Skip to main content

হরিনাম ও হরিবোল এর যথার্থতা।

লীলামৃত এর বিজ্ঞান ভাবনায়- হরিনাম ও হরিবোল এর যথার্থতা-        -জগদীশচন্দ্র রায়
আমার প্রিয় মতুয়া সাথীরা,
 যে যে মহামানব আমাদের পতিত পিড়িত নিষ্পেষিত সমাজের মানুষকে সামাজিক,  সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও ধর্মীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য  জীবনকে বাজি রেখে প্রতিকুল সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করে আজ আমাদের পশু থেকে মানুষের পর্যায়ে উন্নিত করেছেন সেই মহামানব  পতিত পাবন হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা সাহেব আম্বেদকর এবং সর্বপরি মহান দার্শনিক গৌতম বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানাই। আর মঞ্চে উপবিষ্ট বক্তাগণ ও আমার সামনে বসে আছেন বুদ্ধিজীবি বর্গ। আমি কখনো আপনাদের শ্রতা বলতে চাইনা। কারণ শ্রতা আর বুদ্ধিজীবি (অর্থাৎ বিচারধারায় প্রভাবিত) মানুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। রাজহাসকে দুধ আর জল মিশিয়ে দিলে সে দুধটাকে চুষে খায়। আর জল পড়ে থাকে। তাই এই দুধ আর জলকে আলাদা করে বোঝার ক্ষমতাবানদের আমি এখানে বুদ্ধিজীবি বলছি। যে কথা মহাকবি তারক সরকার ও লীলামৃত লিখতে গিয়ে বলেছেন-                 শ্রোতাগণ হংসবৎ    দোষ ছাড়ি গুণ যত
                                             দুগ্ধবৎ করুন গ্রহন। 
                                                (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত ১ম সংস্করণ পৃঃ ৩৯) 
                                                   
আজকে আমার বিষয় হচ্ছে- লীলামৃতের বিজঙ্গান ভাবনায় হরিনাম ও হরিবোল এর যথার্থতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ।
প্রথমেই আমি এই অনুষ্টানের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই এই জন্য যে তাঁরা ‘লীলামৃতের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে, লীলামৃতের অভ্যন্তরিন রহস্যকে গবেষনার দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের জন্য আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।
সাথীরা, লীলামৃত এমনই একটা গ্রন্থ যেটার মূল্য কিন্তু পয়সার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় না। কারণ এর মূল্য হচ্ছে অমূল্য। অর্থাৎ যার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আজ থেকে ১০০ বছর পূর্বে এই গ্রন্থটি কবি তারক সরকার রচনা করেছিলেন বলেই একটা জাতির ইতিহাস, তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক,  সর্বোপরি ধর্মীয় অবস্থাকে তুলে ধরে হয়েছে। তাই এই গ্রন্থ মতুয়াদের কাছে অমূল্য রতন স্বরূপ। তবে এই গ্রন্থের মধ্যে অনেক কথার আমরা বৈপরিত্ব দেখতে পাই। এই বৈপরিত্বের কারণ বিশ্লেষণ করতে হলে পাঠকে গবেষণার দৃষ্টি নিয়ে অধ্যায়ন করতে হবে। এখানে আমি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি  লীলামৃতের বিজ্ঞান ভাবনায় হরিনাম ও হরিবোল এর যথার্থতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ।  
    সাথীরা, আমরা লীলামৃতে দেখতে পাই “হরিনাম হচ্ছে একটা মহামন্ত্র। এবং এই মহামন্ত্রকে সবাইকে জানতে বলা হয়েছে। “হরিনাম মহামন্ত্র জানো সর্বজন।”এখানে “নাম” শব্দের অর্থ কি?  হরিচাঁদ ঠাকুর “নাম” বলতে কি বুঝিয়েছেন?  
লীলামৃতের ভিতরে এই “নাম” নিয়ে কিছু বিপরিত কথা দেখতে পাই।  যেমন-
                 ব্রহ্মত্ব সাজুয্য মুক্তি কৃষ্ণ প্রেমে দন্ড
                “হরিনামে পাপ ক্ষয় কহে কোন ভন্ড।” (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ৪,  ১ম সংস্করণ) –অর্থাৎ হরিনামে কোন পাপ ক্ষয় হয়না। আর যিনি বলেন হরিনামে পাপ ক্ষয় হয় তিনি ভন্ড।
 তারপরে আছে – “নামে প্রেমে মাতোয়ারা মতুয়ারগণ।।
                  ভিন্ন সম্প্রদায় রূপে হইবে কির্তণ।।
 এখানে দেখতে পাচ্ছি নামের প্রেমে অর্থাৎ হরিনামের প্রেমে যারা মাতোয়ারা তারাই হচ্ছেন মতুয়া। তো এখানে কোন নামের প্রেমে মতুয়ারা মেতেছেন? কি সেই নাম? আর সেই নামের জন্য কেন মানুষ মেতে প্রেম নিবেদন করছেন?
 আবার আমরা দেখতে পাই- যেটাকে মতুয়ার তৃরত্ন বলা হয় সেই-
              জীবে দয়া, নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।
            ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।। (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ১১,  ১ম সংস্করণ ) এখানে তিনটি মুখ্য কথা বলা হয়েছে।   
               এক-জীবে দয়া,
               দুই- নামে রুচি,
            আর তিন- মানুষেতে নিষ্ঠা। এই তিনটি কথাকে মতুয়া ধর্মের মূল তত্ত্ব বলা হয়। জীবের প্রতি দয়া কর। নামের প্রতি রুচি বা ভালবাসা রাখ আর মানুষের প্রতি নিষ্ঠা রাখ, বিশ্বাস রাখ।  তাহলে এখানে নাম বলতে হরিচাঁদ কি বোঝাতে চেয়েছেন? এখানে আবার নামের পরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জীবে দয়া, নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত, সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।  (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং ১১ ১ম সংস্করণ)
নামে রুচিঃ- এই নাম শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। নাম মানে হরি নাম কৃষ্ণ নাম নয়। নাম শব্দটির অর্থ এখানে বিজ্ঞান। মানে বিশেষ জ্ঞান। রুচি- মানে অনুরাগ।
অর্থাৎ একত্রে নামে রুচি কথাটির অর্থ হচ্ছে- বিজ্ঞানে অনুরাগ। বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত হও।
 আবার আমরা দেখতে পাই  হরিনামকে তুচ্ছ করে বললেন-
                      না মানিবে শিব দুর্গা কৃষ্ণপ্রেমে বাম।
                     না লইবে হরিনাম বলি মরা নাম।।  (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ৭, ১ম সংস্করণ)
 অর্থাৎ শিব দুর্গা ও কৃষ্ণের প্রতি কোন প্রেম বা আস্থা বা বিশ্বাস রাখবেনা। এটাতো মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু হরিনাম নিতে এখানে মানা করা হয়েছে। কারণ ওটা মরা নাম। যে নাম বা যে জিনিস মৃত তার নাম নেওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে?
তাহলে নাম  বলতে হরিচাঁদ ঠাকুর আমাদের কি বুঝিয়েছেন?
লীলামৃত বলছে- নাম এবং হরি এক। কথাটির তাৎপর্য ভাল করে লক্ষ্য করতে হবে-
                       যেই নাম সেই হরি শ্রীমুখের বাক্য।
                       মনে প্রাণে চিত্ত কভু নাহি করে ঐক্য।।
যেই নাম সেই হরি, 'হরি' মানে শুধু এই 'হরি' নয়। 'হরি' মানে 'জ্ঞান'তাহলে এই বিশেষ জ্ঞান বা চরম জ্ঞানকে বলা হচ্ছে হরির নাম। সেই পরম জ্ঞানকে বুঝে যদি আমরা নাম করি, তবেই জ্ঞানের আলোকে ভিতরের যে অন্ধকার, যে অন্ধকার সূর্যের আলো দূর করতে পারে না, সেই অন্ধকার আপনা থেকে দূর হয়ে যাবে। শত চেষ্টা করলেও সেই অন্ধকারকে অন্য উপায়ে দূর করা যাবে না।  তবে জ্ঞান রূপ আলো দিয়েই সেটাকে অনায়াসেই দূর করা যাবে।

লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই- বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য। 
                             যশোমন্ত গৃহে হরি হৈলেন অবতীর্ণ।।
                                          (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ১৫, ১ম সংস্করণ) 
   এই যে, যে “নাম ভাবনা”- এটাকে দেখতে পাই বুদ্ধের দর্শনে। এই নাম আর রূপ মিলে হচ্ছে  চেতনা শক্তি। অর্থাৎ জীবকুল। রূপ হচ্ছে কায়া বা অবয়ব। আর নাম হচ্ছে তার ভিতরের চেতনা। চেতনা অর্থাৎ চার বস্তুর মিশ্রণে অর্থাৎ ক্ষিতি, অপ্‌, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই চার বস্তুর প্রামাণিক মিলনে জীবনের সৃষ্টি হয়, আর জীবের যে  চেত শক্তির উৎপন্ন হয়, সেটা কে তিনি নাম রূপে আক্ষায়িত করেছেন। সেটা হচ্ছে এক মহা  বিজ্ঞান। যেটাকে জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হয়। তাই এখানে “নাম”কে হরিচাঁদ ঠাকুর জ্ঞানের অনুশিলনকে বুঝিয়েছেন ।  যার জন্য তিনি আমাদেরকে-হাতে কাম আর মুখে নাম অর্থাৎ বিজ্ঞান চেতনার কথা বলেছেন। যেটা হচ্ছে একটা চরম বিজ্ঞান। আর এই চরম বিজ্ঞানকে মহামন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এবং সেই চরম বিজ্ঞানকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার কথা বলা হয়েছে। 
    লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই- আড়োকান্দী মাঠ মধ্যে তুলি উচ্চে শির।
                                  বলুলের গাছ এক দাঁড়াইয়া স্থির।।
                                  সন্ধার অগ্রেতে প্রভু কি জানি কি ভাবি।
                                  বসিলেন বৃক্ষমূলে চিন্তা মাঝে ডুবি।।
                                  অনন্ত 'আপন' মাঝে প্রভু ডুবে রয়।
                                  আপন স্বরূপ প্রভু দেখিবারে পায়।।
                                   মহান পুরুষরূপে আপনার আত্মা।
                                  প্রভুর সম্মুখে আসি কহিলেন বার্ত্তা।।
                                  "নামধারী দেহরূপে তুমি হরিচাঁদ।
                                  জীব-শিক্ষা-লাগি নরজগতের নাথ।।
                                  তুমি স্থুল আমি শুক্ষ, উভয়ে অভিন্ন ।
                                  দেহ আত্মা মোরা দোহে মূলে নহি ভিন্ন।। ........."  
                           (শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত, ঠাকুরনগর ঠাকুরবাড়ি, দশম সংস্করণ, পৃঃ ৭৩)
        এখানে “তুমি” কে? তুমি হচ্ছে আমার এই শরীর বা দেহ। আর “আমি” হচ্ছে- আমার এই দেহের ভিতরের চেতনা শক্তি। যাকে আত্মা বলা হয়েছে। তাই বলা হয়েছে-
                             তুমি স্থুল আমি শুক্ষ, উভয়ে অভিন্ন ।
                             দেহ আত্মা মোরা দোহে মূলে নহি ভিন্ন।।  - অর্থাৎ দেহের আকার স্থুল বা বড় কিন্তু এর অভ্যন্তরের আত্মা হচ্ছে শুক্ষ, তবে এই দুটো সত্ত্বা একত্রিত । একটা ভিন্ন অন্যের অবস্থান অসম্ভব। তাই-দেহ আত্মা মোরা দোহে মূলে নহি ভিন্ন।।  শরীরের বা দেহের মৃত্যুর পরে আত্মার ও বিনাশ ঘটে। দেহের বাইরে আত্মার অস্থিত্ব বলে কিছু নেই। 
তবে প্রজনন প্রকৃয়ার মাধ্যমে একের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের উৎপত্তি ঘটে। যার ফলে সন্তানের জন্ম হয়। এখানে পিতার বির্জ স্খলিত হয়ে মাতৃ ডিম্বকোষে মিলিত হয়। একটা স্বত্বার বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্য স্বত্বার উৎপত্তি শুরু হয়। এই যে, যে system  বুদ্ধ একে Rebirth  বা পুনর্জন্ম বলেছেন।  হরিচাঁদ ঠাকুরও এই চেতনার বিনাশ ও উৎপত্তিকে মেনে নিয়েছেন। যার জন্য তিনি বলেছেন-
                             তুমি স্থুল আমি শুক্ষ, উভয়ে অভিন্ন ।
                             দেহ আত্মা মোরা দোহে মূলে নহি ভিন্ন।।
     আর সেজন্য তিনি বলেছেন-হরিনাম মহামন্ত্র জানো সর্বজন। এখানে বিজ্ঞানের ভাবনাকে ঠাকুর সর্বজন অর্যন্ত পৌঁছে দিতে বলেছেন। এখানে মৃত্যুর পরে কাল্পনিক আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই। তাই তিনি বলেছেন-
                           যাগ যজ্ঞ পুজা-পার্বন কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন।
                         হরিনাম মহামন্ত্র জানো সর্বজন।। -একথা বলে সেই হরি বা জ্ঞানকে নামের মাধ্যমে অর্থাৎ চেতনার বা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রকাশ করে জন থেকে বহুজন বা সর্বজন পর্যন্ত পৌঁছে দাও। 
আর এই বিজ্ঞানের চেতনাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি আবার বললেন –
                             এক গুরু ভিন্ন কোন পুজা নেই।
                             হরি মন্দিরে নিত্য পুজা দেওয়া চাই।
এক গুরু অর্থাৎ হরিচাঁদ ঠাকুর। আর হরি মন্দির হচ্ছে- আপনার জ্ঞানের মন্দিরে হরিগুণ গান গাও। অর্থাৎ চেতনার বিকাশ ঘটাও। যে কথা বুদ্ধ বলেছেন- আত্ম দ্বীপভব।  সেই চেতনার বিকাশ কিভাবে হবে? সেই চেতনার বিকাশ করতে হলে চাল করা দিয়ে পূজা দিলে হবে না। হরিচাঁদের নির্দেশিত পথে চলে বিজ্ঞান ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে নাম বা চেতনার বিকাশ ঘটাতে হবে। তবেই হবে আসল পুজা।
আর আপনার ভাবেন ভগবান বা ঈশ্বরই সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। ঠিক ভেবেছেন। কিন্তু কে সেই ঈশ্বর? সেই ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা লীলামৃতে দেখতে পাই-
                            বিশ্বভরে এই নীতি দেখি পরস্পর।
                            যে যাহারে উদ্ধার করে সেই তার ঈশ্বর।
তাহলে আপনাদের ধর্মহীনতা থেকে, অস্পৃশ্যতা থেকে, চন্ডালত্ব থেকে কে বা কারা উদ্ধার করেছে? কে আপনাদের শিক্ষার অধিকার এনে দিয়েছেন? কে আপনাদের পশুর অবস্থা থেকে মানুষের পর্যায়ে উন্নিত করেছেন? নিশ্চয় তেত্রিশ কোটি দেবতার একজন দেব বা দেবী নয়? আপনার দেবতা, ভগবান বা ঈশ্বর তাহলে কে বা কারা? নিশ্চয় হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, বাবা সাহেব আম্বেদকর গৌতম বুদ্ধসহ মূলনিবাসী মহামানবেরা? নয় কী?
এবার বিচার করুন এখানে অলৌকিকতার ছাপ আছে কি? যদি না থাকে তাহলে আমরা আপনা কোন আশায় অলীকের পিছনে ছুটে চলেছি আপন অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে?

 
হরিবোল এর “বোল” কথাটির অর্থ কি?

   সাথীরা, আমরা মতুয়া আদর্শে অনুপ্রাণিত বান্ধবরা হরিচাঁদের দেওয়া বুলিকে পরস্পরে সম্বোধন করি “হরিবোল” বলে। তো এই হরিবোল এর “বোল কথাটির অর্থ কি?   
বোল কথার অর্থ হচ্ছে বানী। বাণী কি? কোন মহামানব তাঁর আদর্শ প্রচার প্রসারের জন্য, মানুষকে জাগৃত করার জন্য  কিছু কথা বলে যান। সেই কথাগুলো মানুষের চেতনা জাগৃত করে। সেটাই হচ্ছে “বাণী”। তো এখানে হরি বোল কথার অর্থ হচ্ছে- হরিচাঁদের বাণী এখানে একটি  কথা লক্ষ্য করতে হবে হরিবোল, হরিবল নয়, বোল হবে বল নয়। হরিবল বললে সেখানে “বল” মানে  শক্তি বোঝায়। আবার হরিবল বললে হরি বল অর্থাৎ হরি বলতে বোঝায়। এখানে কোন দর্শন থাকে না। কিন্তু “হরিবোল” বললে হরিচাঁদের দর্শন সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান উপলব্ধি করতে পারি। সেই আলোচনাই এখানে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।  তাহলে আমরা দেখছি, হরিবোল মানে হরিচাঁদের বাণী। কিন্তু হরিচাঁদের বানীটা কি? সেই বিশ্লেষণে যাওয়া যাক।  
হরিচাঁদ তাঁর নৈতিক বাণীর উপরেই আমাদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলেছেন। সেই  বাণীগুলোকে আমাদের ভালোভাবে অবলম্বন করতে হবে। যেমন গৌতম বুদ্ধের বেঁচে থাকা কালিন  তাঁর উপর কোন গ্রন্থ লেখা হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন-যে আখ্যান জুড়ে বা কোন কাহিনি নিয়ে গ্রন্থ লিখতে গেলে সেখানে কল্পনাশ্রিত ও অলৌকিক ভাবনা চিন্তা দিয়ে সেটা লেখা হয়। যিনি লেখেন  তাঁর কথাই সেই গ্রন্থের ভিতরে থাকে। তাই “আমার কিছু বাণীর ভিতরেই আমার ধম্ম সীমাবদ্ধ  থাকবে।” বুদ্ধের মহাপরিনিরর্বাণ এর ২৫০ বছর পর ত্রিপিটক লেখা হয়। আর হরিচাঁদ ঠাকুরের মহাপরিনির্বাণের ২৪ বছর পরে লীলামৃত লেখা শুরু হয়।
   হরিচাঁদ ঠাকুরও চেয়েছিলেন তাঁর কিছু নৈতিক বাণীর ভিতরে তাঁর ধর্মটাকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে। আর সেটাই হচ্ছে হরিবোল। তাই বোধ হয়, হরিচাঁদ ঠাকুর প্রথমে তাঁর সম্পর্কে লেখাটাকে ছুড়ে ফেলেছিলেনকারণ কাহিনি জুড়ে লেখা যাবে না, তাহলে কল্পনায় বৈদিক ভাবনা   এর ভিতরে এসে যাবে। “আমার কথা কেউ যদি লেখেন তাহলে আমার কথাগুলো অর্থাৎ আমার  বাণীগুলো বা বোল গুলো যেন ঠিক ঠিক মত লেখা হয়।” তাই তারক সরকার হরিচাঁদ ঠাকুরের কিছু বাণীকে লিখেছেন লীলামৃতের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে। যার জন্য আমরা গবেষণা করে হরিচাঁদের  মতুয়া ধর্মের একটা সঠিক দর্শনের দিশায় পৌছাঁতের চেষ্টা করছি। এটাই হচ্ছে হরিবোল।
 এবার আমরা  হরিচাঁদের কিছু বোল বা বাণীর বিশ্লেষণ করি। আমরা প্রথমেই ঠাকুরের মুখে  মতুয়ার তৃরত্ন বাণী শুনতে পাই-  জীবে দয়া, নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা।
                             ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
                                               (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ১১,  ১ম সংস্করণ)
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঠাকুর বলছেন, ‘তুমি প্রতিটি জীবের প্রতি দয়া কর। প্রতিটি জীবকে ভালবাস। নামের প্রতি অর্থাৎ চেতনা বা বিজ্ঞানের প্রতি রুচি রাখ। চেতনা বা বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত হও। আর মানুষের প্রতি নিষ্ঠা রাখ। বিশ্বাস রাখ। মানুষকে ভালবাস। এই তিনটি কথা বা বাণীকে তোমরা অনুসরণ কর । এই তিনটি মূল মন্ত্র বাদের সব কিছু ভ্রষ্টা। মিথ্যা। অলিক। অবৈজ্ঞানিক।’ 
ঠাকুর আমাদের মতুয়া ধর্ম দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই মতুয়া ধর্মের আদর্শটা কেমন হবে? হরিচাঁদ ঠাকুর Academic শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদী যে ক্রুরতা দেখেছেন, তিনি তাঁর  অনুসন্ধানি জ্ঞান দিয়ে উপলব্ধি করেছেন যে, এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাকে সংগ্রাম করতে হবে। তো সেই সংগ্রামের প্রথম বাণী কি দিলেন?  
                    কুকুরের উচ্ছিষ্ঠ প্রসাদ পেলে খাই।
                  বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই।। (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ১০৪, ১ম সংস্করণ)
তিনি কি বললেন? কুকুর যে খাবার খেয়েছে, আমরা যাকে বলি উচ্ছিষ্ট হয়েগেছে বা এটো হয়েগেছে। আমি সেই খাবারও খেতে রাজি আছি। অর্থাৎ কুকুরের খাবারের থেকেও নিকৃষ্ট মনে করছেন বেদকে। কারণ বেদ এত নিকৃষ্ট সেখানে মানুষকে মানুষ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। মানুষকে পশুর থেকেও অধম করে রাখা হয়েছে। এর থেকে খারাপ কিছু আর বিশ্বে হতে পারে কি? সে জন্য প্রথমেই  ঠাকুর ঘোষণা করলেন, ‘বেদ এবং তার নিয়ম কানুনকে আমি মানিনা।

আবার বললেন- মর্ম না জানিয়া কেহ কারে না নিন্দিবে।
             হইলে আত্ম-বিদ্রোহ ছারে খারে যাবে। (লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ১৪৩, ১ম সংস্করণ)
               
অর্থাৎ কারো সঠিক কথা না জেনে, না বুঝে কাউকে নিন্দা করবে না। আর নিজেদের মধ্যে বিদ্রোহ হ’লে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। তাই বিবেক বুদ্ধি দিয়ে কোন কথাকে বিচার করে তার পরে সেটা সম্পর্কে কাউকে কিছু বল। তবে না জেনে কিছু করোনা।
তিনি আবার বাণী দিচ্ছেন-     বাহ্য অঙ্গ ডোর কপিন মালা আর।
                              সব হ’তে সবাকে করেছি অবসর।। (তথ্য ঐ)
                                                                         
 ঠাকুর বলছেন, বহির অঙ্গের জন্য ডোর, কপিন মালা ইত্যাদি এসবের কোন প্রয়োজন নেই। এগুলো থেকে আমি তোমাদের অবসর করে দিলাম। অর্থাৎ এগুলো তোমাদের কাছে প্রয়োজন হীন।
ঠাকুর আবার বলছেন- তাহলে তোমাদের কি করতে হবে?
                            সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হইবেক যেই।
                         না থাকুক ক্রিয়া কর্ম হরিতুল্য সেই।। (তথ্য ঐ)
 আপনি যদি সত্যবাদী হন। আপনার ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখতে পারেন। তাহলে আপনি যদি কোন ক্রিয়া কর্ম না করেন অর্থাৎ হরিচাঁদের জন্য সকাল সন্ধ্যা হরি মন্দিরে পূজা নাও দেন তাতে কোন ক্ষতি নেই। কারন আপনি হরিচাঁদের বাণীকে পালন করার চেষ্টা করছেন। তাই আপনি হরি তুল্য হবেন। অর্থাৎ হরি বা জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত হবেন।
   আবার আমরা দেখতে পাচ্ছি-
পর-ধর্ম নমঃশুদ্রে নিবে কি লাগিয়া?
নমঃশুদ্রে ধর্ম গেছে হরিচাঁদ দিয়া।
________________________
ক্রমে ক্রমে আসিবেক যুগধরাতলে।
হরিচাঁদ-ধর্ম মতে মাতিবে সকলে।।
                                                               (গুরুচাদ চরিত পৃষ্ঠা নং ১৬৬, ৫ম সংস্করণ)
এখানে আমরা দেখতে বাণী দেওয়া হয়েছে তোমরা পরের ধর্ম গ্রহন করছ কি জন্য? তোমাদের জন্য তো হরিচাঁদ নতুন ধর্ম দিয়েগেছেন। কিন্তু আমরা হরিচাঁদের বাণীরকে বোঝার চেষ্টা না করে দু’নৌকায় পা দিয়ে চলেছি। আমরা আমাদের অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম না করে পরের ঘরকে আপন ঘর ভাবতে চেষ্টা করছি। তবে আমরা যদি আমাদের নিজের ঘর বানানোর জন্য সংগ্রাম করি অর্থাৎ মতুয়া ধর্মের স্বিকৃতির জন্য সংগ্রাম করে সেটাকে অর্জন করতে পারি, তাহলে পৃথিবীতে একদিন হরিচাঁদের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম দর্শনে মানুষ প্রভাবিত হয়ে নব বৌদ্ধের যুগের সূচনা করবেন।
এবার আর একটি বাণীকে আমরা দেখতে পাই। এই বাণীতে বলা হয়েছে যে-
                    মতুয়ার পক্ষে কোন পূজা পাবর্ন নাই,
                    শ্রী হরি মন্দিরে নিত্য পূজা চাই।
অর্থাৎ মতুয়াদের কোন পূজা পার্বনের কোন প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র হরি মন্দিরে অর্থাৎ জ্ঞানের আলো জ্বালানো এবং শিক্ষার আলো জ্বালানোই হচ্ছে মন্দিরের কাজ। এই কাজ করতে পারলে সমস্ত অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। আর চেতনার আলো উদ্ভাসিত হবে। তখন সেটাই হবে মন্দিরে পূজা দেওয়া। আর এই পূজা দেওয়ার কাজ নিরন্তর করে যেতে হবে।
ঠাকুর আবার বাণী দিচ্ছেন-  ঠাকুর কহেন বাছা ধর্ম কর্ম সার।
                           সর্ব ধর্ম হ’তে শ্রেষ্ঠ, পর উপকার। (লীলামৃতে(পৃষ্ঠা নং ১৫০)
এখানে ধর্ম বলতে বর্তমান প্রচলিত ধর্মের কথা বলা হয়েছে। সেই প্রচলিত ধর্মের কর্ম কি? আমি তিন বেলা স্নান করছি। মন্দিরে বিগ্রহের পূজা দিচ্ছি। আবার বাড়িতে কোন ভিখারী এলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছি। মানুষকে  জাত-পাতের ভিত্তিতে ঘৃণা করছি। এসব ধর্মের কর্ম নয়।  ঠাকুর এই প্রচলিত ধর্মের কাজকে গুরুত্ব দিতে নিষেধ করেছেন। কারণ হরিচাঁদের কাছে এই সব প্রচলিত ধর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ আর একটি ধর্ম আছে। সেটা হচ্ছে পর উপকার করা। মানুষের বিপদের সময় মানুষের সেবা করা। মানুষকে ভালবাসা। তবেই হবে আসল ধর্মের কাজ।
আবার আর একটা বাণীতে আমরা দেখতে পাই-
                        সর্পের দংশনে কভু সজ্জন মরে না।
                        সজ্জনের কোপ হ’লে সর্পি বাঁচে না।
                                                     -(লীলামৃত পৃষ্ঠা নং- ৬৩,  ১ম সংস্করণ )
শাপ দংশন করলে একজনকে কাটতে পারে। একটা শাপ অনেকে এক সঙ্গে মারতে পারেনা। কিন্তু সজ্জনের কোপ হলে অর্থাৎ আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যদি বিদ্বেষভাবের সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই বিদ্বেষের ফলে সবার চরম ক্ষতি হয়ে যায়। তাই ঠাকুর এই কথার মধ্য দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তোমরা নিজেদের মধ্যে কোন শত্রু মনোভাব গড়ে তুলনা। সকলে মিলেমিশে থাক। আর পরস্পরের শত্রু হলে কেউ আর শান্তিতে বাঁচতে পারবেনা।
    এই যে যে, হরিচাঁদের বাণীগুলো, একে যদি কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়িত করা যায় নিজে সৎ পথে চলে, সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায়, আমাদের জীবনের চলার পথে  তবেই হবে হরিবোলের সার্থকতা। তা না হলে মুখে শুধু হরিবোল বললে কিন্তু বুলি হয়ে থাকবে। বাণীরূপে কার্যকরী হবে না।
এবার গুরুচাঁদ চরিত (পৃষ্ঠা নং ১৩০)থেকে আর একটি বাণীর উল্লেখ করছি-
তাই বলি ভাই      মুক্তি যদি চাই
বিদ্যান হইতে হবে।
পেলে বিদ্যাধন       দুঃখ নিবারণ
চির সুখী হবে ভবে।।
আমরা প্রায়ই কথায় কথায় বলি ঠাকুর আমাদে মুক্তি দাও। কিন্তু সেই মুক্তি কোথায় পাওয়া যাবে? সেই মুক্তি পাওয়া যাবে বিদ্যা অর্জন করতে  হবে। সঠিক বিদ্যা লাভ করলে সব দুঃখ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। চির সুখী হওয়া যাবে। আজ আমরা যা কিছু অর্জন করেছি সেটার মূলে হচ্ছে বিদ্যাতাই ঠাকুরের এই ধরনের অনেক যে বাণী আছে সেই বাণীকে আমাদের কর্ম জীবনে প্রয়োগ করার ব্রত গ্রহন করতে হবে। তবেই  হবে হরিবোলের বা হরিচাঁদের বাণীর স্বার্থকতা।  

Comments

  1. কি সব বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন ভাই

    ReplyDelete
  2. সীমিত জ্ঞান দিয়ে সীমাহীন জ্ঞান কে বোঝাতে গেলে আপনার মত বিপর্যয়কারীর সৃষ্টি হয় ।
    অনেক শব্দের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন, অনেক কথা অনেক ঘটনার প্রেক্ষিতে লেখা হয়েছে। সে সব না নিয়ে নিজের মত ব্যাখ্যা করেছেন । বুদ্ধের প্রতি ঝোঁক দেখা গেছে, যেটা কাম্য নয় । " হরি " শব্দের ব্যাখ্যা প্রাথমিক অবস্থায় রেখেছেন। এ জন্যে আরও পড়াশোনা করতে হবে।
    শেষে, লীলামৃত ব্যাখ্যা করতে হলে কম করে সাত বছর দ্বাদশ আজ্ঞা সর্বান্তকরণে পালন করলে -তবে সম্ভব হবে।
    তবুও, আপনার প্রয়াস কে ধন্যবাদ জানাই।

    ReplyDelete

Post a Comment