ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চক্রান্তে, স্বজাতি নাস্তিকদের দ্বারা হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বদনাম। লেখক- জগদীশচন্দ্র রায় (মুম্বাই)
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের
চক্রান্তে, স্বজাতি নাস্তিকদের দ্বারা
হরিচাঁদ ও
গুরুচাঁদ ঠাকুরের বদনাম
লেখক- জগদীশচন্দ্র রায়
উপরের হেড
লাইনটা দেখে চম্কে গেলেন নাকি? হ্যাঁ বিগত বেশ কিছু দিন ধরে তথাকথিত নাস্তিকরা
তাঁদের নাস্তিকতার যুক্তি দিয়ে তুলে ধরছেন অনেক সম্ভার। যেগুলো সরাসরি কবি তারক
সরকারের বিরুদ্ধে এবং মতুয়া অন্ধভক্তদের বিরুদ্ধে হলেও প্রকারন্তে সেই আঘাতটা গিয়ে
পড়ছে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের উপর। কেউ বই লিখে দেখাচ্ছেন, যে হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই
তাঁকে নিয়ে লিখতে মানা করেছিলেন। অতএব কবি তারক সরকারের লেখা “শ্রীশ্রীহরি
লীলামৃত” পড়া উচিত নয়। আবার কেউ লিখছেন, হরিচাঁদ ঠাকুর যদি ভগবান হন, তাহলে তিনি
মানুষের বিভিন্ন দুঃখ-দুর্দশাকে মুক্ত করেননি কেন? কত মতুয়াইতো মতুয়া হয়েও অনাহারে
মৃত্যু বরণ করেছে। কেন? তাহলে তিনি কেমন ভগবান? তাঁকেতো আবার অবতার টবতার কি সব
নাম দিয়ে লোকে মাথায় নিয়ে নাচা নাচি করছে। আবার ভাবের ঘোরে গড়াগড়ি দিচ্ছে। ইত্যাদি
ইত্যাদি। এই নাস্তিকদের সব কথার যুক্তি সংগত উত্তর হয়তঃ আমি দিতে পারব না। আর
দিলেও তাঁদের মতপুত হবে বলে আশা করি না। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে কী সেটার পরিচয় আমার
কর্ম ও বিভিন্ন লেখায় যেটা ফুটে ওঠে তার থেকে যেটা আপনারা আমাকে মনে করেন সেটাই
আমি। যদিও আমি এই নাস্তিকদের মত কোন লেখক নই।
আমি চেষ্টা করছি
উপরের কথাগুলি সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরতে।
হ্যাঁ, হরিচাঁদ ঠাকুরকে নিয়ে প্রথমে যখন তারক সরকার কিছু
লিখেছিলেন, সেটা দেখে তারক সরকারকে তিনি অনেক গাল-মন্দ করেছিলেন। সেই লেখা ছুড়ে
ফেলে দিয়েছিলেন। এবং তারককে ভয় দেখিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে হরিচাঁদ ঠাকুর এরকম কেন
করেছিলেন? এরকমতো হতে পারে যে, কবি তারক সরকার প্রথমে যেটা লিখেছিলেন, সেটা
হরিচাঁদ ঠাকুরের পছন্দ হয়নি। আবার এরকমও হতে পারে এবং আমিও যেটাকে বেশি
যুক্তিযুক্তি বলে মনে করি সেটা হচ্ছে, কোন মানুষ জীবিত থাকা কালীন যদি তাঁর জীবনী
লেখা হয়, তাঁকে অনেক মহৎ মানুষ বলে তুলে ধরা হয়, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর শেষ মুহুর্ত
পর্যন্ত তিনি কোন গর্হিত কাজ করবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? মানুষের মন বা মত যে
কোন সময় পরিবর্তন হবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? কিন্তু কারো মৃত্যুর পর তাঁকে
নিয়ে লিখলে অন্তত এই মন বা মত
পরিবর্তনের অনিশ্চয়তার প্রশ্ন আসবে না।
হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন, কর্মধারা, আদর্শ যাকিছু হোক না কেন
আমরা যেটা পাই সেটা হচ্ছে, কবি তারক সরকার লিখিত “শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত”-এ।
যে লীলামৃতে প্রায় ৮০% বৈদিকভাব ফুটে উঠেছে। আর ২০% মত লেখা অবৈদিকভাব ফুটে উঠেছে।
কেন এরকম হয়েছে? মহাকবি তারক সরকার ও লীলামৃত লিখতে গিয়ে বলেছেন-
শ্রোতাগণ হংসবৎ, দোষ ছাড়ি গুণ যত
দুগ্ধবৎ করুন গ্রহণ। (পৃষ্ঠা
৩৯)
তিনি শ্রতাদের বলেছেন, যে, রাজ হাঁসের মত
এই গ্রন্থ থেকে শুধু দুধটাকে গ্রহণ করতে। তাছাড়া
লীলামৃত পড়ার ব্যাপারে কিছু
নির্দেশিকা আছে, যেটা ডাঃ মনিন্দ্রনাথ বিশ্বাস-এর হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত-এর
প্রকাশিকার কথায় আছে, সেটা হচ্ছে-(১)গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া স্বাভাবিকভাবে
পাঠ করিয়া ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’
এবং ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’ গ্রন্থদ্বয় হইতে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যে পৌছানো সম্ভব
নহে।
(২) কোন গ্রন্থকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করিতে হইলে গ্রন্থকারের সামগ্রিক জীবন সম্বন্ধে ধারণা রাখা
প্রয়োজন।
হ্যাঁ,
উপরের কথা দুটি কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার।
পাঠককে এটা
মনে রাখতে হবে যে, হরিচাঁদ ঠাকুরের
মহাপরিণির্বানের (১৮১২ সালের ১১ই মার্চ) ২৪
বছর পরে লীলামৃত লেখার কাজ শুরু হয়। এবং প্রায় জোর করেই কবি তারক সরকারকে
এই মহান দায়িত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এবার এখানে তারক সরকারের সম্পর্কে পাঠকের
গভীরভাবে অধ্যয়ন করা দরকার । তিনি একজন কবিয়াল ছিলেন। আর কবিগানে তৎকালীন সময়ে
হিন্দু ধর্ম গ্রন্থের কাহিনির উপরই বেশি আলোচনা হত। কবি তারক
সরকার ও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তাই তাঁর লেখায় সেই ভাবধারাতো প্রত্যক্ষ বা
অপ্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ হবেই।
লীলামৃতের প্রথমেই আমরা দেখতে পাই কবি তারক
সরকার চিরাচরিত বন্দনা রীতিকে অনুসরণ করেননি। মাথা নত করেননি। তিনি কোন দেব-দেবী
তো দূরে থাক কাউকেই প্রনাম পর্যন্ত করেননি। তিনি মানবতার জয়ধ্বনি দিয়ে শুরু করেছে।
তিনি যে সকল ব্যক্তিবর্গের জয়ধ্বনি দিয়েছেন, তাতে হরিচাঁদ আর একক থাকেননি, সেখানে
একতাবদ্ধ শক্তিতে পরিনত হয়েছে।
তারপরে আমরা দেখতে পাই হরিচাঁদ ঠাকুরের যে মূল আদর্শ সেটা হচ্ছে-
জীবে দয়া, নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।। (পৃষ্ঠা ১১)
এ বিষয়ের উপর ব্যাখ্যা করেছেন শ্রদ্ধেয় সুষেন বিশ্বাস মহাশয়
এইভাবে- ‘তিনটি জিনিসকে তিনি তুলে ধরেছেন এই মহাবাণীর মধ্য দিয়ে।
এক-জীবে দয়া, দুই- নামে রুচি, তিন-মানুষেতে নিষ্ঠা।
জীবে দয়াঃ- অর্থাৎ যেখানে প্রাণী জগৎ রয়েছে,
উদ্ভিত জগৎও রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিত জগতের প্রতি দয়াশীল হতে হবে। প্রাণী জগতে দীন দুঃখীর প্রতি যত্নবান হতে হবে। তাদের দুঃখ
মোচনের কাজে নিজেকে নিবৃত্ত থাকবে হবে। এটা বোঝাতে চেয়েছেন। প্রচলিত সকল ধর্ম লঙ্ঘন করে সারবস্তু হিসেবে শুদ্ধ মানুষেতে আর্তি, আর মানুষেতে নিষ্ঠা- এর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্রাহ্মণেতে
নিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। কোন বর্ণে নিষ্ঠার কথা বলা হয়নি।
নামে
রুচিঃ-
এই নাম শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। নাম মানে হরি নাম কৃষ্ণ নাম নয়।
নাম শব্দটির অর্থ এখানে বিজ্ঞান। মানে বিশেষ জ্ঞান। রুচি- মানে অনুরাগ। অর্থাৎ
একত্রে নামে রুচি কথাটির অর্থ হচ্ছে- বিজ্ঞানে অনুরাগ। বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত
হও। যে বিশেষ জ্ঞানকে ধারণ করে, যে বিশেষ জ্ঞানকে আশ্রয় করে শুধু এযুগেই
নয়, অতীত ভারতবর্ষে, অতি প্রাচীন
ভারতবর্ষে যখন আর্যরা আসেনি, এই বিশেষ জ্ঞানকে আশ্রয় করে
ভারতীয় মানুষ সেখানে সাম্যের একটা বাতাবরণ তৈরী করেছিলেন এবং বর্তমানকালেও বিশেষ
জ্ঞানকে আশ্রয় করে আমরা বহির্বিশ্বে যাকিছু সুন্দর, যাকিছু
আমাদের সহজ লভ্য সেটা পাচ্ছি। এই নামে রুচি মানে সেই
বিজ্ঞানে রুচি। যে বিশেষ জ্ঞানকে অবলম্বন
করলে মানব ও জীব জগৎ ক্রমশঃ প্রগতির দিকে
যায়। বিভিন্ন দিকে তার প্রজ্ঞা জম্মায়। একজন মানুষ যেমন নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হতে
পারে, চরিত্রবান হতে পারে, পরিপূর্ণ মানুষে রূপ নিতে পারে।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বুদ্ধ, তাঁর মত পরিপূর্ণ রূপ সে পেতে
পারে। সেই জ্ঞান রূপ নাম, তার প্রতি প্রজ্ঞা জন্মানর কথা বলা
হয়েছে লীলামৃতে। এখানে বৈদিক ভাবে আছে কি? তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুরের যে
অবৈদিক জ্ঞানের দর্শন; সেটা হচ্ছে- জ্ঞান কর্ম বাণীর ধর্ম,
মতুয়া ধর্ম। সেটাই এই বাণীর মধ্য দিয়ে তারক গোসাঁই লিখেছেন। তাহলেও প্রশ্ন জাগে কেন কবি লীলামৃতে বৈদিক ও অবৈদিক ধারার মিশ্রন ঘটালেন? আজ থেকে আমরা একশ বছর আগে, অর্থাৎ লীলামৃত প্রকাশের একশ বছর পরে যারা
গবেষণা করছি, যারা দুটি কথা বলছি তাদের জানতে হবে আজ থেকে
একশ বছর আগে বর্তমানের সঙ্গে মিল ছিলনা। অনেক কিছু মিল থাকার কথা নয়। কারণ যে দিন
যাচ্ছে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটছে। মুহুর্তের মধ্যে মানুষের মন পরিবর্তন হয়। কারণ
মানুষের মন হচ্ছে বিচিত্র জগতের বাসিন্দা। মুহুর্তের মধ্যে change হয়। তারক গোসাঁই হরি লীলামৃত লিখেছিলেন। তিনি হরিচাঁদের
আদর্শ বুঝেছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু তারপরেও
কেন দুধের মধ্যে জল ঢাললেন? তার কারণ, যে যুগে দাঁড়িয়ে
তিনি লীলামৃত রচনা করেছিলেন সেটা হচ্ছে আজ থেকে একশ বছর আগে। সে সময়ের পরিমন্ডলটা কী?
প্রেক্ষাপটটা কী? যুগোপযোগী মানুষের চাহিদা কী ছিল? আমরা তো চাই কোন কবি
সাহিত্যিক যুগের উর্ধে নয়। যে কবি যে যুগে দাঁড়িয়ে কলম চালনা করেন সেই যুগের
মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা, তাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, এটাই প্রতিফলিত হয় তার লেখনীতে। একটা ভাবগম্য পরিবেশের মধ্যে থেকে
তারক গোসাঁইকে কিন্তু লীলামৃত রচনা করতে
হয়েছে। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যে গ্রন্থ রচনা করলে মানুষ গ্রহণ করবে না; সে যতবড়ই সত্য কথা হোক। মানুষ যদি তা গ্রহণ না করে সে গ্রন্থ তো মৃত গ্রন্থ। সেটা পাঠ করবে না, অথচ তাকে গ্রন্থ বলব। সেটাতো হতে পারেনা। তারক গোসাঁই তাই কী করলেন? অবৈদিক দর্শন ভাব বোঝার পরে যুগোপযোগী
চাহিদা অনুসারে তৎকালীন মানুষের যে চাহিদা সেটা লীলামৃতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি
চাইলেন, অন্ততঃ বেঁচে থাক। যদি বেঁচে থাকে পরবর্তী
কালে যে গবেষকরা আসবেন, যে মানুষ আসবেন, তাঁরা এর সঠিক তত্ত্ব খুঁজে নেবে। তাই
অন্ততঃ বাঁচিয়ে রাখার ভাবনাটা কাজ করেছিল।
তাই আমি বলব, তারক গোসাঁই যে বৈদিক
ধর্ম-দর্শন এই লীলামৃতের মধ্যে ঢুকিয়েছেন, এটা তাঁর
উদ্দেশ্য প্রনোদিত প্রয়াস।
অন্তরের প্রচেষ্টা নহে।
তৃতীয় কারণ- আমাদের মনে রাখতে হবে কাদের আঙ্গুলি লেহনে
সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হত? কোনটা গ্রহণ করা হবে আর কোনটা বর্জন করা হবে সেটা তাদের মর্জির উপর নির্ভর করত।
আমরা জানি, লীলামৃত ছাপাতে গিয়ে ভীষণ অসুবিধার মধ্যে
পড়তে হয়েছিল। কোন প্রকাশকই ছাপাতে রাজি হচ্ছিল না।
সেরকম একটা যুগে একটা আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার
জন্য কিছু উদ্দেশ্য কাজে লাগাতে হয়েছে। তাই সেটা উদ্দেশ্য প্রনোদিত। অন্তরের কথা
নয়। উনি কিন্তু বেনা জল ঢুকিয়েছেন এটা ঠিক। লীলামৃত ছাপাতে গিয়ে হুচোট খেতে হয়েছে
এটাও ঠিক। সেই যুগে কোন নিজিসটা গ্রহণ করতে হবে বা বর্জন করতে হবে সেটা নির্ভর
করত উচ্চ বর্ণের মানুষের উপর। তারা যেটার স্বীকৃতি দেবে সেটাই মানুষের মধ্যে বেঁচে
থাকবে।
তাই তারক গোসাঁই কি করলেন? সর্বজন মান্যতা ও
সর্বজন গ্রাহ্যতা যাতে লীলামৃত পায়, তার জন্য তিনি লীলামৃতে অলৌকিক কাহিনি ঢুকাতে বাধ্য
হয়েছিলেন। পাঠক যেন মনে করেন এটা তারই কথা। আমরা লীলামৃত
পড়তে গিয়ে এসব বাদ দিয়ে কি পড়তে পারিনা? তারক গোসাই কি লিখেছেন ওই কথার আড়ালে এটা কি আমরা বুঝতে পারিনা? ছাইয়ের গাদার মধ্যে সোনা থাকলে সেই সোনাকে সোনা বা বলে কি ছাই বলবে?
লীলামৃতে ছাইও আছে, সোনাও আছে। অনেক
মনি-মুক্তা থরে থরে সাজানো রয়েছে। সেটা দেখতে হবে।’
এবার আমরা দেখি লীলামৃত অনুসারে,
হরিচাঁদের কালজয়ী ঘোষণা-
কুকুরের
উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই।
বেদ বিধি শৌচাচার
নাহি মানি তাই।। (পৃষ্ঠা
১০৪)
আজ
থেকে একশ বছর আগে যে কথা কবি লীলামৃতে লিখেছেন, সে কথা সেই যুগে দাঁড়িয়ে বলার সাহস
দেখানো মানে মৃত্যু অনিবার্জ; সেখানে কবি তারক সরকার লিখে
জানিয়ে দিলেন যে, হরিচাঁদ তাঁর আদর্শে বেদকে কুকুরের উচ্ছিষ্ট বা এটো খাবারের
থেকেও নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বেদ ও তার বিধানকে অস্বীকার করেছেন। এখন
প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি বেদকে মানেনি তাঁর উপর কোন অলৌকিকত্ব
আরোপ করা কিভাবে সম্ভব? সেই গবেষণামূলক দৃষ্টি দিয়ে কি আপনারা কখনো ভেবে দেখেছেন?
শুধু উপরে উপরে দেখেই যদি সেটা নিয়ে মাতামাতি করেন তাহলে সাধারণ মানুষের থেকে
আপনাদের পার্থক্য কোথায়? শিক্ষিত হওয়া এক জিনিস, আর জাগ্রত হওয়া কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য জিনিস।
শিক্ষিত আমরা অবশ্যই। যে লিখিত জিনিস পড়ে তাকে পড়া লেখা বলা হয়।
আর যে লিখিত বস্তুর থেকে তার ভিতরের অর্থ বের করে তাকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। BETWEEN THE LINE
AND BEHIND THE LINE যে পড়ে তাকে বুদ্ধিজীবী বলে। কারণ লেখা জিনিস তো যেকেউ পড়তে পারে। কিন্তু তার অন্তর্নিহীত অর্থ যে খুঁজে বের করে সে হচ্ছে
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। হরিলীলামৃত
সবাই পড়তে পারে এবং পড়ে। যারা পড়ে গতানুগতিক অর্থ বোঝে, তারা শুধু শিক্ষিত ব্যক্তি। কিন্তু যারা তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অর্থকে প্রকাশ
করে তাকে বলা হয় বুদ্ধিজীবী। তাই BIHIND THE LINE AND
BETWEEN THE LINE বোঝা দরকার।
এবার আসি হরিচাঁদ ঠাকুরের ভগবান আখ্যা সম্পর্কে।
গতানুগতিকতাকে মাথায় রেখে যদি আমরা
কোন যুক্তিকে তুলে ধরি সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে সেটা আমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়
কি? সাধারণতঃ ভগবান বা ঈশ্বর বলতে কোন অলৌকিক শক্তিকে বোঝানো হয়। কিন্তু লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই সেখানে কিন্তু সেই গতানুগতিকতাকে ধরা হয়নি। সেখানে
উল্লেখ আছে- যে যাহারে ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর। (পৃ. ১)
আবার গুরুচাঁদ চরিতে আছে-
“বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
যে যাহারে উদ্ধার
করে সে তার ঈশ্বর।।”
মতুয়া ধর্মে
ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মীয় শব্দের সাদৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু
মতুয়া ধর্মে সে সব শব্দের মর্মার্থ আলাদা। যেমন ঈশ্বর, হরি, অবতার, ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্মা, ধর্ম, সনাতন ইত্যাদি। মনে
রাখা দরকার সূক্ষ্ম সনাতন মতুয়া ধর্মের সাথে সনাতন হিন্দু ধর্মের কিছু শব্দ সাদৃশ্য
আছে মাত্র কিন্তু মর্মার্থে হুবহু এক নয়। বাইরে থেকে দেখতে similar but not the same. এই বাহ্যিক
সাদৃশ্য দেখে মতুয়া এবং অমতুয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। স্বাদে, গুণে,
ব্যবহারে, চিন্তায়, প্রয়োগে, মতুয়া ধর্ম দর্শন ও সমাজব্যবস্থার ফল আলাদা।
উদাহরণ - শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ বলেছেন ‘আকাশে ঈশ্বর খুঁজতে যেয়ো না, ঈশ্বর আকাশে থাকে না, ঈশ্বর খোঁজ মানুষের মধ্যে।’
এখানে কি বলা হচ্ছে- যে যাহারে
ভক্তি করে সে তার ঈশ্বর। আপনি কাকে ভক্তি করবেন? কাকে ঈশ্বর হিসাবে মনে করেবনে? যিনি আপনার জন্য মঙ্গল জনক কাজ করেছেন তাকে?
নাকি যিনি বা যারা আপনাকে মানুষ থেকে পশুর স্তরে নামিয়ে এনেছে। আপনার সার্বিক অধিকারকে
ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে?
আবার- বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর/যে যাহারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর। অর্থাৎ সারা বিশ্বে
দেখা যায় যে যাহাকে উদ্ধার করে সেই তার ঈশ্বর। এই ঈশ্বর কি কোন কাল্পনিক বৈদিক
ঈশ্বর? যে মানুষেরা এক সময় প্রতাপ প্রতিপত্তিশালী ছিলেন, যারা বৌদ্ধ ধম্মের
অনুরাগী ছিলেন। কালের চক্রে তাঁদের এই ধম্ম থেকে বিতাড়িত করে পতিত করে দেওয়া হয়।
যাদের উপরে ব্রাহ্মণী বৈদিক অত্যাচার নিরন্তর চলতে থাকে। মানুষ হিসাবে পরিচয়
দেওয়াও যেন অন্যায় বলে বিবেচিত হয় তখন সমাজ শোষণকারীদের কাছে। সেরকম একটা অমানুষিক
পরিস্থিতি থেকে ধর্ম হীন পতিত মানুষদেরকে হরিচাঁদ ঠাকুর নতুন ধর্ম দিলেন। তাদের
মানুষ হিসাবে জীবন যাপনের স্বপন দেখালেন। তাদের বেঁচে থাকার জন্য কাজ করার নির্দেশ
দিলেন। এ সব কি কোন বৈদিক ঈশ্বর করেছে। একটা কথা বলা হয় সেই সময় ১১ কোটি নিপীড়িত
লোক ছিল। আর বৈদিকবাদীদের ৩৩ কোটি দেবতা আছে। অঙ্কের হিসাবে
এক এক জন নিপীড়িতের ৩ জন করে দেবতা পড়ে। তাহলে কোন দেবতা কেন তাদের এই পাতিত্য,
চন্ডালত্ব, এবং বৈদিকতার অমানুষিকতার নির্জাতন থেকে উদ্ধার করেনি। উদ্ধার কেন এক
জন মানুষকে করতে হল? এখন সেই মানুষকে যদি নির্যাতিতরা ঈশ্বর
বা ভগবান বলে তাতে কি অন্যায় করল তারা? না কি আপনাদের ব্যাখ্যায় এই শব্দ মেলে না। কারণ
আপনারাতো নাস্তিক। আপনাদের মত নাস্তিক আমি নই বলেই এসব লিখতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ রোগমুক্ত হতে গেলে রোগের কারণ অবশ্যই জানতে হবে। আর সেই কারণ অনুসন্ধানকে যদি
পরনিন্দা বলেন বলতে পারনে।
অন্যায় যাঁরা প্রতিনিয়ত করে চলেছেন সেই সনামধন্য ডিগ্রীধারীরা, যাঁরা মতুয়া ধর্মের নাম নিয়ে হরি-গুরুচাঁদের আদর্শকে ধুলায় লুন্ঠিত করে ব্যবসা করছেন। আর যাদের মধ্যে এখনও শিক্ষার আলো প্রবেশ করেনি, জ্ঞানের আলো জ্বলেনি তাঁরা যে বৈদিকতায় ডুবে আছেন, সেটা এই ডিগ্রীধারিদের প্রভাবের জন্য। এদের গুরু সাজার জন্য। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে কলম চালান। সমাজকে সঠিক দিশা দেখান। শুধু ঝাল ঝাড়লে কিন্তু আপনাদের নাম যষ বাড়তে পারে; সমাজের তাতে ভাল কিছু হবে বলে মনে হয়না। তাই আসুন সকলে মিলে হরি-গুরুচাঁদের সঠিক ধর্ম ও দর্শনকে দেশ তথা সমাজের সামনে তুলে ধরে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেই সকলের অন্তরে।
Comments
Post a Comment