Skip to main content

দুর্গা পূজা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর -লেখক/ সম্পাদক ডাঃ শুধাংশু শেখর মালাকার


                                                                                  

         দুর্গা পূজা ও গুরুচাঁদ ঠাকুর

   আমরা প্রায়ই বলি যে, গুরুচাঁদ ঠাকুর জীবিত থাকাকালীন ওড়াকান্দির ঠাকুর বাড়িতে দুর্গা পূজা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? গুরুচাঁদ ঠাকুর কি এই পূজার সমর্থক ছিলেন? তিনি দুর্গা বলতে  কাকে বুঝাতে চেয়েছিলেন? মতুয়াদের কি সত্যি কোন ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর পূজা করা দরকার আছে?

 

 (নিচের লেখাগুলো আমি (জগদীশ রায়) শুধু সাজিয়েছি। প্রকৃত লেখক/ সম্পাদক ডাঃ শুধাংশু শেখর মালাকার ১ম অংশ পরবর্তি অংশ কালিদাস বারুরীলেখাটা অনেক বড়, কারণ ঘটনা আরো বড়। তাই ধৈর্য ধরে পড়ে মতামত জানাবেন)

                                                                                                                  


           

     আমরা জানি, গুরুচাঁদ পুত্র শশীভূষণ কলকাতায় পড়াশুনা করাকালীন তিনি ব্রহ্ম সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে অনুমতি চেয়ে ছিলেন ব্রহ্মধর্ম গ্রহণ করার জন্যতখন গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁকে বুঝিয়ে ছিলেন,  

 

                   বন্ধ চোখে যে ব্রহ্মকে দেখিবারে চাও

                   সে ব্রহ্ম পারেনা কিছু এই কথা লও

                   ব্রহ্ম নহে অন্য কোথা ব্রহ্ম নিজ দেহে

                   সে আছে ঘরে তব নহেত বাহিরে। (গুরুচাঁদ চরিত, পৃষ্ঠা নং ৩৪৮)

    অর্থাৎ শরীরের বাইরে কোন ব্রহ্ম নেই সেটা নিজের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আছে তাকে জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে উদ্ভাসিত করা দরকারএইভাবে বুঝিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুর শশীভূষণকে তখনকার মত থামিয়ে রেখে ছিলেন। কিন্তু শশীভূষণের মনের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ্য ভাবনা চিন্তা ও আচার আচরণের প্রভাব পড়ে ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতেই তারঁই জেদের জন্য দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয়

আসুন এ বিষয়ে আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হই

(সৌজন্যে- শ্রীশ্রী গোপালচাঁদ চরিত্র সুধা। লেখক শ্রী শ্রীকান্ত ঠাকুর

সম্পদনায়- ডাঃ সুধাংশু শেখর মালাকার, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৪৭১-৪৭৪)

 আচার্য মহানন্দ হালদার রচিত “শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ চরিত”-এ আমরা দেখতে পাই   

   পৃঃ ৫০১ গৃহীরে করিতে শুদ্ধ, ওড়াকান্দি হরি-বুদ্ধ , আসিয়াছে বহু যুগ পরে। হরিচাঁদ রূপে বুদ্ধ

   পৃঃ ৬৯  মতুয়া জীবনে তাই, দেবদেবী কেহ নাই।---- তাঁর হরি আছে সদা মানুষে মিশিয়া।

   পৃঃ ৭০  নাহি দেব-দেবী পূজা, দীক্ষাশূন্য মহাতেজা ;

             ---কিবা বেদ কিবা স্মৃতি, কিবা শিক্ষা রীতিনীতি, 

             যাবলে ঠাকুর মোর সেই সর্ব্ব সার

             নাহি চাহি মোক্ষধাম, হাতে কাম মুখে নাম,

             চরিত্র পবিত্র রাখা সাধনা সবার

             ............ বেদাতীত এই ভাব।

    পৃঃ ৭৩  নাহি চেনে দেবদেবী     ঘট, পট কিংবা ছবি  

                   জানে মানে মনে প্রাণে শুধু হরিচাঁন্দে।

    পৃঃ ২৩৭ শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে দুর্গা পূজা শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রীশশীভূষণের যেদের ফল ১৩০৯ সালে শ্রীপ্রমথ রঞ্জনের জন্ম, সেই উপলক্ষে অবুঝ কিছু মানুষ পুরানো অভ্যাসবশে শ্রীশশীভূষণের কাছে দুর্গাপূজার বায়না করেন, শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের নিকট সরাসরি বলার সাহস হয়নি, তাই শশীভূষণ তাঁদের পক্ষ নিয়ে জন্মদাতা পিতার নিকট সে পূজার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু জাতির পিতা শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ প্রবলভাবে নিষেধ করেন। অপ্রতিভ শশীভূষণ মান সংকটে পড়ে যান। জগৎপিতার নিষেধের সুদূরপ্রসারী মর্মার্থ না বুঝে শ্রীশশীবাবু পিতার প্রতি অভিমানবশতঃ জবরদস্তি অনশন শুরু করেন। উভয় সংকটে পড়ে আদর্শে অবিচল শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ আত্মজ জ্যেষ্ঠ পুত্র শশীভূষণের মুখ রক্ষার জন্য স্বপ্ন ছলনার অবতারণা করেন। শ্রীশ্রী গুরুচাঁদের প্রতিজ্ঞা তিনি কাল্পনিক দুর্গার প্রতি নতি স্বীকার করবেন না। কৌশলে ঘোষণা করেন দুর্গার প্রতি শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের প্রণাম নিষেধ আছে। শ্রীধাম ওড়াকান্দির মালিক যদি প্রণাম না করেন তাহলে কি তাঁর পূজা করা হল? অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হল- শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ নিজে দুর্গাপূজা করেন নি, ওটা তাঁর অভিপ্রায় নয় সেটাই তিনি কৌশলে জানিয়ে দিলেন, শুধুমাত্র ছেলেপেলেরা করেছে-মানে ওটা ছেলেখেলা

        দুর্গাপূজার পরিবর্তে শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের অভিপ্রায় ছিল শান্তি সভা ও হরিকথা আলোচনা

 [এ প্রসঙ্গে কপিল কৃষ্ণ বিশ্বাস লিখিত  শ্রীধাম ওড়াকান্দি ঠাকুরনগর ও মতুয়াদের নানা প্রসঙ্গ গ্রন্থের ৩৪-৩৯ পৃঃ দ্রঃ ।]

         ১৩০৯ বঙ্গাব্দে / ১৯০২ খ্রিঃ শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে প্রথম দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় শ্রীশ্রীহরিচাঁদের জীবদ্দশায় এবং তাঁর তিরোধানের পরও ২৫ বছর পর্যন্ত শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে দুর্গাপূজা হত না

        শশীভূষণ ঠাকুরের পুনঃপুনঃ অনুরোধে আদর্শিক কারণে প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও শর্তসাপেক্ষে শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর শ্রীধামে দুর্গাপূজার অনুমতি দেন ১৩২০ বঙ্গাব্দে। ডাঃ মীড্ সাহেবের ওড়াকান্দি আগমনের পর ১৯০৬ খ্রীঃ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ) থেকে ১৯১২ খ্রীঃ (১৩১৯ বঙ্গাব্দ) পর্যন্ত ৬ বছর পর্যন্ত গুরুচাঁদ ঠাকুর দুর্গপূজা বন্ধ রাখেন।  শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের জীবনের প্রথমার্ধেও ওড়াকান্দিতে দুর্গাপূজা হত না। ১৩০৯ সনে গুরুচাঁদের বয়স ৫৬ বছর

         ১৩২৬ সালে ৭ই আশ্বিন (১৯১১ খ্রীঃ) মহাঝড়ে প্রলয়কাণ্ড ও বহু জীবনহানি ঘটে। ওড়াকান্দিতে পূজা মণ্ডপ ঝড়ে পড়ে গেল। দুর্গামূর্তিও ভেঙ্গে গেল। গুরুচাঁদ ঠাকুর বিরক্তিভরে পূজা বন্ধের আদেশ দিলেন। তাঁর মনে  শ্রীশ্রী শান্তি-হরির লীলার কথা ভেসে ওঠে।  প্রধান প্রধান ভক্তগণও সারভাব বুঝে বললেন- শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ও শান্তি মাতা-ই ত সকলের সকল মঙ্গল সাধন করেন, দুর্গতি নাশ করেন। শ্রীধামে শ্রীশ্রীহরিচাঁদের পূজা হয়, তাই তাঁরা শান্তি সভা করার প্রয়োজন অনুভব করেন। শ্রীশ্রী গোপালচাঁদও একমত হয়ে কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ও শান্তি মাতার যুগল পূজা এবং শান্তিসভা করার অনুমতি চাইলে শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ তার অনুমতি দেন। শান্তিসভায় হরিবর সরকার ও মনোহর সরকার শান্তিমাতার জন্ম বিবরণ ও প্রশস্তি গাইলে সকল ভক্তবৃন্দ প্রেমানন্দে আপ্লুত হন।]

        শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত - পৃঃ ৩১৬-৩১৭

        শ্রীশ্রীগুরুচাঁদের ছোট ছেলে সুরেন্দ্র নাথ মারা গেলে (১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে)  গৃহবাসী ভক্তগণে সবাই দুর্গাপূজা করতে চাইলেও -

প্রভু বলে, ‘এই কার্য্য আমি না করিব

মরণের ভয়ে শেষে দেবতা ডাকিব ।।

        এখানে অতি স্পষ্ট ভাবে দেবদেবীর অস্তিত্ব অস্বীকার করলেন, এমন কি মৃত্যুমুখেও  নতিস্বীকারে অস্বীকৃতি জানালেন। হিন্দুধর্মের দেবদেবী প্রথা বর্জন একটি মৌলিক পরিবর্তন, আদর্শ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত এটি। এর পরেও মতুয়ারা কি দেবদেবী আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকবে ? আবার স্বপ্নের আশ্রয় প্রসঙ্গে বলা যায়- তখনকার সময়ের বিচারে মতুয়া ধর্মের শৈশব অবস্থার কারণে, পুরানো অভ্যাসে অভ্যস্ত অবুঝেরা যেন বিগড়ে না যায় সে দিকেও তাঁর খেয়াল রাখতে হয়েছে। মূল মর্মভাবটি ছিল  দেবদেবী পূজা বর্জন। ওটা ছিল এক প্রথা থেকে অন্য ধারায় উত্তরণ প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি বা কৌশল। অনেকেই কৌশলটিকে গন্তব্য বলে ধরে বসে থাকায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সমাজভয়ে বঙ্কিমচন্দ্রও কমলাকান্তকে আফিম খাইয়ে তার মুখ দিয়ে কৌশলে সত্য কথা বলাতেন। আফিমের নেশাটা মুখ্য  বিষয় নয়

     শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর নিজে পূজা করা থেকে দূরে রইলেন, শুধুমাত্র ছেলে পেলেরা করেছে। তিনি নিজে কোন পূজা করেন নি, বরং এর বিরুদ্ধে ছিল তাঁর জোরালো ঘোষণা। তিনি নিজে যা করে দেখিয়েছেন সেটা হ শান্তি সভাসুধী মতুয়া ভক্তবৃন্দ কাকে মান্যতা দেবেন, কোন্‌টা ধরবেন?

     * শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা-    ডাঃ তারিণী বল দুর্গাপূজার বদলে শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ও মাতা সত্যভামার পূজা করেন।          

 প্রভু বলে ওরে বাপ কি বলিব আর

 কেহ নাহি এই কর্ম্ম করেছে এবার

 বড় শিক্ষা দেখাইলে অদ্যকার দিনে

 হেন কর্ম্ম নাহি কেহ জানে মতোগণে

 এমন অমূল্য শিক্ষা দিলে নিজ করে

 দেখাইলে প্রতি জীবে ভকতি অন্তরে ॥

 কেহ বলে শ্রী তারিণী ম’তোদের রাজা

করিল সে বর্তমানে মানুষের পূজা

কোন দিন কেহ নহে জানে এই মর্ম

শিক্ষা পেল মতোগণ মর্মান্তিক মর্ম ॥

 

     *শ্রীশ্রীহরি-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধা গ্রন্থের ২৭১ পৃষ্ঠায় শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ বললেন

           বর্তমান যুগে কেহ না জানিত যাহা।                  

       সর্ব্ব প্রথমেতে তুমি দেখাইলে তাহা।

       এ পূজার অগ্রগণ্য তুমি বাপধন

       এই কীর্ত্তি রবে ব্যপ্ত এ তিন ভুবন।।...

        পুনঃ বলে মহাপ্রভু শুনহ তারিণী

        আদর্শ করম ইহা রহিল ধরণী।

        স্বর্ণাক্ষরে বিশ্বমাঝে রহিবে অঙ্কিত

        মম ভক্তগণে ইহা করিবে গ্রন্থিত।।

 

   এ লীলার মর্মার্থ হ শ্রীশ্রীহরিচাঁদ-শান্তি মাতা; শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ-সত্যভামা মাতা; আর ভক্তের নিজ নিজ পিতা-মাতার পূজা-ই প্রকৃত দুর্গা পূজা; আর কোন মাটির প্রতিমায় দেবদেবী পূজা নয়

* আত্মচরিত বা পূর্ব্বস্মৃতি - শ্রী প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর -

   পৃঃ ১১৯  শ্রীশ্রী ঠাকুর কোন দেবদেবীতে বিশ্বাস করতেন না। (মন্তব্য : শ্রীশ্রী পি.আর.ঠাকুরের এই সাক্ষ্যকে প্রামাণ্য ধরতে হবে। আর এ কথা সত্য হলে শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর শ্রীধাম ওড়াকান্দিতে দুর্গা পূজা করেছিলেন সে কথা কি আর ধোপে টেকে? একই যুক্তিতে অন্যান্য দেব-দেবীর বেলাতেও একই কথা সত্য হতে বাধ্য। শব্দসাদৃশ্য দেখে মর্মার্থ বুঝতে গোলমাল হচ্ছে। শ্রীশ্রীহরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মুখে এক কথা বলে কাজে অন্য রকম করতে পারেন ? তা কি বিশ্বাসযোগ্য?)

   পৃঃ ১৫০  শ্রীশশীভূষণের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানদের হবিষ্যান্ন করতে নিষেধ করেন শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর। তিনি বলেন - এই সকল শাস্ত্রের ব্যবস্থার মধ্যে বিশেষ কিছুই নাই । উহা কতকগুলি সংস্কার ব্যতীত অন্য কিছুই নহে। যে খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর স্বাভাবিক ভাবে সুস্থ ও সবল থাকে সেই আহার বিধেয়। ১১ দিনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া

 

এর পরে আর একটা প্রমান আমার হাতে আছে। সেটাও তুলে ধরছি

 

 মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিত- (এর অংশ বিশেষ।) লেখক- কালিদাস বারুরী

(মতুয়া দর্পণ, ১৬নবর্ষ, অক্টোঃ-ডিসেঃ’২০১৫, কার্তিক-পৌষ’১৪২২, ৬৩ সংখ্যা, ২০৪ হরিচাঁদাব্দ, চতুর্থ পর্ব)

 

    “ভক্ত শিরোমণি গোলক সাধুর বাড়ীতে হরিচাঁদ প্রায়শঃই যেতেন এবং রাত্রিযাপন করতেন। ধর্ম আলোচনা চলত সারারাত ধরে। গোলক সাধুর ছোট নাতি জগবন্ধু সরকার তৎকালীন শিক্ষিত মার্জিত এবং সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। একমাত্র গুরুচাঁদ ভক্ত। জগবন্ধুকে একবার মাচকান্দির লেংটা সাধু গোস্বামী দালান বাড়ী নির্মাণ করতে বলেছিলেন। একই নির্দেশ গুরুচাঁদ ঠাকুর যখন দিলেন তখন জগবন্ধুরা পাঁচভাই আলোচনা করে গুরুচাঁদের আশীর্বাদধন্য দালানের নির্মাণ কাজ মাত্র চারমাসে সমাপ্ত করে, গুরুচাঁদ সত্যভামা মাতা সহ সকল ভক্তদের নিমন্ত্রণ  জানালেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর জগবন্ধুকে দালান তৈরি করে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। জগবন্ধুর মেজদার নাম ছিল শ্রীনাথ এবং মাচকান্দির বিশালদেহী সর্বত্যাগী লেংটা সাধু গোস্বামী শ্রীনাথের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। ফলে গৃহপ্রবেশ ও দেবী দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে গোস্বামী শ্রীনাথ, বিচরণ পাগল, জ্ঞানী ষষ্টীবাবু, নীলরতন, নেপাল গোসাঁই, মাধবেন্দ্র, বাবুরাম, অনুধর বালা, অর্থাৎ গুরুচাঁদ পার্ষদবর্গ সেনাবাহিনী সকলেই হর্ষধ্বনি দিতে দিতে উপস্থিত হয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে স্বয়ং গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের এবং পত্নি সত্যভামা মায়ের পরিচয় দিয়েছেন যা সঙ্গী মনোহর রায়ের পান্ডুলিপি ধরে রেখেছে। 

“মম আজ্ঞা পূজা কর শুধু একবার

এরপর পূজা আর নাই দরকার

মম মাতা শাতিদেবী যায় তব বাড়ী

নেয় তব পিতামহ গোলক বিহারী

পিতামহী বিষ্ণুপ্রিয়া অতি ভক্তিমতী

তাঁর ভক্তিগুণে যায় শান্তিমাতা সতী

আদিশক্তি শান্তিমাতা মূল শক্তিদাতা

তাঁর বংশ সত্যভামা যিনি তব মাতা

তোমরা আমাকে বল শিব অবতার

সত্যভামা রূপে দুর্গা জননী তোমার

যায় নাই তব বাড়ী জীবনে কখন

দুর্গারূপে যাবে বাড়ী পূজিবে যখন

আমার রহস্যকথা বুঝিবে সময়ে

তাই কর দুর্গাপূজা আশ্বিনে নির্ভয়ে।”

     আমাকে শুনতে হয়েছে, “বড়ো পন্ডিত অইছে গুরুচাঁদ ঠাহুর দুগ্‌গাপূজা হরছে, তাও জানো না পন্ডিত মশাই।” সেইসব মতুয়াদের আজ প্রমাণ্য দলিল তুলে ধরে অনুরোধ করছি, অনুগ্রহ করে গুরুচাঁদ পড়ুন, গুরুচাঁদ বুঝুন। গুরুচাঁদকে ছবির মধ্যে না রেখে মনের মধ্যে রাখুন। মাথা ঝাঁকিয়ে, ডঙ্কা বাজিয়ে হরিবোল করলেই গুরুচাঁদ বোঝা যায় না। গুরুচাঁদ বুঝতে হলে চাই মন  মানসিকতা। নিরালায় ধ্যানমগ্ন হয়ে গুরুচাঁদ বুঝতে হয়। তামাম মতুয়ারা গুরুচাঁদকে শিব অবতার বলেন অথচ শিবের ঘরণী সত্যভামা মাকে দুর্গারূপে ভাবতে বা পূজা করতে পারছেন না কেন? কাল্পনিক রংমাখা সংরূপি প্রাণহীন খড় কাঠ মাটির দুর্গাপূজার কথা বলেন নাই গুরুচাঁদ। ব্রাহ্মণ্য অসাড় দুর্গাপূজা তিনি কখনও করেন নাই

    সয়ং গুরুচাঁদ যেখানে সত্যভামা মাতার স্বরূপ তুলে ধরেছেন তারপরেও কি মাথা ঝাঁকাবেন? এরপরেও কি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বিদ্যা জাহির করবেন? আপনার শাস্ত্র কোনটা? মনুসংহিতা না গুরুচাঁদ চরিত? হরিলীলামৃত না গীতা? মনুসংহিতায়(১১/১৩০-১৩১) বলা আছে, বিড়াল, বেজি, ব্যাং, কুকুর, পেচক, কাক-এদের যেকোন একটিকে সজ্ঞানে হত্যা করলে যে পাপ হয় একজন শূদ্র মানুষকে হত্যা করলে সমান পাপ হয়। এই অপূর্ব বিধানে পূর্ণ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রসমূহ। কাকে মানবেন? কোনটা মানবেন? মাথা ঝাঁকাবেন না শান্ত হয়ে ভাবুন, বুঝুন। আপনি যে শাস্ত্র মানবেন আপনার প্রাপ্তি তদ্রুপ হবে

    পূন্যবান সাধুশ্রেষ্ঠ গোলক বংশধর জগবন্ধু পঞ্চভ্রাতার প্রতি সত্যভামা মায়ের বচন-

“জগবন্ধু প্রতি বলে শুনহে বচন

তব পূজা পেয়ে মোর হরষিত মন

ওড়াকান্দি হতে এবে আসিলাম আমি

আমি হই সত্যভামা গুরুচাঁদ স্বামী।”

স্বয়ং মণোহর রায়ের মন্তব্য নিজেই লিখেছেন তার পান্ডুলিপিতে-

“এ কাহিনী হতে মোরা বুঝিলাম সার

সত্যভামা রূপে দুর্গা এল শেষবার

যদি মানি এ কাহিনী প্রশ্ন জাগে মনে

মতুয়ারা দুর্গাপূজা করে কি কারণে

যদি তাহা করি মোরা সব মতুয়ারা

দুর্গা কালী পূজি কেন হয়ে আত্মহারা?”

    বোঝো ঠ্যালা। আবার বলি, আমি কি মতুয়া হতে পেরেছি? এখন শ্রাবণ মাস। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নরনারী ২২/২৪ মাইল খালিপায়ে বহু কষ্ট স্বীকার করে হেঁটে হেঁটে বাবার মাথায় জল ঢালছে। এক শ্রেণীর ভক্ত সুতোধারী ব্যবসাদারদের ভূঁড়ি মোটা করছে। বাড়ীতে বৃদ্ধ পিতামাতা-শ্বশুর-শ্বাশুড়িরা রোগে কাতরাচ্ছে। এক ফোঁটা জল দেবার লোক নেই। ঔষধ পথ্য জোটেনা কিন্তু শিব নামক পাথরের মাথায় জল ঢালার নামে মহানন্দে হাজার হাজার টাকা উবে যায়। এই বন্ধ্যাপূজায় মতুয়াদের বিশ্বাস থাকা উচিত নয়

   অথচ গুরুচাঁদনামী বিশ্বেশ্বর জগবন্ধু পঞ্চভ্রাতাকে কে দুর্গাপূজা করিয়েছিলেন তাও লিখেছেন মনোহর রায়ঃ-                 “ইহার বিপক্ষে কথা না থাকিলে কারো

দুর্গাপূজা কালীপূজা সকলেই ছাড়ো

মতুয়াদের এই কথা বুঝাবার তরে

জগবন্ধু দুর্গাপূজা মল্লকান্দি করে

করালেন গুরুচাঁদ শিক্ষার কারণ

বুঝাইতে সত্যভামা হল কোন্‌ জন

______________________

মতুয়ারা হিন্দু নয় ভিন্ন পথ ধারা

হিন্দু হতে জন্মিয়াছে ধর্ম মতুয়ার

তাই বলে হিন্দু হবে এ কোন বিচার

_______________________

মহর্ষি তারকচাঁদ আকার ইঙ্গিতে

বলেছেন সেই কথা মতুয়ার হিতে।”

   আশাকরি শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের ছায়াসঙ্গী মনোহর রায় ঠাকুর লিখিত পান্ডুলিপি থেকে (আংশিক) হরি-গুরুচাঁদের যে সব অমূল্য কীর্তিকাহিনী, আদেশ নির্দেশ, উপদেশ এবং বাণী দেবেন্দ্রলাল বিশ্বাস ঠাকুর উদ্ধার করে লিপিবদ্ধ  করতে পেরেছে, সেখান থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে আমার মনের মানুষ মতুয়া ভক্তদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি মাত্র। মতুয়া ভক্তদের গ্রহণীয় হলে  নিজেকে ধন্য মনে করব।”

_________________________________   

 

Comments

  1. খুব ভাল,জয়হরিচাঁদ জয়গুরুচাঁদ

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ @কপিল দেব

    ReplyDelete
  3. হিপোক্রেসি মনে হলো। দুর্গা কালী শিব পুজা করা যাবে না কিন্তু নিজেরাই শিব, দুর্গা হতে দোষ নাই। ভাল।

    ReplyDelete

Post a Comment