হরিলীলামৃতের বিজ্ঞান ভাবনা
মতুয়া অনুরাগী সাথীরা,
সবাইকে আমার আন্তরিক সুভেচ্ছা জানাই। বর্তমানে আমরা একটা শতাব্দী
অতিক্রান্তের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। কি সের শতাব্দী? সেটা হচ্ছে “শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত প্রক”শ"-এর শতাব্দী। অর্থাৎ বাংলা ১৩২৩ সাল এবং ইংরাজী ১৯১৬ সালে এই মতুয়া আকর গ্রন্থের প্রকাশ
হয়েছিল অনেক পাহাড় প্রমান বাধাকে উত্তির্ণ করে।
একটা প্রবাদ আছে- জঙ্গলের বাঘও চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকায়, তাকে
কেউ অনুসরণ করছে কি না সেটা জানার জন্য।
আমরা লীলামৃত প্রকাশের এই একশ বছরের কধ্যে কখনও পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি কি
বা পর্যালোচনা করেছি কি? যে, হরিচাঁদ ঠাকুরের যে মতাদর্শ ও দর্শন
লীলামৃতের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে তার কতটা আমরা বাস্তবায়িত করতে পারলাম?
কতটা পারলাম না? কেন পারলাম না? এই দর্শনকে প্রচার প্রসার করার জন্য কি করতে হবে? কিভাবে করতে হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু “হরি-গুরুচাঁদ আম্বেদকর চেতনা মঞ্চ” সেই লীলামৃতের operation-এর কাজে ব্রতী হয়েছে,
লীলামৃতের প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। তার জন্য আয়োজক ও সংগঠনের কর্মকর্তাদের কে আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
লীলামৃতের অগ্রগতিকে আরও মশৃণ ও সুদূর প্রসারী করার জন্য আমাকে subject দেওয়া হয়েছে-“হরি লীলামৃত-এর বিজ্ঞান ভাবনা”।
(আমি যে কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে যাচ্ছি, সেটা
আপনারা কতটা গ্রহন করবেন বা করবেন না সেটা অবশ্যই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে যে কথা আলোচনা করতে যাচ্ছি সেটা আশা করি, ধৈর্য সহকারে শুনতে চেষ্টা করবেন। )
বিজ্ঞান কাকে বলে? যে বিষয় বা বস্তু বা যে কোন কিছুকে যদি যুক্তি-তর্ক ও
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক বলে বিবেচনা করা হয় সেটাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
পরিবর্তনশীল বলে গ্রহণ করা হয়, তাকেই আমরা বিজ্ঞান বলে
থাকি।
তাহলে হরি লীলামৃতে এমন কি বিজ্ঞান ভাবনা আছে যেটা আমরা যুক্তি-তর্কের
মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারি যে এটা বিজ্ঞান সঙ্গত?
হরিচাঁদ ঠাকুরের মতাদর্শ ও দর্শন এবং মানুষের কর্মজীবনকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে
তুলে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার জন্য মহাকবি তারক সরকার এই গ্রন্থের অবতারনা
করেছেন। এই গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই হরিচাঁদ ঠাকুর এক
নতুন ধর্মের স্থাপন করেছেন। যার নাম দিয়েছেন “মতুয়া ধর্ম”। তো এই মতুয়া ধর্ম কি সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র ধর্ম নাকি অন্যকোন ধর্মের পরবর্তী
রূপান্তর?
লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই- কবি লিখেছেন-
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ।।
আবার এটাও বলা হয়েছে- পূর্বে ছিল মুনিগণ করিতেন ধ্যান।
এবে সেই ধ্যান হয় জ্ঞানেতে বিজ্ঞান।।
অর্থাৎ বুদ্ধের কামনা বা ইচ্ছাকে পূর্ণ করার জন্য হরিচঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহন
করেছেন। তাহলে আমরা বলতে পারি মতুয়া দর্শন হলো বৌদ্ধ দর্শনের এক
পরিস্রুত রূপ বা পরবর্তী সংস্করণ।
আমরা জানি মহামানব গৌতম বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন । অর্থাৎ জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কারণ বুদ্ধ কথার অর্থ হচ্ছে-‘জ্ঞান’ Knowledge.
কিন্তু গৌতম বুদ্ধের পূর্বে আরো ২৭ জন বূদ্ধ ছিলেন। এই জ্ঞান প্রাপ্ত বুদ্ধদেরকে মুনিও বলা হত। এখানে কথা হচ্ছে- এই মুনিগন কারা ? এখানে মুনিগন হচ্ছেন গৌতম বুদ্ধ পূর্ব্বর্তী পূর্ব
বুদ্ধরা, যাদের মুনি বলা হয় । এখানে একটি কথা আমাদের বিশেষ ভাবে জানা দরকার যে, আমরা কথায় কথায় বলি যে, মুনি ঋষি । এই মুনি এবং ঋষি কি এক না আলাদা । যারা অবৈদিক ভাবনা বা বিজ্ঞান ভাবনা বা যুক্তিসংগত ভাবনার প্রসার করেন
তাঁরা হচ্ছেন ‘মুনি’ । আর যারা বৈদিক ভাবনা বা অবিজ্ঞান ভাবনা বা অযৌক্তিক বা অলৌকিক ভাবনার
প্রসার করেন তারা হচ্ছেন ‘ঋষি’।
তাই তাঁরা যে ধ্যান করতেন, সেই ধ্যানের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানের উদ্ভব হত।
সূক্ষ্ম সনাতন ধর্মঃ-
লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই মতুয়া ধর্ম হচ্ছে ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’। অর্থাৎ হরিচাঁদের মূল দর্শন হচ্ছে ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’। এই সনাতন ধর্ম কথাটিকে আবার ‘সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম’ কেন বলা
হলো? কারণ
সনাতন ধর্ম হচ্ছে একটা বিজ্ঞান ভাবনা। গৌতম বুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই সনাতন
ধর্ম ছিল একটা বস্তুবাদ। অর্থাৎ আমরা যাকিছু প্রত্যক্ষ করি
সেটাই বস্তু। এর বাইরে বস্তুবাদীরা অন্য কিছু ভাবতে পারেন না।
আবার যারা ভাববাদী তাদের বলা হয় আত্মাবাদী। তাদের কাছে শরীরের বাইরেও শরীর সংক্রান্ত অন্য কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে। যার নাম দিয়েছেন আত্মা। তাই এদের বলা হয় আত্মাবাদী। গৌতম বুদ্ধ কিন্তু এই বস্তুবাদ
এবং আত্মাবাদ দুটোকেই অস্বীকার করেছেন। তাই বৌদ্ধ দর্শন হচ্ছে অবস্তুবাদী ও
অনাত্মাবাদী। আর হরিচাঁদ ঠাকুরও সেই একই পথ প্রদর্শন করেছেন। প্রশ্ন
হচ্ছে সেটা কিভাবে? কারণ পূর্ব বুদ্ধদের যে ভাবনা বা দর্শন বা ধর্ম ছিল সেটা সনাতন ধর্ম
দর্শন। পূর্ব বুদ্ধদের এই সনাতন ধর্ম দর্শন হচ্ছে একটা বিজ্ঞান
ভাবনা। পঞ্চ ভুতের ভাবনা। ক্ষিতি, অপ, তেজ,
মরুত ও বোম হচ্ছে পঞ্চ ভুত। পূর্ব বুদ্ধদের ভাবনা ছিল পৃথিবীতে যাকিছু তৈরী হয়েছে তার উৎপত্তি এই
পঞ্চভুত থেকে হয়েছে। সনাতন কথাটিকে একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করত আমাদের
পূর্ব ভারতের মানুষেরা । তারা পঞ্চ নয় চার ভুতকে অর্থাৎ ‘বোম’ কে বাদ
দিয়ে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ কে
সনাতন আখ্যায়িত করতেন। সৃষ্টির আদি থেকে এই চার ভুত আছে
ও থাকবে। পৃথিবীর সবকিছু এই চার ভুতের সংমিশ্রণে তৈরী। এটা সাস্বত। তাই এটা বিজ্ঞান ভাবনা। সমস্ত সৃষ্টি একটা প্রবাহমান অবস্থায় চলছে। প্রতিক্ষণে তার রূপান্তর ঘটছে। Transfer হচ্ছে। পিতা-মাতার থেকে সন্তানের জন্ম। মাতৃগর্ব ছাড়া সন্তানের জন্ম হয় না। এটা একটা বিজ্ঞান ভাবনা। তবে এই জীবন প্রবাহের জন্য বিশেষতঃ
চার ভুতের দরকার। সেটা হচ্ছে- ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ। এখানে বোম অর্থাৎ আকাশ বা মহাশূন্যকে জীবন সৃষ্টির উপাদান হিসাবে গ্রহন
করা হয়নি। ছোটবেলার আমি আর বর্তমানের আমির মধ্যে কিন্তু বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এক বস্তু একই অবস্থাতে স্থির নেই। এটাই অবস্তুবাদের ধারণা।
আর অনাত্মবাদ হচ্ছে- শরীরের বাইরে বা জীবনের মৃত্যুর পরে আত্মা বলে কোন
কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই। তবে মাতা-পিতার প্রজননের ফলে যে
সন্তানের জন্ম হচ্ছে এটাকে বৌদ্ধ দর্শনে জন্মান্তরবাদ বলা হয়েছে। অর্থাৎ মাতা-পিতার পরবর্তী প্রজন্ম থেকে যাচ্ছে সন্তানের মাধ্যমে। একের লয় এর সঙ্গে সঙ্গে অন্যের উৎপত্তির প্রক্রিয়া শুরু এটাকে বলা হচ্ছে
অনাত্মবাদ। আর বুদ্ধের জন্মান্তরবাদ।
লীলামৃতেও আমরা দেখতে পাই- তুমি স্থুল আমি সূক্ষ্ম, উভয়ে অভিন্ন।
দেহ আত্মা মোরা দোহে মূলে নহে ভিন্ন।।
লীলামৃতও দেহের বাইরে আত্মার অস্তিত্ত্বকে মানেনা। দেহ আর আত্মা একই। অতএব বৌদ্ধ দর্শন যেহেতু সনাতন ধর্ম
দর্শনেরই বিবর্তীত রূপ, আর মতুয়া দর্শনও সনাতন দর্শনেরই বিবর্তিত রূপ। একারণে মতুয়া ধর্মকে সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম বলা হয়।
তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার যে, বর্তমানে আমরা যে সনাতন ধর্মের কথা শুনতে পাই সেটা
কিন্তু এই পূর্ব বৌদ্ধদের সনাতন দর্শনকে চুরি করে তাদের সনাতন ধর্ম বলে প্রচার
করছে। সনাতন কথাটি এক অর্থে যেমন বিজ্ঞান ভিত্তিক দর্শন, তেমনি এটা সুপ্রাচীন দর্শনও।
কিন্তু বৈদিকবাদীরা প্রচার করে তাদের ধর্ম হচ্ছে সনাতন ধর্ম। সেটা কি সম্ভব? কারণ বেদ তৈরীর পরে বৈদিক ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। আর বেদ তৈরী হয়েছে প্রায় তিন হাজার বছর আগে। তাই এটা পূরাতন নয়। কারণ এর বহু পূর্বে পুর্ব বৌদ্ধরা এই
বিজ্ঞান ভিত্তিক সনাতন ধর্ম দর্শনের প্রবর্তক।
বেদকে আস্বীকারঃ-
বেদের কথা যখন এল তখন আমরা দেখেনি হরিচাঁদ ঠাকুর এই বেদ সম্পর্কে কি বলেছেন?
কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলেও খাই।
বেদবিধি
শৌচাচার নাহি মানি তাই।।
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে হরিচাঁদ ঠাকুর বেদকে কুকুরের উচ্ছিষ্ট থেকেও কেন
নিকৃষ্ট বলে মনে করেছেন? কোন কিছুর উপর মানুষের ঘৃণা তখনই জাগৃত হয়, যখন
সেটা থেকে মানুষের অষেশ ক্ষতি সাধন হয়। তাহলে বেদ থেকে কি ক্ষতি হয়েছে? বেদে মানুষের মধ্যে বর্ণভেদ দেখানো হয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষকে পশুর থেকেও নীচু স্তরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর অন্য এক শ্রেণীর মানুষকে ভগবান তুল্য উৎকৃষ্ট হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের ধর্ম নয়, জন্মকেই তার কর্ম নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এইভাবে যে গ্রন্থে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টির কুটিলতা নিহীত আছে তাকে
সেজন্য নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন। সেই বেদের যে বিধান বা আইন তাকে তিনি
ঘৃণাভরে প্রত্যাক্ষান করেছেন । তাই এখানে এই কথার মধ্য দিয়ে আমরা
মানবিকতা ও যুক্তিবাদের জয়গানের জন্য সংগ্রামী বাণী শুনতে পাই। তাই এটা একটা বাস্তব বিজ্ঞান ভাবনার প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি।
পূর্ণব্রহ্ম
লীলামৃতে আমরা দেখতে পাই হরি ঠাকুরকে পূর্ণব্রহ্ম বলে আখ্যায়িত করা
হয়েছে। এখানে কি কোন বিজ্ঞান ভাবনা লুকায়িত
আছে ? না কি অন্য কিছু?
ব্রহ্মবাদ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টির রহস্য। এটা একটা বিজ্ঞান ভিত্তিক মতমাদ। বৈদিকবাদীরা যে ব্রহ্মের কথা বলে সেই ব্রহ্ম আর ভারতীয় সনাতনী
ব্রহ্ম কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। বৈদিকবাদীদের ব্রহ্ম হচ্ছে বুজরুকী। আর সনাতনী ব্রহ্ম হচ্ছে- জ্ঞান। যুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক সত্যকেই ব্রহ্ম বা জ্ঞান বলা হয়। সেটা সকল মানুষের মধ্যে সুপ্তভাবে অবস্থান করে। এই ব্রহ্মের বিকাশ ঘটানোর জন্য সত্যনিষ্ঠ যুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক সঠিক
শিক্ষার প্রয়োজন। যুক্তি ও বিজ্ঞান ভিত্তিক সঠিক শিক্ষার দ্বারা মানুষ
যদি সুপ্তরূপে বিরাজমান দেহের মধ্যের সেই বিশেষ শক্তি অর্থাৎ ব্রহ্মত্ব বা জ্ঞানকে
অর্জন করতে পারেন তবেই তিনি সেই আলোয় আলোকিত হয়ে বৈদিকবাদী অত্যাচারী মানুষের
অত্যাচারের হাত হতে প্রকৃত মুক্তির রাস্তা দেখাতে পারেন। সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন ঠাকুর হরিচাঁদ । তাই তিনি বৈদিকবাদীদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি করার জন্য নতুন
ধর্মের ও দর্শনের প্রনয়ন করেছিলেন। বৈদিকবাদীদের ব্রহ্ম যে সম্পূর্ণ
অলীক সে বিষয়ে আমরা ‘গুরুচাঁদ চরিত’-এ দেখতে পাই গুরুচাঁদ ঠাকুরের পুত্র শশীভূষণ যখন
ব্রহ্মধর্ম গ্রহনের জন্য তাঁর কাছে অনুমতি চাইলেন তখন তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুরুচাঁদ
ঠাকুর বললেন-
বন্ধ চোখে যে
ব্রহ্মকে দেখিবারে চাও।
সে ব্রহ্ম
পারেনা কিছু এই কথা লও।
ব্রহ্ম নহে অন্য
কোথা ব্রহ্ম নিজ দেহে।
সেট আছে ঘরে তব
নহেত বাহিরে।
অর্থাৎ শরীরের বাইরে কোন ব্রহ্ম নেই। সেটা নিজের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আছে। তাকে জ্ঞানের প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে উদ্ভাসিত করা দরকার। এখানের এই কথায় মতুয়া ধর্মের ব্রহ্ম ভাবনা হচ্ছে চরম বিজ্ঞান ভাবনার
প্রকাশ।
এতক্ষণ আমরা অনেক গুরু-গম্ভীর বিজ্ঞান ভাবনার আলোচনা করলাম। এবার কিছুটা সরলভাবে আরও লীলামৃতের বিজ্ঞান ভাবনার প্রকাশ করা যাক-
বন্দনাঃ
লীলামৃতের শুরুতে আমরা দেখতে পাই বন্দনা দিয়ে শুরু করা হয়েছে।
লীলামৃতের প্রথমেই বন্দনা অংশের যে পদ তা মতুয়াদের সকলেরই জানা। যে কোনো মতুয়া অনুষ্ঠান বা উৎসবে প্রথমেই এই পদটি গীতিকারে পরিবেশিত হয়। এতকাল যত ধর্মগ্রন্থ বা কাব্য রচিত হয়েছে তাতে অলৌকিক দেবদেবীর বন্দনা করা
হয়েছে। কিন্তু কবি তারক সরকার এখানে কোনো দেবদেবীর বন্দনা না
করে মানুষ, মনুষ্যত্ব ও
ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তাদের জয় গান করেছেন। হরিচাঁদ, কৃষ্ণদাস, বৈষ্ণব দাস, গৌরী দাস, এবং স্বরুপ দাস এই পাঁচ ভাইয়ের জয়
ধ্বনি করেছেন।
চিরকালীন বন্দনার যা রীতি তাদে দেব-দেবী হল নত মস্তকে প্রণাম করা। কবিগানেই শুধু নয় সমস্ত গানেই আসর বন্দনার যা রীতি তাতে দেব-দেবী ও
গুরুজনদের প্রণাম ও স্মরণ করে সূচনা হয়। কিন্তু কবি তারকচন্দ্র সরকার বন্দনা অংশে কোনো দেব-দেবী দূরে থাক-
কাউকেই প্রণাম করেননি বা ভজনা করিয়ার কথা বলেন নি। বরং মানবাত্মার জয় ধ্বনি দিয়ে যেন যাত্রা শুরু। সেই জয় ধবনি মানবের, মানবতাবাদের। মানুষের জয়ধ্বনি যদি বন্দনা বলে স্বীকৃতি পায় এবং গ্রন্থের খন্ডে খন্ডে, তরঙ্গে তরঙ্গে সেই জয় সূচক ধ্বনি
বস্তুবাদী মানবতাবাদকে সূচিত করে। নিজেকে মনুষ্যবর্গের দাস করার মত এবং সেই মানবে লীন হওয়ার মত দুঃসাহসী কথা
বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম। কবি যে সকল ব্যক্তিবর্গের জয়ধ্বনি দিয়েছেন, তাতে হরিচাঁদ আর ‘একক শক্তি’ রইল না বরং একতাবদ্ধ শক্তিতে পরিণত
হল। আধুনিক কালের সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য হল public Service প্রত্যেক উচ্চপদস্থ
ব্যক্তিই আসলে public Servant-তাই তারা public এর মধ্যেই নিজেদের সেবকের ভূমিকায় নিমগ্ন থাকতে চান। কবি তারকচন্দ্র সরকারের এই বোধ ও উপলব্ধি আধুনিক কবি সমাজের এক বড় বিপ্লব।
তাই হরি লীলামৃত কেবল মতুয়া ধর্মকেন্দ্রিক গ্রন্থই নয়, বরং বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব মুখর। যাতে মানুষকে মানুষের কৃতিত্ব ও গৌরব গাথা প্রকাশের ও স্বীকৃতির স্থান আছে। গ্রন্থটি পড়তে পড়তেই মনে হতে থাকে যে, এমন গ্রন্থটি কেবল চ্যালেঞ্জ হিসাবেই লেখা যায়। এই চ্যালেঞ্জ চিরকালীন প্রথা, রীতি ও শৈলীর বিরুদ্ধে। চিরকালীন সমাজ সংস্কৃতি, মানসিকতা সব কিছু থেকে আলাদা করে এমন গ্রন্থের সূচনা করা যায়। হরিচাঁদের জীবন বলতে কেবল একক জীবন তাঁর কলমে লিপি বদ্ধ হয়নি। ঠাকুর হরিচাঁদ একজন রক্ত মাংশের মানুষ। কবি লীলামৃতে যেভাবে হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন–কর্ম-ধর্ম-শিক্ষার বর্ণনা করেছেন
সেখানে আমরা দেখতে পাই হরিচাঁদ ঠাকুরের বিচারধারা ও ভাবনা চিন্তা অন্যের থেকে
সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে সময়োপযোগী বিজ্ঞান ভাবনার
প্রকাশ দেখতে পাই । সেই ভাবনাগুলোকে আমরা এইভাবে বর্ণনা করতে পারি। সে গুলি হোল- বাল্য জীবনঃ-
হরিচাঁদের বাল্য জীবনে অলস পরগাছা বৈরাগীদের বিরোধীতা করা। বালক হরিচাঁদ বৈষ্ণবদের আচার আচরনকে একটুও পছন্দ করতেন না ।
তাই বৈষ্ণবরা স্নান করতে গেলে বালক হরিচাঁদ তাদের ঝোলা গুলো উল্টিয়ে দিত ।
এতে তার বাবা রেগে গিয়ে তাকে শাস্তি দিলে সে
কিন্তু বলত বৈষ্ণবরা ভন্ড ওদের চলে যেতে বল ।
পিতৃ-কোলে থাকি হরি ক্রোধ করি বলে ।
ভন্ডবেটা বৈরাগীরা দূরে যারে চলে ।।
হরিচাঁদ ঠাকুর তথা কথিত স্কুল শিক্ষা গ্রহন করতে না পারলেও সমাজের ধর্মীয়
কুসংস্কার তাঁকে ব্যথিত করে তোলে ।
হরিচাঁদ
ঠাকুর ব্রাহ্মণদের ও বৈষ্ণবদের দূরভী সন্ধিকে খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তাই তিনি
আবার স্পষ্ট ঘোষণা করলেন-তিন বেলা স্নান করে কে হয় বৈরাগী।
স্নান করে
পান কৌড়ি সেও কি বৈরাগী।
এরকম একই উদাহরন কিন্তু আমরা গৌতম বুদ্ধের এক মহিলা
ভন্তের কাছ থেকে পাই। ব্রাহ্মণ বলছে- গঙ্গায় স্নান করলে সব পাপ মুক্ত হয়ে যাবে।
তখন ঐ মহিলা ব্রাহ্মণের কাছে জানতে চান- মাছ তো জলে বাস করে। তাহলে জলের সব মাছ বা
জলজ প্রাণী তোমার মত ব্রাহ্মণের থেকে বেশী পবিত্র নয় কি?
হরিচাঁদ
ঠাকুর যৌবনের
প্রারম্ভে তারঁ
উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে উপলবদ্ধি করলেন সমাজের ব্রাহ্মণী যাতা কলের বন্ধন। সেই বন্ধন
থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য তৈরী করলেন যুক্তি সংগত ধর্মের যার নাম দিলেন-“মতুয়া ধর্ম।” একটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক জিনিস
গুলোর প্রয়োজন সেই জিনিস গুলো হ’ল- খাদ্য,বস্ত্র,বসবাসের
স্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,কর্মের অধিকার। আর জীবনকে
সুন্দরভাবে গড়ার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম নীতি। যে নিয়ম-নীতির নাম দেওয়া যেতে পারে কোন ধর্ম। হরিচাঁদ ঠাকুর তাই মাবনুষকে
সুন্দরভাবে জীবন যাপনের নিয়ম নীতির নাম দিলেন “মতুয়া ধর্ম।” যেখানে কোন অলৌকিকতার প্রশ্রয় নেই। সেখানে কোন অযৌক্তিক আচার বিচারের স্থান নেই। সেখানে সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবনা চিন্তার প্রবাহমানতা।
তাই আমরা দেখতে পাই-
জীবে
দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা
ছাড়া আর যত সব কৃয়া ভ্রষ্টা।
এখানে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসাকে তিনি অগ্রাধীকার দিয়েছেন। এই
মানুষের প্রতি নিষ্ঠা ভিন্ন সব কিছুকে তিনি ভ্রষ্ট বলে উল্লেখ করেছেন।
জাতিভেদ প্রথার বিলুপ্তিঃ-
হরিচাঁদ ঠাকুরের ধর্মযুদ্ধে যে ধর্মের প্রতিষ্ঠা সূচিত হল তাতে কোনো উঁচু
জাতি, নিচুজাতি, অস্পৃশ্যতা, ভেদাভেদের কোনো স্থান নেই। জাতি বৈষম্যকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। তাঁর ধর্ম বিপ্লবে সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বিষয়টিই প্রাধান্য
পেয়েছে। মানুষই দেবতা। মানুষের অসম্মান, অমর্যাদা যে ধর্মে প্রকটিত সেই
ধর্মকে তিনি প্রকৃত ধর্ম বলে স্বীকার করেননি। তার ধর্মযুদ্ধের মূল কথাই হল- “নরাকারে ভূমন্ডলে যতজন আছে।
একজাতি
বলে মান্য পাবে মোর কাছে।।
মানুষে
মানুষে বল ভিন্নজাতি কোথা।
নরজাতি একজাতি ভেদ করা বৃথা।।”
শিক্ষাঃ- বৃহত্তর পিছিয়ে পড়া যে জনসমাজ তার
সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা আমরা লক্ষ্য করি সেটা হচ্ছে- ‘শিক্ষা’ । এক মুহূর্তে সর্বজনীন শিক্ষার জন্য আমরা মাথা খুঁড়ছি এবং আমরা দেখছি, মানুষের মুক্তির সবচেয়ে বড় অস্ত্র
হচ্ছে সর্বজনীন ‘শিক্ষা’। ধর্মের মোহ এবং অশিক্ষা এই দু’টো অজগর সাপ যখন মানুষকে বেষ্টন করে থাকে তখন তার সামনে
তাকাবার দৃষ্টি আর প্রসারিত হয় না । সেই জগদ্দল পাথরকে সরানোর কাজ শুরু
করেন হরিচাঁদ ঠাকুর । শিক্ষা বিনা তো কোনো বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব হতে
পারেনা। আর ধর্মীয় কুসংস্কারই মানুষকে ডুবিয়ে রাখে অযৌক্তিক
অন্ধকারের জগতে । তিনি প্রথমেই এই দুটি স্থানে আঘাত করেন । তিনি তাঁর জীবদশায় এই শিক্ষার আন্দোলকে প্রসারিত করতে পারেননি। তাই এই
গুরুদায়িত্ব তিনি অর্পণ করেন স্বীয় পুত্র গুরুচাঁদের উপর । আর গুরুচাঁদ ঠাকুর
ঘোষণা করেন-খাও বা না খাও তাতে ক্ষতি নেই।
ছেলে মেয়েকে শিক্ষা দাও এই আমি চাই।
ছেলে মেয়েকে দিতে শিক্ষা।
প্রয়োজনে করিবে ভিক্ষা।
আসলে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। তাই এখানে তাঁর চরম
বাস্তবতার ও বিজ্ঞান ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে।
মরাগরু বাঁচানোঃ-
মতুয়াদের মুখে মুখে একটা কথা শোনা জায় যে, হরিচাঁদ ঠাকুর মরা গরুকে বাঁচিয়ে
তুলেছিলেন। অন্ধ বিশ্বাসী মতুয়ারা ভক্তির প্রবলতায় যুক্তিকে কখন আশ্রয় দিতে চায়
না। যার জন্য এই ভ্রম। তারা লীলামৃতের এই লাইনটি কখন দেখেছেন কি -বাঁচিবে না ঐ গরু
প্রায় মরে গেছে । -এই প্রায় মরাকে সম্পুর্ণ মরা বানিয়ে প্রচার করা হয়। হরিচাঁদ ঠাকুর প্রকৃতির
মানুষ। তাই তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধ কিছু করতে পারেন না। এখানে কিন্তু কোন অলৈকিকতার
স্থান নেই।
ঈশ্বরঃ-
হরিচাঁদ
ঠাকুরের সবচেয়ে যুগান্তকারী যুক্তিবাদী দার্শনিক যুক্তি হল-
‘যে যাহারে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর।’
এমন নৈর্ব্যক্তিক, নিস্পৃহ, বস্তুবাদী দার্শনিকের মত কথা কবি যে
ভাবে ব্যক্ত করেছেন সেই যুগে দাঁড়িয়ে তা সত্যিই ধর্ম বিপ্লব বলা যায়। কারণ এখানে
চরম সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে কোন অলৌকিক দেব-দেবীর স্থান নেই। জীবনের চলার
পথে যিনি পথ প্রদর্শক হন। যাঁর কঠিন
সংগ্রামের ফসল জনগণের মঙ্গলের জন্য
মুক্তির পতাকা বহন করে আনে, তিনিই হবেন একমাত্র
ঈশ্বর। আর মতুয়াদের সেইপ্রধানতম ঈশ্বর
হচ্ছেন হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুর। আর পরবর্তীতে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল,
বাবা সাহেব আম্বেদকর। কারণ এদেঁর কঠোর সংগ্রামের ফলে আজ সম্পূর্ণ
না হলেও অনেকটা মুক্তির স্বাদ অর্জন করতে পেরেছে।
গৃহ ধর্ম গৃহ কর্মঃ-
হরিচাঁদের জীবন চরিতের ভাষ্যকার তারক চন্দ্র সরকার লিখেছেন-
“মালা-টেপা
ফোটা কাটা জল-ফেলা নাই।
হাতে কাম, মুখে নাম, মন-খোলা
চাই।।
সহজ
গার্হস্থ্য ধর্ম সর্বধর্ম সার।
গৃহীকে
বিলাতে মুক্তি শ্রীহরি আমার।।”
ঠাকুর হরিচাঁদ যে মুক্তির বাণী সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারিত ও প্রসারিত
করতে চেয়েছেন সে মুক্তি বৈরাগ্যের মধ্যে মুক্তির সন্ধান নয়, সে মুক্তি সহজ গার্হস্থ্য ধর্ম সকল
ধর্মের সার, গৃহী জীবনের মধ্যে মুক্তির সন্ধান।
চিকিৎসা বিষয়ঃ-
আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে চিকিৎসা ব্যাবস্থার প্রচলন ছিল ভীষণ কম । কিন্তু রোগ ব্যাধী তো লেগেই থাকত । কারণ তখনকার জল-জঙ্গল- জন্তুর সঙ্গে
সংগ্রাম করা লোকেরা কোন পুথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না । তাই চলত গ্রাম্য চিকিৎসা বা যাকে বলা হ’ত কবিরাজি চিকিৎসা । কিন্তু সেই সময়ে আমরা যদি হরিচাঁদ ঠাকুরের চিকিৎসা পদ্ধতি গভীরভাবে
বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই যে, সেই পদ্ধতি কিন্তু বর্তমান বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতির সঙ্গে মিলে যায় । আমরা লীলামৃতের “রাখাল বিশ্বনাথের জীবন দান’’ কাহিনিতে
দেখতে পাই যে, বিশ্বনাথের বিসুচিকা ব্যাধি বা পাতলা
পায়খানা হওয়ায় সে মরণাপন্ন অবস্থা পড়ে আছে । বাকী লোকেরা তার অন্তিম অবস্থার অপেক্ষায় আছে । কিন্তু হরিচাঁদ ঠাকুর নাটুর কাছ থেকে বিশের এই অবস্থার কথা জানতে পেরে
ছুটে জান। তিনি বিশেকে প্রথমে অন্ধকার ঘরের থেকে বের করে বাইতে
এনে বিশেকে কিছুটা পান্তা ভাত লবন দিয়ে মাখিয়ে জলটা খাইয়ে দেন । অতিরিক্ত পাতলা পায়খানা হলে শরীরের জল ও লবন কমে যায় । যার ফলে জীবনী শক্তি অতি দ্রুত কমতে থাকে । বিশে ঐ লবন মিশ্রিত পান্তা ভাতের জল খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে একটু সুস্থবোধ করে। তখন তাকে কিছুক্ষণ পর পর ঐ পান্তা ভাত খাওয়ানো হলে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে ।
হরিচাঁদ ঠাকুরকে হীরামন পাগলের রামরূপ দর্শন কাহিনীর বিশ্লেষণ ।
মাতা কাশীশ্বরী যখন হরিচাঁদকে ফুল দিয়ে সাজাচ্ছিলেন সেই সময় রাস্তা দিয়ে
থোড়া বাঁশ কাঁধে করে একদল কিষাণ যাচ্ছিলেন । সেই দলে রাউৎখামারের হীরামনও ছিলেন । হরিচাঁদ ঠাকুরকে এই ভাবে ফুলে ফুলে সজ্জিত দেখে আবাক হয়ে যান হীরামন । তাঁর মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কবিগানের কাহিনীতে বর্নিত রামচন্দ্রের কথা । তাই হীরামন তাঁর মনের মন্দিরে ভাবনার আবেশে ভাসতে থাকেন । তিনি হরিচাঁদকে সাক্ষাৎ রামরূপে দর্শন করেন । আর মুহুর্তের মধ্যে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুর্ছা যান ।
এই ভাবনা ও তার থেকে মুর্ছা যাওয়া হচ্ছে এক প্রকার Hallucination. যাকে মতিভ্রম বা
দৃষ্টিভ্রম বলা হয় । বিজ্ঞানে এ বিষয়ে যুক্তিসংগত
ব্যাখ্যাও আছে ।
তো হীরামন মূর্ছা গেলে সকলে তড়িঘড়ি করে তার চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে
কিছুটা সম্ভিত ফেরালে, হীরামন উঠে বসেন । কিন্তু সেই ভাবনার ঘোর কাটতে না
কাটতে হরিচাঁদকে বলেন 'ঠাকুর একটু আগে আমাকে যে রাম রূপ দর্শন করালেন সেটা আবার দেখান ।'
হরিচাঁদ জানেন ভক্তের কাছে ভক্তিই প্রবল হয় । আর সেই ভক্তিতে কোন যুক্তির ছায়াও থাকেনা । তাই তিনি এমন উপায় বের করলেন যেটা শুনে ভক্তও সন্তুষ্ট হবেন আবার ভক্তকে
বা অন্যদের মিথ্যা কথাও বলা হবেনা যেটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ । তাই তিনি হীরামনকে বললেন-
প্রভু কহে
তোরে ওরে হীরামন ।
যদি কেহ কারু
কিছু করে দরশন ।।
অসম্ভব দেখে
জ্ঞানী প্রকাশ না করে ।
শুনিলে
সন্দেহ হয় লোকের অন্তরে ।।
হরিচাঁদ হীরামনকে বোঝালেন যে, জ্ঞানী মানুষ অসম্ভব কিছু দর্শন করলে সেটা তখন প্রকাশ
করেনা । কারণ সেটা তো কেউ মেনে নেবেনা , উল্টা তাকে জ্ঞানী না ভেবে লোকে পাগল
ভাববে । তাকে উপহাস করবে । তাই সেও যেন যা দেখেছে সেটা প্রকাশ না করে ।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গ্যালিলিওর কথা স্মরণ করতে পারি । তিনি যখন আবিষ্কার করেছিলেন যে সূর্য স্থির আছে । পৃথিবী সূর্যের চার পাশে তার নিজের কক্ষ পথে ঘুরছে । একথা তখন কেউ মানতে পারেননি । যার পরিনতি স্বরূপ তাঁকে কঠিন শাস্তি
ভোগ করতে হয় ।
হরিচাঁদ ঠাকুর কিন্তু এটুকুই বলে বা হীরামনকে জ্ঞানী বলেই থেমে থাকলেন না । কারণ তিনি জানেন যে সাধারণ কথায় তখন হীরামন শান্ত হবার নয় । তাই তিনি হীরামনকে আরও উদাহরন দিয়ে বোঝাল শৈল মাঝে
অগ্নি থাকে জানে সর্বলোক ।
ঠুকনি
লৌহাঘাতে জ্বলে উঠে সে পাবক ।
তেমনি পাথর
মাঝে রহিয়াছে দেখিতে
পাইবা পুন
যদি থাকে কিন্তু সে
আগুন যদি জ্বালাইয়া লয় ।
শীলা কাষ্ঠ
পুড়ে যায় কিছু নাহি রয় ।।
হরিচাঁদ বোঝান যে, পাথর দেখে তো বোঝা যাবেনা যে তার মধ্যে আগুন আছে । সেটাকে বোঝা বা জানার জন্য ঐ পাথরের সাথে অন্য পাথরের ঘর্ষণ করতে হবে
উপযুক্ত পরিনামে । তেমনি লোহার মধ্যেও একই ভাবে আগুন আছে, কিন্তু সেই আগুন বার করতে হলে ঠুকনির
সাহায্য নিতে হবে । আবার তুমি দেখ দু'খন্ড শুষ্ক কাঠ যেটার দ্বারা আগুন
জ্বালানো হয় । কিন্তু এই কাঠের মধ্যেই যে আগুন লুকিয়ে আছে সেটাও জানা
যাবে যখন দু'খন্ড কাঠকে প্রবল বেগে ঘর্ষণ করা যাবে আর এই ঘর্ষণের ফলে যে আগুন
জ্বলবে সেই আগুন কিন্তু তখন সমস্ত কাঠকেই পুড়িয়ে দেবে । এভাবে প্রখর বিজ্ঞানবাদী যুক্তি দিয়ে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর প্রিয় ভক্তকে
বোঝান । এবং তাকে আত্মস্ত্ব করেন যে সে যা দেখেছে সেটা আর
প্রকাশ করবে না ।
সবশেষে বলা যায় যে, এই গ্রন্থটি শুধু মাত্র মতুয়া সমাজ ও সাহিত্য নয়, বাংলা সাহিত্যে ও সমাজ বিজ্ঞানে এক অভিনব সংযোজন । এই আলোচনা এখানে সমাপ্ত করার আগে আপনাদের কাছে আবেদন হরিচাঁদ ঠাকুরের
বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রকাশ এটা নিয়ে আপারা তাঁকে অন্ধ শ্রদ্ধা-ভক্তি না করে তাঁকে
নিয়ে অলৌকিকতার পিছনে না ছুটে,তাঁর আদর্শ ও কর্ম কে অনূসরণ করার চেষ্টা করুন। কারণ তিনি তো বলেছেন-
আমাকে না ডাকলে চলবে। আমার প্রদর্শিত পথে ও মতে চললে আমি তার সেই কর্মের মধ্য দিয়ে
প্রকাশিত হব । আর লীলামৃতে তো নিষেধাজ্ঞা আছে-
না মানিবে
শিব দুর্গা কৃষ্ণ প্রেমে বাম।
হরিনাম না
লইবে বলি মরা নাম।।
আবার এটাও বলেছেন- যাগ-যজ্ঞ তন্ত্র-মন্ত্র দীক্ষা শিক্ষা পূজাপার্বণ
কোন
কিছুর নাহি প্রয়োজন।
হরিনাম
মহামন্ত্র জান সর্বজন।।
_____________________________
সবগুলি খুব বাজে লেখা | প্রথমত লেখকের, বিজ্ঞান কাকে বলে,এ সম্পর্কে কোনো ধারনাই নেই | যুক্তি-বিজ্ঞান ও সাধারন অর্থে বিজ্ঞান এর কী পার্থক্য তাও উনি জানেন না |
ReplyDeleteকুকুরের উচ্ছিষ্ট ইত্যাদি এর ব্যাখ্যা করতে গেলে গল্পটির উল্লেখ প্রয়োজন | উনি তা না করে অত্যন্ত কদর্য নিম্নরুচির একটি ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছেন | হরিলীলামৃত আদ্যন্ত অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের উল্লেখে পূর্ণ একটি বই | এটির সাথে বিজ্ঞান বা যুক্তিবিজ্ঞান এইসবের কোনো সম্পর্ক নেই |