পূজা বা প্রার্থনা করার পরিবর্তে বন্দনা করা কেন বলা দরকার?
প্রশ্নঃ-
(আমাকে একজন বন্ধু প্রশ্ন করেছিল) বৌদ্ধ ধম্মাবলম্বী লোকেরা
বুদ্ধের মুর্তি অথবা ফটো রেখে পূজা করে, প্রার্থনা করে, আগরবাতি
জ্বালায়, মোমবাতি জ্বালায়; এতসব করার
পরেও কেন বলে তাঁরা “দেব-দেবতা মানিনা?’’ এ বিষয়ে তোমার
মতামত কি?
উত্তরঃ-
আমি শান্তভাবে বন্ধুকে বললাম,- “কিরে তোর বাবা গতবার মারা গেছেন; কিন্তু
তুই রোজ আগরবাতি লাগিয়ে কিছু তোর বাবার কাছে চাস কি?”
সে বলল,
“না, কিছু চাওয়ার মত দেবতা তো আমার বাবা নয়।
আমার জন্মদাতা বাবা, তাই তাঁকে পূজা করি।”
তখন আমি বললাম,
“আমারাও বুদ্ধ এবং বাবাসাহেব আম্বেদকরকে পিতাতুল্য বলে মনে করি। তাই
তাঁদের বন্ধনা করি। তাঁদের কাছে কিছু চাইনা। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করি। তাঁরা
জন্মদাতা মা-বাবা অপেক্ষা মহান উপকার করেছেন সমস্ত
মানবজাতির প্রতি। তাঁদের উপকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁদের স্মরণ করি। তাঁদের মূর্তির
সামনে নতমস্তক হই। আমরা হাত জুড়ে তাঁদের প্রতি প্রার্থনা করি না। ওটাকে আমরা “বন্ধনা” বলি। প্রার্থনার অর্থ
কিছু চাওয়া (request), আর বন্দনার অর্থ-অভিবাদন করা স্তুতি করা। বন্দনা
করে আমরা প্রতিজ্ঞা গ্রহন করি। তাঁরা যেটা করেছেন ও বলেছেন, সেই বিষয়কে উপলব্ধি করার
জন্য চিন্তন-মনন করি। বারবার সেই কথাগুলো উচ্চারণ
করি, যাতে সেই
আদর্শ থেকে পথ ভ্রষ্ট না হই।
পঞ্চশীল, এটা প্রার্থনা নয়। শীল
অর্থাৎ আচার। এগুলো প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য
বিষেশ গুণ। তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, এই পঞ্চশীল হচ্ছে পাঁচটি শ্রেষ্ঠ নিয়ম।
আমরা আগরবাতি দেবতাকে
প্রশন্ন করার জন্য লাগাই না। আগরবাতি যেমন নিজে জ্বলে এবং সুগন্ধ বিতরণ করে; সেই রকম পঞ্চশীল পালন করা হচ্ছে আমাদের মানবিকতার সুগন্ধ বিতরণ করা। এই ভাবনার প্রতীক হচ্ছে আগরবাতি।
মোমবাতি কিন্তু
প্রদ্বীপ (সল্তে ও তেল যুক্ত) নয়, প্রদ্বীপে তেল দেওয়া হয় দেবতাকে প্রশন্ন করার
জন্য। আমরা মোমবাতি এই জন্য জ্বালাই যে, সেটা যেমন নিঃস্বার্থভাবে নিজে জ্বলে এবং
আলো দেয়, কোন প্রকার ক্ষতি করে না; তেমনি
আমাদের জীবন যেন অন্য মানুষকে জাগাতে সাহায্য
করে, আমাদের
দ্বারা অন্যের জ্ঞানের আলোর প্রকাশ ঘটে। এই উদ্দেশ্যে আমরা মোমবাতি প্রজ্বলন করি।
আমরা দেবতাকে প্রশন্ন করার
জন্য ফুল অর্পণ করি না। তবে ফুল
যেমন তার সল্পায়ুতে মানুষের মনকে প্রফুল্লিত করে তোলে, সুগন্ধ বিতরণ করে, আনন্দ প্রদান করে। আর সময়ের অন্তরালে নষ্ট হয়ে যায়; তেমনি আমাদের এই
মানব জীবনও মানুষের উপকারের জন্য সমর্পিত হোক এই আশা করে আমরা ফুল দেই।
আর আমরা বৌদ্ধ লোকেরা বুদ্ধ
এবং বাবাসাহেবের শিক্ষার ভিত্তিতে চলতে চেষ্টা করি। কারণ আমাদের জীবন স্বর্ণময়
হয়েছে শুধুমাত্র বুদ্ধ এবং বাবাসাহেবের আদর্শকে মাথায় রেখে চলার জন্য।
আমরা এই মহামানবদের মুর্তি অথবা ফটো লাগাই; তাকি আমাদের আগামী প্রজন্ম এই মহামানবদেরকে
এবং তাঁদের কর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারে তার জন্য। এই মহামানবেদের
উপকার থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে বিস্মৃত না হয়, তার
জন্য। যার জন্য আমরা নিজেদেরকে বুদ্ধ এবং বাবাসাহেবের অনুরাগী মনে করি। ভক্ত বা পূজারী মনে করি না। আমরা বুদ্ধ এবং আম্বেদকরের
বিচার ধারাকে প্রামানিক হিসাবে স্বীকার করেছি। কারণ তাঁরা
আমাদের অসীম জ্ঞান প্রদান করেছেন। এক সময় আমাদের লোকদের যে সমাজ ব্যবস্থা পশুর
থেকেও নীচ্ মনে করত, যে জলাশয়ে পশু জল পান করতে পারত কিন্তু
আমাদের লোকেরা সেই জল স্পর্শ করলে নাকি অশুদ্ধ হয়ে যেত! এরকম ঘৃণ্য অবস্থা থেকে আমাদের মানুষদের উন্নিত করেছেন।
আমরা এঁদের সংগ্রামের জন্য মান-সম্মান, প্রতিপত্তি সবকিছু আজ
অর্জন করতে পেরেছি। তাই এঁদের কাছে চাইবার কিছু নেই। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধার্পণ করি। আমরা তাঁদেরকে
পূজা নয়,
তাঁদের অসীম উপকারকে শ্রদ্দা জানাই। এঁরা আমাদের কাছে মহামানব।
আমাদের দেবতা নয়। আমরা তাঁদের বন্দনা করি, পূজা বা প্রার্থনা করি না।
আমরা যে বন্দনা করি, সেই বন্দনার অর্থ হচ্ছে- মহামানবদের উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা
স্বীকার করা। এখানে কোন মানত করা হয় না কিছু পাওয়ার আশায়। তাঁদের কাছে কিছু চাওয়া
হয় না কোন সংকট থেকে মুক্তি লাভের আশায়। এখানে কোন যজ্ঞ করা হয় না। আর কোন জীবকে
ক্রুরভাবে বলি দেওয়া হয় না কোন দেবতাকে প্রশন্ন করার জন্য। আমরা আমাদের মহামানবদের
বন্দনা করি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদান করার জন্য।
‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামি’ অর্থ- বুদ্ধের অর্থাৎ জ্ঞানের স্মরণ যাচ্ছি বা
জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি।
‘ধম্মং শরনং গচ্ছামি’- ‘ধম্ম’ অর্থ সমতা, সততা, বন্ধুতা ও ন্যায়-এর প্রতি ধাবিত হচ্ছি।
‘সংঘম শরনং গচ্ছামি’- ‘সঙ্ঘ’ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধতা। আমি
সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হ’তে যাচ্ছি। কারণ সঙ্ঘবদ্ধভাবে কাজ করলে সেকাজ বেশি ফলপ্রদ হয়।
(এই বিষয়টি what’s
app থেকে সংগৃহীত। মারাঠী থেকে অনুবাদ করেছি।)
এই বিষয়টির
অনুবাদ করার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে- আমরা যাঁরা নিজেদের হরি-গুরুচাঁদের ধর্ম ও দর্শনের অনুরাগী, তাঁদের জন্য। লীলামৃতে আপনারা দেখে
থাকবেন, প্রতিটি অংশের শুরুতে দেওয়া
হয়েছে “বন্দনা”। আর এই বন্দনা করা হয়েছে, হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁদের
বংশধরদের এবং গোসাঁই পাগলদের নাম করে। অর্থাৎ এক কথায় এখানে মানুষের বন্দনা করা
হয়েছে। কোন দেব-দেবীর নয়। তাঁদের কাছে কিছু চাওয়া হয়নি। তাঁদের অভিবাদন করা হয়েছে।
স্তুতি করা হয়েছে। তাই আমাদেরও হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরের পূজা বা
প্রার্থনা করা না বলে বন্দনা করা বলাই মনে হয় শ্রেয় হবে। আর বুদ্ধিজমে যেমন পঞ্চশীল, অষ্টম মার্গ আছে, বাবাসাহেব ২২ প্রতিজ্ঞা দিয়েগেছেন; মতুয়া ধর্মেও দশম
আজ্ঞা ও সপ্তম নিষেধাজ্ঞা আছে। আর বাকি ব্যাখ্যাতো যেভাবে
করা হয়েছে সেইভাবে চাইলে গ্রহন করা যেতে পারে। কি বলেন আপনারা?
Comments
Post a Comment