মরা গরু বাঁচানোর কাহিনি
হরিচাঁদ তাঁর প্রিয় সাথী ব্রজনাথ, বিশ্বনাথ
আর নাটুকে নিয়ে ঘুরে রেড়াতেন। গ্রামে কারো কোন সমস্যা হ’লে তার সমাধানের চেষ্টা
করতেন। কখনও সবাই মিলে গাছে চড়তেন। কখনও গরু চরাতে যেতেন। আর কখনও খোলা মাঠে গলা
ছেড়ে দিয়ে গান করতেন। আর এই সব করতে করতে খিদে পেলে কখনও কখনও নিজেদের বাড়ী এসে
খেয়ে যেতেন। কিন্তু অধিক সময় বিশের মা এঁদের আদর যত্ন করে যা পারতেন তাই খেতে
দিতেন। কারণ হরিচাঁদের জন্যই বিশে মরতে মরতে বেঁচে গেছে।
এই যে বন্ধুদের মিলন এটা প্রতিদিনই চলত। কখনও কখনও এঁরা প্রয়োজনবোধে
কৃষিকাজে হাত লাগাতেন। একত্রে কাজ করে অল্প সময়ে অধিক কাজ করতেন। আবার কোন দিন
ইচ্ছা হ’লে সবাই মিলে ঘুড়ি ওড়াতেন। এইভাবে এঁদের জীবন ধারা চলছিল।
একদিন দেখা গেল হরিচাঁদের বাড়ির গোয়ালের সব থেকে শক্তিশালী ও কর্মঠ বলদ
গুরুটি শুয়ে বা টান টান করে পড়ে আছে। নাক দিয়ে শ্লেষ্মা বের হচ্ছে। এরকম অবস্থা
দেখতে পেয়ে বড়ভাই কৃষ্ণদাস আর ছোটভাই স্বরূপদাস গরুর কাছে ছুটে যান। ছোটভাই গরুটির
মাথা কোলের মধ্যে নিয়ে সেবা করার চেষ্টা করে। কিন্তু বড়ভাই গরুর অবস্থা দেখে ছোট
ভাইকে বলেন-
‘কেন বসিয়াছ মরা গরু কোলে করে?
পেট ফুলে উঠিয়াছে পা হ’য়েছে টান।
পেট ফুলে উঠিয়াছে পা হ’য়েছে টান।
দাঁতে দাঁত লেগে গেছে উত্তার নয়ন।।
বাঁচিবেনা ঐ গরু প্রায় মরে গেছে।
উঠে এস, থাক কেন বলদের কাছে।।
(লীলামৃত ১ম প্রকাশ পৃষ্ঠা নং ৪৩)
অর্থাৎ মরা গরু কোলে করে কেন বসে
আছ। দেখছোনা দাঁতে দাঁত লেগে গেছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে। এ গরু আর বাঁচবে না, এতো
প্রায় মরে গেছে। তাই এই গরুর কাছে বৃথা বসে থেকোনা।
পাঠককে বুঝতে হবে গরুর মরনাপন্ন
অবস্থার বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। প্রথমে বলা হচ্ছে মরা গরু কোলে করে কেন বসে আছ।
আবার পরক্ষণেই বলে হোল ঐ গরু বাঁচবেনা প্রায় মরে গেছে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি
গরু মরার পুর্বাবস্থার পরিস্থিতিগুলি দেখা যাচ্ছে, তবে গরু যে পুরাপুরি মরেনি সে
কথা পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে।
হরিচাঁদ তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ঐ সময় বাড়িতেই
ছিলেন। গোয়াল ঘরের এই ঘটনার কথা তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি সেখানে ছুটে যান
বন্ধুদের নিয়ে। কিন্তু গোয়ালের সব থেকে ভাল গরুটি এই ভাবে চোখের সামনে মরে যাচ্ছে
দেখে বড় ভাইয়ের খুব দুঃখ হয় কিছু প্রতিকার করতে না পারার জন্য। গ্রামের চাষিদের
কাছে হালের গরু হচ্ছে যুবক সন্তানের মত। কারণ জমি চাষ করার জন্য বিশেষ করে বলদ গরু
বিশেষে দরকারী। সেই যুবক সন্তানসম গরু যদি চোখের সামনে প্রায় বিনা কারণে হঠাৎ করে
মরনাপন্ন হয় তখন চাষির জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়।
তখন হরিচাঁদকে দেখে বড়ভাই কৃষ্ণদাস
দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে কিছুটা রাগের সঙ্গে হরিচাঁদকে বলেন-‘তোমরা কয়জনে মিলে পাড়া
ভরে ঠাকুরালী করে বেড়াও। জানিনা কি ভাল কাজ করো তোমরা লোকের। আমিতো দেখি তোমরা
শুধু শুধু কোন কাজ না করে অন্ন ধ্বংস করছ। আজ দেখব তোমাদের ঠাকুরালী করার কত
প্রভাব আছে। যাও আজ যদি তোমরা গোয়ালের মরনাপন্ন গরুটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পার তবেই
বুঝবো তোমাদের সত্যি সত্যি কোন ক্ষমতা আছে। আর যদি তোমরা এই গরুকে বাঁচাতে না পার
তাহলে এবাড়িতে তোমাদের আর ভাত নেই একথা বলে দিলাম।’
বড়দাদা কৃষ্ণদাসের মুখে এসব কথা শুনে –
এত শুনি ব্রজ চাহে ঠাকুরের ভিতে।
ঠাকুর ব্রজকে ব’লে দিলেন ইঙ্গিতে।।
“যারে ব্রজ আমি তোরে দেই অনুমতি।
উঠ্ বলি বলদেরে মার গিয়া লাথি।।”
হুঙ্কার করিয়া ব্রজ করি হরিধ্বনি।
বলদেরে লাথি গিয়া মারিল অমনি।।
“ওঠ্ ওঠ্ ওরে গরু র’লি কেন শুয়ে।
অমনি উঠিয়া গরু গেল দৌড়াইয়ে।।
(লীলামৃত ১ম প্রকাশ পৃষ্ঠা নং ৪৩)
অর্থাৎ- বড়কর্তার এই সব কথা শুনে
ব্রজনাথ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে হরিচাঁদের দিকে তাকান। চোখের ভাষায় জানাতে চান এই
সমস্যার থেকে কি করে উদ্ধার হওয়া যাবে? তখন হরিচাঁদ ঈশারায় ব্রজকে অনুমতি দেন
গরুকে গিয়ে লাথি মেরে ওঠানোর জন্য। ব্রজ আজ্ঞা মত হরিধ্বনি দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন আর বলেন “ওঠ্ ওঠ্
এখনো শুয়ে রয়েছিস কেন?” এই বলে গরুর পিঠে লাথি মারেন। লাথি খেয়ে গরু উঠে দাঁড়ায়।
এখানের এই ঘটনার এখন আমরা বিশ্লেষণ করে
দেখি-
প্রথম কথা হচ্ছে- পৃথিবীতে কোন
প্রাণী একবার মারা গেলে সেটা আর কখনও জীবিত হয় না। এটা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রমান্য
মতবাদ। তবে কিছু কিছু ঘটনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন ঘটেছে যে, আপাত দৃষ্টিতে মৃত মনে
হলেও তার মৃত্য হয়নি। বা Brian Death হয়নি। কোমায় চলে গেছে। বা এই ধরণের কোন ঘটনা ঘটেছে। তবে
সম্পূর্ণরূপে মরেনি। হয়তঃ কখনও কখনও ডাক্তার অসবাধানরা বশতঃ মৃত বলে ঘোষণা করে
দেওয়ার পরেও বেঁচে থাকার নিদর্শন পাওয়া গেছে।
এখানে এই গরুর ক্ষেত্রেও তেমনি কোন কারণ ঘটে
থাকবে। গরুকে এমন জায়গায় আঘাত করার ফলে তার নার্ভ System সচল হয়ে যায়। যেটা বেশী
যুক্তি সংগত বলে মনে হয়। যার ফলে লাথি খেয়ে গরু উঠে দাঁড়ায়।
আবার এমনও হ’তে পারে পালের সব থেকে
শক্তিশালী গরুটিকে বেশী বেশী করে কাজ করানো হ’ত। কিন্তু গরুটি কাজ করার ইচ্ছা না
থাকায় সেই সময় মরার মত ভান করে পড়েছিল। আর
যখন ব্রজ জোরে হুঙ্কার দিয়ে সেই গরুর পিঠে যোরে লাথি মারে তখন গরুটি ভান করা ছেড়ে
দিয়ে আর বেশী মার খাওয়ার থেকে বাচাঁর জন্য উঠে দাঁড়িয়ে পালিয়ে গিয়ে মাঠে গিয়ে ঘাস
খেতে শুরু করে।
এখানে এই দু’টি ঘটনার মধ্যে যে
ঘটনাই ঘটুক না কেন; এখানে কিন্তু এই ঘটনার
পিছনে কোন অলৌকিকতার ছাপ নেই। হরিচাঁদ ঠাকুরও আমাদের মতই মানুশ। কিন্তু তাঁর বিচার
–বুদ্ধির প্রখরতা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক উচ্চ স্তরের ছিল। যেটা সাধারণ মানুষে
সেই প্রখরতাকে তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়েো
বিশ্লেষণ করার চেষ্টা না করে হরিচাঁদের প্রতি দেবত্ব, অলৌকিকত্ব আরোপ
করতেন। যে পরম্পরা আজ বিজ্ঞানের যুগেও সমান তালে ঘটে চলেছে। যার ফলে লোকে আপাত
দৃষ্টিতে এই অসম্ভব ঘটনার কারণ বুঝতে না পেরে হরিচাঁদকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী
মেনেন নিয়ে তাদের নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ করে চলেছে। আর এই হরিচাঁদকে অলৌকিক ক্ষমতার
অধিকারী বলে মেনে নেওয়া ও তাদের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়ার জন্য কিছু ধুর্ত লোক গুরু সেজে মানুষকে ধোকা দিয়ে
অর্থ উপার্জনের ব্যবসা ফেঁদেছে। আর এই
ব্যবসার কাজে আগুনে ঘি ঢালার মত কাজ করেছে হরিলীলামৃতের পরবর্তী সংস্করণগুলো।
যেখানে পূর্বের চেয়ে আরো বেশী বেশী করে অলৌকিকতাকে সুচতুর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
যাইহোক এই ঘটনা বড়ভাই কৃষ্ণদাস দেখার পরে, হরিচাঁদ ও তাঁর সাথী ব্রজ, নাটু আর
বিশ্বনাথকে অন্তরের ভালবাসা প্রেরণ করেন।
তাদের বলেন, “তোমরা শুধু অন্ন ধ্বংস করে বেড়াও না। মানুষের উপকার কর সেটা
আমি প্রত্যক্ষ করলাম। তাই আজ থেকে আমি তোমাদের বলছি, তোমরা এইভাবে জগতের কল্যান
মূলক কাজ করো। তোমাদের ভরন পোষণের সব দায়িত্ব আমার, আমি প্রয়োজনে ভিক্ষা করেও
তোমাদের খাওয়াবো।
______________________
Comments
Post a Comment