চন্ডাল তথা
নমঃশূদ্ররা কি ব্রাহ্মণ?
লেখক – স্বপন
কুমার বিশ্বাস
(বই-
হরি-গুরুচাঁদ বাঙলার চণ্ডাল ও ভারতবর্ষের
অভ্যুত্থান পৃষ্ঠা ক্রমাঙ্ক ৬০ থেকে ৬৫)
---- একদল নমঃশূদ্র নিজেদের
ব্রাহ্মণ বলে পরিচিত করানোর চেষ্টা করে। তাতেই তারা আনন্দ পায়। কেন? একি কেবল
হীনমন্যতা প্রসূত পলায়ন মনবৃত্তি না ঐতিহাসিক তত্ত্ব ভিত্তিক সত্য? হরিচাঁদ
বেদ, ব্রাহ্মণ মানেননি। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন ও বৈপ্লবিক আধ্যাত্মিক আন্দোলনের
মাধ্যমে তিনি জাতিভেদ ব্যবস্থার বিলোপ করার সাধনা করেছেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে কিংবা
তাঁর পরিবার বা বংশকে এবং সর্বশেষে, সমগ্র চণ্ডাল তথা নমঃশূদ্র জাতিকে ব্রাহ্মণ
হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা যে কত বড় অপপ্রচেষ্টা তা নির্ণয় করাও কঠিন।
চণ্ডাল জাতির কিছু সম্পন্ন মানুষ সামাজিক
মর্যাদা অর্জনের জন্য চেষ্টা চালান। এর জন্য তৎকালে তাদের সামনে দুটি মাত্র পথ
খোলা ছিল, প্রথমতঃ ধর্মান্তরিত মুসলমান হওয়া দ্বিতীয়তঃ হিন্দুদের মাঝে হিন্দু ব্রাহ্মণ
সমাজপতিদের দ্বারা গ্রহণযোগ্য স্তরে স্থান লাভ করা। তৎকালে প্রায় এক কোটি চণ্ডাল জাতির সদস্য মুসলমান ধর্ম গ্রহণ
করে মানুষ হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নেয়। একদল যারা চৈতন্য মহাপ্রভুর
অত্যাচারে এবং অন্যবিধ প্রচারের প্রভাবে মুসলমান খ্রীষ্টান হতে পারেনি, তারা
হিন্দুদের পঙ্তিতে আশ্রয় গ্রহণের চেষ্টা
চালায়। এক দল ব্রাহ্মণ সমাজপতিও এমনি
শূদ্র-স্বেচ্ছাদাস বানাবার এক সুযোগ খুঁজছিলো।
সামান্য শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত
সদস্যরাই দলিত বহুজন সমাজকে স্ব-স্বার্থে ধোঁকা দিয়েছে, বিপন্ন করেছে চিরকাল। তারা নানান ভাবে প্রমাণ
করতে চেষ্টা করেছে চণ্ডালেরা ব্রাহ্মণ, কিম্বা চণ্ডালেরা চণ্ডাল নয় তারা নমঃশূদ্র
এবং নমঃশূদ্ররা ব্রাহ্মণ। এই পথে তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের কাছে ঘেঁসার
চেষ্টা করেছে।
হরিচাঁদ জন্মের প্রায় শত বৎসর পরে তারক
গোঁসাই লেখা হরিলীলামৃত প্রকাশিত হয়। গ্রন্থমধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, জীবনীর
পাণ্ডুলিপি দেখে ঠাকুর হরিচাঁদ নিষেধ করেছিলেন জীবনী লিখতে। যাইহোক ইতিমধ্যে আমরা
লক্ষ্য করেছি চণ্ডালদের মধ্যে হিন্দু হবার একটা আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। যদিও
হরিচাঁদের ধর্ম ও দর্শনতত্ত্ব, ধর্মাচার ও পদ্ধতি সবই হিন্দুধর্ম তথা
ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে বিভিন্ন। তথাপি পরবর্তী কালের শিষ্যরা তাঁকে এবং তাঁর ধর্মকে
হিন্দুভুত করার ত্রুটি রাখেন নি। এবং আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য
অন্যায় ও হীন মনোভাব গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ হরিচাঁদকে ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভুত বলে পরিচয়
দেবার ব্যবস্থা করে। বলা হয়, তার পূর্বজ পুরুষ, উত্তর বিহারের মিথিলা অঞ্চলের একজন
ব্রাহ্মণ সাধু পুরুষ ছিলেন। তিনি পূর্ববঙ্গে এসে নমঃশূদ্র কন্যার পাণী গ্রহণ
করেছিলেন। তারপর থেকে বংশটি নমঃশূদ্র বলে পরিচিত হয়।
এমনকি মহাকবি মহানন্দ হালদার মীড সাহেবের
মুখে উচ্চারণ করিয়েছেনঃ-
“আমি বলি এই জাতি নিশ্চয়
ব্রাহ্মণ।
হীন হয়ে আছে শুধু হিংসার
কারণ।।
আদি কালে এরা সবে ছিল যে
ব্রাহ্মণ।
ক্ষুদ্র কিম্বা শূদ্র
এরা হবে না কখন।।”
এমন মতবাদ জাতিতত্ত্বের হিসাব নিকাশে মেলে
না। কারণ, প্রথমতঃ জাতকের জাত পিতার জাত হিসাবেই নির্ধারিত হয়। কন্যার জাত থেকে হয়
না। দ্বিতীয়তঃ যে অতীত কালে হরিচাঁদের পূর্বপুরুষ নমঃশূদ্র কন্যা বিবাহ করেন বলে
বলা হয়েছে, সেইকালে চণ্ডালী মাতার গর্ভের সন্তান নমঃশূদ্র বলে পরিচিত হয়েছিল, এমন
কথা শাস্ত্র সম্মত নয়। নমঃশূদ্র তখন ছিলই না।
এই সব দাবী-দাওয়ার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
কোন শাস্ত্র বা লিখিত প্রমাণ নেই। দাবীগুলি যে অলীক ও কৃত্রিম সে কথা নানান ভাবে
বোঝা যায়। বঙ্গ দেশে তৎকালেই এক কোটি সংখ্যার
বেশি চণ্ডাল ছিল। প্রায় নব্বই লক্ষ চণ্ডাল মুসলমান হয়ে যায়। সংখ্যা তত্ত্বের দিক
থেকে অনায়াসেই বলা যায়, এত সংখ্যক ব্রাহ্মণ পূর্বভারত তথা বঙ্গদেশে তৎকালে থাকতেই
পারেনা। ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণের সংখ্যা কখনও ৩% - ৩.৫% শতাংশের বেশি হয়নি। কিন্তু বঙ্গদেশে
চণ্ডালের সংখ্যা মোট জন সংখ্যার প্রায় ৯%
শতাংশে ছিল। এর সঙ্গে আসল ব্রাহ্মণের সংখ্যা যুক্ত হলে দাঁড়ায় প্রায় ১৪% শতাংশ।
সপ্তশতী (শূদ্রব্রাহ্মণ) কিম্বা আদি সুরের আনিত পঞ্চ ব্রাহ্মণ যাই হোক না কেন;
ব্রাহ্মণ হীন, বেদবাহ্য বঙ্গদেশে মাত্র কয়েকশ বছরে ব্রাহ্মণের সংখ্যাবৃদ্ধির হার
যদি আর্যাবর্তের আর ব্রহ্মবর্তের মাত্র ৩% - ৪% শতাংশ ব্রাহ্মণের সঙ্গে তুলনা করা
যায় তবে নিশ্চিতই, অবিশ্বাস্য মনে হবে। উত্তর প্রদেশের তথা আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ
সংখ্যা ৪% শতাংশের বেশি নয় আজও। বঙ্গে কি করে সেকালেই দেড় দুই কোটি ব্রাহ্মণ হবে?
এই ধরণের ভাবনা হিসাবে মেলেনা। নমঃশূদ্ররা
যদি চণ্ডাল না হত, তারা সকলে যদি ব্রাহ্মণ হত তবে সর্বমোট ব্রাহ্মণের সংখ্যা কত
হত? এই কালে, যুগী ও বৈদ্যজাতের লোকেরাও নিজেদের ব্রাহ্মণ বলে দাবী করে আন্দোলন
চালিয়েছিল। ভারতবর্ষের সব কটি প্রদেশে ব্রাহ্মণের শতকরা সংখ্যার সঙ্গে বঙ্গের
ব্রাহ্মণের শতকরা সংখ্যার কি মিল থাকে? যে দেশে অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীর পূর্বে
ব্রাহ্মণ ছিল না সেই পাণ্ডব বর্জিত দেশে এত বিপুল সংখ্যক (চন্ডাল + ব্রাহ্মণ +
যুগী + বৈদ্য + ধর্মান্তরিত চণ্ডাল + মুসলমান) ব্রাহ্মণ উৎপন্নের হিসাব কোন
ম্যালথাস সাহেব দিতে পারবেনা। চণ্ডালের ব্রাহ্মণত্ব ঐতিহাসিক ও গাণিতিক দিক থেকে
অবাস্তব।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতভুক্তি
করণের মাধ্য দিয়ে হিন্দুকরণের বা ব্রাহ্মণের দাস হিসাবে পরিণত করার কাজের স্রোত এত
প্রবল হয়েছিল যে এই একই সময়ে বঙ্গের কায়স্ত, মাহিষ্য, রাজবংশী, পোঁদ-পৌন্ড্র, হাড়ি
ইত্যাদি জাতের লোকেরা নিজেদের ক্ষত্রিয় হিসাবে দাবী করতে থাকে। সরকারী নথিতে
ক্ষত্রিয় পরিচয় লিপিবদ্ধ করানোর জন্য শাস্ত্রের অকাট্য যুক্তি প্রমান দেখায়। এভাবে
দেখা যায় বেদবাহ্য বঙ্গের প্রায় ৩০% ব্রাহ্মণ এবং ৬০% ক্ষত্রিয় জাতের বা বর্ণের
মানুষ।
আর্যসংস্কার তথা মনোবৃত্তি বলে, যা কিছু
প্রবল এবং ভাল গুণ সম্পন্ন তাই ব্রাহ্মণজাত, আর্য বিষয়। আর যা কিছু মন্দ, দুর্বল, কদাকার কিম্বা
ভারতীয় তা অন-আর্য। পক্ষান্তরে বলা যায়, যা কিছু ভারতীয় অন্আর্য এবং অব্রাহ্মণ্য তাই মন্দ,
নিন্দনীয় ও অস্থায়ী। তার মধ্যে উজ্জ্বল ও প্রশংশনীয় কিছ থাকতে নেই। বঙ্গের
প্রবল, সংখ্যাবহুল বিকাশশীল চণ্ডালদের মুক্তিসূর্যের মহিমময় জ্যোতির্লোক
হরি-গুরুচাঁদকে তাই আত্মস্মাৎ করে নিতে হবে ব্রাহ্মণ বলে? চণ্ডাল জাতির শৌর্য এবং
মানবিক সাধন-সিদ্ধির প্রতি এ এক অন্যায় ব্যঙ্গ এবং বিদ্রুপ মাত্র। ব্রাহ্মণ হওয়া
কোন গৌরবের নয়। ব্রাহ্মণজাত ভারতবর্ষের প্রগতি- বিকাশ এবং উত্থানের জন্য কোন
অবদানই –ত রাখেনি। ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণদের কোন অবদান যদি থাকে তবে
তা দাসপ্রথার স্থায়ীত্ব দান, দাসদের সংখ্যা বৃদ্ধি। “ছোট ছোট এই সব (ভারতীয়)
গোষ্ঠী ছিল, জাতিভেদ ও কৃতদাসত্ব দ্বারা কলুষিত। অবস্থার প্রভুরূপে মানুষকে উন্নত
না করে তাকে (ব্রাহ্মণেরা) করেছে বাহিরের অবস্থার পদানত। স্বয়ং-বিকশিত একটি সমাজ
ব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তমান প্রাকৃতিক নিয়তি রূপে। এবং এইভাবে আমদানি
করেছে প্রকৃতির এমন পূজা, যা পশু করে তোলে
লোককে। প্রকৃতির প্রভু যে মানুষ তাকে হনুমানদেব রূপী বানর এবং শবলাদেবী রূপী গরুর
অর্চনায় ভুলুন্ঠিত করে অধঃপতনের প্রমাণ দিয়েছে।” Indian Castes, those decisive impediments to Indian progress and
Indian power’ জাত ভেদ ব্যবস্থা ভারতীয় শক্তি ও প্রগতির চূড়ান্ত
প্রতিবন্ধকতা। সুতরাং ব্রাহ্মণ হবার পিছনে কোন গৌরব থাকতে পারে না। শোষক-দলক-ঘৃণক
যারা, তাদের বিরুদ্ধে সদা দণ্ডায়মান ছিলেন গুরুচাঁদ।
বাংলায় তথা পূর্ব ভারতে ব্রাহ্মণ ছিল না
একেবারেই। ‘শপ্তশতি ব্রাহ্মণের কাহিনি যারা জানে তারা এটাও জানেন, যে গল্পটি অনঐতিহাসিক
কাহিনি। যদি ঐতিহাসিকও হয়, কৃত্রিমভাবে, উদ্দেশ্য
মূলকভাবে বানান গল্প নাও হয়, তাহলেও ঐ সাতশত ব্রাহ্মণ কিন্তু কাহিনি অনুসারেই
সাজানো ব্রাহ্মণ। গলায় উপবিতের মতন সুতো পরিয়ে গরুর পিঠে চড়িয়ে তাদের পাঠিয়ে ছিলেন
রাজা আদিশূর। আদিশূরের ঐতিহাসিক স্থানকাল নির্ণয় করা যায় না। তাহলে বলতে হয় এই সাতশত শূদ্রব্রাহ্মণ আর স্ত্রীহীন কনৌজ থেকে আগত
ব্রাহ্মণই যৌগিক শব্দের ‘নম’ এবং ‘শূদ্র’ বঙ্গ দেশে ব্রাহ্মণের সংখ্যা বৃদ্ধি করে
ছিল। সুতরাং সাধু সাবধান। আমাদের স্মরণে রাখা
দরকার যে বেদবাহ্য দেশের বামুন, রাজা রামমোহন রায় বেদের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বলে
কাশীর বামুনেরা তাঁকে অধিকার ভঙ্গের জন্য গালি দিয়েছিল। এ হেন অবস্থায়, বৈদ্য,
যুগী আর বিপুল সংখ্যক নমঃশূদ্ররা যদি, পূর্বোক্ত নকল জারজ ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সঙ্গে
ব্রাহ্মণের খাতায় নাম লেখায় তবে ইতিহাস ভূগোলের সাথে গণিতেরও গণ্ডগোল শুরু হবে।
তারা প্রশ্ন তোলেনি, নমঃশূদ্ররা যদি
ব্রাহ্মণ তবে ‘ব্রাহ্মণ’ এই বিশেষ্য লিখবে না কেন? নমঃশূদ্র লিখবে কেন? নমঃশূদ্ররা
যদি ব্রাহ্মণ, তবে বিহারের মৈথিলী ব্রাহ্মণ পুত্র পুর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র মেয়ে বিয়ে
করে, হরিচাঁদের সপ্তম ঊর্দ্ধপুরুষ ব্রাহ্মণত্ব হারায় কেন?
চণ্ডালেরা
তথা নমঃশূদ্ররা যদি ব্রাহ্মণই হবে তবে ব্রাহ্মণের (দশ দিনে শ্রাদ্ধ ছাড়া) অপরাপর
বিদ্যাশিক্ষায় অধিকারাদি নেই কেন? শ্রাদ্ধ ব্যবস্থাও তো অবৈদিক। চণ্ডাল তথা
নমঃশূদ্রদের জাতিগত চারিত্রিক লক্ষণ মোটেই ব্রাহ্মণাক্রান্ত নয়। ব্রাহ্মণের ন্যায়
এরা পরান্ন ভোগী, পরশ্রমশোষক, তঞ্চক, শঠ এবং বিবেকহীন নিষ্ঠুর নয়। এরা কঠোর শ্রমশীল
উৎপাদক, স্বনির্ভর, সৎ এবং অত্যন্ত সাহসী জাতি। এরা হৃদয়বাণ ও ধর্মপরায়ণ। রিজলের
মত----- এরা সর্বকর্ম পরঙ্গম। নৌচালনা, মৎস শিকার, যুদ্ধবিদ্যা, কৃষিবাণিজ্য,
বাস্তুবিদ্যা এবং চিকিৎসা (চাঁদসী) বিদ্যায় দক্ষ। ব্রাহ্মণেরা এসবের কিছুই পারে
না। জলে এবং ডাঙ্গায় এরা সমান পারদর্শী। এস্ফিভিয়াস অর্থাৎ উভয়চর বলে উচ্চপ্রশংশীত
হয়েছে চণ্ডাল জাতি, ইংরেজ বিদ্বান ও গবেষকগণ কতৃক।
এই সব অতিমহৎ ও সুদূর্লভ গুণ সম্পন্ন চণ্ডাল
তথা নমঃশূদ্রদের অপগুণের তথা সর্বপ্রকার অমানবিক
এবং পৈশাচিক কাজকর্মের গুণধর যে ব্রাহ্মণ তাদের দলভুক্ত করাটা চণ্ডালের কপালে
অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক লেপনের থেকেও বড় গ্লানিদায়ক। চণ্ডালকে ব্রাহ্মণ আখ্যা
দিলে প্রকৃতপক্ষে চণ্ডালকে চুড়ান্ত অপমান
করা হয়। ব্রাহ্মণ জাত তো অপরাধ জগতের অবতার। সেন্সাস কমিশনার মিঃ এল.
এস. এস. ও ‘মেলী, ভারতবর্ষ, অপরাধ
প্রবণ, সম্প্রদায় ও জাতিগুলির তুলনা মূলক বিচার করে লিখেছিলেনঃ “The
number of Muslim and Hindu convicts in Bengal is almost exactly proportionate
to their strength in the population…… The largest number of Hindu criminals are
Kayasthas and Brahmins.” ব্রাহ্মণদের
বহুবিবাহ, কুলীন প্রথা, বাল্যবিবাহ, বিধবা অত্যাচার, মন্দির বেশ্যা ব্যবসা, সতীদাহের
নারী হত্যা, ছোটজাত বলে মানুষের প্রতি অমানবিক ঘৃণা ইত্যাদি হাজারো ক্রাইমদোষে
কলঙ্কিত। কলঙ্কের ঐতিহ্যময় ব্রাহ্মণ হতে যাবেন কেন হরি-গুরুচাঁদ!!
হরিচাঁদ ঠাকুর যাদের পারিবারিক, উপাধী ‘দাস’
কিম্বা ‘বিশ্বাস’ ছিল, ভক্তদের দ্বারা ব্রাহ্মণ বলে কীর্তিত। বলা হয়েছে তার
পূর্বতন পিতৃপুরুষ শ্রীরামদাস বিশুদ্ধ এবং পূণ্যবাদ মৈথিলী ব্রাহ্মণ সন্তান
ছিলেন। তার পুত্র এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের সপ্তম ঊর্দ্ধপুরুষ চন্দ্রমোহন নমঃশূদ্র কন্যা
বিবাহ করেন, একারণেই এবং সেই থেকে বংশটি নমঃশূদ্র জাত হিসাবে পরিগণিত হয়।
প্রকৃত পক্ষে এই সব কথা অতীত ইতিহাস ভিত্তি
হীন। কোন প্রাচীন লিখিত প্রমাণ তথ্যের ভিত্তিতে
এ সব কথা তারক গোঁসাই লেখেন নি। যে কালে হরিচাঁদের পিতৃপুরুষের
দ্বারা নমঃশূদ্রের কন্যার পাণিগ্রহণের কথা বলা হয়েছে সে কালে নমঃশূদ্র কোথায়?
জাতিমালার কোন গ্রন্থেই নমঃশূদ্র নেই। এদের নাম ছিল চন্ডাল। নমঃশূদ্র শব্দের
আবির্ভাব মোটামুটি ১৮৮০ দশক থেকে। স্বং গুরুচাঁদ কিছু চেষ্টা করেছিলেন চণ্ডাল
নামের পরিবর্তে নমঃশূদ্র নাম দিতে। সুতরাং অতপ্রাচীন কালে নমঃশূদ্র কন্যা বিবাহের
কাহিনি কাল্পনিক বলেই বলতে হয়।
আরো দেখা যায়, বর্ণান্তরে বিবাহের ফলে,
নিয়মানুসারে পিতার বর্ণ বা জাতের নামে পরিচিত হয় সন্তান। যেমন, ব্রাহ্মন যদি
নমঃশূদ্র কন্যা বিবাহ করে, বর্তমান সমাজে আমরা দেখি সন্তানের পরিচয় ব্রাহ্মণই হয়।
নমঃশূদ্র যদি কায়স্ত কন্যা বিয়ে করে তাদের সন্তান নমঃশূদ্র এবং তপশীল ভুক্তই হয়।
কায়স্ত হিসাবে পরিচিত হয় না। হরিচাঁদের ব্রাহ্মণ প্রপিতামহ নমঃশূদ্র কন্যা বিবাহ
করার পরেও বংশধরেরা তো ব্রাহ্মণ হিসাবেই অন্ততঃ পতিত ব্রাহ্মণ হিসাবে গৃহীত হবে।
অস্পৃশ্য নমঃশূদ্র কেন হয়ে গেল? জাত তো
জনকের সূত্রে আগত। মাতৃসূত্রে নয়।
আবার শাস্ত্রে দেখা যায় ভিন্ন রকম। মনু
বলেছেন শূদ্র পিতা এবং ব্রাহ্মণ মাতার উত্তর পুরুষ চণ্ডাল নামে খ্যাত হয়। অর্থাৎ
ব্রাহ্মণ হয় না কখনই। দুজনের কারো জাতের নাম পায় না। নতুন এক সঙ্কর বর্ণের সৃষ্টি হয়।
তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রপিতামহের বেলায় এই অদ্ভূৎ, কৃত্রিম এবং পতনপদ অবস্থা ঘটল
কেন? পিতা ব্রাহ্মণ, মাতা নমঃশূদ্র। সঙ্কর
বর্ণ কিছু নতুন নাম পাবেতো? পিতৃ সূত্রে পাবে তো? শূদ্রের থেকেও নিম্নতম স্থান তথা
অস্পৃশ্যত্ব কি করে পায়? হিসাব, কোনভাবে না মেলায় একমাত্র এবং পরিষ্কার কারণ এই যে
এই পরিচয় পত্রটি একেবারেই বানানো এবং কৃত্রিম। চণ্ডালরা মাতৃসূত্রে আর্য; আর
নমঃশূদ্রতো প্রিতৃসূত্রে আর্য!
হরিচাঁদ ঠাকুরের ব্রাহ্মণ উৎস কোনভাবেই
তাদের কিম্বা তাঁর স্বজাতির মর্যাদা বাড়ায় না। বরং ভাবিকালের আদালতে ব্রাহ্মণজাতের দ্বারা কৃত
সব মানবতা বিরুদ্ধ অপকর্ম এবং অপসংস্কৃতি অনুষ্ঠানের সব দায় তাদের ঘাড়েও বর্তাবে। অন্য
পরে কা কথা স্বয়ং হরি-গুরুচাঁদ বলেছেন,
“দলিত গলিত যত পতিত
মানব।
ব্রাহ্মণের কুটচক্রে
মৃতপ্রায় সব।।”
মানব জাতিকে দলিত- গলিত পশ্বাধাম
করে রেখেছে যে জাত গোষ্ঠী, সেই কুচক্রি ব্রাহ্মণ নরগোষ্ঠী-সদস্য হতে যাবে কোন দুঃখে, ধন উৎপাদক,
সৎ ও উদার প্রাণের কৃষক সম্প্রদায়। হরি-গুরুচাঁদ
দলিত বহুজন, আর্ত সমাজের উদ্ধার কর্তা, তাদের জীবন ও সমাজের কালোত্তীর্ণ
ধ্রুবতারা, তিনি কি করে ব্রাহ্মণ হবেন? ব্রাহ্মণ তো দলিত বহুজন মানুষের নৈস্বর্গিক
দুষমন। ঘৃণক তারা মানবের। উপনিবিষ্ট, বিদেশী। শূদ্র শম্বুকের উত্থানে ব্রাহ্মণ
শিশুর অকাল মরণ ঘটে আর শূদ্র শম্বুকের
শিরচ্ছেদ হলে, তাঁর মরণ কাঠির যাদুস্পর্শে দূরবর্তী মৃত ব্রাহ্মণ কুমার পুনঃপ্রাণ
লাভ করে। দলিত বহুজন মানুষের প্রাণের ঠাকুর হরি-গুরুচাঁদ কি করে ব্রাহ্মণ হবে।
মিথ্যা কথা! সব ঝুট হ্যায়! হতেই পারে না।
যে মতুয়ারা, ‘জন্মগত জাতিকথা কয় না’ সেই
মতুয়া- জনক হরি-গুরুচাঁদের গলায়, ‘ব্রাহ্মণ’ – জাতের জুতোর মালা কেন পরাই?
---------------------------------------
সুন্দর তথ্য ভিত্তিক ব্যাখা পেলাম। এটার বহুল প্রচার হওয়া দরকার। বিশেষ করে বাংলাদেশ ভিত্তিক মতুয়া গ্রুপ( ফেসবুক পেজ), কোন ভাবেই এই কথাগুলি মানতে চায় না। তারা মনুবাদী মতুয়া হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
ReplyDeleteদারুণ তথ্য দার্শনিকের মতো যুক্তি- অসাধারণ।
ReplyDelete