হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত-ডাঃ মণীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস (পৃঃ নং- ১৯২ থেকে১৯৭)
ঋগবেদের কৃষ্ণের সাথে পরবর্তী কৃষ্ণের সাদৃশ্য
আর্যপূর্ব ভূভারতে ধর্ম ছিল বৌদ্ধ ।
প্রাচীন ভারত যারা করিল সমৃদ্ধ ।।
ছোট ছোট রাজ্যে ছিল ভারত বিভক্ত ।
একের প্রভাব থেকে অন্যে ছিল মুক্ত ।।
তথাপিও পরস্পরে ছিল সদ্ভাব ।
বৌদ্ধিক চেতনা আনে এমনি স্বভাব।।
জনগণ ছিল রাজ্যে ক্ষমতার কেন্দ্র ।
সংসদীয়
পদ্ধতিতে চালাইত তন্ত্র ।।
বহু রাজ্য নিয়ে হয় এক জনসংঘ ।
রাজ্যে রাজ্যে মিলনের ইহা বড় অঙ্গ ।।
জনসংঘ মিলে ছিল বেদের বিরোধী ।
বিরুদ্ধে লড়িত সবে এর নিরবধি।।
ঋগবেদে দেখা যায় ইহার প্রকাশ ।
বিভিন্ন সূক্তের মাঝে আছে এই ভাষ ।।
'ওহে ইন্দ্র সোমরসে হইয়া আচ্ছন্ন ।
সংসদের পরস্পরে করো হে বিচ্ছিন্ন ।।
যজ্ঞ বিহীন সংসদ দুরাচার বড় ।
অতি শীঘ্র ইহাদের হত তুমি কর ।।'
১৯৩
যাগযজ্ঞ পূজা আদি বৌদ্ধরা মানে না ।
পুনর্জন্ম স্বর্গ নিয়ে ইহারা ভাবে না ।।
ইহাতে প্রমাণ হয় প্রাচীন ভারতে ।
ভূমিপুত্র সবে ছিল বৌদ্ধধর্ম মতে ।।
বৌদ্ধ ধর্মাশ্রয়ে ছিল সকল অসুর ।
তাই বেদে যুদ্ধ করে অসুর ও সুর ।।
বৌদ্ধধর্ম মাঝে ছিল যত সংস্কৃতি ।
যোগবিদ্যা প্রাণায়াম তার মূল ভিত্তি ।।
বৌদ্ধধর্মে ছিল যত মুনি ও শ্রমণ ।
সকলে করিত ঐ যোগ অনুশীলন ।।
যোগবিদ্যা হতে পেত প্রভূত ক্ষমতা ।
দেহ মন হতে যেত সব অক্ষমতা ।।
শারীরিক শক্তি আর বৌদ্ধিক যে জ্ঞান ।
যোগ প্রাণায়াম থেকে করিত অর্জন ।।
তার মাঝে কেহ হত পারদর্শী শ্রেষ্ঠ ।
কৃষ্ণ হল তার এক প্রমাণ প্রকৃষ্ট ।।
মহাযোগী মাহাধ্যানী মহাশক্তিশালী ।
রাষ্ট্রসংঘে শ্রেষ্ঠ নৃপ কৃষ্ণ মহাবলী ।।
জ্ঞানে ছিল যুগশ্রেষ্ঠ যুদ্ধে পারঙ্গম ।
সর্বশক্তিমান বলে তাই হত ভ্রম ।।
অসুর মানবগোষ্ঠী যত ভূভারতে ।
আশ্রিত সকলে ছিল এক বৌদ্ধধর্মমতে ।।
শ্রীকৃষ্ণও ছিলেন এক বৌদ্ধ সুজন ।
যাগযজ্ঞ বেদাচার মানেনি কখন ।।
তাই করে ঋগবেদে ইন্দ্র সনে যুদ্ধ ।
ভূভারতে বেদবিধি করিরারে রুদ্ধ ।।
শক্তির উৎস ছিল দেশীয় রাজন্য ।
অসুর রাক্ষস নাগ এরা অগ্রগণ্য ।।
'সংঘং শরণং' বৌদ্ধিক এই বাণী নিয়ে ।
সঙ্ঘবদ্ধ ছিল এরা সর্বশক্তি দিয়ে ।।
১৯৪
ইহাদের বল নিয়ে কৃষ্ণ ছিল বলী ।
তাই ভয়ে ভীত ছিল দেবতা সকলি ।।
ইন্দ্রের সমীপে চেয়ে এর প্রতিকার ।
ঋগবেদে ভাষ্য এই অতি চমৎকার ।।
পরস্পর বিরোধী করে ঐ জনসঙ্ঘ ।
উহাদের যৌথ শক্তি করো তুমি ভঙ্গ ।।
মহাভারত ভাগবত গীতা ও পুরাণ ।
ছান্দোগ্য উপনিষদ অধিক পুরাণ ।।
ছান্দোগ্যে আছে ঘোর অঙ্গিরা একজন ।
বৌদ্ধধর্মী ছিল সে যে বলিষ্ঠ শ্রমণ ।।
কৃষ্ণের শিক্ষক রূপে তাকে দেখা যায় ।
উপদেশ দেয় কৃষ্ণে বৌদ্ধ চেতনায় ।।
'অতীন্দ্রিয় জ্ঞান যাহা হল আলোচনা ।
এবে তুমি মুক্ত হলে তৃষ্ণা ও বাসনা ।।
অতীন্দ্রিয় যাহা কিছু প্রকৃতির মাঝে ।
ভূত নিয়ে ভূতনাথ প্রকাশে স্বকাজে ।।
এবে তুমি অবিনশ্বর তুমি অক্ষয় ।
প্রাণশক্তির মূল তত্ত্ব কহিনু তোমায় ।।'
আরেক প্রাচীন গ্রন্থ ঐ সূত্র ত্রিপিটক ।
এই তত্ত্ব সমর্থন করেছে কথক ।।
অসুর মানব কৃষ্ণ দিল পরিচয় ।
এ কথা সূত্র পিটক গ্রন্থ মাঝে রয় ।।
এই ঘোর অঙ্গিরা পুত্র কণ্ব আঙ্গিরা ।
কম্ব পুত্র প্রস্কণ্ব বেদে আছে এরা ।।
এই তথ্যে এই কথা হইল প্রমাণ ।
বেদ থেকে ছান্দোগ্য অধিক পুরাতন ।।
অথচ ঘোর অঙ্গিরাকে বৈদিক গ্রন্থে ।
দীক্ষিত করেছে পরে বৈদিক মন্ত্রে ।।
১৯৫
কৌষিত ব্রাহ্মণ গ্রন্থে রয়েছে প্রকাশ ।
শ্রীকৃষ্ণকে বলিয়াছে সেথা অঙ্গিরস ।।
অঙ্গিরার ছাত্র কৃষ্ণ এই নাম তায় ।
বুৎপত্তি শব্দ অর্থে ইহা বোঝা যায় ।।
কৃষ্ণের পত্নীসংখ্যা ছিল কতজন ।
দিয়েছে বলিষ্ঠ তথ্য ঐ বিষ্ণুপুরাণ ।।
কোথাও বা ষোল হাজার একশত এক ।
ষোল হাজার সাতজন অন্য একক ।।
ষোল হাজারের পরে আছে আটজন ।
এত তথ্য দেয় একা ঐ বিষ্ণুপুরাণ ।।
এই সত্য এতে কিন্তু হয় যে প্রমাণ ।
বহু পত্নী নিয়ে ছিল কৃষ্ণের জীবন ।।
ঋগবেদে এই কথা করেছে স্বীকার ।
বহু পত্নী নিয়ে ছিল কৃষ্ণের সংসার ।।
ঋজিশ্বন রাজা সহ ইন্দ্র দেবপতি ।
কৃষ্ণ পত্নীগণে মারে যারা গর্ভবতী।।
এক সাথে বহু পত্নী গর্ভবতী হয় ।
আরো বহু পত্নী তার আছে নিশ্চয় ।।
এই কথা ঋগবেদে আছে প্রকাশিত ।
প্রমাণের তরে করা হল উপনীত ।।
মহাভারত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ শৈশবে ।
চরাইত ধেনু মাঠে বন্ধু মিলে সবে ।।
ঋগবেদে সমর্থন করেছে লেখনি ।
যদুবংশীয়রা ছিল গোধনেতে ধনী ।।
উৎকৃষ্ট প্রমাণ এবে হইল প্রদান ।
বিজ্ঞজনেরা সবে করুন অবধান ।।
চতুর্থ অধ্যায়ে গীতার এক নং শ্লোকে ।
কৃষ্ণ নাকি বলিয়াছে আপনি স্বমুখে ।।
আমি ধ্বংস যায় না করা এ মহাজ্ঞান ।
সূর্যকে শিখিয়েছিল এ যোগবিজ্ঞান ।।
১৯৬
সূর্য ইহা বিবস্বানে দিয়েছিল শিক্ষা ।
বিবস্বান মনুকে দিল এ জ্ঞান ভিক্ষা ।।
ইক্ষাকুদের শিখাইল মনু এ জ্ঞান ।
গীতার মাঝেতে ইহা হয়েছে লিখন ।।
ঋগবেদেও আছে ঐ নামের তালিকা ।
বিভিন্ন ঋকের মাঝে আছে উহা লেখা ।।
ঘোর অঙ্গিরা হতে কৃষ্ণ পেল যে জ্ঞান ।
সে জ্ঞানই এই জ্ঞান হয় যে প্রমাণ ।।
পরবর্তী কালে
দেখি মুনি সন্দীপন ।
শ্রীকৃষ্ণের গুরুরূপে হয়েছে লিখন ।।
সন্দীপন তো কৃষ্ণকে দেয়নি দর্শন ।
কৃষ্ণ যে অঙ্গিরা
ছাত্র ইহা নিদর্শন ।।
এ জ্ঞান জানিত যদি নিজে সন্দীপন ।
পুত্রশোকে তবে কেন কাতর সে জন ।।
মহাভারতে আদি পর্বে আছে এ সূত্র ।
শূদ্র ছিলেন মনু বিবাস্বনের পুত্র ।।
রাজসূয় যজ্ঞে আছে বিশেষ প্রমাণ ।
শূদ্র গালি দিয়ে কৃষ্ণে করে অপমান ।।
ঋগবেদে মেলে কিন্তু এর সমর্থন ।।
মনুর পিতাই ঐ অসুর বিবাস্বন ।।
শূদ্র বলিয়া মনু মহাভারতে খ্যাত ।
কৃষকের নেতা বলে বেদে পরিচিত ।।
এইভাবে সূত্র ধরে নিলে পরিচয়।
অবশ্যই কেটে যাবে মনের সংশয় ।।
তত্বগত দিকে যদি দৃষ্টিকে ফিরাই ।
মহাভারতের মাঝে দেখিবারে পাই ।।
উদ্যোগ পর্বেতে কৃষ্ণ করেছে স্বীকার ।
ব্যক্ত করিতে পারি আমি পুরুষকার ।।
দৈব অনুষ্ঠানে কিন্তু বিন্দুমাত্র নাই ।
প্রকাশ করিতে মোর শক্তির বড়াই ।।
১৯৬
মানুষী শক্তির বেশি শক্তি নাহি তার ।
নিজমুখে কৃষ্ণ ইহা করেছে স্বীকার ।।
সেই কৃষ্ণ কি করিয়া গীতার মাঝারে ।
বিশ্বরূপ দেখাইল তিনি অর্জুনেরে।।
এইভাবে ধরে ধরে নিলে পরিচয় ।
হুবহু প্রমাণ আরো মিলিবে নিশ্চয় ।।
ঋগবেদে কৃষ্ণ যিনি কবির লিখনে ।
দাঁড়াইল বংশী হাতে আসি বৃন্দাবনে ।।
সূক্ষ্ম হাতে সাজিয়েছে শাস্ত্রগ্রন্থ পট ।
সত্যকে পারেনি তবু করিতে লোপাট ।।
বৈদিক ধর্মেতে আছে তাই যত পুঁথি ।
সর্বত্র রয়েছে তার বহু অসংগতি ।।
উদ্দেশ্য মগজে নিয়ে কল্পনা আশ্রয়ে ।
তিলকে করেছে তাল পান্ডিত্য মিশিয়ে ।।
সত্যকে দিয়েছে চাপা বহু গ্রন্থ শাস্ত্রে ।
হয় নাকো হত সত্য কভু কোন অস্ত্রে ।।
চুরিকালে চোর যত হোক সাবধান ।
রয়ে যাবে তবু তার চুরির প্রমাণ ।।
গ্রন্থের ফাটল দিয়ে সত্যের কিরণ ।
করিতেছে সর্বদাই আলো বিকিরণ ।।
সত্যের আলোকে সত্য খুঁজে নিতে হয় ।
হইবে প্রকাশ সত্য না রবে সংশয় ।।
__________________________
Comments
Post a Comment