শৈশব কৈশোর অতিক্রান্ত করে হরিচাঁদ যৌবনে পদার্পন করেছেন। তাই শৈশবে তাঁর
মধ্যে যে বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেই চেতনার গভীরতা
ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সংসার জীবন আজ তিনি অতিক্রম করতে চলেছেন।
কারণ তাঁর দুই পুত্র ও তিন কন্যা হয়েছে।
যার মধ্যে গুরুচাঁদ সব চেয়ে বড়। অন্যান্য ভাইদের অনুরোধে আমভিটার বসবাস স্থল ছেড়ে
দিয়ে ওড়াকান্দীর পোদ্দার বাড়িতে এসে বসবাস শুরু করেছেন। কিন্তু এখন তাঁর অন্তরের
মধ্যে প্রায়ই কি যেন ভাবনা ঘুরপাক খায় নিরন্তর। যার জন্য তিনি উদাস হয়ে থাকেন। এই
উদাস ভাবনা বা একাকিত্বে কিছু চিন্তা বা মন্থন করা শুরু হয়েছিল ছোট বেলা থেকে।
একবার তিনি শৈশবে তাঁদের বাড়ির পাশের বড়
নিমগাছের নীচে চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে ছিলেন।
শৈশবেতে
সকলের চক্ষু দিয়ে ফাঁকি।
বৃক্ষ তলে
হরিচাঁদ বসিত একাকী।।
ভ্রাতাসহ
সাঙ্গপাঙ্গ করে যবে খেলা।
হরিচাঁদ বসে
থাকে নীরবে একেলা।।
ধ্যানাসনে
বসে থাকে মুদি অক্ষিদ্বয়।
হৃদয়েতে হয়
কত ভাবের উদয়।।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা
নং 269)
তিনি হয়তঃ
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে মানুষের সামাজিক ও আর্থিক সমস্যার কিভাবে
সমাধান করা যায় সেই কথা মন্থন করছিলেন। কারণ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তাঁর চিন্তা ভাবনা
অন্য ভাইদের থেকে পৃথক ছিল। অন্য ভাইয়েরা বৈষ্ণবদের পদতলে লুটাতে পারলেই নিজেকে
ধন্য মনে করত। বৈষ্ণবদের অলিক গল্প ও ক্রিয়া-কর্মই তাদের বেশী পছন্দ ছিল। কিন্তু
হরিচাঁদের ভাবনায় ছিল মানুষের সার্বিক মঙ্গল কিভাবে হবে।
তাই এইভাবে
হরিচাঁদ যখন ধ্যানে বসে আছেন তখন তাঁর সাথীরা তাঁকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে শুরে
করে। কারণ এদিকে তো সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। খবর পেয়ে হরিচাঁদের মাও খুঁজতে বের হন।
তিনি দেখেন তাঁর বালক পুত্র নিমগাছের নিচে
ধ্যানস্ত হয়ে বসে আছে। তাঁর কেমন যেন কোন বাহ্য জ্ঞান নেই। কারণ শান্তিমাতা
দেখলেন –
হঠাৎ দেখিল
মাতা বাম জানু পাশে।
কাল সর্প ফনা তুলে ফুলিতেছে রোষে।।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং ২৬৯)
-একটা কাল কেউকেটে শাপ হরিচাঁদের বাম
পায়ের উরুর উপরে ফনা তুলে আছে। এই দৃশ্য দেখে
শান্তিমাতা কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে যান। আর শাপটি অন্য মানুষের উপস্থিতি বুঝতে
পারে ধীরে ধীরে বনের মধ্যে চলে যায়।
কি এল কি
গেল কিবা ছিল জানু ‘পরে।
কোন কিছু
হরিচাঁদ জানিতে না পারে।।
ছুটে গিয়ে
মাতা বুকে লয়ে পুত্রধনে।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং ২৬৯)
অর্থাৎ শাপ হরিচাঁদের শরীরের উপর ফনা
তুলে ছিল পরে চলে গেল, এসব কিছু তিনি বুঝতে পারেননি। শাপ চলে গেলে শান্তিমাতা ছুটে
গিয়ে হরিচাঁদকে কোলে তুলে নেন।
এইভাবেই হরিচাঁদ শৈশবকাল থেকেই সত্যকে খুঁজে চলেছেন। আর আজ যখন তিনি পরিনত
বয়সে পদার্পণ করেছেন বা তাঁর বয়স বৃদ্ধি হয়েছে, এখন তাঁর ভাবনাগুলোও সূক্ষ্ম থেকে
সূক্ষ্মতর হচ্ছে। তাই তিনি আজ আবার পরিনত বয়সে ধ্যানে বসলেন-
সন্ধ্যার
অগ্রেতে প্রভু কি জানি কি ভাবি।
বসিলেন বৃক্ষমূলে
চিন্তা মাঝে ডুবি।।
অনন্ত আপন
মাঝে প্রভু ডুবে রয়।
আপন স্বরূপ
প্রভু দেখিবারে পায়।।
(লীলামৃত, ঠাকুরনগর প্রকাশ ২০০৯)
সন্ধ্যার
সময় হরিচাঁদ বকুল গাছের নিচে বসে চিন্তায় মগ্ন হলেন। তিনি যেন দেখলেন তাঁর সামনেই
তাঁর বিবেক উপস্থিত হয়ে তাঁর অন্তর-আত্মাকে জাগিয়ে তুলে তাঁর অন্তরের মধ্যে
প্রবাহিত হওয়া তুফানকে শীতল করার রাস্তা বলে দিচ্ছেন।
কি সেই
তুফান-
যত যত বিধি
দেখে চোখের গোচরে।
ততোধিক
তত্ত্ব দেখে অন্তর গভীরে।।
বিজ্ঞানের
দৃষ্টি আর যুক্তিবাদী মন।
আড়ালে সত্য
খুঁজে ফেরে সর্বক্ষন।।
চাপা পড়ে
আছে যত পূর্ব ইতিহাস।
হরিচাঁদ
কাছে ক্রমে হইল প্রকাশ।।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত
পৃষ্ঠা নং ২৬৯)
তিনি তাঁর ধ্যানের মাধ্যমে অন্তর আত্মা দিয়ে
নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে তার সমাধান খুঁজছেন। সমাজে যত ধর্মীয় নিয়ম কানুন আছে যেটা
মানুষের জন্য বাস্তবে ঘৃণ্য, এর কারণ তিনি খুঁজে বের করেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও
যুক্তিবাদী মন দিয়ে অনুসন্ধান করে। মূলনিবাসীদের শৌর্য বির্যের যে অতীত ইতিহাস
চাপা পড়ে আছে ধীরে ধীরে সেই সব তত্ত্বেরও প্রকাশ ঘটে তাঁর কাছে।
তিনি আরো
খুঁজে পান-
অন্ধত্বের
মূলে দেখে বৈদিকতা ভাব,
বুঝিল এভাব
শুধু বৈদিক স্বভাব।।
বৈদিক পোষাক
যদি নাহি ফেলে খুলে।
পতিতেরা
জাগিবেনা কভু কোন কালে।।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং ২৬৯)
মানুষের
মধ্যে যে অজ্ঞানতার অন্ধকার, সেটার মূল হচ্ছে বৈদিকতা। তাই মানুষকে অন্ধকার থেকে
আলোর দিশা পেতে হলে বৈদকতাকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। তবেই পতিতরা জেগে উঠতে পারবে। তা
না হলে এঁরা বৈদিকতার মায়া জ্বাল থেকে এবং মানষিক গোলামী থেকে মুক্তি পাবেনা।
আর এর জন্য
তিনি ঠিক করলেন-
বেদবিধি
সংস্কার তাই ঝেড়ে ফেলে।
মতুয়ার
আঙিনাতে আনিল সকলে।।
(হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত পৃষ্ঠা নং ২৭১)
অর্থাৎ বেদ
বিধির সংস্কার থেকে মুক্ত করে নতুন ধর্ম, ‘মতুয়া ধর্ম’-এর আঙিনায় সকলকে আনতে হবে।
যেখানে সব কিছু থাকবে বৈদিকতা মুক্ত।
তিনি তাঁর ধ্যানকে আরও গভীর করে আর এক চরম
বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করলেন। সেটা হচ্ছে-
তুমি
স্থূল আমি সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন।
দেহ আত্মা মোরা দোঁহে মূলে নহি ভিন্ন।।
(লীলামৃত,
ঠাকুরনগর প্রকাশ ২০০৯ পৃষ্ঠা নং- ৭৩)
অর্থাৎ ‘তুমি’
হচ্ছে এখানে আমার শরীর। এই শরীরটা হচ্ছে
স্থূল। ‘স্থূল’ অর্থাৎ বড় কায়া বা অবয়ব, আর আমি হচ্ছে এখানে আমার এই দেহের
ভিতরের ‘চেতনা শক্তি’। যাকে আত্মারূপে তুলে ধরা হয়েছে। এই আত্মা হচ্ছে সূক্ষ্ম। আর এই দেহ এবং আত্মা
একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একের সঙ্গে অন্যটা মিশে আছে। দেহ বিনা আত্মার
অস্তিত্ত্ব সম্ভব নয়। যার ফলে দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মারও মৃত্যু ঘটে।
দেহের বাইরে আত্মার অস্তিত্ত্ব বলে কিছু নেই। তবে একটা প্রদীপ থেকে যেমন অসংখ্য
প্রদীপ জ্বালানো যায়; তেমনি প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে
যে অন্য জীবের উৎপত্তি প্রকৃয়া শুরু হয়, এই উৎপত্তি ও বিনাশের System কে হরিচাঁদ উপলব্ধি করতে পারেন, এই যে যে, System এই System এর মূল
হচ্ছে পঞ্চ ভুতের চার ভুত। ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ এই চার ভুতের প্রামানিক মিলনেই
জীবের সৃষ্টি হয়। আবার মৃত্যুর পরে এই চার
ভুতে বিলিন হয়ে যায়।
হরিচাঁদ এই চরম বিজ্ঞানকে ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধি করেন।
তিনি তার অন্তর আত্মা দিয়ে আরও উপলব্ধি করেন-
তুলিয়া নামের ঢেউ প্রেম প্লাবনেতে।
ধুয়েমুছে নি’ব সব নাম প্রবাহেতে।।
(লীলামৃত, ঠাকুরনগর
প্রকাশ ২০০৯ পৃষ্ঠা নং ৭৩)
অর্থাৎ অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্য নাম এর
বন্যা বইয়ে দিতে হবে। যে নামের প্রেমের বন্যার প্লাবনে বৈদিকতার সকল কলুষতা ধুয়ে
মুছে যাবে।
এখানে এই ‘নাম’
হচ্ছে- বিজ্ঞান। তাই বিজ্ঞানে আশ্রয় নিয়ে যুক্তিবাদী ভাবনায় ভাবিত হয়ে
যদি কাজ করা যায়; তাহলে এই বিজ্ঞানের আলোতে অজ্ঞানতার অন্ধকারকে দূর করে দিয়ে নতুন
দিশা দেখাবে।
আর সেই দিশা পাওয়ার জন্য অন্য কোন কানে মন্ত্র দেওয়া গুরুর
প্রয়োজন হবেনা। মানুষের দেহমন শুদ্ধ হ’লে আত্মাও স্থির হবে। প্রেমের প্লাবনে মনের
মধ্যে জমে থাকা অজ্ঞানতার মৃত্তিকা সরস হবে। সেখানে সোনার ফসলের আবাদ করা যাবে।
অর্থাৎ সঠিক জ্ঞানের বিজ বপন করা যাবে।
এইভাবে নিশি ভোর ভাবে অচৈতন্য।
আত্মস্থ হইল প্রভু জীব মুক্তি জন্য ।।
(লীলামৃত, ঠাকুরনগর
প্রকাশ ২০০৯ পৃষ্ঠা নং ৭৪)
এইভাবে সারা রাত ধ্যানস্ত অবস্থায় থেকে হরিচাঁদ প্রাতে
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মানুষকে বৈদিকতার এবং অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দেওয়ার
সমাধান বের করে আত্মস্থ হন।
এই যে যে, ঘটনা প্রবাহ এটাকে আমরা কিন্তু মহামানব গৌতম
বুদ্ধের ভাবনা ও মানুষের জন্য জ্ঞানের আলোক প্রকাশের প্রকৃয়ার সঙ্গে মিল খুঁজে
পাই। কারণ গৌতম বুদ্ধও বট বৃক্ষের নিচে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে মানুষের দুঃখ ও
তার থেকে মুক্তির কারণ উদ্ভাবন করে ছিলেন। আর পরবর্তিতে তিনি মানুষের কল্যানে
ব্রতী হয়েছিলনে। যার জন্য তাঁকে বুদ্ধ অর্থাৎ জ্ঞান বলা হয়। যিনি এই জ্ঞান প্রাপ্ত
হন তাঁকে বুদ্ধ বলা হয়। যেমন গৌতম বুদ্ধের পূর্বে এই জ্ঞান প্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল
২৭ । অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের পূর্বে আরো ২৭ জন বুদ্ধ ছিলেন। আমরা এই ক্ষেত্রে মহামানব
হরিচাঁদকেও বুদ্ধ বলতে পারি। যার জন্য লীলামৃতের প্রথমেই আমরা দেখতে পাই কবি তারক
সরকার লিখেছেন-বুদ্ধের কামনা পুর্ণ করার ব্রত নিয়েই হরিচাঁদ মানুষের মুক্তির কর্মে ব্রতী হয়েছেন।
_______________________
Comments
Post a Comment