাক্‌, - প্রজ্ঞাবন্ধ, সম্যক্‌ ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক্‌ সমাধি- সমাধিস্কন্ধ এবং সম্যক্‌ বাক্য, সম্যক্‌ কম্মান্ত ও সম্যক্‌ আজীব- নীলঙ্কন্দের অন্তর্গত। এই অষ্ট মার্গ ছাড়া দশতি নিষেধ- বিধির উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ-
১. পানাতিপাত- প্রাণীহত্যা হইতে বিরতি।
২. অনিন্নাদান- অদত্তা দান বা চুরি।
৩. কামেসুমিচ্ছাহার- মিথ্যা কামাচার।
৪. মুসাবাদ- মিথ্যা কথা বলা।
৫. পিসুনবাদ- ভেদ বাক্য।
৬.করুদবাদ- কর্কশ কথা বলা।
৭. সম্মপ্পলাপ—নির্থক কথা বলা।
৮. অভিজ্‌ ঝা- পরদ্রব্যে লোভ।
৯. ব্যাপাদ – মানসিক হিংসা।
১০. মিচ্ছাদিট্‌ঠি- বিপরীত জ্ঞান।”(তথ্যঃ- ‘বৃহৎ বঙ্গ’ ১ম খন্ড –লেখক – দীনেশচন্দ্র সেন।  পৃঃ ১১৭)    

 বুদ্ধের ন্যায় হরিচাঁদ ঠাকুরও তাঁর ধর্ম দর্শনে অনুরাগীদের জন্য বারটি(১২) আজ্ঞা বা আদেশ দিয়েছেন। যাকে বলা হয় দ্বাদশ আজ্ঞা
সেগুলো নীচে দেওয়া হল-
 (১) গার্হস্থ্য ধর্ম পালন বা এক নারী ব্রহ্মচারিঃ
                                     করিবে গার্হস্থ্য ধর্ম লয়ে নিজ নারী।
                                     গৃহে থেকে সন্ন্যাসী বানপ্রস্থ ব্রহ্মচারী ।। (লীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃঃ ৮)
(২) সত্য কথা বলাঃ গৃহধর্ম রক্ষা করে বাক্য সত্য কয় ।
                                     বানপ্রস্থী পরমহংস তার তুল্য নয় । (ঐ পৃঃ ৮)
(৩) পরদুঃখে দুখী হওয়া এবং দুঃখীকে সহযোগিতা দানঃ
                                     পরনারী মাতৃতুল্য, মিথ্যা নাহি কবে ।
                                     পরদুঃখে দুঃখী সদাই সচ্চরিত্র রবে ।। (ঐ পৃঃ ৮)
(৪) সাধন, ভজন, দীক্ষা, তীর্থ পর্যটন প্রভৃতি আচার সর্বস্বতা পরিত্যাগ করাঃ
 দীক্ষা নাই, করিবে না তীর্থ পর্যটন ।
মুক্তিস্পৃহা শূন্য, নাহি সাধন ভজন ।। (ঐ পৃঃ ৮)
(৫) ভাবের আবির্ভাবঃ
গৃহেতে থাকিয়া যার ভাবোদয় হয় ।
সেই সে পরম সাধু জানিবে নিশ্চয় ।(ঐ পৃঃ ৩২)
(৬) গৃহধর্ম ও গৃহকর্ম  করাঃ
গৃহধর্ম গৃহকর্ম করিবে সকল ।
হাতে কাম মুখে নাম ভক্তিই প্রবল ।।
(৭) জ্ঞানতত্ত্বঃ
 কিবা শূদ্র কিবা ন্যাসী কিবা যোগী কয় ।
 যেই জানে আথতত্ত্ব সেই শ্রেষ্ঠ হয় ।।
(৮) জীবের প্রতি দয়া করা ও মানুষের প্রতি নিষ্ঠা রাখাঃ
                                     জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা ।
                                     ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা ।।(ঐ পৃঃ ১১)
(৯) উদ্ধার কর্তাকে(হরিচাঁদ)ঈশ্বর মনে করাঃ
“যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর।”(শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত পৃঃ নং ১ )
                                    বিস্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর ।
                                    যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর ।। (শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত- পৃঃ ৫৭২)
(১০) কর্ম ও ধর্মের সমন্বয় সাধনঃ
                                    মালাটেপা ফোটাকাটা জলফেলা নাই ।
                                     হাতে কাম মুখে নাম মনখোলা চাই ।।
(১১) পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, দেহ ও মনশুদ্ধ রাখাঃ
                                    নরনারী প্রাতঃস্নান অবশ্য করিবে ।
                                    দেহশুদ্ধি চিত্তশুদ্ধি অবশ্য আসিবে ।
(১২) সংযম রাখাঃ
পরপতি পরসতী স্পর্শ না করিবে ।
না ডাক হরিকে, হরি তোমাকে ডাকিবে ।।
হরিচাঁদ নির্দেশিত এসব গুণের অধিকারি একজন গৃহী হয়ে ওঠা আসল কথা । এসব গুণের অধিকারি কোন গৃহী হরিকে না ডাকলেও হরি তাকে ডাকবেন ।
উপরে উল্লেখীত গুলোকে দ্বাদশ আজ্ঞা বলা হলেও এরকম আরো বেশ কিছু আজ্ঞা বা নির্দেশ আছে লীলামৃতের পাতায় পাতায় ।
    এই আদেশের সঙ্গে সাতটি নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হ', যাকে বলা হয় সপ্ত নিষেধাজ্ঞা। সে গুলো হ'লঃ- (১)ভিন্ন গুরু ও ভিন্ন দল না করাঃ
                                     মতুয়ার এক গুরু ভিন্ন গুরু নাই ।
                                     মধ্যস্বত্ত্ব জমিদারি ধর্মক্ষেত্রে নাই ।।
                                     ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ করো না গোসাই ।
(২) নারী দিয়ে অঙ্গ সেবা না করাঃ
নারী দিয়ে অঙ্গসেবা হবে ধর্মক্ষয় ।
তেল ঘসা অঙ্গসেবা মহা ব্যাভিচার ।
(৩) পরনারীকে মাতৃ জ্ঞান করে দূরে থাকা ।
(৪) পরিহাস বাচালতা কখন না করা ।
(৫)মদ গাঁজা না খাওয়া এবং চুরি না করা ।
(৬) তাস-দাবা-জুয়া খেলা সব ছেড়ে দিতে হবে
(৭) কাউকে (অর্থাৎ দেব-দেবীর প্রতি) ভয় করার দরকার নেই।
                                    হরি বলে ডঙ্কা মার শঙ্কা কর কারে ।
                                    শ্রীহরি সহায় তব,  সাথে সাথে ফেরে ।।
এছাড়া- ভেকধারী বৈরাগীকে ভিক্ষা দিতে মানা করা হয়েছে, কারণ তাদের ভীক্ষা দিলে ব্যাভিচার আরো বেড়ে যাবে
 আবার বৈদিকতার বিধান ও আচার বিচারকে না মানতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

    এই আদেশ ও নিষেধগুলো পালন করার নির্দেশ এইজন্য দেওয়া হ'ল যাতে মানুষ তার মনুষত্বকে খুঁজে পায় অলীকতার পিছনে বোকার মত ঘুরে না বেড়ায় ।
এইভাবে আমরা দেখতে পাই হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা ও সপ্তম নিষেধাজ্ঞা।   



Comments