হরিলীমৃতে অলৌকিকতার প্রাসঙ্গিকতা
*সুষেণ বিশ্বাস*
জয় হরিচাঁদ, জয় গুরুচাঁদ। মঞ্চে উপবিষ্ট গুণীজন,
সামনে বসে আছেন বিজ্ঞজন। মা, বাবা,
ভাই, বোন প্রত্যেককে আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাই। শ্রীশ্রীহরি
লীলামৃতে অলৌকিকতার প্রাসঙ্গিকতা- এই বিষয়ে আমার বক্তব্য। আমরা আলোচনার আগে
বুঝেনেব বৈদিক এবং অবৈদিক প্রসংগ। বৈদিক- প্রধানতঃ
বেদকে আশ্রয় করে যে অমানবিক অবৈজ্ঞানিক
অলৌকিক কাহিনি গাথা, সেটা হচ্ছে বৈদিক। যেখানে একটা
ভগবান থাকবে, তিনি সর্ব শক্তিমান, অসংখ্য দেব-দেবী থাকবে। অনেক অবতার পুরুষ থাকবেন। জন্মান্তরবাদ থাকবে।
সেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প কথা থাকবে। একটা শোষণের ধর্ম। এটা বৈদিক।
তাহলে
অবৈদিক? অবৈদিক ধর্মদর্শন বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। অত্যন্ত মানবিক,
বিজ্ঞান ভিত্তিক, পরিসুদ্ধ একটি ধর্ম,
যা মানব জীবনকে ক্রমশঃ উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, প্রগতির দিকে নিয়ে যায়। যেখানে একটা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নেই। তেত্রিশ
কোটি দেবতা নেই। অবতার পুরুষ নেই। জন্মান্তরবাদ নেই। আত্মার অস্তিত্ত্ব নেই। এমন
একটা ধর্ম দর্শন হচ্ছে অবৈদিক ধর্মদর্শন।
কবি
চুড়ামণী রসরাজ তারক সরকারের শ্রীশ্রীহরি
লীলামৃত গ্রন্থ খানি মতুয়া ধর্মদর্শনের একমাত্র আকর গ্রন্থ। এতে ভুল নেই। কিন্তু
আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, লীলামৃতে দু'টি
ধারার মিশ্রণ ঘটেছে। একটি বৈদিক অপরটি অবৈদিক। কারণ আমি একটু আগেই বললাম বৈদিক
মানে সেখানে অলৌকিক কাহিনি গল্পকথা থাকবে,
মানব জীবনের সাথে যার কোন যোগ নেই। অপার্থিব । এবং এমন কিছু কথা
যাতে আছে। একটা ধর্মীয় শাসন, অনেক মানুষের উপরে জুলুম।
যেটাকে শোষণের একটা চরম নিদর্শন হিসাবে দেখান যায়।
মতুয়াধর্ম তো তা নয়। অবৈদিক, মানবিক,
বিজ্ঞান ভিত্তিক, যুক্তিবাদী পরিশুদ্ধ
একটি ধর্ম। যে মতুয়া ধর্মের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুর। তাঁর কর্ম
দর্শনের কথা লিখতে গিয়ে সেখানে দু'টি ধারার সংমিশ্রণ এল কেন ? এটাতো এযুগের গবেষকদের মনের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের কারণ দর্শাতে গিয়ে
আধুনিকালে বা বর্তমানকালে প্রায় গবেষকই একটি মতে আস্থা রেখেছেন। সেটা কি? প্রায়ই আমরা শুনতে পাই- তারক গোসাঁই বৈদিক ভাবাপন্ন। তিনি বৈদিক কবি। আর এই বৈদিকতা
পারিবারিক সুত্রে পেয়েছিলেন। তারক সরকারের পিতা কাশিনাথ। তিনি কবিগান পরিবেষণ
করতেন। আর কবিগান পরিবেষণ করতে গেলে বেদ, পুরাণ, গীতা, ভাগ্বত, রামায়ণ,
মহাভারত এসমস্ত বৈদিক গ্রন্থ পড়তে হয়। তারক গোসাই তাই করেছিলেন। পরবর্তীকালে
তারক গোসাঁই পিতার পেশাকে গ্রহন করেছিলেন। তিনিও কবিয়াল হয়েছিলেন। কবিগান গাওয়ার জন্য তাঁকে বিভিন্ন গ্রন্থ পড়তে হ'ত। যেটা বৈদিক গ্রন্থ। একটা সময় কবিগান শোনার মত ছিলনা। অশ্রাব্য
খিস্তি খেউর দিয়ে, আদি রসাত্তক ভাব দিয়ে কবিগান পরিবেষিত
হ'ত। তারক গোসাঁই এইযে কবিগান পরিবেষণ করতেন, বৈদিক ভাবের মধ্যে ডুবে থাকতেন, এর জন্য লীলামৃত লিখতে গিয়ে তার ভাব ঢুকেছে এটা সত্য। কিন্তু এই কারণটি
প্রধান কারণ নয়। আরও অনেক কারণ থাকতে পারে সেটাই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
যদি তারক সরকার সত্যি সত্যি অবৈদিকতা কিছু না
বুঝতেন, তাহলে লীলামৃতের মধ্যে যে টুকরো টুকরো কথা এসেছে ; আবার এ বিষয়ে আমরা লীলামৃতে দেখতে পাই মহানন্দ হালদার, তিনি মুখবন্ধে লিখতে গিয়ে
জানিয়েছেন, গ্রন্থকর্থা অর্থাৎ তারক সরকারের প্রিয় গ্রন্থ
ছিল চৈতন্য চরিতামৃত। ওটা বিশেষভাবে তিনি পাঠ করতেন। লীলামৃত রচনা করতে গিয়ে তাঁর
(তারক সরকার) প্রিয় পাঠের ভাবধারা লীলামৃতের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তাহলে এখানে আমরা
বর্তমান গবেষকের সঙ্গে ওনার (মহানন্দ হালদার) মতের মিল দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তারক সরকার
অবৈদিক ভাবটাও বুঝতেন। সেটা লীলামৃতের পাতায় বিশেষভাবে তোলা আছে। উনি কি বললেন
লীলামৃতে?
জীবে দয়া, নামে রুচি,
মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত, সব ক্রিয়া
ভ্রষ্টা।।
তিনটি জিনিসকে তিনি তুলে ধরেছেন এই মহাবাণীর মধ্য
দিয়ে। এক-জীবে দয়া, দুই- নামে রুচি, তিন- মানুষেতে নিষ্ঠা। জীবে দয়াঃ- অর্থাৎ যেখানে প্রানী জগৎ
রয়েছে, উদ্ভিত জগৎও রয়েছে। এর মধ্যে উদ্ভিত জগতের প্রতি
দয়াশীল হতে হবে। একটা গাছ লাগালে তাকে
প্রত্যেক দিন জল ঢালতে হবে, তাকে লালন পালন করতে হবে
প্রানী জগতে দিন্ দুঃখীর প্রতি যত্নবান হতে হবে। তাদের দুঃখ মোচনের কাজে নিজেকে
নিবৃত্ত থাকবে হবে। এটা বোঝাতে চেয়েছেন।
নামে রুচিঃ- এই নাম শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে
প্রযুক্ত হয়েছে। নাম মানে হরি নাম কৃষ্ণ নাম নয়। নাম শব্দটির অর্থ এখানে বিজ্ঞান।
মানে বিশেষ জ্ঞান। রুচি- মানে অনুরাগ।
অর্থাৎ একত্রে নামে রুচি কথাটির অর্থ হচ্ছে-
বিজ্ঞানে অনুরাগ। বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত হও। যে বিশেষ জ্ঞানকে ধারণ করে, যে বিশেষ জ্ঞানকে
আশ্রয় করে শুধু এযুগেই নয়, অতীত ভারতবর্ষে, অতি প্রাচীন ভারতবর্ষে যখন আর্যরা আসেনি, এই
বিশেষ জ্ঞানকে আশ্রয় করে ভারতীয় মানুষ সেখানে সাম্যের একটা বাতাবরণ তৈরী করেছিলেন
এবং বর্তমানকালেও বিশেষ জ্ঞানকে আশ্রয় করে আমরা বহির্বিশ্বে যাকিছু সুন্দর,
যাকিছু আমাদের সহজ লভ্য সেটা পাচ্ছি। এই যে আলোটা জ্বলছে
বিশেষ জ্ঞানের জন্যে। এই যে পাখাটা ঘুরছে
বিশেষ জ্ঞানের জন্যে। আমি ছোটো করে কথা বলছি বড় করে শোনা যাচ্ছে বিশেষ জ্ঞানের
জন্যে। ট্রেন চলছে বিশেষ জ্ঞানের জন্যে। রকেট চলছে মহাকাশে বিশেষ জ্ঞানের জন্যে। এই
যে যে ছোট্ট একটি যন্ত্র (মোবাইল দেখিয়ে) দেখতে পাচ্ছেন আমার হাতে, এতো কতগুলো
কলকব্জা। আপনার সন্তান হাজার মাইল দূরে আছে। আপানার দেখা করতে হবে। কিন্তু সেখানে
গিয়ে দেখা করার সময় আপনার নেই। তাই এই যন্ত্রটি এমনভাবে কাজে লাগাচ্ছে-
সন্তান
থাকিলে দূরে হাজার মাইল,
তার সঙ্গে কথা বলায় ছোট্ট
মোবাইল।
কে কথা বলাচ্ছে- বিজ্ঞান। কৃষি কাজ করছে
বিজ্ঞান। ভাত খেলে কি হয়? আপনি মাছ মাংস
ডেইলি খান ক'য় দিন পর খেতে পারবেন না। কিন্ত ভাত এমনই
একটা খাবার যে, প্রত্যেক দিন খেলেও আপনাকে খেতে ইচ্ছা
করে। ভাতের এরকম গুণ মানুষেরা বুঝেছে। এর মধ্যেও বিজ্ঞান।অর্থাৎ বিজ্ঞান ছাড়া
কিছু নেই। এই নামে রুচি মানে সেই
বিজ্ঞানে রুচি। যে বিশেষ জ্ঞানকে অবলম্বন করলে মানব ও জীব জগৎ ক্রমশঃ প্রগতির দিকে যায়। বিভিন্ন দিকে তার
প্রজ্ঞা জম্মায়। একজন মানুষ যেমন নৈতিক জ্ঞানের অধিকারী হ'তে পারে,
চরিত্রবান হ'তে পারে, পরিপূর্ণ মানুষে রূপ নিতে পারে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বুদ্ধ, তাঁর মত পরিপূর্ণ রূপ সে পেতে পারে। সেই জ্ঞান রূপ নাম, তার প্রতি প্রজ্ঞা জন্মানর কথা বলা হয়েছে লীলামৃতে। তাই
বলছে নামে রুচি। জীবে দয়া, নামে রুচি,
মানুষেতে নিষ্ঠা। সৃষ্টির শ্রেষ্ট
সম্পদ মানুষ। কে কোন ধরনের মানুষ, কে কোন জাতের মানুষ। কে
ছোটো, কে বড়, কে অস্তিত্ত্বহীন
মানুষ, কার অস্তিত্ত্ব
আছে, এই Movement কে
মানুষের প্রতি দৃড় আস্থাকে বলা হচ্ছে
নিষ্ঠা। প্রত্যেকটি মানুষের প্রতি যে দৃড় আস্থা বা বিশ্বাস। যে বিশ্বাস থেকে
ভালবাসা জন্মায়। যে ভালবাসা থেকে দায়বদ্ধতা জন্মায়। দায়বদ্ধাতা থেকে জন্মায় আমায়
কিছু করতে হবে পৃথিবীর জন্যে। পৃথিবীর মানুষের জন্যে। এটা হচ্ছে মানুষেতে নিষ্ঠা।
এখানে বৈদিক ভাবে আছে কি? তাহলে অবৈদিক হরিচাঁদ ঠাকুরের যে অবৈদিক জ্ঞানের দর্শন, জ্ঞান কর্ম বানীর ধর্ম, মতুয়া ধর্ম। সেটাই এই বানীর মধ্যদিয়ে তারক গোসাঁই লিখেছেন। তাহলেও প্রশ্ন জাগে কেন তিনি এই বৈদিক ধারার মিশ্রন ঘটালেন? আজ থেকে
আমরা একশ বছর আগে, অর্থাৎ লীলামৃত প্রকাশের একশ বছর পরে
যারা গবেষণা করছি, যারা দু'টি
কথা বলছি তাদের জানতে হবে আজ থেকে একশ বছর আগে বর্তমানের সঙ্গে মিল ছিলনা। অনেক
কিছু মিল থাকার কথা নয়। কারণ যে দিন যাচ্ছে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটছে। মুহুর্তের
মধ্যে মানুষের মন পরিবর্তন হয়। কারণ মানুষের মন হচ্ছে বিচিত্র জগতের বাসিন্দা।
মুহুর্তের মধ্যে change হয়।
তারক
গোসাঁই হরি লীলামৃত লিখেছিলেন। তিনি হরিচাঁদের আদর্শ বুঝেছিলেন এটা ঠিক।
কিন্তু তারপরেও কেন দুধের মধ্যে জল ঢাললেন? তার কারণ, যে যুগে
দাঁড়িয়ে তিনি লীলামৃত রচনা করেছিলেন সেটা হচ্ছে আজ থেকে একশ বছর আগে। সে সময়ের
পরিমন্ডলটা কি? প্রেক্ষাপটটা কি? যুগোপযোগী মানুষের চাহিদা কি ছিল? আমরা তো চাই
কোন কবি সাহিত্যিক যুগের উর্ধে নয়। যে কবি যে যুগে দাঁড়িয়ে কলম চালনা করেন সেই
যুগের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা, তাদের ভাললাগা, মন্দলাগা,এটাই প্রতিফলিত হয় তার লেখনিতে। সেসময়ের প্রেক্ষাপট যদি আমরা দেখি-
আমিতো ছোট বেলায় দেখেছি- সেটা বেশী দিনের কথা নয়। মহাভারত পাঠ চলছে , ভাগবত পাঠ চলছে। নরনারী বসে আছে। গল্পকথা শুনছেন- একলব্যের আঙ্গুল
কেঁটে নিল দ্রোনাচার্য কৌশল করে। তার সারা জীবনের সাধনা নষ্ট হয়ে গেল। আর সেখানে
কাঁদছে কি বলে? "হায়, হায়,
একলব্যের গুরুভক্তি।" দেখেছেন বিবেচনা কোথায়? একথা আমি শুনেছি। সেখানে যে ছলচাতুরি সেটা বোঝেনি মানুষ। ঐ বৈদিককাল
থেকে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারনা। ইহজগৎ
পরজগৎ সম্পর্কে ধারনা, একটা জন্মান্তরবাদ সম্পর্কে ধারনা, ব্রহ্মপদ লাভ করার ধারনা,
মোক্ষলাভ করার ধারনা। এই সব ধারনার বশবর্তী হয়ে মানুষ তখন গ্রন্থ
পাঠ শুনতেন। তাঁরা যখন নিজে পাঠ করতেন বা পাঠকের মুখ থেকে শুনতেন, সেগুলো শুনতে শুনতে এমনভাবে গদ গদ হয়ে যেতেন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যেন
পরম আনন্দ লাভ করতেন, স্বর্গ সুখ পেতেন। কি অদ্ভুত পরিবেশ। তাঁরা এর বাইরে কিছু ভাবতে পারতেন না। সেরকম একটা
ভাবগম্য পরিবেশের মধ্যে থেকে তারক গোসাঁইকে কিন্তু লীলামৃত রচনা করতে হয়েছে। এটা
আমাদের মাথায় রাখতে হবে। যে গ্রন্থ রচনা করলে মানুষ গ্রহন করবে না; সে যতবড়ই সত্য কথা হোক। মানুষ যদি তা গ্রহন না করে সে গ্রন্থ তো মৃত
গ্রন্থ। সেটা পাঠ করবে না, অথচ তাকে গ্রন্থ বলব। সেটাতো হ'তে পারেনা।। তারক গোসাঁই তাই কি করলেন? অবৈদিক
দর্শন ভাব বোঝার পরে যুগোপযোগী চাহিদা অনুসারে তৎকালীন মানুষের যে চাহিদা সেটা
লীলামৃতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি
চাইলেন, অন্ততঃ বেঁচে থাক। যদি বেঁচে থাকে পরবর্তী
কালে যে গবেষকরা আসবেন, যে মানুষ আসবেন, তাঁরা এর সঠিক তত্ত্ব খুঁজে নেবে। তাই অন্ততঃ বাঁচিয়ে রাখার ভাবনাটা কাজ করেছিল।
তাই আমি
বলব, তারক গোসাঁই যে বৈদিক ধর্ম-দর্শন এই লীলামৃতের মধ্যে ঢুকিয়েছেন,
এটা তাঁর উদ্দেশ্য প্রনোদিত প্রয়াস। অন্তরের
প্রচেষ্টা নহে। তৃতীয়
কারণ- আমাদের মনে রাখতে হবে কাদের আঙ্গুলি লেহনে সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত হ'ত? কোনটা গ্রহন করা হবে আর কোনটা বর্জন করা হবে সেটা তাদের মর্জির উপর
নির্ভর করত।
আমরা
জানি, লীলামৃত ছাপাতে গিয়ে ভীষণ অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কোন প্রকাশকই
ছাপাতে রাজি হচ্ছিল না। তারপরে কলকাতার ছিদাম মুদি লেনের শাস্ত্র প্রচার প্রেস ২০
টাকা ঘুষ নিয়ে ছাপাতে রাজি হয়েছিল। তবে পরিবর্ধন পরিমার্জন করে।
সেরকম
একটা যুগে একটা আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু উদ্দেশ্য কাজে লাগাতে হয়েছে।
তাই সেটা উদ্দেশ্য প্রনোদিত। অন্তরের কথা নয়। উনি কিন্তু বেনা জল ঢুকিয়েছেন এটা
ঠিক। লীলামৃত ছাপাতে গিয়ে হুচোট খেতে হয়েছে এটাও ঠিক। সেই যুগে কোন নিজিসটা গ্রহন
করতে হবে বা বর্জন করতে হবে সেটা নির্ভর করত উচ্চ বর্ণের মানুষের উপর। তারা যেটার
স্বীকৃতি দেবে সেটাই মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে।
তাই
তারক গোসাঁই কি করলেন? সর্বজন মান্যতা ও সর্বজন গ্রাহ্যতা যাতে লীলামৃত
পায়, তার জন্য তিনি লীলামৃতে অলৌকিক কাহিনি ঢুকাতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাঠক যেন মনে করেন এটা
তারই কথা। আমরা লীলামৃত পড়তে গিয়ে এসব বাদ দিয়ে কি পড়তে পারিনা? তারক গোসাই কি লিখেছেন ওই কথার আড়ালে এটা কি আমরা বুঝতে পারিনা? ছাইয়ের গাদার মধ্যে সোনা থাকলে সেই সোনাকে সোনা বা বলে কি ছাই বলবে?
লীলামৃতে ছাইও আছে, সোনাও আছে। অনেক
মনি-মুক্তা থরে থরে সাজানো রয়েছে। সেটা দেখতে হবে।
শ্রদ্ধেয় মণীন্দ্রনাথ বৈরাগী মহাশয় ও আরও তিন জন ব্যক্তি আমার চোখ খুলে
দিয়েছেন। কিন্তু তবুও আমার আধাঁর কাটেনি। লীলামৃতে সবকিছু আছে। কিন্তু ছাই টুকু
অবলম্বন না করে সোনা টুকু গ্রহন করব।
লীলামৃতের মধ্যে আছে- ব্রহ্মত্ব মাধুর্য্য মুক্তি কৃষ্ণ ভক্তে দন্ড।
হরিনামে পাপ ক্ষয়
কহে কোন ভন্ড।।
মুক্তি শ্রেষ্ঠ
ব্যাখ্যে যারা ভক্তি নাহি চিনে।
হরিনামে পাপ ক্ষয়
তারা ইহা মানে।।
কি বললেন তারক সরকার? যে মানুষটা অবৈদিক দর্শন বোঝেন
না, তিনি কি এই কথা শুনে শুনে লিখেছেন? কোন কিছুকে আত্ত্বস্থ করতে হয়, ভিতরে সেটা
ভালো না লাগলে লিখবেন কেন সেকথা? যে কথা আমার ভাল লাগে না
সেকথা লিখতে যাব কেন? তিনি কি বললেন? "ব্রহ্মত্ব মাধুর্য্য মুক্তি" উনি মাধুর্য্য কথাটি
ব্যবহার করেছেন।
ব্রহ্মত্ব
মাধুর্য্য মুক্তি কৃষ্ণ ভক্তে দন্ড।
হরিনামে পাপ ক্ষয়
কহে কোন ভন্ড।।
ব্রহ্মত্ব কথাটির মানে হচ্ছে-
ব্রহ্মেরভাব। আর একটা মানে হচ্ছে ব্রহ্মপদ। অর্থাৎ একজন মানুষ যদি ব্রহ্মপদ লাভ করেন তার যে আনন্দ, ভক্ত
মোক্ষলাভ করলে তদ্রুপ আনন্দ পায়। এর
জন্য ব্রহ্মত্ব মাধুর্য্য মুক্তি। মুক্তি
মানে আনন্দ। কিন্তু সেতা কৃষ্ণ ভক্তে দন্ড। দন্ড মানে সাজা। কেন?
একটু দূরে
সরে যান, আরও অতীতে। দেখবেন এই মোক্ষ
লাভের জন্য মুনি-ঋষি অনেক মানুষ তাঁরা তপস্যা করছেন, হরি
নাম জপ করছেন। কেউ অগ্নি প্রজ্বলিত করে তপস্যা করছেন। কেউ পর্বতের উপরে গিয়ে
তপস্যা করছেন; কেউ না খেয়ে তপস্যা করছেন; এগুলো সাজা নয় কি? দন্ড মানে শাস্তি। তারক
গোসাঁই বলেছেন শাস্তি। কারণ হরিনামে পাপ ক্ষয় হয় না। অথচ যে মোক্ষও নেই মুক্তিও
নেই এঁরা সেই মোক্ষ এবং মুক্তি পাওয়ার জন্য এরকম সাজা ভোগ করছেন । হরিনামে পাপ
ক্ষয় কহে কোন ভন্ড? এই পাপ
মানে অজ্ঞানতা। এই যে হরিনাম, ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে
মালাটিপে হরিনাম করছে ; তারক সরকার বলছেন না, ঐ হরিনামে অজ্ঞানতা যায় না। অজ্ঞানতা যেতে গেলে চাই বিজ্ঞান রূপ নাম।
অজ্ঞানতা তাড়াতে গেলে জ্ঞান রূপ আলো দিয়ে সেটাকে দূরে সরাতে হয়। তাই নাম হচ্ছে-
জ্ঞান, বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান হিসাবে সেটাকে ব্যবহার করিছেন
কবি। তবে তো তোমার ভিতরে যে অজ্ঞানতার অন্ধকার সেটা দূর হয়ে যাবে।
লীলামৃত বলছে- নাম এবং হরি এক। কথাটির তাৎপর্য ভাল করে লক্ষ্য
করতে হবে-
যেই নাম সেই হরি শ্রীমুখের বাক্য।
মনে প্রাণে চিত্ত কভু নাহি করে ঐক্য।।
যেই নাম সেই হরি, 'হরি'
মানে শুধু এই 'হরি' নয়। 'হরি' মানে 'জ্ঞান'। তাহলে এই বিশেষ জ্ঞান বা চরম জ্ঞানকে বলা হচ্ছে হরির নাম। সেই পরম জ্ঞানকে বুঝে যদি আমরা নাম করি, তবেই
জ্ঞানের আলোকে ভিতরের যে অন্ধকার, যে অন্ধকার সূর্যের আলো
দূর করতে পারে না, সেই অন্ধকার আপনা থেকে দূর হয়ে যাবে।
শত চেষ্টা করলেও সেই অন্ধকারকে অন্য উপায়ে দূর করা যাবে না। তবে জ্ঞান রূপ আলো দিয়েই সেটাকে অনায়াসেই দূর
করা যাবে।
হরিলীলামৃত পাঠ করার সময় আমরা যদি স্বচেতনভাবে
একটু লক্ষ্য করে দেখি, তাহলে দেখব
লীলামৃতের পাতায় পাতায় অসংখ্য মণি-মুক্তা থরে থরে সাজানো রয়েছে। এগুলোকে
যদি আমরা হৃদয়ে আশ্রয় দিতে পারি, তাহলে সেই মণি-মুক্তার
দ্যুতিতে নিজে ও জগৎকেও আলোকিত করতে পারব। মতুয়া দর্শন এমন একটি দর্শন, যে দর্শনের বীজ যদি মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়; বিশ্ব কে জয় করা যায় এমন একটা মহামন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে। যার নাম হচ্ছে-ভালবাসা, ভালবাসা,
ভালবাসা। যে ভালবাসা ভিন্ন একজন মানুষ কোন কিছু করতে পারে না। যে
ভালবাসা ভিন্ন একজন মানুষ বড় জায়গায় পৌঁছাতে পারেন। এই মানব প্রেমের কথা কিন্তু
এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে লীলামৃতের পাতায় পাতায়।
আর
অবৈদিক? বেদ বিরুদ্ধ কথাতো উনি বলেছেন।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট
প্রসাদ পেলে খাই।
বেদ বিধি শৌচাচার
নাহি মানি তাই।।
কি একথা বলেন নি? একটা মানুষ
ভিতর থেকে যেটা বোঝেননি সেটা লিখতে পারেন কি? এটা অসম্ভব।
তিনি বুঝে ছিলেন তখনকার দিন শুধু নয়, এখনকার দিনেও বেদ
হিন্দু ধর্মের একটা পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ। সেই গ্রন্থকে কিভাবে অবমাননা করা হয়েছে,
কিভাবে উপেক্ষা করেছেন হরিচাঁদ ঠাকুর, এটাতো
হরিচাঁদ ঠাকুরের মুখে পরিয়েছেন তারক গোসাঁই। এটা তাঁর ভিতরের একটা পরিমার্জিত ফসল।
এটা তিনি পেয়েছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের কাছ থেকে। সেটাকে তিনি লীলামৃতের পাতায় তুলে
ধরেছেন। যে বেদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস এখনও আমরা পাইনা এ যুগের মানুষ; আর তখন তিনি একথা বলেছিলেন।
আর
চরমতম যে দর্শন- গার্হস্ত প্রসস্থ ধর্ম। এ ধর্ম সম্বন্ধে তো তিনি দারুনভাবে বলেছেন
যে, শ্রষ্টা ঈশ্বর নয়। শ্রষ্টা হচ্ছে- বিশ্বের যাকিছু আছে প্রত্যেকেই
শ্রষ্টা।
করিবে গার্হস্ত ধর্ম লয়ে
নিজ নারী।
গৃহে থেকে ন্যাসী
বাণপ্রস্থী ব্রহ্মচারী।।
গৃহ ধর্ম রক্ষা করে বাক্য
সত্য কয়।
বানপ্রস্থী পরমহংস তার
তুল্য নয়।।
লীলামৃতে যে বৈদিক ভাবনা দেখতে পাই সেই বৈদিক ভাবনা
ব্যাখ্যা করুন। বেদ,
পূরাণ নিয়ে আসুন, যে ক'টা লাইন আছে লীলামৃতের মধ্যে। সেই বৈদিক ভাবনা যতটুকু আমরা দেখতে পাই
সেটা যদি আমরা দেখি, অবৈদিক ভাবনার আলোকে যদি আমরা একটু
তাকিয়ে পড়ি তাহলে সেটা ফুতকারে উড়ে যাবে।
প্রত্যেক বিজ্ঞ জন এবং আমার একান্ত আপনার জন যাঁরা রয়েছেন, আমি অনুরোধ রাখব লীলামৃত পড়তে গিয়ে যদি একটু নিজেকে পরিবর্তন করে পড়তে
চেষ্টা করি তাহলে আসল সত্যটা আমরা বুঝতে পারব। এই প্রার্থনা রেখে শ্রদ্ধা, ভক্ত, প্রনাম জানিয়ে আমার সামান্য বক্তব্য শেষ
করছি। জয় হরিচাঁদ। জয় গুরুচাঁদ।
________________________________
Source
Comments
Post a Comment