Skip to main content

মৃতপ্রায় বিশের জীবন দান।

মৃতপ্রায় বিশের জীবন দান।
শৈশবে হরিচাঁদ তাঁর প্রিয় সাথী ব্রজনাথ, নাটু আর বিশ্বনাথের সঙ্গে খেলা করতেন। একদিন খেলতে খেলতে অনেক দেরী হয়েগিয়ছে, কিন্তু তবুও বিশ্বনাথকে খেলতে আসতে না দেখে নাটুর কাছে হরিচাঁদ জানতে চান বিশে (বিশ্বনাথ) এখনও পর্যন্ত কেন খেলতে এলোনা। তখন নাটু বলল,-
বিশের হয়েছে রাত্রে বিসুচিকা ব্যাধি।
মৃতপ্রায় সবে করিতেছে কাঁদাকাঁদি।। (লীলামৃত, ঠাকুরনগর, প্রকাশ 2009, পৃষ্ঠা নং-55)
অর্থাৎ বিশ্বনাথের কলেরা বা পেট খারাপ হয়েছে। সে মরনাপন্ন অবস্থায় আছে। সবাই বিশের অকাল মৃত্যুর ঘনিয়ে আসার জন্য কান্নাকাটি করছে।
      এই ঘটনা 1920 সাল এর কাছাকাছি সময়ে আমরা ধরে নিতে পারি। তখন গরীব লোকদের পুকুর অথবা নদীর জল পান করতে হ’ত। টিউবওয়েল হয়তঃ রাজা জমিদার বা এই ধরণের ধনী লোকদের বাড়িত থাকত। তাই সাধারণ মানুষের নদী বা পুকুরের জলই ভরসা ছিল। যার ফলে প্রায়ই কলেরা ডায়রিয়া বা এই ধরনের রোগ লেগেই থাকত। আর একবার যদি এই ধরনের অসুখ কারো হ’ত, তার মৃত্যু অনিবার্য ছিল। কারণ তখনকার সময়ে ভাল ডাক্তার পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। সেজন্যই নাটু বলল- বিশের মৃতপ্রায় অবস্থা।
   নাটুকে করিয়া সঙ্গে ঠাকুর চললি।
   হেনকালে বিশ্বনাথ অজ্ঞান হইল।।
বিশাইর হইয়াছে মৃত্যুর লক্ষন।
           ঘন শ্বাস বহে তার উত্তার নয়ন।। (তথ্য ঐ)
নাটুর কথা শুনে হরিচাঁদ নাটুকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে বিশেদের বাড়িতে পৌঁছান। ততক্ষণে বিশে অজ্ঞান হয়ে যায়। ঘন শ্বাস বইতে শুরু করে, চোখ উপরে উঠে আসে।
  হরিচাঁদ একজন বালক হলেও তাঁর বিচার ধারা, ভাবনা চিন্তা সর্বদা অন্যের থেকে পৃথক এবং বিজ্ঞান সম্মত ও যুক্তিবাদী ছিল। হরিচাঁদ তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখেন ঘরের মধ্যে হাওয় বা আলো আসার মত কোণ জায়গা নেই। অন্ধকার অবস্থা। ঘরের একোনে বিশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তখন তিনি নাটুর সাহায্য নিয়ে বিশেকে ঘরের বাইরে বের করে খোলা হাওয়াতে রাখেন। তারপর আবার ঘরের মধ্যে গিয়ে কিছু খাবার খুঁজতে গিয়ে দেখেন ভাতের হাড়িতে কিছুটা পান্তা ভাত পড়ে আছে।
  তখনকার দিন সাধারণ কোকদের প্রতিদিন খাবার পাওয়া মুশকিল ছিল। একবেলা খেতে পারলেও দ্বিতীয় বার খাবার মিলত না। তাই একবার খাবার রান্না করলে খাবার খাওয়ার পর কিছুটা ভাতে জল দিয়ে রেখে দিত পরে খাবার জন্য।
    হরিচাঁদ পান্তাভাত লবন দিয়ে ভাল করে চটকিয়ে একেবারে ঘোলের মত বানিয়ে একটু একটু করে বিশেকে খাওয়াতে থাকেন। দুই তিন বার একটু একটু করে ভাত চটকানো জল খেয়ে বিশের জ্ঞান ফেরে। তারপর ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হ’তে থাকে।     
    বিশের শরীর থেকে অতিরিক্ত dehydration এর ফলে সে অচেতন হয়ে গিয়েছিল। শরীর থেকে জল, লবন পাতলা পায়খানা ও বমির সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে সে মরনাপন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চটকানো ভাতের জলের সঙ্গে লবন মিলিত থাকায় “ওর সেলাইন”  তৈরী হয়ে ছিল। সেই ওর সেলাইন খাওয়ানোর ফলে বিশের জীবন রক্ষা হয়। ( তথ্য সংগ্রহ- হরিচাঁদ এক মুক্তি সেনা- মনোরঞ্জন ব্যাপারী)

    এই ঘটনা সাধারণ লোকের কাছে অলৌকিক কিছু বলে মনে হয়েছিল। এই ঘটনার কারণ বোঝার মত ক্ষমতা তখনকার লোকের ছিলনা। আর এই সব কারণ খুঁজতে হ’লে বুদ্ধি লাগাতে হয়। কিন্তু সব থেকে সহজ কাজ হচ্ছে কোন বুদ্ধি না লাগিয়ে একবারে অলৌকিক ঘটনা নাম দিয়ে প্রচার করলে বেশী প্রচার হয়হরিচাঁদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। চারি দিকে প্রচার হয়ে গেল ‘হরিচাঁদ মরা বিশেকে বাঁচিয়েছে।’  হরিচাঁদ অবশ্যই অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বিশেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তবে বিশেকে মৃত অবস্থা থেকে জীবন করেননি। যদিও প্রচার হয়ে গেল মরা বিশেকে বাঁচিয়েছেন। হরিচাঁদ একজন প্রকৃতির মানুষ। প্রকৃতি বিরুদ্ধ তিনি বা কেউই করতে পারেন না। তাই তিনিও মারা বিশেকে বাঁচাননি। মৃতপ্রায় বিশেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তবে এই বোধ তখনকার দিনের কথাতো দূরের কথা, বর্তমান কালের শিক্ষিত লোকেরাও এই ধরণের ঘটয়ার বিশ্বাস করেন। তখনকার সাধারণ লোকেরা হরিচাঁদের বিজ্ঞান ভিত্তিক কাজের ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে তাঁকে ভগবান বলে মানতে শুরু করে।  

Comments