Skip to main content

লোকায়ত ইতিহাস থেকে সত্যের অনুসন্ধান

লোকায়ত ইতিহাস থেকে  সত্যের অনুসন্ধান
    শৈবকাল থেকেই হরিচাঁদের চিন্তা-ভাবনা, ক্রিয়া-কর্ম, চলন-বলন সব কিছুই অন্যের থেকে  পৃথক মনে হ’ত। প্রায়ই মনে হ’ত তিনি যেন কোন গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে আছেন। বয়ষ্ক   লোকদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেনকিন্তু তিনি যেটা খুঁজছিলেন, তার অনুসন্ধান বেশীরভাগ লোকই দিতে পারতেন না। যদিও অতীতের অনেক ইতিহাস গল্পাকারে লুকিয়ে আছে মানুষের মধ্যে। তবুও তিনি খুঁজে ফেরেন তার আখাংকিত তথের সন্ধানে   
   গ্রাম্য বাংলায় একটা প্রবাদ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। বিশেষ করে ছোট বেলায় বাচ্চারা খেলার ছলে কখনও কোন শাপ দেখলেই মারত। আর সেটা যদি মেটে শাপ হয় তাহলে তো আর  কোন কথাই নেই। কারণ এই মেটে শাপের কোন বিষ নেই। তাই এই শাপ মারার সময় সকলে মিলে গান করত-
কলির বাওন মেটে শাপ।
   যে না মারে তার হয় পাপ।।
অর্থাৎ কলিকালের বামনরা হচ্ছে মেটে শাপের মত। কারণ এদের কোন বিষ নেই। এরা মানুষকে যে দেব-দেবীর ভয় দেখায়, আসলে সে সব মিথ্যা। ভন্ডামী। বাস্তবের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই;  বুদ্ধিমান মানুষেরা এটা বুঝতে পারেন। এই কলির বামুনরা মেটে শাপের মতই নির্বিষ। তাই এদের দেখলেই মারা উচিত। তা না হলে এদের মিথ্যাচারকে বাড়তে দিলে দেশের ক্ষতি। এদের ভন্ডামীর বিরুদ্ধে যিনি প্রতিবাদ না করবেন তাঁরই পাপ হবে। অর্থাৎ তিনি একতো নিজের ক্ষতি করে ব্রাহ্মণ্যবাদের গোলাম হয় নিজে অশিক্ষিতি থেকে সমাজের ক্ষতি করছেন। আর তিনি যে কষ্ট করে উপার্জন করছেন, সেই উপার্জনের অর্থ ব্রাহ্মণকে বিভিন্ন প্রলোভনের শিকার হয়ে দান করছেন। এই দান করা তো মহাপাপের সমান। তাই কলির বামুনকে অর্থাৎ ব্রামণ্যবাদকে নির্বিষ মেটে শাপ মনে করে ব্রাহ্মণ্যবাদকে নষ্ট করা দরকার।
এখানে আর একটা কথা বলা হয়েছে। ‘কলির বামুন’। কলি অর্থাৎ কলি যুগের ব্রাহ্মণ। এই কলি যুগ সম্পর্কে আমরা লীলামৃতে দেখতে পাই-
তিন যুগ পরে কলি যুগ এ কনিষ্ঠ।
কনিষ্ঠ হইয়া হৈল সর্ব যুগ শ্রেষ্ঠ।।
                                                                  (লীলামৃত ১ম সংস্করণ, পৃষ্ঠা নং ১)
কলি যুগের পূর্ববর্তী তিন যুগে অনেক অবতার জন্মগ্রহন করেছেন। আর সেই অবতাররা  ব্রাহ্মণদেরই উপকারে এসেছে। কিন্তু কলিকালে কোন অবতার জন্মগ্রহন করেনি। জন্মগ্রহন করেছেন মহামানবেরা। যাঁরা হচ্ছেন সনাতন কালের ২৭ জন পূর্ব বুদ্ধ। আর তার পর বৌদ্ধ ধম্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ। এঁরা মানবতার জয়গান করেছেন, কোন ব্যাক্তি বা বর্গ বিশেষের নয়। এই সময় ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলায় তো ১১৩০ সালের পূর্বে কোন ব্রাহ্মণ প্রবেশই করতে পারেননি। কারণ বাংলায় পাল রাজারা প্রায় চারশ বছর রাজত্ব করেছেন। আর এই পাল নৃপতিরা ছিলেন বৌদ্ধ ধম্মাবলম্বী।
                         তাই- কলির বামুন মেটে শাপ
                              যে না মারে তার হয় পাপ।। এই প্রবাদটার গুরুত্ব কিন্তু অসীম।
     হরিচাঁদ বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন-  
গৌতম বুদ্ধের কথা শুনিতে শুনিতে।
পূর্ব বুদ্ধদের তথ্য ধরিল জ্ঞানেতে।।
                                                                          (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং-২৮১)
তিনি বয়ষ্ক লোকদের কাছ থেকে গৌতম বুদ্ধের কর্ম-কান্ড শুনতে শুনতে পূর্ব বুদ্ধদের তথ্যকেও তার জ্ঞান দৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেন। তিনি এটাও জানতে পারেন-
মহান আশোক যিনি শ্রেষ্ঠ নৃপমণি।
  আনুগত্য ছিল বৌদ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ জানি।।
     জাতিতে চন্ডাল জেনে এ হেন আশোক।
শিশু হরিচাঁদ মনে জাগিত পুলক।।
                                                                  (তথ্য ঐ)
মহান সম্রাট অশোক যিনি শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন। তিনি বৌদ্ধের অনুরাগী ছিলেন। তিনি যুদ্ধের হিংসা কে প্রত্যাহার করে মানব কুলে বুদ্ধের প্রেমের বাণী প্রচারের কাজে ব্রতী হন। আর এই মহান রাজা অশোক ছিলেন একজন চন্ডাল বংশজাত। হরিচাঁদও ছিলেন চন্ডাল বংশের। তাই এ  কথা জেনে বালক হরিচাঁদের মনে গর্ব সঞ্চার হতো। নিজের জাতি যে, হীন্‌ জাতি নয়, শৌর্য-বীর্যশালী গর্বের জাতি এটা বুঝতে পেরে তাঁর জাতির প্রতিও শ্রদ্ধা বেড়ে যেত।
     কিন্তু যখন শুনলেন,- সম্রাট অশোকের বংশধর নাবালক রাজা বৃহদ্রথকে কুটকৌশলী ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুশ্যমিত্র শুঙ্গ প্রকাশ্য রাজ সভায় তাঁকে হত্যা করে শাসন ভার দখল করে নেয়। আর বৌদ্ধ রাজত্বের পতন ঘটিয়ে ব্রাহ্মণ শাসন প্রচলন করে। তখন বালক হরিচাঁদের হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আর-
                                              ব্রাহ্মণের দুর্নীতি শুরু হ’ল জানা।
                                   ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি জেগে ওঠে ঘৃণা।।  ( তথ্য ঐ) 
 ব্রাহ্মণদের এই দুর্নীতির ইতিহাস জানতে পেরে বালক হরিচাঁদের মনে তাদের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক শুরু হয়।
   হরিচাঁদ পাল রাজাদের সম্পর্কেও অনেক কথা জানতে পারেন। পাল রাজাদের বীরত্বের কাহিনি শুনে তাঁর মন গর্বে ভরে যায়। আরও গর্ব বোধ করেন যখন তিনি জানতে পারেন-
ইহারাও নমঃ ছিল জানিল তা ধীরে।
       বৌদ্ধ ধম্ম ছত্র ছিল ইহাদের শিরে।  ( তথ্য ঐ) 
এই পাল রাজারাও নমঃজাতির ছিল। এবং এঁরা সর্বদা বৌদ্ধের নীতি নিয়েই শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। যার ফলে তাদের শাসন কালে জনগনের মধ্যে অনেক সুখ-শান্তি বিরাজ  করত। এই সময় শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞান চর্চার জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়। এর থেকে হরিচাঁদ ঠাকুর বুঝলেন-
শিক্ষাই জাতির ভিত প্রভু বুঝে নিল।
          শিক্ষা প্রতি অনুরাগ প্রগাঢ় হইল।।     ( তথ্য ঐ) 
শিক্ষাই হচ্ছে কোন জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা বিনা কোন জাতির অগ্রগতি অসম্ভব। হরিচাঁদ বুঝলেন কোন জাতির উন্নতির জন্য তার ভিত হচ্ছে শিক্ষা। যদিও হরিচাঁদের সময়ে সেই শিক্ষার আলোর প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতা লাগিয়ে রেখে ছিল। হরিচাঁদ নিজেও সেই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার শিকার হয়ে শুধুমাত্র পাঠশালা পর্যন্ত পড়ার পর আর অগ্রসর হতে পারেননি। কিন্তু  তিনি এটা ভাল করে উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর জাতিকে জাগাতে হ’লে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। তাই পরবর্তীতে সেই গুরুদায়িত্ব তিনি নিজ পুত্র গুরুচাঁদের উপর অর্পণ করেছিলেন।
এর পর হরিচাঁদ সেন রাজাদের অত্যাচারের কথাও জানলেন-
সেন রাজাদের কথা যখনে জানিল।
             বেদবিধি প্রতি ঘৃণা তীব্রতর হ’ল।।       (তথ্য ঐ)
তখন তাঁর হৃদয়ে বেদবিধির প্রতি তীব্র ঘৃণার উদ্রেক হয়। যার জন্য তিনি তাঁর ধর্ম মত প্রতিষ্ঠাকালে প্রথমেই ঘোষণা করেছিলেন-
কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ প্রসাদ পেলেও খাই।
বেদবিধি শৌচাচার নাহিমানি তাই।। 
                                          (হরিলামৃত ১ম সংস্করণ পৃষ্ঠা নং ১)
অর্থাৎ আমি কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ বা এটো খাবার খেতেও রাজি আছি। কিন্তু কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ থেকে নিকৃষ্ঠ বেদ ও তার বিধানকে মানতে রাজী নই। কারণ পৃথিবীতে এর থেকে অমানবিক ঘৃণ্য কোন গ্রন্থ ও তার নিয়ম হতে পারেনা।
    হরিচাঁদের এই জানার আগ্রহ দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর যে তথ্য জানতে পারেন, সেটাকে তাঁর অন্তর আত্মা দিয়ে সেই পরিস্থিতির ছবিটাকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন।
    একদিন একজন শতবর্ষ অতিক্রান্ত বৃদ্ধার অনুসন্ধান পেলেন। তিনি সেই বৃদ্ধার কাছে গেলেন। বৃদ্ধা আগেই হরিচাঁদের সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছিলেন। তাই তিনি বলেন, শুনেছি, “তুমি বালক হলেও আমাদের মত মানুষের কাছে গল্প শুনতে ভালবাস? কিন্তু আমার কথা তো কেউ শুনতে চায়  না। তুমি কি আমার মনের ব্যথাকে শুনবে?” হরিচাঁদ বৃদ্ধার কথা শুনতে আগ্রহী হলেন।
কথা প্রসঙ্গে বৃদ্ধা বলে মৃদু হেসে।
     কিছু পূর্বে পূজা-আশ্রা ছিলনা এ দেশে।
ঠাকুমার মুখে গল্প শুনেছি আমরা।
 গঙ্গার ওপার হ’তে এল বামুনেরা।।
    ফেরিঅলা সম তারা ঘুরে গ্রামে গ্রামে।
                 শুনাত মাহাত্ম্য কথা দেবতার নামে।। (হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং-২৮২ )
কথায় কথায় বৃদ্ধা বললেন-“আমি আমার ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনেছি এক সময় এখনকার মত  এদেশে  কোন পূজা-পার্বণ হ’তো না। সেই সময়ের লোকেরা খুব সুখ-শান্তিতে বসবাস করত।  কারো মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব বিবাদ ছিলনা। প্রায় সবাই কৃষিকাজ করত। কিন্তু গঙ্গার ওপার থেকে নাকি কোন বামুনেরা এসে ফেরিওলাদের মত গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বেড়াত; আর কি সব দেব দেবতার কথা প্রচার করত। তাতে নাকি সংসারের মঙ্গল হবে। আর ধন সম্পত্তির বৃদ্ধি হবে। ইহকালে সুখী হবে। পরকালের জন্য মোক্ষ লাভ হবে।  
 তা বাবা তুমিই বল, আজ আমাদের লোকদের এই যে যে, দুর্দশা সেটা এই দেব-দেবতার পূজা-পাবন করতে গিয়েই হচ্ছে না? যদি দেব-দেবতার পূজা- পাবন করেই সব কিছু ভালো হবে তাহলে আমাদের এই দুর্দশার মূলে কে? আসলে জানতো বাবা, এই সব হচ্ছে ভেল্কি দেখানো। এই ভেল্কি দেখিয়ে বামুনরা আমাদের লোকদের সর্বস্ব লুটে-পুটে নিচ্ছে। তুমি বাবা ভেবে দেখ এর থেকে কিভাবে নিস্তার পাওয়া যায়। মানুষ আগের মত সেই বৌদ্ধ যুগের শান্তি ফিরে পায়।”
বৃদ্ধা তার অন্তরে এই সব আগুনটাকে বের করতে পেরে যেন পরম শান্তি লাভ করলেন।
  আর হরিচাঁদ-                         মুখাশ্রিত তথ্য বহু করিয়া উদ্ধার।
 বুদ্ধিমত্তা যোগে ঘষে দেখে বারবার।।
                             সত্যের সন্ধানে ফেরে সদা হরিচাঁদ।
          অতৃপ্ত বাসনা বুকে মনেতে বিষাদ।     (তথ্য ঐ)
লোক মুখের কাহিনি, জনশ্রুত কথা শুনে শুনে হরিচাঁদ তাঁর বুদ্ধি দিয়ে সেই কথা বা কাহিনির বিচার বিশ্লেষণ করেন। আর মনে অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে সত্যের অনুসন্ধানে ফিরে চলেছেন।
_________________________ 

Comments