(মতুয়া
দর্পণ, ১৬নবর্ষ, অক্টোঃ-ডিসেঃ’২০১৫, কার্তিক-পৌষ’১৪২২, ৬৩ সংখ্যা, ২০৪
হরিচাঁদাব্দ, চতুর্থ পর্ব)
যথার্থ মানবজীবন
গঠনে হরিগুরুচাঁদ প্রদত্ত অফুরন্ত প্রেমপ্রদায়ী মধুভান্ড এখনও ছড়িয়ে আছে ঘাটে,
মাঠে, বাটে দীনদরিদ্রের ভুলে যাওয়া মূল্যহীন ভাঙ্গা বাক্সে।
ওড়াকান্দির
নিকটস্থ মাচকান্দি গ্রামে গোস্বামী শ্রীনাথ রায়ের বসতবাড়ী হলেও তিনি ছিলেন
সর্বত্যাগী লেংটি সম্বল। বিরাট চেহারার ভীম পালোয়ানী মানুষ। মানুষের মনের মানুষ।
প্রাণের মানুষ। প্রায় আট ফুটের মত লম্বা ভীম পালোয়ানী মানুষ শরীর। গুরুচাঁদ
ঠাকুরের ছায়াবৃত্তে বাক্যসিদ্ধ মতুয়া ধর্মের ধারক, বাহক ও প্রচারক। গুরুচাঁদ ঠাকুর
তাঁকে দ্বাপরের ভীম বলতেন। সর্বত্যাগী গোস্বামী শ্রীনাথের গৃহবাসী কনিষ্ঠভ্রাতা
মনোহর মীড্স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনিও
বহুক্ষেত্রে গুরুচাঁদ সঙ্গী ছিলেন। ওড়াকান্দিধামে রাজর্ষির সঙ্গলাভ ও ভক্তদের নিয়ে
গুরুচাঁদের অলৌকিক সব লীলা কাহিনী যা তিনি চাক্ষুষ করেছেন সে সব লিখে রাখতেন। গুরুচাঁদ
ঠাকুর ভক্তালয়ে ঘুরে এসে বহু সমাজ উন্নয়নী মূল্যবান কথা মনোহরকে বলতেন। মনোহর রায়
লিখে রাখতেন। রাজর্ষি গদিতে বসেও বহু বাণী দিতেন, মনোহর তা লিখে রাখতেন।
এমনি তাঁর
দেশীয় ভাষায় লিখিত বহু পান্ডুলিপি তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে পড়ে ছিল অযত্নে অবহেলায় প্রায় শতবর্ষ যাবত। আজও তা ছাপা
হয় নি। হয়তো তার অস্তিত্ব এখন নাও পাওয়া যেতে পারে। বহু কষ্টে এবং বহু অর্থব্যয়ে
ডি. এল. বি. ঠাকুর সেই ৬/৭ খানা পান্ডুলিপির মাত্র দুটি পান্ডুলিপির আবছা জেরক্স কপি
সংগ্রহ করে তা থেকে কষ্টসাধ্যে উদ্ধার করা গুরুচাঁদ ঠাকুরের কিছু জ্বলন্ত ঘটনা ও বাণী নিয়ে ১৩০
পাতার একটি বই ২০০৩ সালে ছেপেছেন। ঐ
পান্ডুলিপি যার কাছে আছে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কাউকে সে দেবে না। অথচ সেগুলি ছাপানোর
ক্ষমতা বা মানসিকতা কোনোটাই তাঁর নেই। এ কেমন ধরণের মতুয়া? কতবড় সম্পদ নষ্ট হয়ে
যাচ্ছে সেই বোধটুকুই তাঁর নেই। তাঁর একটাই গোঁ-‘কাউকে দেবো না। নষ্ট হয় তাও ভাল
কিন্তু কাউকে দেবোনা।’ সাধে গুরুচাঁদ
বলেছেন,- “আকারে মানুষ বটে পশু একদল।”
উক্ত পান্ডুলিপি
থেকে তুলে আনা রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুরের বলা, তাঁরই পিতৃদেব হরিচাঁদ ঠাকুর লোচনকে
বলেছিলেন,- যা মনোহর রায় লিখেছেনঃ-
“ধর্ম
গেল রসাতলে জাতি-ভেদ জন্য
জাতিভেদ
মানে যারা পশুতুল্য গণ্য।
পশুত্ব
হইতে আমি রক্ষিবার তরে
জনম
নিয়েছি হেথা যশবন্ত ঘরে।
এ-কাজ কঠিন অতি একা অসম্ভব
আসিবে আমার সঙ্গে কৈলাশের ভব।
অপূর্ণ আমার কাজ করিবে সমাধা
ইপ্সিত সকল কাজে আছে বহু
বাধা।
এসেছে এনেছি তাই পূর্ব ভক্তগণ
পূর্ব চার যুগ যার সমর্পিত
মন।
তুমি হও একজন তাহাদের মাঝে
অপর আগত যারা রয়েছে সমাজে।”
লিপিকার
লোচন ঠাকুর সম্বন্ধে লিখেছেন-(লোচন ঠাকুরকে রবি নামেও ডাকা হোত)
“যেখানেই যার রবি সম্মান
প্রচুর
তাহাকে বলিত লোকে
লোচন ঠাকুর।
দুরারোগ্য হোয়ে লোকে হতো রোগাভক্ত
সারিত মুখের বাক্যে
হোক যত শক্ত।
লোকজনে দিতো তিনি
সদা উপদেশ
বল যদি হরিচাঁদ রোগ
ছাড়ে দেশ।
পান্তাভাত কাঁচালঙ্কা খাইলে প্রভাতে
সারিবে ত্রিদোষ জ্বালা হরির দয়াতে।”
এসব ঘটনা
হরিলীলামৃতে নাই। অথচ এত বড় মহাসম্পদের কথা কেহ জানে না। এই মূল্যবান পান্ডুলিপির
মূল্যায়ন হল না অবুঝ নির্বোধ গোঁয়ার রক্ষকের জন্য। এখানে লোচনের হরিভক্তির চুড়ান্ত দিক ফুটে উঠেছে যা লিপিকার
স্বয়ং ব্যক্ত করেছেন। এমন গোসাঁই ই এখন খুঁজে পাওয়া যাবে? যদি বলেন-‘না’, তবে আমার
প্রশ্ন, কেন পাওয়া যাবে না? তাহলে বর্তমানে প্রকৃত হরিভক্ত নেই। দলাদলি আর লম্বা
চওড়া বাতেলা ছেড়ে কেমন করে লোচনের মত সম্মানীয় হরিভক্ত হওয়া যায় তার জন্য চেষ্টা
বা সাধনা করাই মতুয়ার লক্ষ হোক।
সাধুহাটির
কায়স্থ জমিদার গঙ্গাধর সাধু, নমঃদের ঘৃণার চোখে দেখতো? নিঃসন্তান গঙ্গাধর
এবং পত্নি চিন্তামণি ওড়াকান্দিতে এসে হরি ঠাকুরের পা ধরে কান্না কাটি করেছিল একটি
সন্তানের জন্য। তখন হরি ঠাকুর গঙ্গাধরকে যা বলেছিলেন গুরুচাঁদ সেকথা মনোহরকে
বললেন। মনোহরের পান্ডুলিপি কি বলছে, শুনুনঃ-
“অন্তর্যামী
হরিচাঁদ বলে গঙ্গাধরে
ভুল আর না করিও জীবনের তরে।
সকল মানুষ সম,
ভেদাভেদ নাই
করোনা মানুষে ঘৃণা আমি যাহা চাই।
তাঁদের করিলে ঘৃণা
মোরে ঘৃণা হয়
মানুষ জাতিতে এক
ভিন্ন কভু নয়।
ভিন্ন জাতি বলে
যারা করে ভাগ
অমানুষ তাহারাই
ভেড়া আর ছাগ।
জাতিভেদ হিংসা দ্বেষ পারিলে ত্যজিতে
প্রকৃত মানুষ তুমি
হইবে মহীতে।
হিংসাতে বাড়ে তাপ
হিংসাই পাপ
পাপ ফল ভোগ হয় নাই
তার মাপ।”
এখানে
গঙ্গাধরকে শ্রীহরি যে উপদেশ দিলেন সেই উপদেশ আপনার আমার প্রত্যেক মাতুয়ার জন্যও
বটে। হিংসা দ্বেষ করলে তাপ হয়, পাপ হয়, আর এই পাপের ফল ভোগ করতে হয়। এই পাপের কোন
মাপ নেই। হরিচাঁদ সাবধান বাণী দেওয়া সত্ত্বেও মতুয়া এ-দলে ও-দলে হিংসা হয় কেন? বড় ভক্ত ছোট ভক্ত ভেদাভেদ হয় কেন? আসরে গান
গাইতে না পারলে রাগ এবং হিংসা হয় কেন? আর এই হিংসাজনিত সঞ্চিত পাপের কোনো মাপ নেই
গোসাঁই। তাই বলি, ডঙ্কা বাজালেই মতুয়া হওয়া যায়না। হাজারবার পদধুলি মাথায় নিলেও
পাপ স্খলন হয়না। হরিঠাকুর স্পষ্ট করে বলেছেন, “পাপ ফল ভোগ হয় নাই তার মাপ।” অতএব
পাপ কার্য, হিংসা, দ্বেষ, দলাদলি থেকে বিরত থাকুন।
এক বছর পরে
গঙ্গাধরের পুত্রসন্তান জন্ম নিল। একান্নটি রৌপ্য মুদ্রা প্রণামী সহ পুত্র নিয়ে
গঙ্গাধর ওড়াকান্দি এল। এই দৃশ্য সম্বন্ধে মনোহর রায়ের পান্ডুলিপি বলছে-
“মনে হরি স্বপ্ন দৃশ্য দেখে কাটে কাল
শুভলগ্নে পুত্র পেল একদা সকাল।
পুত্রজন্ম
শুভবার্তা নিয়ে গঙ্গাধর
ওড়াকান্দি গেল তিনি একদিন পর।
ঠাকুর বলেন
আমি জানি’ত সকল
এই পুত্র
পেয়ে তব জীবন সফল।
তব পুত্র
নাম দেই রসিক সরকার
বাড়ী চলে যাও এবে দেরী কেন আর।”
ঠাকুর গঙ্গাধর
সাধুর পুত্রের পদবী দিলেন “সরকার”। গ্রামের নাম সাধুহাটি। এই গঙ্গাধর স্বপরিবারে
আজীবন মতুয়া জীবন পালন করে ধন্য হয়েছিল।
ওড়াকান্দি
থেকে দু-মাইল দূরে খাগড়াবেড়ে গ্রাম। মুসলমান প্রধান এলাকা। অত্যাচারী লম্পট বড়
মিঞা সেখানকার প্রতাপশালী ধনী ব্যক্তি। এই বড় মিঞা সম্বন্ধে মনোহর রায়ের
পান্ডুলিপির ভাষাঃ- কাউকে মানে না মিঞা,
বিবি আছে চার
পুত্রকন্যা বহুজন বিরাট সংসার।
________________________
জুম্বার নামাজ কালে এক দ্বিপ্রহরে
দৈববাণী শুনিলেন শূন্যের
উপরে
“যে
আল্লাকে ডাক তুমি নামাজ পড়িয়া
সে আল্লাকে দেখ তুমি ওড়াকান্দি গিয়া।
__________________________
অদৃশ্য হইয়া হরি করে
দৈববাণী
সর্বত্র রয়েছি আমি শুন
ওহে মানী।
নিরাকার আল্লা আমি তোমার
উপাস্য
এখন সাকার আমি তব অবিশ্বাস্য।
______________________
হরির চরণে পড়ে মিঞা পর
কয়
হরি আল্লা মোর প্রতি
হওগো সদয়।
আল্লা যে মানুষ হয় হইল
প্রত্যয়
মোরে তুমি কর দয়া তুমি দয়াময়।
________________________
পাপমুক্ত কর মোরে আল্লা
হরিচাঁন
তুমি মোর প্রাণাধিক মোর
বাপজান।
হরিচাঁদ শুনে বলে শুন বড়
মিঞা
হরিবোল জপ কর আমাকে
ভাবিয়া।
_________________________
নামাজ করিল বন্ধ সেই দিন
হ’তে
জপে শুধু হরিবোল দিবা
কিবা রাতে।
আল্লা হরি দেখিবার মন যবে
চায়
বড়
মিঞা ওড়াকান্দি আসে আর যায়।”
এসব ঘটনা
গুরুচাঁদ ঠাকুর গদিঘরে বসে বলতেন আর গোস্বামী শ্রীনাথ ভ্রাতা ভক্তবৎসল মনোহর রায়
লিখতেন। এ হেন মহামূল্যবান সম্পদ যা প্রায় শতবর্ষ পূর্বে লেখা পান্ডুলিপি আজও ছাপা
হয় নি। অগণিত মতুয়া ভক্তের অগোচরেই রয়ে গেল কারারুদ্ধ হয়ে। একজন গোঁয়াড় অবোধ
মতুয়ার অন্ধ অজ্ঞতা বসতঃ এই মহামূল্যবান পান্ডুলিপি কফিনবন্দী হয়ে পড়ে রইল।
বরিশালের
স্বরূপকাঠি থানার কাঠপিটানী গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি অম্বিকাচরণকে গুরুচাঁদ
নিজের পরিচয় নিজেই দিচ্ছেন আর মনোহর রায় লিখছেন,-অর্থাৎ গুরুচাঁদের লীলা শুরু
অম্বিকারচরণকে হাতিয়ার করে।
“মম পিতা হরিচাঁদ পূর্ণ অবতার
অপূর্ণ তাহার লীলা আমি
করি তার।
অংশ অবতারে যারা ছিল
তাঁর সাথী
আসিয়াছে সলকেই হয়ে
নিম্ন জাতি।
মম পিতা হরিচাঁদ মোর
মধ্যে স্থিতি
অপূর্ণকে পূর্ন করি
মেনে পিতৃনীতি।
________________________
হিন্দু তীর্থযাত্রায়
কোন ফল নেই,”- এই তত্ত্ব বোঝাবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর অম্বিকাচরণকে
ভারতের সমস্ত তীর্থস্থান দর্শন করতে পাঠালেন। হরি-গুরুচাঁদ কোনদিন কোন তীর্থে বা
মন্দিরে যান নি। সে সম্বন্ধে মনোহর রায় লিখেছেন,-
“শ্রীঅম্বিকা ওড়াকান্দি করে যাতায়াত
একদিন গুরুচাঁদ বলিল হঠাৎ
শুন শুন শুন ওহে
অম্বিকাচরণ
এইবার কর তুমি
তীর্থ পর্যটন।
বড় বড় বহু তীর্থ এ ভারতে আছে
কিছু তীর্থ দরশিয়া ফিরে এসো কাছে।
গয়া কাশী বৃন্দাবন ত্রিবেণী সঙ্গম
এইসব তীর্থে তুমি যাইবে প্রথম।”
অম্বিকাচরণ যে তীর্থ যায় সেখানেই দেখছেন
গুরুচাঁদ আর সত্যভামা মায়ের প্রতিচ্ছবি-মূর্তি। শ্রী মনোহর রায় লিখেছেন,- “গুরুচাঁদ সব তীর্থে আছে বর্তমান
ওড়াকান্দি গেলে হয় সব সমাধান।
ওড়াকান্দি তীর্থরাজ অথবা সম্রাট
মিছামিছি অন্য তীর্থ খরচ বিরাট।
ওড়াকান্দি গুরুচাঁদ যে করে ভজন
তার নাহি লাগে কোন তীর্থ পর্যটন।
এ-রহস্য বুঝতে অম্বিকাচরণে
গুরুচাঁদ পাঠালেন তীর্থ পর্যটনে।”
কাশীতীর্থে গিয়ে অম্বিকাচরণের যে আধ্যাত্ম
চেতনা জেগেছিল তা নিম্নরূপঃ-
“অম্বিকা রহস্য বুঝে কাশীধাম ঠাঁই
মতুয়ার হিন্দু তীর্থ
প্রয়োজন নাই।
ওড়াকান্দি জয়পুর
লক্ষ্মীখালি ধাম
তিন তীর্থ মতুয়ার আমি
বলিলাম।”
এ হেন চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা সত্বেও মতুয়াদের
হিন্দুতীর্থ যাত্রার সাধ মেটেনা। তাঁরা ঠাকুরনগর বছরে যার একবার। অন্যান্য তীর্থে বারবার।
গুরুচাঁদ ঠাকুর তীর্থযাত্রার রহস্য বোঝাবার জন্যই তো অম্বিকাচরণকে তীর্থে
পাঠিয়েছিলেন। তা সত্বেও মতুয়ারা গুরুচাঁদের গুরুত্ব বুঝলো না। তাঁরা গুরুচাঁদের
ধ্বনি দেন কিন্তু গুরুচাঁদীয় পথে চলেন না। এতে মতুয়া জীবন গঠিত না হয়ে মর্কট জীবন
তৈরী হতে পারে। মতুয়া মানে “তার মতে” চলা। মতুয়া মানে “তার তীর্থে সর্বদা অবগাহন
করা।”
ব্রাহ্মণ্য
হিন্দুধর্ম থেকে হরি-গুরুচাঁদের মতুয়া ধর্ম জন্ম নেয়নি। তাছাড়া ব্রাহ্মণ্য
ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, ধর্মের অধিকার এবং ধর্মপ্রচারের অধিকার একমাত্র ব্রাহ্মণের।
মন্ত্রের অধিকারও তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তাই মতুয়া ধর্ম সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ
স্বতন্ত্র ধর্ম। চন্ডাল ভগবান হরিচাঁদের সম্পুর্ণ নিজস্ব ধর্ম এই মতুয়া ধর্ম। সেই
বিচারে এই ধর্ম ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের শাখা-প্রশাখা হয় কি করে? মতুয়ারাই বা হরিচাঁদ ভিন্ন হিন্দু দেবদেবী পূজা
করে কি করে? অর্থাৎ আমরা হরি-গুরুচাঁদ দর্শনতত্ত্ব আদৌ বুঝিনি। বুঝবার চেষ্টাও করিনি।
কিন্তু হরি-গুরুচাঁদ ভাঙ্গিয়ে দিব্যি
গুরুগিরি, গোসাঁইগিরি করে সংসার চালাই। স্বার্থসিদ্ধি করি মনের হরষে।
প্রকৃত মতুয়া অম্বিকাচরণ তীর্থ সেরে ওড়াকান্দি এসে বুকের উপর গুরুচাঁদের
প্রতিমূর্তি দেখিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেনঃ-
“মতুয়ার হিন্দু তীর্থ প্রয়োজন নাই
ওড়াকান্দি জয়পুর
লক্ষ্মীখালি ধাম
তিন তীর্থ মতুয়ার আমি
বলিলাম।”
ভাবুন, সমস্ত মতুয়ার জন্য তিনি তীর্থ
ওড়াকান্দি, জয়পুর আর লক্ষ্মীখালি বেঁধে দিতে পারেন। মতুয়া হতে হয় সাধনা করে। বলি
ও মতুয়া গোসাঁই কি বুঝলেন? গুরুচাঁদকে টেক্কা দিয়ে কতদিন চলবে? আপনার তীর্থস্থান কোনটা
এবার ঠিক করুন।
গুরুচাঁদ যখন বুঝলেন অম্বিকা মতুয়া ধর্মের
সারকথা অর্থাৎ মতুয়া ধর্মতত্ব দর্শন হাড়ে হাড়ে বুঝেছে, তখন তিনি অম্বিকাকে যে যে
উপদেশ দিলেন সেই মহামৃত কথা ধরা পড়েছে মনোহর রায়ের পান্ডুলিপিতে- “আমাদের কেন্দ্র করে সব তীর্থস্থান
তীর্থ দরশনে তোমা দিয়েছি প্রমাণ।
মতুয়ার তীর্থযাত্রা প্রয়োজন নাই।
ওড়াকান্দি তীর্থরাজ
তোমাকে জানাই।
এ তত্ত্ব বুঝিয়ে দাও সব মতুয়াকে
এ কারণে তীর্থস্থানে পাঠাই তোমাকে।”
এসব গুঢ় তত্ত্ব অতি সহজভাবে গুরুচাঁদ
ভক্তদের মধ্যে প্রচার করলেন অম্বিকাচরণসহ অন্যান্য ভক্ত পার্ষদবর্গদের মাধ্যমে।
বজ্রকঠোর কঠিন অনমনীয় শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে হরিচাঁদ মতুয়া ধর্মের প্রচার ও প্রসার
ঘটালেন ব্রাহ্মণ্যবাদের পুঞ্জিভুত দৈবদোহায়ী পুতুলশক্তি তথা পুত্তলিকাবাদের
বিরুদ্ধাচরণ করে। খলনায়ক ব্রাহ্মণেরা পুতুলকে সর্বশক্তিমান ভগবান বানিয়ে নিজেদেরকে
ঈশ্বরের Direct প্রেরিত দূত ঘোষণা করে তীর্থস্থানের
নামে সূক্ষ্মভাবে বংশ পরম্পরায় সাধারণ মানুষদের শোষণ ও শাসন করে চলেছে।
এই তত্ত্ব বোঝাবার জন্যই গুরুচাঁদ ঠাকুর
অম্বিকাকে তীর্থযাত্রা করিয়ে এনে বললেন,
“মতুয়ার তীর্থযাত্রা প্রয়োজন নাই,
ওড়াকান্দি তীর্থরাজ
তোমাকে জানাই।”
এরপর অম্বিকাকে নির্দেশ দিলেন,- “এ তত্ত্ব
বুঝিয়ে দাও সব মতুয়াকে
এ কারণে তীর্থস্থানে পাঠাই তোমাকে।”
অম্বিকাচরণ একমাত্র ভক্ত যিনি
গুরুচাঁদ তত্ত্ব ও তত্ত্বদর্শন বুঝেছিলেন হৃদয় দিয়ে। তিনি তীর্থে তীর্থে পাথরের
মূর্তির বদলে গুরুচাঁদ দর্শন করতেন এবং করেছেন বহুবার। তিনি তীর্থ ভ্রমণ করে
বুঝেছিলেন, ধর্মের নামে মিথ্যার বেসাতি করে সুতোধারী রাষ্ট্র দুঃশাসন। তাইতো সেই
হারিয়ে যাওয়া মধুর প্রেমভক্তির গহীন গাঙের তলদেশ থেকে অমৃতভান্ডাকে লেখনির মধ্যে
তুলে ধরলেন মনোহর রায়- “ওড়াকান্দি যেয়ে
করে গুরু দরশন
চরণে পড়িয়া করে অশ্রু বরিষণ।
গুরুচাঁদ বলে এবে শান্ত হয়ে রও
বলেছি তোমাকে যাহা সে পথিক হও।”
গুরুচাঁদ ঠাকুর জীবদ্দশায় কোনোদিন কোন
হিন্দু, মুসলমান বা খ্রীষ্টান তীর্থে না গিয়েও ওড়াকান্দি বসে তাঁদের সমস্ত খবর
জানতেন কি করে? এইখানে প্রশ্ন থেকে যায়-
(ক) গুরুচাঁদ ঠাকুর কে? তা কি
বুঝেছি?
(খ) তাঁর দেওয়া মতুয়া জীবন
গঠন করার আদেশ নির্দেশ মেনে চলছি তো?
(গ) ওড়াকান্দি এবং গুরুচাদ
কি?- তা ভক্ত অম্বিকাচরণ বুঝলেও বর্তমান মতুয়ারা বুঝেছেন কি? “বলেছি তোমাকে
যাহা সে পথিক হও” গুরুচাঁদের এই নির্দেশ শুধু অম্বিকাচরণের জন্য নয়। তামাম
দুনিয়ার মতুয়াদের জন্য এই অমর অমৃত নির্দেশ। আর এটাই মতুয়া তত্ত্বদর্শন। এটা না
বুঝলে না মানলে আমি কিসের ছাই মতুয়া? প্রার্থনা করি, অম্বিকাচরণের মত ভক্ত ঘরে ঘরে
জন্ম নিক।
আমি বলব, মতুয়াদের যদি কোন অধঃপতন হয়ে
থাকে তবে তা হয়েছে গুরুচাঁদ তত্ত্ব না বোঝার জন্য। মনে প্রাণে গুরুচাঁদকে অনুসরণ
এবং অনুকরণ না করার জন্য। আমি মতুয়া সমাজকে আহ্বান করছি, আসুন আবার নতুন করে
গুরুচাঁদের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়ে গুরুচাঁদ দর্শনের অ আ ক খ শিখতে শুরু করি।
তাতে লাভ কতটুকু হবে বলতে পারবো না তবে লোকসান আদৌ হবে না, একথা জোর দিয়ে বলতে
পারি।
বহুক্ষেত্রে
হরি-গুরুচাঁদের নীতি-বিধি-বিধান আলোচনা প্রাক্কালে মতুয়া গুরু গোসাঁইরা উন্নসিকতা
প্রদর্শনপূরবক বলে থাকেন, “ওয়া শাস্ত্রে লেখা নাই। বাবুরা নেহা পড়া শিখা
ছাইভস্ম কয় কি? গুরুচাঁন্দের কতা আমাগো চাইতে ভাল জানে কেডা?”……. ইত্যাদি চোখা চোখা বাণে বিদ্ধ হয়েছি বহুবার।
এতদ শাস্ত্র বিষয়ে একটি ঘটনা মনোহর রায়ের
পান্ডুলিপিতে ধরা পড়েছে। ওড়াকান্দির নিকটে বহুগ্রামের মহাজন শ্রীআনন্দ মজুমদারের
বাড়ীতে দানসাগর যজ্ঞ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত গুরুচাঁদ ঠাকুর পার্ষদবর্গ নিয়ে উপস্থিত
ছিলেন। ব্রাহ্মণ পরিবেষ্টিত সেই অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র সম্বন্ধে গুরুচাঁদ
ভক্ত শ্রীচন্ডীচরণ রায়ের বক্তব্য শুনুনঃ-(নির্দেশ গুরুচাঁদ ঠাকুরের)
“ব্রাহ্মণের
স্বার্থ তরে শাস্ত্র লেখে তারা
শাস্ত্রের বিধান মানে অব্রাহ্মণ যারা।
দেবদেবী পূজা করে সব হিন্দুগণ
হয়না তাদের পূজা ব্যতীত ব্রাহ্মণ।
নিজ পূজা নিজে করা অবশ্য উচিত
শাস্ত্রে লেখা নাই তাই হইল গর্হিত।”
মারাত্মক কথা। আবার গুরুচাঁদ বুঝিয়ে দিলেন হিন্দু শাস্ত্রসমুহ কপট ধুরন্ধ্র
ব্রাহ্মণদের স্বার্থ রক্ষার্থে রচিত হয়েছে। সমস্ত হিন্দুরা দেবদেবীর পূজা করে অথচ
অব্রাহ্মণ হিন্দুদের পূজা ব্রাহ্মণ ছাড়া সিদ্ধ হবে না। এ কেমন শাস্ত্র? ঐসব
ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র দূরে ঠেলে গুরুচাঁদ নির্দেশ দিলেন,- “নিজের পূজা নিজে
কর।” কিন্তু হিন্দুশাস্ত্রকার ব্রাহ্মণরা
এই কাজকে ‘গর্হিত’ বলছে কারণ নিজের কাজ নিজে করার কথা শাস্ত্রে লেখা নেই।
প্রশ্ন থেকে যায়, আমি কাকে মানবো? কোণ বা কার শাস্ত্র বানবো? গুরুচাঁদ
শাস্ত্র না ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র? যদি ওদের শাস্ত্র মানি তবে দাসত্বকে স্বীকার করতে
হবে। এটাই শূদ্রের জন্য হিন্দুশাস্ত্রের বিধান। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় নাগপাশে
বাঁধা পশুবৎ জীবন থেকে যাদের হরি-গুরুচাঁদ উদ্ধার করলেন তাঁরা এখনও
হিন্দুশাস্ত্রের শক্ত ভক্ত। ভক্তির নফর। ফলে তারা গুরুচাঁদকে প্রকারান্তরে অস্বীকার
করছে। মতুয়ারা কি মতুয়া? না নামধারী মতুয়া?
এই মনুবাদী হিন্দুশাস্ত্রের বিরুদ্ধে স্বয়ং গুরুচাঁদের উক্তি মনোহর রায়ের
পান্ডুলিপিতে ধরা পড়েছেঃ- “গুরুচাঁদ
বলে শুন ওহে রামতনু
ব্রাহ্মণেরা
আমাদের সমাজেতে মনু।
ওদের
বিধান মোরা সদা মেনে চলি
অন্যায়
হলেও তাহা মুখে নাহি বলি।
অন্যায়
যে করে আর অন্যায় যে সহে
শ্রীহরির
ঘৃণা তারে সর্বদায় দহে।”
এখানে রামতনুকে উদ্দ্যেশ্য করে সমস্ত মতুয়াদের বললেন, ব্রাহ্মণেরা আন্যায়
করে এবং আন্যায় বিধান দেয় মনুস্মৃতির বিধান অনুযায়ী এবং শূদ্রের অন্যায়ের কোন
প্রতিবাদ না করে মুখ বুজে সহ্য করে এবং মেনে নেয়। অর্থাৎ সুতোধারীরাও এক একজন মনু।
তিনি বললেন, অন্যায় যে করে আর সেই অন্যায়ের আপ্রতিবাদ না করে যারা সহ্য করে, মুখ
বুজে থাকে উভয়কে শ্রীহরি ঘৃণাভরে শাস্তি দিয়ে থাকেন।
মতুয়া ভক্ত, গুরু, গোসাঁই আপনারা উপরোক্ত গুরুচাঁদ উবাচ অনুযায়ী জীবনধারণ
করছেন তো? যদি না করে থাকেন তবে এখনই গুরুচাঁদ বর্ণপরিচয় পড়তে ও বুঝতে চেষ্টা করুন
খাঁটি মতুয়া হবার লক্ষ্যে।
মঞ্চে সর্বদর্শী দেবগুরু গুরুচাঁদকে প্রণাম
করে নমঃদের তৎকালীন ভক্ত পন্ডিত ব্যক্তিত্ব গুরুচাঁদীয় ভাষায় নমঃদের চন্ডালতা
প্রাপ্তির কথা বললেন।
“নমঃশূদ্র নির্যাতিত সকল সময়
গোড়ায় শাস্ত্রীয় নীতি
ব্রাহ্মণেরা কয়।
শাস্ত্র লেখে
ব্রাহ্মণেরা উদ্দেশ্য অসৎ
স্বজাতীয় স্বার্থ তরে
দেখায় কুপথ।”
রামতনুর এই বক্তৃতা শুনে সভায়
উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা গুরুচাঁদেকে বারবার প্রণাম করে বলেন-
“তাহা
শুনে ব্রাহ্মণেরা সকলে দাঁড়ায়
বলে তাঁরা হেন কাজ কভু না মানায়।
__________________________
ক্ষমা কর গুরুচাঁদ মোরা তব দাস
এই বলে ব্রাহ্মণেরা জানায় প্রণতি
আর বলে তুমি হও জগতের পতি।
ভেদবুদ্ধি বলে মোরা ছিলাম অজ্ঞান
রামতনু আমাদের করে জ্ঞানদান।
তাহার গোড়ায় তুমি বুঝিলাম সার
প্রণাম তোমাকে করি আমরা আবার।”
ওহে! ভক্ত, গুরু, গোসাঁইয়ের চাটামবাজ
বারফট্টাই ভক্তিবিটেল মতুয়ার দল; যথার্থ বিশ্বাসী মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিত
রামতনুর উপরোক্ত বক্তব্যের সারকথা বুঝে নিজেরা নিজেদের জীবন গড়ে তুলুন। তাতে সমাজ
বাঁচবে, রাষ্ট্র উন্নত হবে। একদিন মতুয়ারাই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য কর্ণধার।
মতুয়া জগতে গোলক সাধু হলেন আশ্চর্য
হরিভক্তির চরম ধুমকেতু। তাঁর সম্পর্কে পান্ডুলিপি বলছেঃ- “তখনের ভক্ত এক
সাধু শ্রীগোলক
হরিবোল সদা জপে মনেতে নাই পুলক।
হরিচাঁদ ভক্ত তিনি অতীব মহান
হরিনাম বিনা কারো মনে নাই স্থান।
মানিত না দেবদেবী পূজাদি ব্রাহ্মণ
_____________________
বিষ্ণুপ্রিয়া নামে ছিল গোলক ঘরণী
হরি নামে বেয়ে চলে হরির তরণী।”
অর্থাৎ গোলক এবং তাঁর স্ত্রী
বিষ্ণুপ্রিয়া শ্রীহরি গুণগান ছাড়া অন্য কোনো দেবদেবী ব্রাহ্মণ কাহাকেও মানতেন না।
একমাত্র উপাস্য হরিচাঁদ।
প্রশ্ন জাতে, বর্তমান মতুয়ারা বোধহয়
গোলকের চেয়ে বড় শাস্ত্রজ্ঞানী, তাই তারা তেত্রিশ কোটি দেবদেবী পূজায় মেতে উঠেছে।
হরিচাঁদ নগণ্য। দু-নৌকায় পা দিয়ে কি সাগর পাড়ি দেওয়া যায়? ভক্তি বিশ্বাস দু-ভাগে
বিভক্ত হলে কে কাকে উদ্ধার করবে? ষোল আনা সঁপে না দিলে কি হরির কৃপা মেলে?
গোলক সাধু এবং বিষ্ণুপ্রিয়ার স্থান চিরকাল মাথার উপরে থাকবে কিন্তু আপনার স্থান
কোথায় হবে ভেবেছেন কি?
এই ভক্ত শিরোমণি গোলক সাধুর বাড়ীতে হরিচাঁদ
প্রায়শঃই যেতেন এবং রাত্রিযাপন করতেন। ধর্ম আলোচনা চলত সারারাত ধরে। গোলক সাধুর
ছোট নাতি জগবন্ধু সরকার তৎকালীন শিক্ষিত মার্জিত এবং সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। একমাত্র
গুরুচাঁদ ভক্ত। জগবন্ধুকে একবার মাচকান্দির লেংটা সাধু গোস্বামী দালান বাড়ী
নির্মাণ করতে বলেছিলেন। একই নির্দেশ গুরুচাঁদ ঠাকুর যখন দিলেন তখন জগবন্ধুরা
পাঁচভাই আলোচনা করে গুরুচাঁদের আশীর্বাদধন্য দালানের নির্মাণ কাজ মাত্র চারমাসে
সমাপ্ত করে, গুরুচাঁদ সত্যভামা মাতাসহ সকল ভক্তদের নিমন্ত্রণ জানালেন। গুরুচাঁদ ঠাকুর জগবন্ধুকে দালান তৈরি
করে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেও নির্দেশ দিয়েছিলেন। জগবন্ধুর মেজদার নাম ছিল
শ্রীনাথ এবং মাচকান্দির মিশালদেহী সর্বত্যাগী লেংটা সাধু গোস্বামী শ্রীনাথের মধ্যে
ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। ফলে গৃহপ্রবেশ ও দেবী দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানে গোস্বামী
শ্রীনাথ, বিচরণ পাগল, জ্ঞানী ষষ্টীবাবু, নীলরতন, নেপাল গোসাঁই, মাধবেন্দ্র,
বাবুরাম, অনুধর বালা, অর্থাৎ গুরুচাঁদ পার্ষদবর্গ সেনাবাহিনী সকলেই হর্ষধ্বনি দিতে
দিতে উপস্থিত হয়েছেন। এই অনুষ্ঠানে স্বয়ং গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের এবং পত্নি
সত্যভামা মায়ের পরিচয় দিয়েছেন যা সঙ্গী মনোহর রায়ের পান্ডুলিপি ধরে রেখেছে।
“মম
আজ্ঞা পূজা কর শুধু একবার
এরপর
পূজা আর নাই দরকার।
মম
মাতা শাতিদেবী যায় তব বাড়ী
নেয়
তব পিতামহ গোলক বিহারী।
পিতামহী
বিষ্ণুপ্রিয়া অতি ভক্তিমতী
তাঁর
ভক্তিগুণে যায় শান্তিমাতা সতী।
আদিশক্তি
শান্তিমাতা মূল শক্তিদাতা
তাঁর
বংশ সত্যভামা যিনি তব মাতা।
তোমরা আমাকে বল শিব অবতার
সত্যভামা রূপে দুর্গা জননী তোমার।
যায় নাই তব বাড়ী জীবনে কখন
দুর্গারূপে যাবে বাড়ী পূজিবে যখন।
আমার রহস্যকথা বুঝিবে সময়ে
তাই কর দুর্গাপূজা আশ্বিনে নির্ভয়ে।”
আমাকে শুনতে হয়েছে, “বড়ো পন্ডিত অইছে
গুরুচাঁদ ঠাহুর দুগ্গাপূজা হরছে, তাও জানা না পন্ডিত মশাই।” সেইসব মতুয়াদের আজ প্রমাণ্য দলিল তুলে ধরে অনুরোধ করছি, অনুগ্রহ
করে গুরুচাঁদ পড়ুন, গুরুচাঁদ বুঝুন। গুরুচাঁদকে ছবির মধ্যে না রেখে মনের মধ্যে
রাখুন। মাথা ঝাঁকিয়ে, ডঙ্কা বাজিয়ে হরিবোল করলেই গুরুচাঁদ বোঝা যায় না। গুরুচাঁদ বুঝতে
হলে চাই মন মানসিকতা। নিরালায় ধ্যানমগ্ন
হয়ে গুরুচাঁদ বুঝতে হয়। তামাম মতুয়ারা গুরুচাঁদকে শিব অবতার বলেন অথচ শিবের ঘরণী
সত্যভামা মাকে দুর্গারূপে ভাবতে বা পূজা করতে পারছেন না কেন? কাল্পনিক রংমাখা
সংরূপি প্রাণহীন খড় কাঠ মাটির দুর্গাপূজার কথা বলেন নাই গুরুচাঁদ। ব্রাহ্মণ্য অসাড়
দুর্গাপূজা তিনি কখনও করেন নাই।
সয়ং গুরুচাঁদ যেখানে সত্যভামা মাতার স্বরূপ
তুলে ধরেছেন তারপরেও কি মাথা ঝাঁকাবেন? এরপরেও কি শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বিদ্যা
জাহির করবেন? আপনার শাস্ত্র কোনটা? মনুসংহিতা না গুরুচাঁদ চরিত? হরিলীলামৃত না
গীতা? মনুসংহিতায়(১১/১৩০-১৩১) বলা আছে, বিড়াল, বেজি, ব্যাং, কুকুর, পেচক, কাক-এদের
যেকোন একটিকে সজ্ঞানে হত্যা করলে যে পাপ হয় একজন শূদ্র মানুষকে হত্যা করলে সমান
পাপ হয়। এই অপূর্ব বিধানে পূর্ণ ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রসমূহ। কাকে মানবেন? কোনটা মানবেন?
মাথা ঝাঁকাবেন না শান্ত হয়ে ভাবুন, বুঝুন। আপনি যে
শাস্ত্র মানবেন আপনার প্রাপ্তি তদ্রুপ হবে।
পূন্যবান সাধুশ্রেষ্ঠ গোলক বংশধর জগবন্ধু
পঞ্চভ্রাতার প্রতি সত্যভামা মায়ের বচন-
“জগবন্ধু প্রতি বলে শুনহে বচন
তব পূজা পেয়ে মোর হরষিত মন।
ওড়াকান্দি হতে এবে আসিলাম আমি
আমি হই সত্যভামা গুরুচাঁদ স্বামী।”
স্বয়ং মণোহর
রায়ের মন্তব্য নিজেই লিখেছেন তার পান্ডুলিপিতে-
“এ কাহিনী হতে মোরা বুঝিলাম সার
সত্যভামা রূপে দুর্গা এল শেষবার।
যদি মানি এ কাহিনী প্রশ্ন জাগে মনে
মতুয়ারা দুর্গাপূজা করে কি কারণে।
যদি তাহা করি মোরা সব মতুয়ারা
দুর্গা কালী পূজি কেন হয়ে আত্মহারা?”
বোঝো ঠ্যালা। আবার বলি, আমি কি মতুয়া হতে
পেরেছি? এখন শ্রাবণ মাস। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নরনারী ২২/২৪ মাইল খালিপায়ে বহু কষ্ট
স্বীকার করে হেঁটে হেঁটে বাবার মাথায় জল ঢালছে। এক শ্রেণীর ভক্ত সুতোধারী
ব্যবসাদারদের ভূঁড়ি মোটা করছে। বাড়ীতে বৃদ্ধ পিতামাতা-শ্বশুর-শ্বাশুড়িরা রোগে
কাতরাচ্ছে। এক ফোঁটা জল দেবার লোক নেই। ঔষধ পথ্য জোটেনা কিন্তু শিব নামক পাথরের
মাথায় জল ঢালার নামে মহানন্দে হাজার হাজার টাকা উবে যায়। এই বন্ধ্যাপূজায় মতুয়াদের
বিশ্বাস থাকা উচিত নয়।
অথচ গুরুচাঁদনামী বিশ্বেশ্বর জগবন্ধু
পঞ্চভ্রাতাকে কে দুর্গাপূজা করিয়েছিলেন তাও লিখেছেন মনোহর রায়ঃ- “ইহার
বিপক্ষে কথা না থাকিলে কারো
দুর্গাপূজা কালীপূজা সকলেই ছাড়ো।
মতুয়াদের এই কথা বুঝাবার তরে
জগবন্ধু দুর্গাপূজা মল্লকান্দি করে।
করালেন গুরুচাঁদ শিক্ষার কারণ
বুঝাইতে সত্যভামা হল কোন্ জন।
______________________
মতুয়ারা হিন্দু নয় ভিন্ন পথ ধারা
হিন্দু হতে জন্মিয়াছে ধর্ম মতুয়ার
তাই বলে হিন্দু হবে এ কোন বিচার।
_______________________
মহর্ষি
তারকচাঁদ আকার ইঙ্গিতে
বলেছেন
সেই কথা মতুয়ার হিতে।”
আশাকরি শ্রীশ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছায়াসঙ্গী
মনোহর রায় ঠাকুর লিখিত পান্ডুলিপি থেকে (আংশিক) হরি-গুরুচাঁদের যে সব অমূল্য
কীর্তিকাহিনী, আদেশ নির্দেশ, উপদেশ এবং বাণী দেবেন্দ্রলাল বিশ্বাস ঠাকুর উদ্ধার
করে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছে, সেখান থেকে
কিছু কিছু অংশ তুলে আমার মনের মানুষ মতুয়া ভক্তদের বোঝাবার চেষ্টা করেছি মাত্র।
মতুয়া ভক্তদের গ্রহণীয় হলে নিজেকে ধন্য
মনে করব।
নমঃশূদ্রদের
দশটি শ্রেণীবিভাগ ছিল নিম্নরূপঃ-
১) যারা ধান চাষ করে তাদের
বলা হত ‘ধানীনমঃ’।
২) নমসমাজের মানী ব্যক্তিদের
বলা হত ‘শেফালীনমঃ’।
৩) মগ জলদস্যুদের দ্বারা
আক্রান্তদের বলা হত ‘মৌগ্গা নমঃ’।
৪) শত্রুদ্বারা আক্রান্ত হয়ে
যারা পিছন ফিরে ভয়ে পালিয়ে যেত এবং পালাবার সময়ে তাদের পশাদভাগ দেখা যেত বলে তাদের
‘পোদ’ বলা হত।
৫) কচ্ছপ, জিয়ল মাছ ধরে যারা
বিক্রি করত তাদের ‘জিয়নি’ বলা হত।
৬) যারা বাজারে মাছ কেটে
বিক্রি করত তাদের ‘কাড়ার’ বলা হত।
৭) যারা নুন বিক্রি করত তাদের
‘নুনিয়া’ বলা হত।
8) যারা বেড়া জাল দিয়ে বেড়
দিয়ে মাছ ধরত তদের ‘বেউড়া’ নমঃ বলা হত।
৯) যারা চাঁই যন্ত্রের
সাহায্যে মাছ ধরত তাদের ‘চাঁইয়া’ নমঃ বলা হত।
১০) যারা তেঁতুলের ব্যবসা করত
তাদের ‘কাঁইয়া’ নমঃ বলা হত।
গুরুচাঁদ ঠাকুর এই দশের মধ্যে নটি শ্রেণীকে
একত্রিত করে নম”শূদ্র জাতি গঠন করেছিলেন। পোদেরা এই দলে না এসে এখনও পোদ বা
‘পৌন্ড্র নামেই অবস্থান করছে।
______________________________________________________________
Comments
Post a Comment