লেখক – জগদীশচন্দ্র রায়
(বই- গুরুচাঁদ ঠাকুরের সমাজ সংস্কার ও মুক্তির
দিশা)
স্বাধীনতা যদি আসে, তা’হতে কি শ্রেষ্ঠ আছে?
বুঝিনা যে এত অন্ধ নই।
তবে যে নামিনা পথে,
বহু বাধা আছে তা’তে
এড়াইতে পারি বাধা কই? -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ
৪৪২
স্বাধীনতার
থেকে শ্রেষ্ঠ কিছু আছে কি? স্বাধীনতার মহত্ত্ব যে বুঝিনা এত বড় অন্ধতো আমি নই। তবে যে স্বাধীনতা আসবে সেটাকি দেশের সকল জনগণের
জন্য? নাকি মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণীয়দের জন্য? বর্তমান পরিস্থিতিতে এই স্বাধীনতা
আমাদের নিম্নবর্ণীয়দের জন্য সুফল ডেকে আনবেনা। সেটা সুবিধাবাদী উচ্চবর্ণীয়দেরই
স্বাধীনতা হবে। আমরা আজ যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের যাতা কলে পিষে মরছি, অশিক্ষার অন্ধকারে
ডুবে আছি, জাতব্যবস্থা বর্ণব্যবস্থার শিকল
আমাদেরকে যেভাবে প্রগতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে; স্বাধীনতার পরেও কিন্তু এর কোন
পরিবর্তন হবেনা। যার জন্য আমি এই পথে নামতে পারছিনা। আমার বিবেক বাধা দান করেছে।
আর সেই বাধাকে আমি এড়িয়ে যেতে পারিনা।
আচ্ছা, তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, অনুন্নত
জাতিগুলি এক সঙ্গে স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দিলেন। তারপর কি কাজ করবেন তারাঁ?
তাঁরা কোন কাজ পারেন? আর ফলাফল কি হবে এঁদের? আমাদের লোকেরা ক’জন চাকরী করেন? ক’জন
আদালতে ঘোরা ফেরা করেন? আমাদের লোকেরা প্রায় সকলেইতো বিদ্যালয়ের দোরগোরায় যেতে
পারেননি। অর্থাৎ এঁরা প্রায় সকলেই শিক্ষার আলো থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছেন। সেই
জন্য আমি বলছি-
তা’তে বলি এই নীতি
অনুন্নত যত জাতি
তাহাদের পক্ষে
নাহি খাটি। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
এই
যে, আন্দোলনের নীতি, এই নীতিটা আমাদের অনুন্নত জাতির জন্য সঠিক নয়।
আপনারা
দেখুনতো, উচ্চবর্ণীয়রা স্কুল আদালতে ভরে আছে। এই নীতিটা তাদের সুবিধার জন্য। আরো আশ্চর্যের
কথা হচ্ছে, উচ্চবর্ণীয়রা আমাদেরকে
আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য বিভিন্ন ভাবে আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা কেউতো চাকরী
ছেড়ে এই আন্দোলনের জন্য পথে নামেননি। তারাতো সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে বহাল আছেন।
এই সব দেখে দেখে
লও ভাই সবে শিখে
কোন্ ভাবে
চলিছে সংসার।
বুদ্ধিহীন সরলতা
আর নাহি চলে হেথা
কুট-বুদ্ধি
বটে দরকার।। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
এই
সব ঘটনা থেকে আপনাদের শিক্ষা গ্রহণ করা দরকার। কিভাবে সমাজ সংসার চালাতে হবে সেটা
বুঝতে হবে। বর্তমান যে যুগ পড়েছে তাতে আর ঐ ‘বুদ্ধিহীন সরলতা’ নিয়ে বেচে
থাকা যাবেনা। তার জন্য কিছু ‘কুট-বুদ্ধি’
অর্থাৎ কৌশলের দরকার আছে।
স্বাধীনতা কথা ভাল,
নে’য়া ভাল দে’য়া ভাল
ভাল তা’তে
নাহিক সন্দেহ। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
‘স্বাধীনতা’
শব্দটি খুব ভাল এটা গ্রহণ করা যেমন ভাল, তেমনি কাউকে দেওয়াও ভাল। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আপনারা ছোট বেলায় পড়ে
থাকবেন যে,
বাঘের গলার হাঁড়
টেনে যদি কর বা’র
পুরস্কার এক
মুঠা ছাই। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
বক
বাঘের গলায় বেধে যাওয়া হাড় বের করে দিয়েছিল। কিন্তু পুরষ্কার স্বরূপ কিছুই পায়নি।
বাঘ উল্টা ধম্কি দিয়ে বলেছিল-“তোর তো সাহস মন্দ নয়, আমি যে তোকে খেয়ে ফেলিনি
এটাইতো তোর সৌভাগ্য।” তো আমাদের লোকদেরও
যে বকের মত অবস্থা হবেনা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলে তার কোন গ্যারান্টি আছে
কি? তারা এমনও তো বলতে পারে যে, তোমরা নিচু জাতির লোক হয়ে আমাদেরর সঙ্গে আন্দোলন
করতে পারছো, এর থেকে বেশি আর কি আশা করতে পারো? কারণ, আজ যারা এই আন্দোলন করছেন,
সেটা সম্পূর্ণ তাদের স্বার্থের জন্য। সেখানে আপনাদের স্বার্থের জন্য কিছু অবশিষ্ট
থাকবে না। হাঁ, তারও প্রমান আপনাদের আমি দিচ্ছি-
স্বাধীনতা পাবে যবে
কাঁ’রা উপকৃত হ’বে
সেই কথা পার কি
বলিতে?
কর্ত্তা আজ যারা যারা
সে দিন একত্রে তারা
রচনা কবিবে শাসন
তন্ত্র।
রাজাদের সে সভায়
তোমাদের স্থান নয়
তোমরাত’ শুধু
বাদ্য যন্ত্র।
যুদ্ধকালে প্রয়োজন
বাদ্য যন্ত্র আগণন
যুদ্ধ শেষে কে করে সন্ধান? -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
বলুনতো
এই স্বাধীনতা কাদের জন্য? এর থেকে কারা উপকৃত হবেন? এসব কথা আপনারা কেউ বলতে পারেন
কি? আপনারা শুনেনিন এবং ভবিষ্যতেও আমার কথা মিলিয়ে নেবেন। আজ যাঁরা এই আন্দোলনের
কর্তা, স্বাধীনতা লাভের পর তাঁরাই শাসনতন্ত্র রচনা করবেন তাদের সুবিধা মত। সেখানে
আপনাদের স্থান রাজার রাজ সভায় বাদ্য যন্ত্রের মত। কারণ, যুদ্ধের সময় বাদ্য
যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেই বাদ্য যন্ত্রের কথা কি কেউ
মনে রাখেন? তবে হ্যা,
যদি থাক’ সেনাপতি
তবে হ’তে পারে গতি
সেই গুণে তুমি
আজ আন। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
আপনারা
যদি কোন কাজে প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করে কাজ করতে পারেন, যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন
সেনাপতি সবকিছু আদেশ করেন, আপনাদেরও আদেশে দেবার মত অধিকার অর্জন করতে হবে। আর সেই
অধিকার অর্জনের জন্য আপনাদের নিরন্ত্রর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
তবে কথা হচ্ছে সেনাপতি হওয়ার জন্য যে গুণের
অধিকারী হ’তে হয়; সেই গুণ আমাদের জাতির মধ্যে এখনও জেগে ওঠেনি। সবে “শিশু মাত্র
জাগরণ-পথে।” যাঁরা যৌবনের পূর্ণতা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন, তাদের
সঙ্গে আমাদের তুলনা করা সম্ভব নয়। আপনাদের জাতি যখন পূর্ণ শক্তির যৌবনে ভরে উঠবে
তখন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চলতে পারবেন।
আজ তা’তে কার্য নাই
তাই বলি শুন ভাই
ভুলে যাও সে
সব কাহিণী। -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
আজ
আমরা বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারে শিশু তুল্য। তাই শিশু হয়ে যৌবনদিপ্ততা প্রকাশ করা
ঠিক নয়। আপনাদের যৌবন আশার অপেক্ষা করুন।
আর বর্তমান আন্দোলনের কথাকে ভুলে যান।
জাতির উন্নতি লাগি
হও সবে স্বার্থত্যাগী
দিবারাত্রি
চিন্তা কর তাই।
জাতি ধর্ম, জাতি মান
জাতি মোর ভগবান
জাতি ছাড়া অন্য
চিন্তা নাই।।
কিবা বিদ্যা, কিবা ধনে কিবা শিল্পে, কি বিজ্ঞানে
রাষ্ট্রনীতি
ক্ষেত্রে রাজ-কাজে।
সবখানে থাকা চাই
তা’ ভিন্ন উপায় নাই
রাজবেশে সাজ’
রাজ-সাজে।।
নর নারী দুইজনে
প্রতি কার্যে প্রতি ক্ষণে
তালে তালে হও
অগ্রসর।
অলসতা দেও ছেড়ে
বল সবে বজ্র স্বরে
“আগে চল নাহি
অবসর।।’’ -গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ৪৪৩
আমাদের
জাতি প্রগতির ক্ষেত্রে এখনও শিশু। এই শিশু প্রগতিকে যৌবনে পদার্পণ করার জন্য
আপনাদরা আজকে নবযৌবন প্রাপ্ত শিক্ষিত যুবকেরা। তাই আপনারা জাতির উন্নতির জন্য সকলে
নিজস্বার্থকে ত্যাগ করে জাতির স্বার্থে দিবারাত্র চিন্তা করুন। আপনাদের কাজ হচ্ছে-
জাতিই ধর্ম, আর জাতিই মান সম্মান। আর জাতিই ভগবান। জাতির উন্নতি ছাড়া আর কোন
প্রকারের চিন্তা করার দরকার নেই।
আপনাদেরকে
বিদ্যা, ধন, শিল্প, বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রনীতির সর্ব ক্ষেত্রে থাকার জন্য কাজ করতে
হবে, এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। জাতির এই
উন্নতির জন্য নরনারী একসঙ্গে প্রত্যেক কাজ হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাবেন, আপনারা
অলসতা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলুন। আর বজ্রকন্ঠে বলুন-
“আগে
চল নাহি অবসর।” এগিয়ে চলো, আমাদের কাছে কোন অবসর নেই।”
খুবই সরল প্রকাশভঙ্গী,,,, গুরুচাদ ঠাকুরের অবদান আমাদের জন্য যে কতটা সেটা বর্ননা করেও শেষ হবে না,,,, দেশ ভাগ হল বাংলাদেশ নামে নতুন দেশ জন্মনিল কিন্তু এখন সেই গুরুচাদ ঠাকুরের নিজের জন্মভূমি সুরক্ষিত নয়।।। তার ভক্তরা এখন বাংলাদেশে মার খাচ্ছে,,,,,
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteমতামত প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন।
DeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteএটা কি মহান গুরুচাঁদ ঠাকুরের লেখা না কি অন্য কারও লেখা?
Delete