আপনি এটা
জানেন কি ? এটা ভাবেন কি ? এটা করেন কি ? তবে ?
 পড়ুন এই লেখাটি।
হরিচাঁদ
ত্তত্ত্বামৃত-ডাঃ মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস 
(পৃষ্ঠা নং V to XX)
শ্রীযুক্ত হরিবর সরকার
মহাশয়ের তৎপরতা এবং শ্রীযুক্ত গোপালচন্দ্র হাওলাদার মহাশয়ের অর্থানুকূল্যে মহামতি
তারক সরকার বিরচিত 'শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত' গ্রন্থখানি সর্ব
প্রথম মুদ্রিত হইয়া   পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় কলকাতার দর্জিপাড়া
পাঁচনং ছিদাম মুদি লেনের 'শাস্ত্র প্রচার প্রেস' হইতে ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে(১৩২৩ বঙ্গাব্দ)। সেখান হইতে ২৭ বৎসর
পরে ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয় মহানন্দ হালদার মহাশয়
প্রণীত 'শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত' কাব্যগ্রন্থখানি ।
------  মূলতঃ  শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত এবং শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত এই দুইখানি গ্রন্থকে  মতুয়া
ধর্মের  আকরিক গ্রন্থ হিসাবে ধরা হয়।   
(মতুয়া
লেখকদের প্রতি হরি-গুরুচাঁদের প্রত্যাশা-)
১৯৪৩ খৃষ্টাব্দে
গুরুচাঁদ চরিত প্রকাশিত হইবার পুর্ব পর্যন্ত তারক সরকার, হরিবর সরকার
এবং অশ্বিনী গোঁসাই (বৈরাগী) সহ অন্যান্য বেশ কিছু ভাবুক কবি  এবং গীতিকার মতুয়া সাহিত্যের পত্তন করিলেও
গুরুচাঁদ চরিত প্রকাশিত হইবার পর হইতে মতুয়া সাহিত্যের কলেবর বিশষভাবে বৃদ্ধি
পাইতে থাকে ততদিনেহরি-গুরুচাঁদের আপনার জনেরা
সাবলীল হাতে কলম ধরিতে শিখিয়াছেন । তাই বহু লিপিকার মতুয়া সাহিত্যের উপরে তাঁহাদের
কলম চালাইতে শুরু করেন তাঁহারা কলম চালাইতে শিখিলেন ঠিকই, কিতু হায় ! গবেষণামূলক দৃষ্টিলাভ করিতে না
পারায়  তাঁহারা কেবল মাত্র বৈদিক সংস্কারাচ্ছন্ন
সাধারণ দৃষ্টিতে যাহা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা লইয়াই
পুস্তকাদি প্রণোয়ন করিতে শুরু করিলেন । 'হরিলীলামৃত'
প্রন্থকারের ইঙ্গিতপূর্ণ লিপিগুলির মর্মার্থ  উদ্ধার করিতে কেহই আত্মনিয়োগ  করিলেন না । তাঁহারা সকলেই বৈদিক ভাবনার
বশবর্তী হইয়া হরি-গুরুচাঁদকে লইয়া কেবলই অলৌকিক কাহিনী লিখিতে যত্নবান হইলেন ।
কিন্দু কেহই তাহার  অন্তর্নিহিত যুক্তি
-বিজ্ঞানেরর সূক্ষ্ম মৌলিক সত্যটিকে উদ্ঘাটন করিয়া পাঠকদের সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে
সচেষ্ট হইলেন না । ইহা আমাদের জাতির পক্ষে সব চাইতে দুর্ভাগ্যজনক চেষ্টাহীনতা ।
তাই মহা চিন্তাবিদ হরি-গুরুচাঁদের কর্মকুশলতা, জাতীয়া
মুক্তির সঠিক তৎপরতা, সমাজ ও ধর্মচিন্তার সার্বননীন
সত্যতা প্রচারের আলোকে আজিও সম্যক মূল্যায়ন হইল না। যে শাশ্বত সত্যকে ঘিরিয়াই ছিল হরি-গুরুচাঁদের ধর্ম আন্দোলন, এই আন্দোলন শুধু মাত্র পতিতদের মাঝেও পরিপূর্ণ মাত্রা লাভ করিলে
হরি-গুরুচাঁদের প্রত্যাশার অনেকটাই পূরণ হইতে পারিত । আজ পর্যন্ত পতিত সমাজের
সমস্ত লিপিকারেরাই চরম দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই মুক্তির জায়গাটিকে অবহেলা ও তাচ্ছিল্য
করিয়া এড়াইয়া যাইতেছেন । যে বৈদিক ধর্ম
এবং তাহার অবিজ্ঞানী মানবতা বিরোধী নয়ম
কানুন আমাদের পাতিত্যে নিমজ্জিত করিয়াছে, যে ধর্ম আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও
মান-মর্যাদার স্বর্ণ সিংহাসন হইতে অজ্ঞানতা এবং অমানবিক দাসত্বের বিষ্ঠামিশ্রিত
ধুলায় নামাইয়াছে এবং তথা হইতে উত্তরণের
সমস্ত পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিতে সর্বদা সচেষ্ট রহিয়াছে, তাঁহারা যেন তাহারই কাছে
দায়বদ্ধ হইয়া হাতে কলম তুলিয়া লইয়াছেন, এবং আমাদের কাছে চরম ঘৃণিত ও বিভীষিকাময়
সেই বৈদিক ধর্মকেই আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল, মুক্তির দিশারী ‘মতুয়াধর্মের’ মাঝে অভিনব
ভাবে প্রতিষ্ঠার দায়বদ্ধাতায় জীবন পণ করিয়া নামিয়াছেন ।
হায়রে
দুর্ভাগা জাতি, স্বর্ণথলি প্রাপ্তির
সন্নিকটে আসিয়া চক্ষু বন্ধ করিয়া হাটিতে শুরু করিলে ! যে হরি-গুরুচাঁদ তোমাদের
পাতিত্যে নিমজ্জিত হইবার একমাত্র কারণ হিসাবে বৈদিক ধর্মকেই শনাক্ত এবং দায়ী
করিলেন, তোমরা সেই হরি-গুরুচাঁদকে তাহাদের কাছে ঘৃণ্য সেই বৈদিক ধর্মের ধারক এবং
বাহক হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করিতে উঠিতে পড়িয়া লাগিয়াছ ! যাঁহাদের উদ্দেশ্য এবং
প্রচেষ্টা ছিল পতিতদের বৈদিক ভাবনা হইতে মুক্ত করিয়া অবৈদিক পথে হাঁটিতে শিখাইবেন
এবং প্রত্যাশা ছিল তাঁহাদের আপনার জনেরা তাঁহাদেরই নির্দেশিত অবৈদিক পথ ধরিয়া
হাঁটিতে হাঁটিতে একদা বেদাতীত ভারতে
পৌঁছাইয়া যাইবে এবং মতুয়াধর্মকে আশ্রয় করিয়া বেদাতীত ভারতবর্ষের
মূল ঐতিহ্য সত্য, প্রেম, পবিত্রতা ও সৌভ্রাতৃত্বের পুনর্জাগরণ ঘটাইবে, তাঁহাদেরই
তোমরা বৈদিক অবতার বলিয়া রঙ মাখাইয়া পালাগান করিতে শুরু করিলে ! যাঁহাদের ঐকান্তিক
স্বপ্ন ছিল সমস্ত ভারতবাসীকে ‘মতুয়াধর্মে’র আঙিনায় দাঁড় করাইয়া জাতপাত এবং শ্রেনী
বৈষম্যহীন সেই বেদাতীত ভারতবর্ষকে নবরূপে
গড়িয়া তোলা, তাঁহাদেরই কিনা জাতে তুলিবার জন্য তোমরা কত রকম ধূর্তামী
ও ফন্দি ফিকির করিয়া চলিয়াছ !
   যে অলৌকিক ভাবনাময় বৈদিক দর্শন- যাহা
মানুষকে সর্বদা অজ্ঞানতার পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত করিয়া রাখিতে চায়, যাহারা সেই বৈদিক দর্শনকে নস্যাৎ করিয়া বেদাতীত
ভারতের প্রাচীনতম অবৈদিক দর্শনকে উন্মোচন
করিয়া নব কলেবর দান করিলেন, তাঁহাদের সম্মুখে রাখিয়া তোমরা তাঁহাদের সৃষ্ট অবৈদিক
মতুয়াধর্মের মধ্যে অলৌকিক বৈদিক দর্শন প্রতিষ্ঠা করিতে চাও ! হায়রে লিপিকারের দল ! তোমরা আজিও হীনমন্যতা
কাটাইয়া উন্মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়াইবার
মত সাহস অর্জন করিতে পারিলে না ! সত্যকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে মেঘমুক্ত আকাশের
মত নির্মল হৃদয়ের অধিকারী হইতে পারিলে না
!তাই তো আজিও হরি-গুরুচাঁদের প্রত্যাশার একাংশও পূর্ণ হইল না। তাঁহাদের সংগঠিত
ধর্ম আন্দোলন আজিও শুধু মাত্র বৈদিক কারাগারের মধ্যেই হস্ত- পদ ছুঁড়িতেছে-
কারাগারের বন্দিদশা হইতে অবৈদিক মাটিতে পা ফেলিবার মত শক্তি সে আজিও অর্জন করিতে
পারিল না । তাই গুরুচাঁদ যে জাতিকে উপলক্ষ্য করিয়া ‘জাতি ধর্ম, জাতি মান’ এই মহান বাক্যটি ঘোষণা করিয়াছিলেন, যাহাদের পাতিত্য মোচন
করিয়া মান-মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য হরিচাঁদ ঠাকুর সত্য, প্রেম,
পবিত্রতার ধর্ম-অবৈদিক ’মতুয়া’ ধর্মের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, যাহাদের সমস্ত রকম
সামাজিক এবং ধর্মীয় শোষণ ও দাসত্ব হইতে মুক্ত করিবার জন্য এই সুমহান ধর্ম একান্ত
নিজস্ব করিয়া হাতে তুলিয়া দিয়াছিলেন, যাহাদের হরিচাঁদ ধর্মীয় ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ
করিয়া এক ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে তাহাদের মুখে একাত্মভূত হইবার
মহামন্ত্র এই ‘হরিবোল’ ধ্বনি তুলিয়া
দিয়াছিলেন, যাহাদের হাতে কলম তুলিয়া দিয়া গুরুচাঁদ চুপিসারে বুঝাইয়াছিলেন ‘বিদ্যা
চাই, ধন চাই, রাজকার্য চাই, প্রকাশ্য সমাবেশে
দাঁড়াইয়া চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্জনের লোভে উৎসাহিত করিবার জন্য যাহাদের উদ্দেশে
নির্ভীক কন্ঠে জানাইয়াছিলেন “পৃথিবীতে রাজশক্তিই
সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি ।
এই রাজশক্তির চাইতে
কোন শক্তিই বড় নহে । জাতি ধর্ম যাহা কিছুই তোমরা জাগাইতে চাও এই রাজশক্তিকে
করায়ত্ত করিতে পারিলে তাহার সব কিছুই সম্ভব হইবে ।” 
    এই রাজশক্তি অর্জনের পন্থা স্বরূপ গুরুচাঁদ
ঠাকুর যাহাদের উদ্দেশে নির্দেশ রাখিলেন “তোমরা সকলে
রাজনৈতিক দল গড়ার চেষ্টা করিও ।” যাহাদের জাগাইয়া তুলিবার জন্য গুরুচাঁদ
গ্রামে গ্রামে জাগরণী সভার প্রচলন করিয়াছিলেন, তাঁহার সেই স্বপ্নের জাতি কিন্তু
হায়, আজিও দুঃস্বপ্নের মহাঘোরে গভীর ঘুমে ঘুমাইয়া রহিয়াছে । ব্রিটিশ ভারত হইতে
বিতাড়িত হইল, ভারত নাকি স্বাধীনতা লাভ করিল । সকলে সেই স্বাধীনতাকে মনপ্রাণ ভরিয়া
উপভোগ করিবার জন্য যাহার যাহার মত করিয়া দেশকে ভাগাভাগি করিয়া লইল । কিন্তু
হরি-গুরুচাঁদের আপনজনেরা আরও গভীর হইতে গভীরতর পরাধীনতার গহ্বরে নিমজ্জিত হইল ।
যাহার ফলস্বরূপ তাহাদের অধিকাংশ
দাঙ্গাকবলিত হইয়া সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় পরাধীন পূর্ববঙ্গ ছাড়িয়া সাধীন ভারতে
প্রবেশ করিল এবং স্বাধীনতা উপভোগের নামে উদ্বাস্তু বা রিফিউজি পরিচয়ে সমস্ত জায়গায়
আজিও সমানে নির্যাতিত হইয়া চলিয়াছে । অপরিচিত পরিবেশে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়াও দুই
বেলা অন্ন জোগাড় করিতে পারিতেছে না,
অহর্নিশি সর্পাঘাতে মরিতেছে, ব্যাঘ্র এবং কুম্ভীরের পেটে যাইতেছে, সর্বোপরি রাজশক্তির
নিষ্ঠুর অমানবিক খেলায় মরিচঝাঁপি ও সিঙ্গুরের মত আরও কত স্থানে যে কাতারে কাতারে
মরিতেছে, কে তাহার হিসাব রাখে ! অন্যদিকে যাহারা এখনও পূর্ববঙ্গে রহিয়াছে, তাহাদের
দুর্দশার কথা ভাষায় ব্যক্ত করিবার নহে । এই পৃথিবীতে তাহাদের হইয়া কথা বলিবার মত
কেহই নাই । কিন্তু এই জাতির মধ্যে যাহারা কিছুটা
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া দুই বেলা অন্নের নিশ্চয়তা লাভ করিয়াছে, যাহারা গুরুচাঁদের
শিক্ষা আন্দোলনের ফলস্বরূপ লেখাপড়া শিখিয়া চাকুরীপ্রাপ্ত হইয়া এক প্রকার সাবলীল সাচ্ছন্দ্যের জীবনযাত্রায়
পৌঁছাইয়া গিয়াছে, নীতিগতভাবে জাতিকে টানিয়া তুলিবার দায়ভার তো তাহাদের উপরেই
বর্তায় । হরি-গুরুচাঁদ তো এমনই প্রত্যাশা রাখিয়া গিয়াছেন তাঁহার আপন জাতির শিক্ষিত
অর্ধশিক্ষিত সংগতি সম্পন্ন মানুষদের কাছে । ইহারা
হরি-গুরুচাঁদ সম্বন্ধে আদৌ ভাবে না এমন নহে, বরঞ্চ হরি-গুরুচাঁদ চর্চা ইহাদের
মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পাইতেছে । তথাপিও হরি-গুরুচাঁদ জাতির যে জাগরণ এবং উত্তরণ চাহিয়াছিলেন, সেই রকমের কোন
জাগরণ বা উত্তরোণের লক্ষণ ও অগ্রগতি আদৌ পরিলক্ষিত হইতেছে না কেন ? তাহা হইলে কি
হরি-গুরুচাঁদের চর্চা সঠিকভাবে হইতেছে না ? এই জায়গাকে একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা
করিলে এই সত্যটাই প্রকট হইবে যে, হরি- গুরুচাঁদের দর্শনকে আজিও আমরা সঠিকভাবে
উপলব্ধি করিতে পারি নাই । 
(1) তাই জাতির মঙ্গল
চিন্তার পরিবর্তে জাতির প্রতি দোষারোপ করিতেই আমরা বেশী অভ্যস্থ হইয়া পড়িলাম।
(2) দল গড়িবার
পরিবর্তে বিভিন্ন দলের পিছনে ছুটাছুটি করিতে শিখিলাম । 
(3) গুরুচাঁদের
জাগরণী সভার পরিবর্তে সুনিদ্রার নিমিত্ত ধর্মসভা করিতে শুরু করিলাম ।
(4) রাজশক্তি
শ্রেষ্ঠ শক্তি জানিয়া বিভিন্ন দলের নেতাদের চামচায় পরিণত হইলাম । 
(5) জাতি-ধর্ম জাগাইবার পরিবর্তে
জাতি-ধর্মকে অস্বীকার করিয়া পরিচয় গোপন করিতে শুরুকরিলাম । 
(6) হরিগুরুচাঁদের
‘মতুয়াধর্ম’কে বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে মিলাইয়া
জাতে তুলিবার মানসে ‘বিদ্যা চাই, ধন-মান চাই, রাজকার্য
চাই’কে শুকরের বিষ্ঠার সঙ্গে তুলনা করিতে আরম্ভ করিলাম। 
(7) হরিনামে
প্রেম প্রাপ্তির পরিবর্তে সংকীর্ণতার প্রাপ্তি ঘটিল ।
(8)
‘যে যারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর’- এই কথার অর্থ একমাত্র ঈশ্বরই
সকলের উদ্ধার কর্তা ভাবিতে শুরু করিলাম ।
    তাই জাতীয় উত্তরণের পরিবর্তে অধিকতর হীনতায়
নিমজ্জিত হইয়া পড়িতেছি । ‘অবৈদিক’ কথাটি মতুয়া ধর্মে কেবল মাত্র কথার কথাই হইয়া
রহিল; কার্যত বৈদিকতাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া
রহিলাম । তাই হরি-গুরুচাঁদের ধর্ম আন্দোলন চলন রহিত অবস্থায় স্থির বিন্দুতেই
দাঁড়াইয়া রহিল । যেটুকু দেখিয়া মতুয়াধর্মের অগ্রগতি বলিয়া মনে হয়, তাহা নিছকই ভ্রম; আসলে তাহা বৈদিক তথা
বৈষ্ণব ধর্মকেই আগাইয়া লইয়া যাইবার চিত্র, তাহার মধ্যে মতুয়া ধর্ম দর্শনের ছিঁটেফোটাও
পরিলক্ষিত হয় না । হায় রে আমাদের পোড়া কপাল ! মতুয়াধর্মের যে একান্ত নিজস্ব স্বতন্ত্র একটি দর্শন ও সংস্কৃতি
রহিয়াছে, যাহা যুক্তি-বিজ্ঞানের কাছে ভিত্তিহীন অলৌকিক বৈদিক দর্শন এবং অমানবিক
বন্য সংস্কৃতি লইয়াই মাতামাতি করিয়া চলিয়াছি । এই জায়গাটিকে যতদিন মতুয়ারা
সম্যকভাবে উপলব্ধি করিতে না পারিবে, ততদিন তাহাদের উত্তরণের সম্ভাবনা আছে বলিয়া আমার
মনে হয় না । যাহা দেখিয়া আমরা উজ্জ্বল সম্ভাবনা বলিয়া মনে করিতেছি তাহা নিছক রঙধনু
মাত্র, দূর হইতে দেখিতেই কেবল সুন্দর লাগে, বাস্তবে সেই রঙে আপনাকে রাঙাইয়া লওয়া
যায় না । 
(মতুয়া
লেখকদের ভূমিকা ও পরিনতিঃ )
   মতুয়াদের এই জায়গা হইতে তুলিয়া আনিবার
দায়-দায়িত্বের সিংহভাগই বর্তায় মতুয়া লিপিকারদের উপর । একমাত্র তাঁহারাই পারেন
মতুয়াধর্মের সঠিক দর্শন সকলের সামনে ব্যাখ্যা করিয়া সাধারণ মতুয়াদের
হরি-গুরুচাঁদের কাছে ঘৃণিত অলৌকিক বৈদিক ভাবনার জায়গা হইতে মুক্ত করিতে । 
   বর্তমান সময়ে পতিত সমাজে অন্যান্য যত অভাবই
থাকুক না কেন, লেখকের অভাব যে নাই এ কথা
বলিতেই হইবে । কারণ অজস্র লেখক অন্তহীন সদিচ্ছা বুকে ধারণ পূর্বক হাতে কলম তুলিয়া
লইয়াছেন, লিখিয়াও চলিয়াছেন অজস্র দুর্বোধ্য সব গ্রন্থাদি । স্বশ্রমে উপার্জিত অর্থ
ব্যয় করিয়া মুদ্রণ করিতেছেন সেই সব গ্রন্থ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত
সদিচ্ছার বশবর্তী হইয়া মূল্য না লইয়াই সেই
সব পুঁথিসকল স্বজাতিদিগের হস্তে তুলিয়া দিতেছেন । কিন্তু যে
উদ্দেশ্যে এতসব প্রয়াস, জাতির সেই জাগরণ
বা উত্তরণের ফলাফলের চিত্র খুবই হতাশাব্যঞ্জক । সঠিক তত্ত্ব এবং তথ্যবিহীন প্রায় সমস্ত গ্রন্থই
পতিতমুক্তির ক্ষেত্রে সঠিক কোন দর্শন ও দিগ্নির্ণয় করিতে না পারায় পাঠকমন্ডলী
একটি মস্ত বড় ধাঁধাঁয় পড়িয়া যান । এই সকল ধাঁধাঁয় নিপতিত হইয়া কেহ বা বিরক্ত হইয়া
বৈদিক আশ্রয়কেই শেষ আশ্রয়স্থল বলিয়া
মানিয়া লন। আবার কেহ বা কোন রকম চিন্তা ভাবনা না করিয়া যেমনটি আছেন তেমনটিই ভাল
মনে করিয়া ঘুম হইতে গভীর ঘুমে, তৎপরে মহাঘুমের মধ্যে কালাতিপাত করেন । 
   ফলে
গ্রন্থাকারের দীর্ঘদিনের পরিশ্রম এবং অর্থব্যয় সমস্ত অহেতুক হইয়া যায় । পতিতদের
জাগরণ তো দূরের কথা তাহাদের অগ্রগতিতে
ধাক্কামারিয়া খানিকটা পিছনের দিকে ঠেলিয়া দেয়। কারণ মতুয়াধর্মকে উপলক্ষ্য করিয়া এই
পর্যন্ত যত পুঁথিই লেখা হইয়াছে তাহার সমস্তই মতুয়াধর্মের স্বতন্ত্র পরিকাঠামো,
সঠিক দর্শন এবং নিজস্ব সংস্কৃতি জানাইতে পরিপূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হইয়াছে ।
মতুয়াধর্মের উপরে আজ পর্যন্ত এমন কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় নাই যাহার উপরে নির্ভর করিয়া নির্দ্বিধায় ঘোষণা করা যাইতে পারে মতুয়া
ধর্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধর্মীয় সত্ত্বা, অন্য কোন ধর্মের অনুকরণ বা অনুসরণ
তাহার মধ্যে নাই । এইখানে একটি তথ্য বোধ হয় উল্লেখ করা বিশেষ জরুরী ।
ভারতবর্ষে বলিলে ভুল হইবে, সারা পৃথিবীতে ধর্মীয় চেতনার মূলে দুইটি
ধারা প্রবাহিত- একটি বৈদিক, 
             এবং অপরটি অবৈদিক । 
যুক্তি-বিজ্ঞান
বহির্ভূত অলৌকিক কল্পনাপ্রসূত অন্ধবিশ্বাসের ধারাই হইতেছে বৈদিক ধারা এবং
যুক্তি-বিজ্ঞান সমর্থিত পরিশুদ্ধ জ্ঞান বা বৌদ্ধিক চেতনার ধর্মীয় ধারাই হইতেছে
অবৈদিক ধারা। বৈদিক চেতনা পৃথিবীর
শুভাশুভ উপেক্ষা করিয়া অলীক কল্পনার আশ্রয়ে অপার্থিব বা অতীন্দ্রিয় স্বর্গসুখকেই
কামনা করিয়া চলে এবং অবৈদিক ধর্মীয় চেতনা অলৌকিক কল্পনাশ্রয়ী অবিনশ্বর আত্মা,
ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক, পুনর্জন্মকে ঘৃণাভরে বর্জন করিয়া এই ধরিত্রী এবং তার জীবকুলের
মঙ্গল সাধনে আত্মনিয়োগ করে । 
    বৈদিকেরা জানে জগৎ মিথ্যা, একমাত্র ঈশ্বরই
সত্য এবং অবৈদিক চেতনায় যুক্তি-বিজ্ঞানের আলোকে অস্তিত্বের প্রমাণহীন ঈশ্বর ঈশ্বর
করিয়া জীবনের অমূল্য সময়কে নষ্ট না করিয়া চাক্ষুষ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্যের হিতার্থে আত্মনিয়োগ
করাই বিধেয় । ঐতিহ্যময় যে প্রাচীন ভারত একদা জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসন অলঙ্কৃত
করিয়াছিল সে কিন্তু এই অবৈদিক ধর্মীয় চিন্তা চেতনাকে আশ্রয় করিয়া। এই স্থলে একটি
কথাস্মরণে রাখা জরুরী যে, ভারতভূমে বৈদিক ধর্মের
অনুপ্রবেশ ঘটিয়াছে মাত্র সাড়ে তিন হাজার বৎসর পূর্বে । ভারতবর্ষের সেই
প্রাচীন স্বর্ণময় যুগে ছিল এই বৈদিক
ধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে যাহা দ্বাদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বঙ্গদেশে
সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। হরিচাঁদ ঠাকুর সেই ঐতিহ্যময় প্রাচীন ভারতের অবৈদিক ধারাকে
সযত্নে আহরণ করিয়া স্বীয় চিন্তা চেতনায় পরিশুদ্ধ এবং পরিপুষ্ট করিয়া এই অবৈদিক
মতুয়াধর্মের সৃষ্টি করিয়াছেন । তাই তো তিনি
বলিতে পারিলেন “ কুকুরের উচ্ছিষ্টও আমি খেতে রাজি,
কিন্তু বেদবিধি অর্থাৎ বৈদিক আচার কিছুতেই
আমি মানতে রাজি নই।” ঠিক আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে গৌতম বুদ্ধও এই অবৈদিক
বৌদ্ধিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হইয়া বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটাইয়াছিলেন । কিন্তু
বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর তাঁহার সেই যুক্তি-বিজ্ঞান আশ্রয়ী বিশ্বের
সর্বশ্রেষ্ঠ অবৈদিক ধর্মদর্শন বৌদ্ধধর্মের মধ্যেও বৈদিক কলুষতা প্রবেশ করিতে আরম্ভ
করিল । এই ভাবে বৈদিক অস্তিত্ব গলাধঃকরণ করিতে করিতে ভারতবর্ষ হইতে ইহা প্রায়
নিশ্চিহ্ন করিয়া ফেলিল । ফলে বর্তমান কালের বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে বুদ্ধের জগৎ হিতকর
অবৈদিক ধর্মদর্শন প্রতিষ্ঠার আর কোন সম্ভাবনা রহিল না। বুদ্ধের
সেই অপূর্ণ কামনাকে আপনার হৃদয়ে ধারণ পূর্বক হরিচাঁদ তাঁহার
ধর্মযাত্রা শুরু করিলেন এবং অবৈদিক দর্শনে সৃষ্টি করিলেন মতুয়াধর্ম
। যাহা
অলৌকিক কল্পনাশ্রয়ী বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ । তাই মহামতি তারক সরকার ‘বুদ্ধের  কামনা পরিপূর্ণ করিবার জন্য যশোমন্তের গৃহে
হরিচাঁদের জন্ম হইল’ এই কথাটি
লিখিবার রসদ জগাড় করিতে পারিয়াছিলেন । অতএব মতুয়াধর্ম সম্পূর্ণ অবৈদিক
মতাদর্শের ধর্ম, যে ধর্মের উৎস হইল মাঙ্গলিক জ্ঞান এবং পরিণতি হইল জগৎ হিতার্থে
পরিপূর্ণ বিজ্ঞান । অতএব এই সত্যে আমরা উপনীত হইতে পারিলাম যে, মতুয়াধর্ম হইতেছে একটি স্বয়ং
সম্পূর্ণ অবৈদিক ধর্ম ।
*অবৈদিক সংস্কৃতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান
করিতে হইবে*   
    
 এই
অবৈদিক চেতনায় আত্মা, ঈশ্বর, পুনর্জন্ম, স্বর্গ-নরক, দেবদেবী কোন কিছুর অস্তিত্ব
স্বীকৃত নয় । ফলে ইহাদের সংস্কৃতি জীবনে যাগ-যজ্ঞ, পূজা-পার্বণ, নাম সংকীর্তন
অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় কোন অলৌকিক ক্ষমতাকে কল্পনা করিয়া তাহার নিমিত্ত কোন আচার
অনুষ্ঠানই বিধেয় নহে । শুধু বিধেয় নহে বলিলে ভুল হইবে, এই সকল অনুষ্ঠান কঠোর ভাবে
নিষিদ্ধ । তাহা হইলে কি অবৈদিক মতে সঙ্গীতাদিসহ সমস্ত রকম অনুষ্ঠানই নিষিদ্ধ ?
অলীক কল্পনাশ্রয়ী অনুষ্ঠানাদি ছাড়া সকল প্রকার অনুষ্ঠানই করা যাইতে পারে । যে সকল
অনুষ্ঠান এই পার্থিব জগৎ সহ তাহার সমস্ত জীবকুলের মঙ্গল কামনা করে এবং তাহাদের
প্রতি হৃদয়ে প্রেম-ভালবাসার আধিক্য ঘটায়, মৃত্যুর পরে ভ্রান্ত স্বর্গসুখ বা
উৎকৃষ্ঠতম পুনর্জন্মের লোভ না দেখাইয়া সকলকে এই পার্থিব বিশ্বকে সৌভ্রাতৃত্বের
বন্ধনে আবদ্ধ করিবার জন্য জ্ঞান, ন্যায়, নৈতিকতা এবং একতাবোধের প্রয়োজন শিখায়,
পরস্পর পরস্পরের সুখ-দুঃখকে অনুভব করিবার মন্ত্র শিখায় । এই সকল ভাবনার পরিচায়ক ও
পরিপোষক সঙ্গীতাদি পরিবেশনের মাধ্যমে সকলে বিশ্বমানবতা বোধের প্রেমসাগরে ভাসিয়ে
থাকে এবং পরিশেষে সকলে একসঙ্গে বসিয়া ভোজন করে । এমনই তো হইবার কথা অবৈদিক
অনুষ্ঠানাদি । অতএব অবৈদিক সংস্কৃতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করিতে বাধা কোথায়
?  
প্রশ্ন
উঠিতে পার – হরিচাঁদ তবে সকলকে একসঙ্গে হরিনাম করিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর বোধ
হয় সকল মতুয়ারই জানা আছে । হরিলীলামৃতকার বলিয়াছেন ‘হরিনামে কোন পাপমোচন হয় না।
হরিনামে হৃদয়ে প্রেমের আবির্বাভ ঘটায় । এই প্রেমই অবৈদিক চেতনাপ্রসূত ।  এই ভাবনা লইয়াই হরিচাঁদ ঠাকুর হরিনাম করিবার
নির্দেশ দিয়াছিলেন । হরিচাঁদ ঠাকুর যদি অবৈদিক ধর্মের প্রবর্তকই হন অর্থাৎ তাঁহার
সৃষ্ট মতুয়াধর্ম যদি অবৈদিক ধর্ম বলিয়া স্বীকৃত হয়, তাহা হইলে উক্ত চিন্তা চেতনা
এবং সংস্কৃতিই ইহার উপজীব্য হইবার কথা ।
অবৈদিক চিন্তা-চেতনার মূল বিষয়বস্তু এই
জায়গাটিকে কোন দলিত অথবা মতুয়া লেখক আজ পর্যন্ত লেখার মাধ্যমে আলোকিত করেন নাই।
 অবৈদিক চিন্তা-চেতনার মূল বিষয়বস্তু এই
জায়গাটিকে কোন দলিত অথবা মতুয়া লেখক আজ পর্যন্ত লেখার মাধ্যমে আলোকিত করেন নাই ।
তাঁহারা সকলে মুখে বলিতেছেন মতুয়াধর্ম অবৈদিক ধর্ম, কিন্তু মতুয়া পুঁথিপত্রে এই
পর্যন্ত তাঁহারা যাহা লিখিয়া চলিয়াছেন তাহা অলৌকিক কল্পনাশ্রয়ী বৈদিক ধর্মের ভাবনা
চিন্তার বিষয়বস্তু এবং ক্রিয়া-সংস্কার ছাড়া আর কিছুই নহে । মতুয়া ধর্মের ধর্মীয়
ক্রিয়া-কর্মাদি সহ সম্পূর্ণ সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে স্বাতন্ত্র্যতার জায়গায় না
আনিতে পারিলে আচিরেই যে তাহা বৌদ্ধধর্মের মত বৈদিক ধর্মের উদরস্থ হইয়া যাইবে, এই
সত্যটিকে লেখক মহাশয়েরা কি বুঝিতে পারেন না ? বৈদিক ঘেঁষা হইয়া রহিলে যে উদ্দেশ্য
লইয়া হরিচাঁদ মতুয়াধর্মের সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহা কোন দিনই হইবে না। 
মতুয়াধর্ম প্রবর্তনের প্রয়োজন কেন
হয়েছিল ?
  
অতীব সহজ সরল সমীকরণ হিন্দু তথা বৈদিক ধর্মকে আশ্রয় করিয়া যদি দলিত এবং
পতিতদের সামগ্রিক উত্থানের সম্ভাবনা থাকিত, তবে হরিচাঁদ ঠাকুরই বা মতুয়াধর্মের
প্রবর্তন করিতে যাইবেন কেন ?  তিনি তো
হিন্দুত্বের ভিতর থাকিয়াই দলিত-পতিতদের মান-মর্যাদার জায়গায় উন্নীত করিতে পারিতেন । না, তাহা কখনও সম্ভব নহে বলিয়াই হরিচাঁদ ঠাকুর
পাতিত্যমুক্তির হাতিয়ার হিসাবে এই মতুয়াধর্মকে পতিতদের হস্তে তুলিয়া দিয়াছেন । সেই
মতুয়াধর্মকে যদি আমরা বৈদিক রঙে রাঙাইয়া তুলি তাহা হইলে সে কি আর আমাদের
মুক্তিদানে সমর্থ হইবে ? 
 গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া
স্বাভাবিকভাবে পাঠ করিয়া ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’
এবং ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’ গ্রন্থদ্বয় হইতে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যে পৌছানো সম্ভব
নহে ।
 এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন ।
মতুয়াধর্মের মুখ্য দুইখানা আকরিক গ্রন্থ ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ এবং ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ
চরিত’ যাহারা পাঠ করেন, স্বাভাবিক কারণেই তাঁহাদের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়,
মতুয়াধর্ম কি তাহা হইলে বৈদিক মতাদর্শের ধর্ম, নাকি বৈদিক মতাদর্শের বিরোধী কোন
অবৈদিক ধর্ম ? কারণ গবেষণার দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া স্বাভাবিকভাবে পাঠ করিয়া গ্রন্থদ্বয়
হইতে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যে পৌছানো সম্ভব নহে । শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত লইয়া
আবশ্য আমার কোন বক্তব্য নাই । কারণ জনশ্রুতিতে জানিয়াছি কোন এক বিশেষ ব্যক্তির
নির্দেশ  মাথায় রাখিয়া মাননীয় মহানন্দ
হালদার মহাশয়কে উক্ত গ্রন্থখানি লিখিতে হইয়াছিল ।  তবুও বলিতেছি এই গ্রন্থে গুরুচাঁদ ঠাকুর পতিতদের
উত্তরণের জন্য যত যত কর্মকান্ডের অবতারণা 
করিয়াছিলেন, অতীব সুন্দরভাবে কাব্যিক ছন্দ ও ভাষায় তিনি তাহার বর্ণনা
করিয়াছেন, কাব্যরসিক ও তথ্যপ্রেমিকদের কাছে ইহা খুবই সমাদৃত হইয়া থাকিবে সন্দেহ
নাই । কিন্তু মতুয়াধর্মের স্বতন্ত্রতা প্রমাণে ইহার ধর্ম-দর্শন ও সংস্কৃতির দিগ্নির্ণয়ে
গ্রন্থকার যে পুরোপুরি ব্যর্থ হইয়াছেন, সেই কথা বলিতেও আমার মনে কোন প্রকার সংশয়
নাই । এই জায়গাটি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পাঠকবর্গ অবশ্যই ধাঁধাঁয় পতিত হন । রামায়ণ
ও মহাভারতকে নিছক মহাকাব্য বলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যেমন ক্ষেপিয়া ওঠে তদ্রূপ
আমার এই উক্তি শুনিয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাননীয় মহানন্দ হালদার মহাশয়ের অন্ধভক্তের
দল ক্রোধান্বিত হইয়া উঠিবেন ইহাই স্বাভাবিক । কিন্তু একটি বিষয়কে উপলব্ধি করিলে
ক্রোধান্বিত হইবার কোন কারণই থাকিবে না । হরিচাঁদ
সৃষ্ট মতুয়াধর্মকে কেন্দ্র করিয়া যত যত গ্রন্থাদি রচিত হইহাছে এবং হইতেছে, সকলই এই
দুর্ভাগা পতিতদের মুক্তি ও উত্তরণের জন্য । সেই সামগ্রিক মুক্তি, আসিবে সেইদিন,
যেইদিন উহাদের উপর হইতে ধর্মীয় শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পুর্ণভাবে নির্মূল হইবে এবং
নীতিবোধ, যুক্তি-বিজ্ঞান ও সংঘশক্তিকে আশ্রয় করিয়া নিজেরাই যেইদিন মতুয়া দর্শন
সম্যকভাবে উপলব্ধি করিয়া আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম হইবে। সেই দিন কেবল ইহারাই যে মুক্ত
হইবে তাহাই নহে, সারা বিশ্বের দলিত নির্যাতিত মানুষদের জন্য মুক্তির দরজাও ইহারা
খুলিয়া দিতে পারিবে। জাতিকে সেই জায়গায় পৌঁছাইয়া দিতে পারে যুক্তি ও
বিজ্ঞানমনস্কতায় সৃষ্ট একমাত্র অবৈদিক মতুয়াধর্ম । মতুয়াধর্মের সেই জায়গাটিকে যথার্থ
বিশ্লেষণকরিয়া প্রতিটি পাঠককে নির্ভুল নিশানার উপলব্ধিতে পৌঁছাইয়া দিতে ব্যর্থ
হইলে গ্রন্থকারের গ্রন্থের সেই ব্যর্থতার দিকটি তো সমালোচিত হইবেই। হওয়াই
বাঞ্ছনীয়, কারণ মতুয়া গ্রন্থের এই হিজিবিজি দিকগুলোর যথার্থ পর্যালোচনা না হওয়ার
ফলে পরবর্তী লেখকেরাও তাঁহাদের লেখনি সঠিক পথে চালাইতে পারিতেছে না। তিক্তকে
তিক্তই বলিতে হয়। মিষ্ট বলিয়া তাহার তিক্ততাকে ঢাকিয়া রাখা যায় না এবং মঙ্গলকরও হয়
না। গিন্নিমার ভয়ে আঁচলের তলায় রাখিয়া খাওয়াইয়া খোকাকে বেশীদিক বাঁচাইয়া রাখা যায়
না। খোকাকে বাঁচাইতে হইলে গিন্নিমার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করিয়া আঁচলের তলা হইতে
খোকাকে বাহির করিতেই হইবে। এই কার্যটি যত সত্বর হইবে খোকার পক্ষে ততই মঙ্গল।
      *কোন গ্রন্থকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করিতে
হইলে
গ্রন্থকারের সামগ্রিক জীবন সম্বন্ধে ধারণা রাখা প্রয়োজন।*
কোন গ্রন্থকে সম্যকভাবে উপলব্ধি
করিতে হইলে গ্রন্থকারের সামগ্রিক জীবন সম্বন্ধে ধারণা রাখা প্রয়োজন ।  তাই ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’ গ্রন্থ সম্বন্ধে কিছু
লিখিবার পূর্বে মহামতি তারক সরকার মহাশয়ের মহতী জীবনালেখ্যের উপর কিছুটা আলকপাত
করিতে চাই । অতীব নির্মল পবিত্র মানবিকতা ও মহানুভবতায় মন্ডিত এক বিরল চরিত্রের
অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁহার জন্ম হইয়াছিল অলৌকিক কল্পনাবিলাসী হৃদয়ের এক বৈদিক
পরিবারে। তাহার পিতা পেশায় ছিলেন একজন কবিয়াল। তাঁহাকে পেশার কারণেই হউক কিংবা
মনের টানেই হউক, সর্বদাই বৈদিক পুস্তকাদি ঘাটিতে হইত। তাই শৈশব হইতেই তারক সরকার
মহাশয়ের এইসব বৈদিক পুস্তকাদি ও ভাবনা চিন্তার উপরে অনুরাগ জন্মায় এবং পারিবারিক
ভক্তি বিশ্বাসের মধ্য দিয়া অলৌকিকতার উপর আস্থাশীল হইয়া বাড়িয়া উঠেন। 
   
শৈশবকাল উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই তাঁহার পিতৃবিয়োগ ঘটে এবং তাঁহাদের সংসারে
আর্থিক অসংগতি শুরু হয়। এই আর্থিক  অসংগতির
সমস্ত দায়ভার আসিয়াপড়ে নাবালক তারকচন্দ্রের উপরে। ফলে সাংসারিক অভাব অভিযোগে তিনি
খুবই বিব্রত হইয়া পড়েন। পিতার কবিগানের সহযোগী দোহারপত্রের অনুরোধে নিতান্ত অপরিণত
বয়সেই তিনি পিতৃ-পেশাকে মানিয়া লইয়া  কবিগান
করিতে আরম্ভ করেন। এই কবিগানে তাঁহার পশার জমাইতে যথেষ্ট সময় লাগিয়াছিল। কথায় বলে
‘রসে বশে কবিগান’- অর্থাৎ কবিয়ালদের রস পরিবেশনের মধ্য দিয়া দর্শকদের বশে রাখিতে
হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই রস পরিবেশনে আদিরসের প্রাধান্যই থাকিত বেশী। সেই কালে কবিগানে
আদিরসের এমন প্রবল্য থাকিত যে, মহিলাদের কবির আসরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এই আদিরসের
উৎসই হইতেছে বৈষ্ণবসাহিত্য এবং বৈষ্ণবীয় সাধন ভজনের ধারা। তাই  বৈষ্ণবসাহিত্য এবং সাধন ভজনের ধারার সঙ্গে সমস্ত
কবিয়ালেরাই পেশাগত কারণে সম্পৃক্ত হইয়া পড়িত। তবে তারক সরকারের জীবনে ইহার কিছুটা
আধিক্য ঘটিয়াছিল। নবদ্বীপের বৈষ্ণব-পন্ডিতমন্ডলীর সঙ্গে তাঁহার মুখে ভাগবত এবং
চৈতন্যচরিতামৃতের ভক্তি গদগদ ব্যাখ্যা শুনিয়া তাঁহারা সকলেই মুগ্ধ হইয়া যাইতেন।
সেই কারণেই তাঁহাকে যথেষ্ট সমাদরও করিতেন। এইভাবে তারক সরকার তাঁহার জীবনের প্রথম
অর্ধাংশ কাটাইয়াছেন নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজের নিবিড় সান্নিধ্যে। অর্থাৎ
শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে জীবন গঠনের সঠিক সময়ই তাঁহার অতিবাহিত হয় বৈষ্ণবদের সঙ্গে
পরিপূর্ণভাবে বৈষ্ণবীয় ভাবনায়। কিন্তু হরিচাঁদের
দর্শন পাইবার পর হইতে তাঁহার সেই বৈষ্ণবীয় ভাবনায় ফাটল ধরিতে থাকে এবং হৃদয়ে বৈদিক
ও অবৈদিক দর্শনের একটা সংঘাত দানা বাঁধিয়া উঠে। আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলার মত আমৃত্যু
তাঁহার হৃদয়ে এই  সংঘাত স্থায়ীভাবে আসনলাভ
করিয়াছিল। তাই তাঁহার সৃষ্ট শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের সর্বত্রই বৈদিক অবৈদিকের
সংঘাত পরিলক্ষিত হয়। কখনও তিনি অবৈদিক ভাবাদর্শ ও ধর্ম-দর্শনকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে
বসাইয়া হরিচাঁদ ঠাকুরকে তাহার সর্বশ্রেষ্ঠ ধারক হিসাবে উপলব্ধি করিয়াছেন, আবার
পরক্ষণেই তিনি বৈষ্ণবীয় ভাবনার বশবর্তী হইয়া তাঁহাকেই রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গের ধারক
হিসাবে প্রকাশ করিতে দ্বিধা করেন নাই । বৈদিক ও অবৈদিক এই দুইটি ধারা যে
দুইটি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে এবং ইহাদের একবিন্দুতে  সহবস্থান যে সোনার পাথরবাটির মতই অবাস্তব, একের
উপস্থিতিতে যে অপরের বিলুপ্তি ঘটে, ভাবাবেগের আধিক্যে সরকার মহাশয় এই সাশ্বত সত্য
বিস্মৃত হইয়া কিছুটা গোলমাল করিয়া ফেলিয়াছেন মাত্র । কিন্তু তিনি যে হরিচাঁদের
ধর্ম-দর্শনের সংস্পর্শে আসিয়া অবৈদিক চিন্তা-চেতনার শ্রেষ্ঠত্বকে চরম ভাবে উপলব্ধি
করিয়াছিলেন তাহার   নিদর্শন গ্রন্থের সর্বত্র প্রচ্ছন্নভাবে তিনি
রাখিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাকে গ্রন্থ হইতে সঠিকভাবে উদ্ধার করিয়া উপলব্ধিতে
আনিতে পাঠকবর্গকে গবেষকের দৃষ্টি লইয়া অনুশীলন করিতে হয় ।
*গ্রন্থমুদ্রণের
অনুমতি দানের আলোচনা* 
তাই
তাঁহার গ্রন্থের পান্ডুলিপি মুদ্রণের অনুমতি লইবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট আনা
হইলে তিনি অনুমতি প্রদানে যথেষ্ট দ্বিধাবোধ করিয়াছিলেন। এই বিষয় লইয়া তিনি শশীবাবুর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরিয়া বহুমুখী আলাপ
আলোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত শশিবাবু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে  বুঝাইতে সক্ষম হইলেন যে, বর্তমান কালে তারক
সরকার ছাড়া পতিত সমাজে কলম চালাইবার মত আর কেহ নাই। অথচ আগামী প্রজন্মের মানুষদের
কথা ভাবিয়া গ্রন্থ প্রণয়ন ভীষণ জরুরী। গ্রন্থের মাধ্যমে মতুয়াধর্মের কোন
স্মারকচিহ্ন ধরিয়া রাখিতে না পারিলে আগামী দিনের মানুষেরা  মতুয়া আন্দোলনের কোন সূত্র খুঁজিয়া পাইবে না।
ফলে কোন প্রকার গবেষণার মাধ্যমেও আর মতুয়া ধর্ম-দর্শনের সঠিক তত্ত্ব ও তথ্য আহরণ
করা সম্ভব হইবে না। অতএব গ্রন্থখানিকে মুদ্রণের অনুমতি দেওয়াই ভাল । 
    শশীবাবু পান্ডুলিপির আদ্যোপান্ত পড়িয়া
ঠাকুরকে শুনাইয়াছিলেন এবং বিশ্লেষণ করিয়া  বুঝাইয়াছিলেন
যে, এই গ্রন্থে এমন যথেষ্ট সূত্রই রহিয়াছে, যাহাকে অবলম্বন করিয়া আগামী দিনের
মতুয়া গবেষক পরিপূর্ণ একটি অবৈদিক ধর্মের পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো অবশ্যই বাহির করিতে
পারিবেন। ভাবীকালে এই জাতির বুকে অনেক গবেষক লেখকের জন্ম হইবে, তাঁহারা এই
গ্রন্থের অবৈদিক ধোঁয়াকে অনুসরণ করিয়া অবশ্যই প্রজ্জ্বলিত অবৈদিক আগুন বাহির করিতে
সক্ষম হইবেন এবং তাহার দাহিকা শক্তিকে সম্যকরূপে কাজে লাগাইয়া ভারতের মাটি হইতে সমস্ত
অশুভ চিন্তার প্রতীক বৈদিক চেতনাকে ভস্মীভূত করিবেন। মহাত্মা শশীভূষণ ঠাকুরই এই
গ্রন্থের নামকরণ করিয়াছিলেন “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত”। 
মহাত্মা শশীভূষণের
হরিলীলামৃত নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি প্রত্যাশা।
 তাঁহার প্রত্যাশা ছিল এই গ্রন্থকে ভিত্তি করিয়া
পরবর্তী কালে লেখকেরা হিমালয় সদৃশ প্রাসাদ গড়িয়া তুলেবেন, যাহারা শীর্ষচূড়ায় পতপত
করিয়া উড়িতে থাকিবে ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রা’র প্রতীক অবৈদিক মতুয়াধর্মের নিশান।
বিশ্বের সমস্ত নরনারী বিষ্ময়ে হতবাক হইয়া তাকাইয়া দেখিবে গৌরবময় বেদাতীত ভারতের
পুনরুত্থান।
মহাত্মা শশীভূষণের পরবর্তী প্রজন্মের
প্রতি প্রত্যাশায় 
পানি ঢেলে দিলেন লেখকেরা । 
    কিন্তু হায়! বাস্তবে এ কি দিখিতেছি ?
হরি-গুরুচাঁদ এবং শশীভূষণ ঠাকুরের সেই প্রত্যাশার  লেখকেরা অবৈদিক অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিবার নামে
বৈদিক অগ্নিতেই সর্বক্ষণ ঘৃত ঢালিয়া চলিয়াছেন। আর তাহার অশুভ লেলিহান শিখা মাহামতি
তারক সরকারের রড়ই উপলব্ধির ধন অবৈদিক ধোঁয়াকে ধরাশায়ী করিয়া তাহার উপরেও দাউদাউ
করিয়া ধবংসাত্মক শিখা বিস্তার করিতেছে। প্রতি বৎসরই মতুয়া ধর্ম-দর্শনের উপরে বহু
লেখকের বহু বহু লেখা মুদ্রিত হইতেছে-লেখকদের কেহ বা স্বঘোষিত মতুয়া আচার্য, কেহ বা
মতুয়া গোঁসাই আবার কেহ বা গবেষক। তাঁহারা প্রত্যেকেই বৈদিক ঢাক গলায় ঝুলাইয়া আপনার
তালে আপনি নাচিয়া চলিয়াছেন। আবার কেহ বা কোন ব্রাহ্মণয়বাদী দলের শিকার হইয়া
তাহাদের নির্দেশিত তালে বাজাইয়া চলিয়াছেন। আর তাঁহাদের ঢাকের তালে পতিত সমাজের
সাধারণ মানুষেরা মাতাল হইয়া ‘মতুয়া’ ধর্মাচরণের নামে অলীক কল্পনাশ্রয়ী বৈদিক
ধর্মের অনুকরণ করিয়া চলিয়াছেন এবং তাঁহারা নিজেদের অজান্তেই প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়
‘মতুয়া’ ধর্মকে তিল তিল করিয়া বিলুপ্তির পথে ঠেলিয়া দিতেছেন। সাধারণ মানুষেরা যে
কোন লেখককেই অতীব জ্ঞানী লোক বলিয়া মনে করেন এবং তাঁহাদের পরিবেশিত যে কোন তত্ত্ব
বা তথ্যকে অভ্রান্ত সত্য বলিয়াই মানিয়া লন। এই সমস্ত সহজ সরল ভক্তপ্রাণ মানুষদের
কাছে যদি ভুল ইতিহাস ও তথ্য তুলিয়া ধরা হয়, অথবা মতুয়াধর্মের নাম করিয়া
হরিচাঁদপ্রদত্ত অবৈদিক ধর্ম-দর্শনের বিরোধী হয়, তাহা তো অবোধ শিশুর হস্তে তীব্র
বিষের পাত্র তুলিয়া দেওয়ার মতই বটে- মৃত্যু তাহার অনিবার্য।
   জাতিকে এই হীন পাতিত্য ও বৈদিক দাসত্ব হইতে মুক্ত
করিতে হইলে কি করিতে হইবে?
তাই
জাতিকে এই হীন পাতিত্য ও বৈদিক দাসত্ব হইতে মুক্ত করিতে হইলে অন্তরে শুধু সদিচ্ছা রাখিলেই
চলিবে না, মগজে ধারণ করিতে হইবে সঠিক ইতিহাস, নির্ভুল তথ্য এবং অবৈদিক ধর্মের
মৌলিক দর্শন। সমস্ত রকম অলৌকিক সংস্কারমুক্ত, যুক্তি-বিজ্ঞানাশ্রয়ী মানুষ হিসাবে
নিজেকে পরিপূর্ণভাবে গড়িয়া তুলিবার পর কলমের গুরুত্ব সঠিকভাবে উপলব্ধি করিয়া হাতে
কলম ধরিতে হইবে। এই কলমের উপরই নির্ভর করিতেছে জাতিরমুক্তি। “হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত”-এ গুরুচাঁদ ঠাকুর এবং শশীবাবুর কথোপকথনে
জানিয়াছি- 
                           “গুরুচাঁদ
বলে তারে শোন বাপ শশী।
                            এ জাতি তুলিতে পারে একমাত্র মসি।।
                            মসি চালনায় যদি হয়ে যায় ভুল।
                            কোনদিনও এ জাতি পাইবে না কূল।।
                                  **    **    **    **     ** 
                          তাই বলি ভুল তত্ত্ব শেখে যদি জাতি।
                          কোনদিনও কাটিবে না এ আঁধার
রাতি।।”
লীলামৃতের
পরে এমন কোন গ্রন্থ রচিত হয়েছে কি যেটাতে হরিচাঁদের
ধর্ম-দর্শনের সুনির্দিষ্ট কোন দিক খুঁজিয়া পাওয়া যায়? 
     মহামতি তারক সরকার বিরচিত ‘শ্রীশ্রীহরি
লীলামৃত’ গ্রন্থের ভিতরের কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ লেখা ছাড়া আজ পর্যন্ত অন্য কোন কবি বা
লেখকের এমন কোন পুঁথি প্রকাশিত হয় নাই, যে পুঁথিতে হরিচাঁদের ধর্ম-দর্শনের
সুনির্দিষ্ট কোন দিক খুঁজিয়া পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত এমন একখানি মতুয়া-গ্রন্থও আমি
খুঁজিয়া পাই নাই, যেখানে মতুয়াধর্কে পরিপূর্ণ স্বতন্ত্রতায় প্রতিষ্ঠিত করিয়া তাহার
নিজস্ব  অবৈদিক কৃষ্টি-কালচার প্রকাশিত
হইয়াছে। মতুয়া ধর্ম-দর্শনের উপর আজ পর্যন্ত এমন একখানি পুস্তকও লেখা হইয়াছে
বলিয়া আমার জানা নাই, যেখানে “কুকুরের উচ্ছিষ্ট খেতে হলে
খাব, বেদবিধি শৌচাচার তবু না মানিব”- হরিচাঁদের এই স্বঘোষিত বাক্যের বৈধতা
প্রমাণিত হইয়াছে। হরিচাঁদের ধর্মবিপ্লবের উপরে এমন একটি পুঁথিও লেখা
হইয়াছে বলিয়া আমার মনে হয় না, যাহাকে অবলম্বন করিয়া হরিচাঁদের আপনার জনেরা তাঁহারই
ইপ্সিত ‘সব পেয়েছি’র মুক্তাঙ্গনে পৌঁচাইতে পারে। 
    মতুয়া ধর্ম-দর্শনের উপরে এই পর্যন্ত যত যত
পুঁথিই বাহির হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি পুঁথিই কম-বেশী বৈদিক অলৌকিকতাকে আশ্রয়
করিয়া মতুয়াধর্মের নামে বৈদিক তথা হিন্দুধর্মের চিত্র ও সংস্কৃতিই অঙ্কন করিয়াছে।
সেখানে আদৌ মতুয়াধর্মের অবৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির কোন চিত্র অঙ্কিত হয় নাই। তাই
মতুয়াধর্ম আজিও নিজস্ব সঠিক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া স্বতন্ত্র কোন ধর্মীয় রূপ
পরিগ্রহ করিতে পারে না ‘আমি একজন মতুয়া। মতুয়াইজ্ম আমার ধর্ম।’
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম-দর্শনের জনক হওয়া সত্বেও মতুয়াধর্মের এই শোচনীয় অবস্থার
জন্য দায়ী একমাত্র মতুয়া ধর্ম-সাহিত্য। এই মতুয়া সাহিত্যই মতুয়ার ধর্মাকাশে ঘোর
অমানিশার অন্ধকার সৃষ্টি করিয়াছে।
এই
হতাশার ঘোর অমানিশাকে বিদীর্ণ করিয়াবার জন্য এমন কোন গ্রন্থ কি বর্তমানে রচিত
হইয়াছে? 
     তবে এই হতাশার ঘোর অমানিশাকে বিদীর্ণ করিয়া
গত ২০ জুলাই, বুধবার ২০০৫ এ শ্রদ্ধেয় গবেষক শ্রীমণীমোহন বৈরাগী মহাশয়ের ‘অস্পৃশ্য ও অনগ্রসর জাতির মুক্তি আন্দোলনে হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুর ও
মতুয়াধর্ম’ পুঁথিখানি আত্মপ্রকাশ করে এবং মাত্র দুই
বৎসরের ব্যবধানে পরপর তাঁহার আরও দুই খানি পুস্তক ‘বৌদ্ধ ও
মতুয়াধর্মের আলোয় অবৈদিক ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি' ও ‘অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্মভাবনা’
প্রকাশিত হয়। পুস্তক তিনখানি পুঙ্খানুপুঙ্খাভাবে একাধিকবার পাঠ করিয়া বিশেষভাবে
বুঝিতে পারিলাম যে, এতদিনে মূলনিবাসী দলিত পতিতদের মুক্তির দিগন্ত উন্মোচিত হইল।
ইতিহাস ও সত্যের আলোকে বৈদিক ও অবৈদিক ধর্মের পার্থক্য এবং স্বরূপটিকে সম্যকভাবে
উপলব্ধি করিলাম। ঠিক এই সময়ে আমার হাতে আসিল ডাঃ মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস(মনু)-এর
লেখা দুইখানি পুঁথির পান্ডুলিপি। প্রথম পুঁথি “হরিচাঁদ
তত্ত্বামৃত” নামে একখানা কাব্যগ্রন্থ এবং
দ্বিতীয়টি হইল প্রত্যক্ষ ঘটনাবলিকে উপলক্ষ্য করিয়া যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে
সত্যকে নির্দেশ করিয়া গুরুচাঁদ ঠাকুরের কিছু উপদেশাবলি “গুরুচাঁদের প্রত্যক্ষ শিক্ষা” নামে একখানা
ছোট্ট পুঁথি। গুরুচাঁদ ঠাকুর সাধারণ  মানুষদের
যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও যুক্তির আলোকে আলোকিত করিবার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট থাকিতেন
তাহারই এক সুন্দর চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে এই ছোট্ট পুস্তকটিতে । সঙ্গে সঙ্গে অলৌকিক
ভাবনা চিন্তা যে সত্যের উপলব্ধিতে সর্বদা বিঘ্ন ঘটায়, এই সত্যও প্রকাশিত হইয়াছে।
“হরিচাঁদ তত্ত্বামৃত” গ্রন্থখানি সঠিকভাবে অধ্যয়ন করিলে, একজন মতুয়া, বৈষ্ণবীয়
ভাবধারাসহ বৈদিক ধর্মের অন্যান্য শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মতুয়াধর্মের মূল পার্থক্য
সকল তথা মতুয়াধর্ম এবং বৈদিকধর্ম যে পরস্পর বিপরীতমুখী এই মহাসত্য সম্যকরূপে
বুঝিতে পারিবেন। সেই সঙ্গে বৈদিক হিন্দুধর্মের সমস্ত রকম প্রভাব হইতে মুক্ত হইয়া
অবৈদিক মতুয়াধর্মের সঠিক দর্শন ও সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করিয়া ‘মনের
বাঁধন’ ছিড়িয়া নিজস্ব তাগিদেই হরি-গুরুচাঁদের ধর্মান্দোলনে আত্মোৎসর্গ করিতে বাধ্য
হইবেন, ইহাই আমার ঐকান্তিক বিশ্বাস। 
                                           ------------------------------------------ 

সকল সুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মতুয়াদের কাছে অনুরোধ এই post পড়ার জন্য।
ReplyDeleteসকল সুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মতুয়াদের কাছে অনুরোধ এই post পড়ার জন্য।
ReplyDelete