Skip to main content

নমঃশূদ্রদের পূর্ব পরিচয়- জগদীশচন্দ্র রায়


নমঃশূদ্রদের পূর্ব পরিচয়
জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই) roy.1472@gmail.com M. No. 09969368536
    1881 সালে দত্তডাঙার ঈশ্বর গাইনের বাড়িতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে বহু দূর-দূরান্ত থেকে যে অসংখ্য জ্ঞানী-গূণীজন আসেন, তাদের উপস্থিতিতে গুরুচাঁদ ঠাকুর সভাপতির ভাষণে প্রথমেই জানান-                “তাই বলি সভাজন          সবে হয়ে এক মন
                                 নমঃশূদ্র জাতি কথা শুন মন দিয়া।
                        -----------------------------------------  
                       নমঃশূদ্র কবে হল          পূর্বে তারা কিবা ছিল
                              সংক্ষেপেতে সেই কথা বলিব সভায়।-গুরুচাঁদ চরিতপৃঃ ১২৩         
সুধী সভাসদগণ, আপনারা ধৈর্য্য ধরে শান্ত হয়ে শুনুন কিভাবে এই নমঃশূদ্র জাতি তৈরী হল। আর এর পূর্বে এই জাতির পরিচয় ও ধর্ম  কি ছিল? সেসব কথা আমি সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করছি।
আচার বিচার যত           সব ব্রাহ্মণের মত
       শুধুমাত্র যজ্ঞসূত্র গলে নাহি রয়।
সবে করে কৃষি কাজ, তা’তে নাহি কোন লাজ 
    পূর্বকালে আর্য জাতি করিত সবাই। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৩                                
আমাদের এই নমঃজাতির আচার অনুষ্ঠান, বিচার ধারা এরকম অনেক কিছুই ব্রাহ্মণদের মত ছিল। (যেমন- ব্রাহ্মণরা শ্রাদ্ধা কার্য দশ দিনে করে। নমঃশূদ্ররা কেউ মারা গেলে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য দশ দিনে পালন করে। অন্য জাতির লোকেরা কিন্তু তারা কেউ ৩০ দিন বা ১৫ দিনে করে)। যদিও আমাদের লোকদের গলায় কোন পৈতা ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সকলে কৃষিকাজ করতেন। যেকাজ সেই সময়ে আর্যরা করতেন।*১   
   আমাদের পূর্বপুরুষেরা শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কোন প্রকার ছল-চাতুরি তাদের মধ্যে ছিলনা। আর কোন বিলাসিতার জীবন-যাপন করতেন নাযাদের মধ্যে কোন ভোগের লালসা ছিলনা। কৃষিকার্য করে যেটা উৎপাদন করতেন সেটা দিয়েই সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতেন। আমাদের এই লোকেরা প্রকৃতির পূজক ছিলেন। অন্যকোন দেবদেবীর পূজা করতেন না। এঁরা দীন-দু;খীকে উদার হস্তে দান করতেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে-
এমন সরল যারা          তারা কেন সর্বহারা
     সেই কথা সভা মাঝে বলিবারে চাই।  - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ নং  ১২৩
    আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন এত সহজ সরল ছিলেন, সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করতেন, তাঁরা কেন সর্বহারায় পরিনত হ’ল? সেই ইতিহাস আমি আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই। যদি কোন ভুল হয় তাহলে আপনারা আমাকে নিজের সন্তান মনে করে মার্জনা করে দেবেন। এই ইতিহাস ভীষণ দুঃখের। সেটা মনে পড়তেই আমার হৃদয় বেদনায় ভরে ওঠে। সে দু;খের কাহিনি ছবির মত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। যেসব কথা আমি আমার পিতা অনন্ত করুনা সিন্ধু শ্রীহরির কাছ থেকে জেনেছি।
চরাচর এ ব্রহ্মাণ্ড          কোথা মূল কোথা কান্ড
     কেবা সৃষ্টি করে তারে কোন বিধিমতে।
জড়-অচেতন সাথে         কিবা ভাবে কোন মতে
     চেতনা রূপিণী শক্তি আছে বসি তা’তে।।
স্রষ্টা-সৃষ্টি কি সম্বন্ধ        সুখ দুঃখ ভালমন্দ
     চেতনাচেতনে রহে কোন সূত্র ধরি।
কেবা দেহে কথা কয়       কেবা সুখ-দুঃখ বয়
     কেবা গেলে জড় দেহ রহে ভূমে পড়ি।।
জীবন মরণ কিবা         কিবা রাত্রি কিবা দিবা
    কোন সূত্রে গাঁথা আছে জীবের জীবন।
জীবন প্রভাত হ’তে       নরজাতি এ ধরাতে
    করিয়াছে অবিরত এ সব চিন্তন।।
অধরে ধরিবে বলে       দিনে দিনে পলে পলে
     চেতনারে ভর করি করেছে সমর।
জড় দেহ করি ক্ষয়       লভিবারে সুবিজয়
      করেছে সাধনা কত যুগ যুগান্তর ।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৩                                 
    এই যে যে, বিশ্ব ব্রহ্মান্ড, এর কোথায় শুরু আর এর শেষ বা কোথায়? কিভাবে এর জড় পদার্থের (পঞ্চভূত) থেকে জীবের সৃষ্টি হ’ল? যে জীবের মধ্যে নিরন্তর চেতনার বিকাশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন্‌ সূত্রে এই স্রষ্টা ও তার সৃষ্টির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে? যে সম্বন্ধ উৎপত্তি ও বিনাশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে  চলেছে?
    আমাদের এই যে যে, দেহ, এর মধ্যে যে চেতনার প্রবাহ চলছে; সেই চেতনার প্রকাশ আমরা ব্যক্ত করতে পারছি। এসব কিভাবে ঘটছে? কোন সূত্রের ফলে এই জীবন মরণের খেলা চলছে? আর অমানিশার অন্ধকার দূরে গিয়ে প্রভাতের কিরণ উদ্ভাসিত হচ্ছে? অর্থাৎ এই সমস্ত কিছু একটা নিয়মে নিরন্তর ঘটে চলেছে। কেন এত দুঃখ? দুঃখের কারণ কি? এর থেকে মুক্তির পথ কি? আর এই সব প্রশ্নের সমাধানের জন্য-
জীবন প্রভাত হ’তে         নরজাতি এ ধরাতে
     করিয়াছে অবিরত এ সব চিন্তন।  - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৩                                   
এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শ্রেষ্ট জীব মানুষেরা অবিরামভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অধরাকে ধরার জন্য। প্রতিদিন প্রতি ক্ষনে চেতনার উপর অর্থাৎ জ্ঞানের বিকাশের উপর নির্ভর করে যেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে সংগ্রাম করে চলেছে। কত মুনিরা এর জ্ঞান পিপাশায় ডুবে গিয়ে ধ্যানমগ্ন চিত্তে সাধনা করে চলেছে।*২ তারা এইসব রহস্যকে  উদ্ধার করার জন্য ধ্যানের মাধ্যমে সাধনায় মগ্ন থেকে তার থেকে জ্ঞান আহরণ করে বিজ্ঞানের বিকাশ সাধন করেছে। এরকমই আমাদের ভারত ভূমিতে পূর্বের ২৭ জন মুনির ন্যায় আর একজন মুনি জন্মগ্রহণ করেন।
একদা ভারত খন্ডে       আসিয়া উত্তর বঙ্গে
    রাজার আলয় জন্মে জ্ঞান-অবতার।
বুদ্ধ নামে পরিচিত       করিলেন জীব-হিত
     ভেদাভেদ ভুলি সবে হল একাকার।।    - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
যিনি রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও সেই রাজা নিজে হাল চালাতেন। কৃষিকাজ করতেন। যেকথা আমি পূর্বেই বলেছি যে, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা চাষাবাদ করতেন। তো সেই রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন একজন ‘জ্ঞান অবতার’। অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতিমূর্তি। তিনি উপরের ঐসব  প্রশ্নের উত্তর কঠোর ধ্যানের মাধ্যমে খুঁজে পান। যাকে বুদ্ধ (জ্ঞান-Knowledge) বলা হয়। তিনি এই মানব কুল তথা জীব কুলের হিত সাধনের জন্য সমস্ত রকমের ভেদাভেদকে দূরে সরিয়ে সাম্য মৈত্রি ও অহিংসার বাণী প্রচার করেন। তাঁর এই সাম্য মৈত্রীর বাণীতে মুগ্ধ হয়ে সমাজের এক শ্রেণীর জনগণ যেন হাতের মধ্যে স্বর্গকে পেয়ে গেলেনসারা বিশ্ব এই মহান বুদ্ধের নীতিতে প্রভাবিত হয়ে মুক্তির আনন্দে জেগে উঠল। অর্থাৎ তার এই সাম্য মৈত্রীর বাণী আর শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বিশ্বের কাছে তুলে ধরনে এই-

জন্ম-মৃত্যু-দুঃখ জ্বরা        নিখিল-অখিল-জোড়া
     অভিনব ব্যাখ্যা তার করিল ডাকিয়া।
জীবে শক্তি পায় বুকে       ত্রিতাপ জ্বালার মুখে
    অহিংসা পরম সত্য জাগিল হৃদয়ে।
নাহি হিংসা নাহি দ্বেষ       এক জাতি এক দেশ
     দলে দলে বৌদ্ধ ছুটে সে ধম্ম বিজয়ে।।
ভারত বিজয় হল          তবে ভূভারতে গেল
    মানব মনের বাধা গেল যে টুটিয়া।
কিবা শিল্প কি সাহিত্য      কিবা ধর্ম কিবা তত্ত্ব
    শাশ্বত রূপের ছবি উঠিল ফুটিয়া।।  - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪                                  
জন্ম হলে মৃত্য হবে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। এই প্রকৃতির পাঁচটি উপাদান ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ  ও ব্যোম। যাকে পঞ্চভুত বলা হয়। এই পঞ্চভুতের চার ভুত(ব্যোম বাদে) নিয়ে প্রথম জীবের সৃষ্টি হয়েছে। আর বিবর্তনের ফলে এবং প্রজননের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এই প্রকৃতি হচ্ছে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড। এর কোন সৃষ্টি কর্তা নেই। প্রকৃতি নিজেই স্বয়ম্ভু। বিবর্তনের মাধ্যমে এই সৃষ্টি ও বিনাশের সূত্র নিরন্তর ঘটে চলেছে। জীবের যে চেতনা ঘটছে; সেটা এই প্রকৃতির চারটি উপাদানের জন্য। এর একটি উপাদানের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে জীবের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়।  জীবের মৃত্যু ঘটে। আর জড় শরীর বা পদার্থ আবার ধীরে ধীরে প্রকৃতির উপাদানে মিলে যায়।
    আর মানুষের যে দুঃখ, কষ্ট; এসব আসে বাসনা বা লোভ থেকে। মানুষ যদি তার ইন্দ্রিয়গত  লোভকে ও হিংসাকে পরিত্যাগ করতে পারে তাহলে তার মধ্যে আর কোন দুঃখ থাকবেনা। কোন হিংসা দ্বেষ থাকবে না। কোন জাতিভেদ থাকবেনা। তখন এইক জাতি (মানব জাতি) এক দেশ(বিশ্ব ব্রহ্মান্ড) গড়ে উঠবে। মানুষ এক অনন্ত শান্তি লাভ করতে পারবে।
   তো বুদ্ধের এই নীতি সারা ভারতকে বিজয় করল। মানুষের মনের গ্লানি দূর হয়ে গেল। আর বুদ্ধের এই অহিংসা, সাম্য, মৈত্রীর বিচারধারা দিকে দিকে শান্তির বাণী বইয়ে দিতে লাগল। এই  নীতির প্রবাহে ভারতবর্ষের শিল্প, সাহিত্য‌ ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটাল।   মানুষকে মুক্তির দরজা খুলে দিল। ভারতবর্ষ এক সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিনত হয়ে উঠল।
কিন্তু এই গৌরব গাথা যেন এক শ্রেণীর মানুষের কাছে সহ্য হোলনা। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকল এর বিনাশ করার জন্য।
দিনে দিনে দিন যায়        প্রকৃতির কি খেলায়
     জীব কুল পূনঃ ভুল করিল ভুলিয়া।
ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নামে         ভারতের পুণ্য ভূমে
     বৌদ্ধ ধম্ম নাশ করে সবলে পিষিয়া।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
   ভারত ভূমি যখন পুণ্য ভূমিতে রূপান্তরিত হ’ল। সমস্ত হিংসা দূর হয়ে শান্তির সমীরণ বইতে শুরু করল, বিশ্বের দরবারে ভারত এক উচ্চ আসন লাভ করল। যার ফলে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এদেশে এসে পড়াশুনা করে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে লাগল, তখন বৌদ্ধ ধম্মের এই ধ্বজাকে চক্রান্ত করে (১৮৫ খৃঃ পূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের বংশধর বৃহদ্রথকে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ প্রকাশ্য রাজ সভায় হত্যা করে শাসন ভার দখল করে ব্রাহ্মণ্য শাসন স্থাপন করে)  ধুলায় মিশিয়ে দেয়। সমস্ত বৌদ্ধ ধম্মাবলম্বীকে মেরে ফেলার হুকুম জারী করে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। অনেক বৌদ্ধ মারা যান। অনেকে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করার জন্য নিজ ধম্মকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আবার অনেকে ব্রাহ্মণ্য শাসনের প্রবল অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশান্তরী হন। কেহ কেহ জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে কোন মতে প্রাণ রক্ষা করেন। এইভাবে ভারত ভূখন্ড থেকে বৌদ্ধের অহিংসা, সাম্য, মৈত্রীর বিচারধারাকে নির্মূল করে দেয়।
তার যত বংশধর              দূরে থাকি পরস্পর
     নিরালয়ে বসিয়া কিছু পালে রীতিনীতি।
ধনবান বলবান               করিবারে হতমান
     আখ্যা দিল তা সবারে অপবিত্র জাতি।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
এই বুদ্ধধম্মাবলবম্বী এক শ্রেণীর বংশধরগণ কিন্তু এই ব্রাহ্মণী শাসন ব্যবস্থাকে স্বীকার না করে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা তাদের ধম্মীয় রীতিনীতি পালন করতে থাকেন। বৌদ্ধধম্মীয় শাসন কালের ধনবান বলবান গোষ্ঠী আজ তাদের সমস্ত বিষয়  সম্পত্তিকে হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে গেলেও তাদের আদর্শকে ব্রাহ্মণী শাসকের কাছে বিলিয়ে দিতে রাজি  হননা। তখন এই বৌদ্ধ মতাদর্শের জনগনকে আরো মানসিকভাবে দুর্বল করে দেবার জন্য অপমান জনক শব্দ বা ঘৃণা মূলক কথা দিয়ে ব্রাহ্মণী শাসন ব্যবস্থা এঁদেরকে ‘অপবিত্র জাতি’ বলে ঘোষণা করে।


কালচক্র ঘুরে আসে         নিরুপায় অবশেষে
    হিন্দুধর্ম কবলেতে বৌদ্ধ আসে ফিরে।
ভারতের ইতিহাসে          বঙ্গ বা অপর দেশে
    হিন্দুরূপী বৌদ্ধ দেখা যায় ঘরে ঘরে।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
কালের চক্রে এক সময়ের ধনবান বলবান বৌদ্ধধম্মাবলবলম্বীরা নিজেদের ধম্মকে হারিয়ে ‘অপবিত্র জাতি’তে পরিনত হয়ে অবশেষে ব্রাহ্মণী শাসনকে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য মেনে নিতে বাধ্য হনযার ফলে তাঁরা নামে হিন্দু হন; কিন্তু তাঁরা তাদের আচার-বিচার-রীতিনীতি সবই পূর্বের বৌদ্ধমতানুসারে করতে থাকেন।
তাই দেখি সর্বদেশে        যা’ দিগে অস্পৃশ্য ভাষে
     হিন্দুর সকল নীতি নাহি জানে তারা।
কিছু হিন্দু কিছু বৌদ্ধ       এই নীতি দেশশুদ্ধ
     বৌদ্ধ সবে মানি লয় হয়ে দিশেহারা।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
যার জন্য আমরা সারা ভারতবর্ষে দেখতে পাই যাদেরকে অস্পৃশ্য বলা হয়, তাদের উপর হিন্দু ধর্মের নাম চাপিয়ে দিলেও তারা হিন্দু ধর্মের কোন রীতিনীতি জানেনা। তাই তারা আধা হিন্দু আধা বৌদ্ধ রীতিনীতি নিয়ে দিশেহারা হয়ে জীবন যাপন করছে।

বঙ্গদেশে নিষ্ঠাবান          ছিল যত মতিমান
     ধম্ম ছাড়ি প্রাণ রক্ষা করিতে না চাহে। 
ধম্ম তরে দূরে যায়        কত অত্যাচার সয়
    ধম্ম-তরে বন মধ্যে হীন হয়ে রহে।।
এই ধম্মবীর যারা         সেই বংশে জন্মি মোরা
     কালের কুটীল চক্রে হয়ে আছি হীন।
বহু দিন গত হয়         সবে মহা দুঃখ সয়
     এই ঘরে এল তাই হরি ভক্তাধীন।। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
সারা ভারতবর্ষে যে বৌদ্ধধম্মাবলম্বীদের অস্পৃশ্য নাম দিয়ে হিন্দু ধর্মের খোয়াড়ে প্রবেশ করায়  ব্রাহ্মণী শাসন ব্যবস্থা; সেই খোয়াড়ে প্রবেশ না করার জন্য জীবনকে বাজি রাখেন বঙ্গের এক শ্রেণীর নিষ্ঠাবান বৌদ্ধধম্মাবলম্বীরা। তাঁরা নিজেদের ধম্ম ও আত্মমর্যাদাকে ব্রাহ্মণী শাসকদের কাছে সমর্পণ করতে কিছুতেই রাজি হননা। যাদের মাথার উপর হীন্‌ সূচক ‘অপবিত্র জাতি’র কলংক  চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও তাঁরা জীবনের থেকে ধম্ম ও আত্মমর্যাদা বেশি সম্মানের মনে করেন। তাই তাঁরা জঙ্গলে গিয়ে বসবাস করেন।
    “এই ধম্মবীর যারা সেই বংশে জন্মি মোরা”- এই যে যে, ধম্মবীররা; যারা নিজেদের ধম্ম ও আত্মমর্যাদাকে রক্ষা করার জন্য শত অত্যাচার সহ্য করেও সংগ্রাম করেছিলেন; কিন্তু কখনও মাথা নত করেননি ব্রাহ্মণী শাসক জাতির কাছে। সেই ধম্মবীররা হচ্ছেন আমাদের পূর্বপুরুষ। আমরা তাদের বংশধর। আর আজ কালের কুটীল চক্রে আমরা এখনও হীন্‌ হয়ে বেঁচে আছি। পতিত হয়ে আছি।   
 কিন্তু এই হীন্‌ অবস্থা বা নিজ ধম্ম থেকে বিতাড়িত পতিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য বহুকাল পরে এই ঘরে (বংশে) জন্ম গ্রহণ করেন এমন একজন মহামানব, যিনি এই ধর্মহীন পতিত জাতিকে পূর্বপুরুষদের মত মান সম্মান সৌর্য-বির্য উদ্ধারের জন্য সত্য প্রেম পবিত্রতা স্থাপনের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন; তিনি হচ্ছেন হরিচাঁদ ঠাকুর।  
ঘরে এল ভগবান        জাগিল জাতির প্রাণ
    নমঃশূদ্র জাতি জন্ম হল সেই দিনে। - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৪
এই হ’ল নমঃজাতির প্রকৃত ইতিহাস। এই নমঃশূদ্রের স্বীয় শক্তিতে প্রাণ ফিরে দেওয়ার জন্য    হরিচাঁদ ঠাকুর এই ধর্মহীন পতিত জাতিকে উদ্ধার করে বৌদ্ধধম্মের মতাদর্শে নতুন ধর্মের স্থাপন করে নাম দেন ‘মতুয়া ধর্মযে ধর্মের রীতি নীতি আচার ব্যবহার সেই পূর্ব পূরুষদের মতই।  
তাই-                       ধর্ম নহে দূরে কোথা         ঘর ছেঁড়ে খোঁজ বৃথা
                                    আপনার ঘরে ধর্ম আছে ঘুমাইয়া।
                             পবিত্র চরিত্র রেখে         সত্য বাক্য বলে মুখে
                                    হরি বলে ধর্ম বাতি লহ জাগাইয়া।।  - গুরুচাঁদ চরিত পৃঃ ১২৫   
আপনাদের ধর্ম আপনাদের ঘরের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে। কারণ, ব্রাহ্মণী শোষকদের অত্যাচারের ফলে সেই ধর্ম জেগে ওঠার অপেক্ষায় আছে। আপনাদের আচার বিচার রীতিনীতির মধ্যে সেই ধর্ম লুকিয়ে আছে। তাই আপনারা নিজেদের মনে পবিত্রতা গ্রহণ করে সত্য বাক্যকে সাথে নিয়ে আপনার আবার আপনাদের পুর্বপুরুষদের অহিংসার ধর্ম, সাম্য মৈত্রীর ধর্মকে জাগিয়ে তুলুন এটাই হরিচাঁদ ঠাকুরের আদেশ। হরি বলে ধর্ম বাতি লহ জাগাইয়া   
__________________________


সূত্র নং ১) আর্য হচ্ছে একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম । আর একাধিক মানবগোষ্ঠীই এই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত  ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দু'টি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে । আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হ'- আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত । এই আলপাইন
মানবগোষ্ঠীভুক্ত  লোকেরা যেমন অসুর নামে পরিচিত; তেমনি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত ।
     নর্ডিক আর্য আগমনপূর্ব ভারতীয় আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর ভাষাও ছিল আর্য । এই দিক দিয়ে অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠী হিসাবে এরাও আর্য বলে গণ্য । ঋগবেদে এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে । অন্যদিকে নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর বৈদিক ব্রাহ্মণদের ভাষা যেহেতু আর্য ছিল তাই তারা আর্যজাতি হিসাবেই পরিচিতঅতএব ভাষাগত দিক দিয়ে বিচার করলে ভারতবর্ষে দু'টি আর্য জাতির সন্ধান মেলে ।
প্রথমটি হ'- আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত প্রাগার্য জাতি
এবং অন্যটি হ'নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত বৈদিক যুগের আর্য জাতি

অনেক চিন্তাশীল লেখকেরাই ব্যাপারটাকে ঘুলিয়ে ফেলেন । তাঁরা বলেন, ডঃ আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়আসলে তাঁরা আম্বেদকরের ব্যাখ্যাকে  সঠিকভাবে  বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়আসলে ডঃ আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্য ভাষীরা বহিরাগত নয়কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ভাষীরা হলেন বহিরাগতযদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকিযারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত ।
    'বেদে আর্যজাতি নামে প্রকৃত পক্ষে কোন জাতি নেই' কারণ বেদে আর্য শব্দটি কখনই জাতি অর্থে ব্যবহৃত হয়নিতাই বেদে দু'টি মানবগোষ্ঠীর ভাষাকেই আর্য হিসাবে সনাক্ত করা হয়েছেযার একটা হ'ল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর-যা ডঃ আম্বেদকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন ।
     আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে যে, নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণেরা এবং আলপাইন মানবগোষ্ঠীর অসুরেরা যেহেতু আর্য ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত তাই সম্ভবত ব্রাহ্মণেরা অসুরদের ইতিহাস চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে আর্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার দিয়ে দেশীয় অসুরদের অনার্য মানবগোষ্ঠী বলে প্রচার করেছেন । আর অসুররা অনার্য মানবগোষ্ঠী হিসাবে প্রচার পাওয়ার সাথে সাথে একেবারেই মাটিচাপা পড়ে গেছে আসল সত্যটি; যেটা হচ্ছে, -'দেশীয় অসুররাও প্রকৃত পক্ষে আর্য ভাষাগোষ্ঠীরই মানুষ' যদিও উভয়ের মধ্যে অর্থাৎ আলপাইন ও নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাট  পার্থক্য রয়েছে{ সংগৃহীত- অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা(যুদ্ধঃ আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)-মনি মোহন বৈরাগী(মতুয়া গবেষক)পৃঃ নং ১২,২৩,২৮ ও ২৯}
সুত্র নং ২)                   পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান
এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।
  (-শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত-তারক সরকার। পৃষ্ঠা নং ৩৬, প্রথম প্রকাশ ১৯১৬ (বাংলা ১৩১২) সাল।) 


  
            


  





 

Comments

  1. ঋদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  2. মতামতের জন্য ধন্যবাদ অনুপ বাবু।

    ReplyDelete

Post a Comment