Skip to main content

বিদ্রোহী বালক হরিচাঁদ


বিদ্রোহী বালক হরিচাঁদ
    হরিচাঁদের পিতা যশোমন্ত পরম বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন। সংসারে অনেক অভাব অনটন থাকা  সত্বেও কোন বৈষ্ণবের সেবা না করে নিজে আহার গ্রহণ করতেন না। হরিচাঁদ ছাড়া বাকি ভাইয়েরাও পিতার মত বৈষ্ণব ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
হরিদাস ছাড়া বাকি পুত্র ছিল যতো।
  বৈষ্ণব দেখিলে সবে হইত পদে নতো।।
                                                      (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং- 258)
তাই বৈষ্ণব দেখ্‌লেই বাকি ভাইয়েরা ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাঁদের পায়ে পড়তেন। কিন্তু সমস্যা  দেখা দেয় হরিচাঁদকে নিয়ে।
পিতার আদেশে সেবা করে ভাই চারি।
হরিচাঁদে নিয়ে বটে গোলযোগ ভারী।।
                            পদরজঃ দূরে থাক্‌ দণ্ডবৎ নাই।
                            প্রহার পীড়ন কর যথাপূর্ব তাই।।
যশোবন্ত বলে, ‘হরি! রজঃ মাখ অঙ্গে।’
অলক্ষিতে চলে হরি চাহিয়া অপাঙ্গে।।
ইঁদুরের তোলা মাটি অঙ্গে মাখি তাই।
বলে ‘মাখিয়াছি রজঃ তুমি দেখ নাই।।
                                                                        (লীলামৃত, ঠাকুরনগর, 2009, p. 54)
    পিতা যশোমন্ত বৈষ্ণবদের সামনে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে যেতেন বালক হরিচাঁদকে নিয়ে। অন্য চার পুত্র পিতার আজ্ঞামত বৈষ্ণবদের দেখলে পায়ের ধূলা নিতেন। কিন্তু হরিচাঁদ? বৈষ্ণবদের  পায়ের ধূলা গ্রহণ তো দূরের কথা, মাথাও নিচু করতেন না। (পদরজঃ দূরে থাক্‌ দণ্ডবৎ নাই।) এর জন্য তাঁকে যতই বকাবকি করা হোকনা কেন তাতে তাঁর মধ্যে কোন পরিবর্তনের লেষমাত্র দেখা যেতনা। এমনকি তাঁর পিতা যখন বলতেন, ‘হরি! রজঃ মাখ অঙ্গে।’ অর্থাৎ পায়ের ধূলা অঙ্গে মাখ। তখন সবার অলক্ষে ইঁদুরের তোলা মাটি অঙ্গে মেখে এসে বলতেন, ‘এই দেখ আমিতো ‘মাখিয়াছি রজঃ।’ এরকম দুরন্ত বালককে নিয়ে পিতা যশোমন্ত প্রায়ই কিছু না কিছু সমস্যায় পড়েতেন।   
    আসলে বাল্যকাল থেকেই হরিচাঁদের স্বভাবে বিদ্রোহী ভাব ফুঁটে উঠেছিল। তিনি বৈষ্ণবদের কর্ম-কান্ড একদম পছন্দ করতেন না। তাই –
ঝোলা রাখি বৈষ্ণবেরা স্নানে, পানে যায়।
       উজাড় করিয়া ঝোলা ঠাকুর ফেলায়।।       (ঐ)
বৈষ্ণবেরা ঝোলা রেখে যখন স্নান করতে যেতেন, তখন হরিচাঁদ তাঁদের ঝোলা উল্টিয়ে ফেলে দিতেন। তিনি যে বৈরাগীদের পছন্দ করতেন না তারই বহিঃপ্রকাশ এই ভাবে করতেন। কিন্তু তাঁর পিতা এসব দেখে রেগে যেতেন-
দুরন্ত অশান্ত পুত্রে পিতা দেয় দন্ড।
          কেঁদে বলে হরিচাঁদ “বৈরাগীরা ভন্ড।।”    (ঐ)
এই দুরন্ত অশান্ত পুত্রকে তিনি শাস্তি দিতেন। তখন হরিচাঁদ পিতার দেওয়া শাস্তি ভোগ করেও চুপ না থেকে বলতেন যে, “ঐ বৈরাগীরা হচ্ছে ভন্ড।” ছোট্ট বালকের মুখে এরকম কথা শুনে পিতা অবাক হয়ে যেতেন। তিনি ভাবনায় পড়ে যেতেন, এইটুকু বালক বৈষ্ণবদের দেখলে এরকম  ব্যবহার কেন করে! তিনি তখন এর সদুত্তোর খুঁজে না পেয়ে হরিকে আবার আদর করতেন।
তখন-                       পিতৃ-কোলে থাকি হরি ক্রোধ করি বলে।      
                            ‘ভন্ডবেটা বৈরাগীরা দূরে যা রে চলে।।’  (ঐ)
পিতার কোলে থেকে আদর ও শান্তনা পেয়ে হরি আরো রেগে গিয়ে বলেতেন-‘এই বৈরাগীরা হচ্ছে ভন্ড, এঁদের তুমি অন্য কোথাও চলে যেতে বল।’
এইভাবে বৈষ্ণবদের প্রতি বালক হরিচাঁদের ক্রোধ যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি তাঁর দুরন্তপনাও দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর দুরন্তপনার আর একটি নিদর্শনে দেখতে পাই-
একদা এক বৈরাগী জপমালা করে।
  চক্ষু মুদে বসে একা বারান্দা উপরে।।
হরিদাস এসে পিছে করিয়া ভ্রুকুটি।
 বৈরাগীর টিকি দেয় একপোচে কাটি।।
                                                   (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং- 258)
একদিন একজন বৈরাগী মালা জপ করছিলেন। তখন বালক হরিদাস ঐ বৈরাগীর পিছনে গিয়ে তাঁর টিকি কেটে দেন। তখন বৈরাগী রাগ আর অপমানে জ্বলে উঠে গালাগাল ও অভিশাপ দিতে থাকেন। বৈরাগীর অভিশাপ শুনে হরিদাস বলেন-
সত্যবাদী ভিন্ন শাপ কভু তো ফলে না।
 সত্যাশ্রয়ী হলে কেহ শাপ তো দেবে না।।
                                                                     (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং- 259)
অর্থাৎ যদি কোন ব্যক্তি সত্যকে আশ্রয় করে চলেন, তিনি যদি কোন অভিশাপদেন তাহলে সেটা সত্যি হলেও হ’তে পারে; কিন্তু ভন্ড লোকের অভিশাপের তো কোন মূল্য নেই। আর যিনি সত্যবাদী হ’ন, তিনি তো কাউকে অভিশাপ দেওয়ার মত অযৌক্তিক কাজ করতে পারেন না।
   এই ঘটনা দেখে হরিচাঁদের পিতা তাঁকে ধরার জন্য চেষ্টা করেন। তখন-
লম্ফ দিয়ে হরিদাস চলে গেল দূরে।
 বলে বাবা দাস কভু বলিও না মোরে।।
পৃথিবীতে দাস বাবা আমি কারো নই।
সত্যের নির্দেশে চলি এর দাস হই।।
------------------------------
                           হরিদাস নামে মোর মনেতে বিষাদ।
দাস স্থানে চাঁদ জুড়ে ডেকো  হরিচাঁদ।।
                                                                 (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং- 260)
হরিচাঁদকে তাঁর পিতা ধরার চেষ্টা করলে লাফ দিয়ে দূরে সরে যান। আর তাঁর বাবাকে বলেন যে, “আমাকে ‘দাস’ বলে ডাকবে না। এই পৃথিবীতে আমি কারো দাস নই। আমি শুধু যেটা সত্য, সেই সত্যের নির্দেশকে মেনে চলি। তাই আমি শুধুমাত্র সত্যের নির্দেশ ব্যতীত অন্য কারো দাস নই।  তাই আমাকে ‘হরিদাস বলে ডাকলে আমার খুব দুঃখ হয়। ‘দাস’ স্থানে চাঁদ জুড়ে আমাকে  ‘হরিচাঁদ’ বলে ডেকো।”
     এই ঘটনা হরিচাঁদের বড় ভাই কৃষ্ণদাস দেখছিলেন। তিনি বালক হরিচাঁদের মুখ থেকে এই কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে আনন্দে হরিচাঁদকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন।
কৃষ্ণদাস ছুটে এসে ভাই নিয়ে বুকে।
         বলে হরিচাঁদ নামে ডাকিব তোমাকে।।     (ঐ)
                                                                          
এসব দেখে মাতা অন্নপূর্ণাও আর স্থির থাকতে না পেরে তিনিও খুশিতে হরিচাঁদকে কোকে তুলে
আদর করেন।          
অন্নপূর্ণা উঠে বলে পুত্র নিয়ে কোলে।   
      তুই মম চাঁদ বাবা জানিবে সকলে।।     (ঐ)
বলেন, ‘তুই তো আমার ‘চাঁদ’আজ থেকে সবাই তোকে ‘হরিচাঁদ’ বলে ডাকবে।

অবশেষে পিতা যশোমন্ত আর চুপ থাকতে না পেরে হরিচাঁদকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করতে থাকেন। আর এইভাবে দুরন্তপনা ও স্নেহ ভালবাসার মধ্য দিয়ে হরিচাঁদ তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে থাকেন। 

Comments