Skip to main content

মতুয়াদের দিশা ও দশা। লেখক-জগদীশচন্দ্র রায়





মতুয়াদের দিশা ও দশা 
লেখক-জগদীশচন্দ্র রায়
প্রবাদ আছে ‘ডুবন্ত মানুষ বাঁচার জন্য খড়-কুটোও ধরে ভাসতে চায়।’ যদিও তখন তার বোঝার ক্ষমতা থাকে যে, ঐভাবে ভেসে থাকা যায় না।
    দেশ ভাগের বলি এই মতুয়া সম্প্রদায় কিন্তু তবুও ঐ খড়-কুটোর ভরসা করে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। যত সংখ্যক বেঁচে ফিরেছে। হয়তোঃ ততধিক ফিরতেও পারেনি। তবুও মানুষের ধর্মই হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। সংগ্রাম করা।
    সেন রাজাদের কোপে পড়ে যারা নিজ ধর্ম(বৌদ্ধ ধম্ম) থেকে পতিত হয়েছিল। সেই পতিতদের উদ্ধারের কাজে লিপ্ত হন প্রায় পৌনে ২00 বছর আগে (১৮৩০সালে) এক অজ পাড়াগায়ের যুবক। তিনি তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে উপলব্ধি করেন সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেনীর মানুষদের প্রতি উচ্চ শ্রেনীর মানুষদের পশুর মত ব্যবহার করার কারণ।  
    তাই তিনি ঘোষণা করেন- আমি বেদ-বিধি শৌচাচার মানিনা।
আর তোমরা –খাও বা না খাও সন্তানদের শিক্ষিত কর।
তোমরা- কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ, কোথায় বৈষ্ণব ।
  এরা- স্বার্থ বশে অর্থ লোভী যত ভন্ড সব ।।
আমার কাছে- মানুষে মানুষে কোন ভেদা ভেদ নেই।
তোমরা এই ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষের প্রতি নিষ্ঠা রাখো।
তোমাদের কোন ভগবান নেই। যে তোমাদের উদ্ধার করবে, তাকেই শুধু ভগবান মনে করবে। অন্য কোন অলৌকিকতাকে নয়।
তোমাদের মুক্তি পাওয়ার জন্য কোন সাধন ভজনের দরকার নেই।
তোমরা অলস হয়ে না থেকে কর্ম কর। পতিত জমি আবাদ করে ফসল ফলাও। অর্থাৎ হাতে কাম কর। আর যে আদর্শ ও নিষেধাজ্ঞা আমি তোমাদের সুন্দর জীবন যাপনের জন্য পালন করতে বলছি, সে গুলোর নাম লও। অর্থাৎ এই গুলো নিজে পালন কর এবং জন-জন-বহুজন পর্যন্ত প্রসারিত কর
     আর তোমাদের অন্যকোন ধর্ম পালন করতে হবে না। আমি যেটা বলি ও করি তোমরা সেটা মেনে চল। তাহলে তোমরা সামাজিক পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হবে। আমি তোমাদের মুক্ত করব। আর তোমাদের সমস্ত বিড়ম্বনা কে ঘুচিয়ে প্রভাতের সূর্যকে উদ্ভাসিত করব। হ্যা, আমি হরিচাঁদ। আমি তোমাদের মুক্তির দিশারী।
আমার আদেশ- নিষেধ ও কর্ম কুশলতা আর নীতি বা আদর্শই তোমাদের সকলের মতবাদ হবে। যার নাম হবে মতুয়াবাদ । আর আমার এই মতবাদ পালনকারীর ধর্ম হবে “মতুয়া ধর্ম।”  
    আর একটা কথা আমি আমার জীবদ্দশায় তোমাদের জন্য সব কর্ম হয়তোঃ করে যেতে পারব না। তোমরা আমার সন্তান তুল্য। আমি তোমাদের পিতা তুল্য। সেই পিতার অধিকার নিয়ে আমি তোমাদের আদেশ দিচ্ছি- গুরুচাঁদ হবে তোমাদের নেতা। তার কর্মের মধ্য দিয়েই তোমরা আমার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবে।   
    তোমরা তোমাদের নেতাকে শ্রদ্ধা ও মান্য করবে। তাহলে তোমাদের কোন দিন কোন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হ’তে হবে না।


    হ্যাঁ, জনগণ কিন্তু হরিচাঁদ পরবর্তী পথ প্রদর্শক বা নেতাকে মেনে নিয়ে ছিল। আর এই জনগণের নেতা শুধু একটি মাত্র আজ্ঞা নিজের কাধে তুলে নিয়ে ছিলেন। সেটা হচ্ছে “শিক্ষা”। কারণ তিনি বুঝে ছিলেন যে, সমস্ত বন্ধ দরজার কপাট খুলে দিতে পারে এই একমাত্র ‘চাবি’। যার নাম “শিক্ষা”
    এই চাবির প্রসারের জন্য তিনি কৌশলও করেছিলেন। যার সুফল হাতে হাতে মিলেছিল। তবে এই শিক্ষার চাবিকে ধারালো করার জন্য শান দেওয়ার কাজ করেছিলেন এক ভিন দেশী অষ্ট্রেলিয়ান মিশনারী। ডাক্তার সি. এস. মিড সাহেব। এক্ষেত্রে এই মিড সাহেবের অবদান কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুরের তুলনায় কোন অংশে কম নয়।  
তাই এই শিক্ষার চাবিকে ধার দেওয়ার যন্ত্র হলেন মিড সাহেব। আর যন্ত্রী অর্থাৎ চালক হলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। এই দু’জনের বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় সমাজে শিক্ষার আলো ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়ে চারিদিকে পঙ্কে কমল ফুটতে শুরু করল।  
এই শিক্ষার ফল স্বরূপ চাকরী, ব্যাবসা ও সামাজিক আধিপত্ত্ব বিস্তার করল। আর সেই বিস্তার কিন্তু থেকে থাকেনি। সেটা দ্রুত প্রসারিত হতে থাকল। জনগণ খুঁজে পেল মানুষ হয়ে মানুষের মর্যাদা। অধিকার। প্রতিষ্ঠা।
   কিন্তু এই এত ঐশ্বর্য্য যেন প্রকৃতির কাছে ভারসাম্যহীন হয়ে উঠল। প্রকৃতির শাসকরা মনে করল এভাবে চললে তো অচিরেই আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাব। আমাদের অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবেনা। কেউ আমাদের মর্যাদা দেবেনা। তাই এই ভুখন্ডকে দু’ভাগ না করলে আমাদের নাম নিশানা মিটে যাবে। এই ভাবনা থেকেই শুরু হোল এই প্রকৃতি প্রেমিক শাসকদের ছলা-কলা- কৌশল। শুরু হোল দাঙ্গা। শুরু হোল আপন জনদের মধ্যে ধর্মীয় হিংসার বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ। জন্ম নিল রাতারাতি মৌলবাদের।  
কেউ বলল-ভারত ভাগ না হলেও চলবে। কিন্তু বাংলা ভাগ হওয়া চাই। কারণ বাংলা ভাগ না হলে আমরা এই প্রকৃতির ঘৃণ্য নীচ প্রাণীদের শাসন করতে পারব না।
কেউ বলল- অতকিছু জানিনা। আমরা আমাদের ধর্মীয় স্থান পাকিস্থান চাই।
আবার কেউ বলল- এসব কিছু আমি হতে দেবনা। এসব হতে হলে আমার মরা শরীরের উপর দিয়ে গিয়ে করতে হবে। যদিও এটা ছিল তাঁর লোক দেখানো খবরে ছাপানো গর্জন। কারণ তাঁরই উপস্থিতিতে তাঁরই সম্মতিতে পাশ হয় ১৯৪৬ সালে এই ভুখন্ড খন্ড-বিখন্ড করার বিল
যার পরিণতি- দেশভাগ। ভারত ভাগ। বাংলা ভাগ এবং বাঙালি ভাগ।
সেই দেশভাগের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল এক সময়ে অর্জিত সমস্ত অধিকার। পরিনত হ’ল আবার সহায় সম্বলহীন, ভীটে-মাটি ছাড়া, দেশ হারা, মাতৃভাষা হারা “উদ্বাস্তুতে”।  
    কাউকে ফেলে দেওয়া হল ঊড়িষ্যার কালা হান্ডিতে। কাউকে দন্ডকারণ্যের জঙ্গলে । কাউকে গড়চিরোলীর গভীর ঘন অরণ্যে। আবার কাউকে কালা পানি আন্দামানে। এইভাবে এক সময়ের একটা সংগঠিত উদিয়মান গোষ্ঠিকে ছুড়ে ফেলা হ’ল ভারতের বন-জঙ্গল-পাহাড় ও জলাশয়ে।
শাসক গোষ্ঠি বদলা নিল ডঃ বি. আর. আম্বেদকরকে সংবিধান সভায় পাঠানোর। আর যিনি এই পাঠানোর কাজে সব থেকে বেশী ভুমিকা গ্রহন করে ছিলেন, তাঁর নামে হোল বদনামী। বলা হোল তিনি মোল্লা। তিনিই দেশভাগের জন্য দায়ী।
যদিও এই সংগ্রামী নেতা এই সহায়-সম্বলহীন মানুষদের অধীকার আদায়ের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেগেছেন। কিন্তু তাঁর উপকার গ্রহন করেও তাঁর নিজের লোকেরাও তাঁকে চিনল না। বা  তাঁর প্রতি ব্রাহ্মণী প্রচার মাধ্যমের অপপ্রচারই চিনতে দিল না।
    তবুও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছুড়ে ফেলে দেওয়া এই “উদ্বাস্তুরা” আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখল। এই স্বপ্ন দেখার জন্য ডাক পড়ল ‘মরিচ ঝাপি’তে । সেখানে যখন নিজেদের চেষ্টায় শ্বাস নেওয়ার কিছুটা উপক্রম হ’ল, তখন শুরু হ’ল আবার আক্রমণ। আবার বুলেটের গুলিতে ঝাঝরা করা হোল এদের। অগনিত নর-নারীকে বরণ করতে হ’ল অমানবিক অত্যাচার। অবশেষে মৃত্যু। এদের অপরাধ? এরা নীচু জাত। এদের কোন নেতা নেই। তাই এদের প্রতি ইচ্ছা খুশি অত্যাচার চালানো যেতে পারে।
    তবুও এই মতুয়ারা, এই উদ্বাস্তুরা যেন দুর্বা ঘাসের জাত। এরা রৌদ্রে পুড়ে গেলেও শুকিয়ে  গেলেও বর্ষার জল পেলে আবার জেগে ওঠে। এই জাতির জীনে মনে হয় সঞ্জীবনী শক্তি আছে। তাই একটু সুযোগ পেলেই এরা জেগে উঠতে চায়। যে জাগা দেখলে শাসক জাতির মনের মধ্যে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যায়। তাই সেই ভুমিকম্পের বাণী শোনা গেল -মন্ডলরা জাগছে
হ্যা, এই সঞ্জীবনী ধারক উদ্বাস্তুরা কিন্তু তাদের নেতা গুরুচাঁদের সংগ্রামী আহ্বানকে মনে রেখে দল গড়ার কাজে অগ্রসর হয়ে ছিল। যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সাংগঠণিকভাবে একত্রিত হওয়া। অনেকটা অগ্রসরও হয়েছিল বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে।
    এরা যুক্তিতে নয়, মনে প্রাণে ভালবাসে ও বিশ্বাস করে তাদের নেতার কোন বংশধর আবার এদের দিশা দেখানোর জন্য হাল ধরুক। হোক না সে নতুন প্রজন্মের। হোক না কিছুটা সময়ের সঙ্গে প্রগতিশীল। কিন্তু সেই আশায় এদের নেতার পরবর্তী প্রজন্ম কোন দিন সেই হাল ধরতে পারেনি বা ধরতে দেওয়া হয়নি ব্রাহ্মণী ষড়যন্ত্রে জন্য। তাদের পতাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।   










এরা শুরু করল খেল। যে খেলার নাম ধর্মীয় খেল। এই খেলায় এদের নেতার পরবর্তী বংশধরেরা পূর্ব-পুরুষের নাম ভাঙিয়ে শুরু করল দল গড়া নয় , দলে ভেড়ার কাজ। তাই ধাপে ধাপে এরা নাম লেখাতে শুরু করল –কংরেস, C.P.M, তৃণমূল ও B.J.P. তে
    এই মানুষদের নেতা বলেছিলেন- যার দল নেই, তার বল নেই ।
                               ভিন্ন ভিন্ন দল কেউ করো না গোসাই।।   
আর পরবর্তী বংশধরেরা দেখালেন যে,
                            দল ছাড় , দল ধর,           নিজ দল গড়ো না ভাই । 
                                অন্য দলে গিয়ে আমরা করব কামাই।।  
তাই এরা এখন “মতুয়া” নয় । এরা মত্‌ - উহা (উহা- ওখানে অর্থাৎ  কংগ্রেস, C.P.M., তৃণমুল, B.J.P.) তে পরিণত হয়েছে। এদের কম্পানির নাম হচ্ছে-মত্‌ উহা প্রডাকশন। প্রডাকশান স্থান- ঠাকুর নগর
    এদের অর্থাৎ পূর্বের এই মতুয়াদের পতিত পাবন বা পিতাকে নিয়ে তারক সরকার যে গ্রন্থ লিখেছিলেন যার নাম “শ্রীশ্রীহরি লীলামৃত”। সেই গ্রন্থ প্রকাশের শত বর্ষ বর্তমানে পূর্ণ হয়েছে।( ১ম প্রকাশ বাংলা ১৩২৩ সাল। ইংরাজী ১৯১৬ সাল।) যে গ্রন্থের বন্ধনে এখনও সেই পতিত পাবনের শল্‌তে মিট্‌ মিট্‌ করে জ্বলছে। সেই শল্‌তে তে যে আরো তেল দিয়ে প্রজ্জলিত করা দরকার। কিন্তু সেদিকে কারো ভ্রুপক্ষেপ নেই।

এরা হরি বোল বলে, ডাঙ্কা পিটিয়ে ছুটে চলেছে কোন দিশায়? কে দেখাবে এদের দিশা? না কেউ নতুন করে জন্ম নেবে না এদের দিশা দেখানোর জন্য। এদের এই আকর গ্রন্থকেই দিশার উৎস মনে করে রাজ হংসের মত জল ফেলে দিয়ে চুষে নিতে হবে দুধকে। চলতে হবে এদের পতিত পাবন পিতা ও এদের শিক্ষা বিস্তারকারী নেতার পালিত ও নির্দেশিত মত ও পথে। তবেই এই সঞ্জীবনী শক্তি আবার পুনরায় জীবিত হবে। তবে তার জন্য এই বংশের পরবর্তী প্রজন্মের উপর ভরসা করা ছেড়ে দিতে হবে। তা না হকলে মতুয়ার অস্তিত্বের নাম ও নিশানা থাকবে না । যেটা থাকবে সেটা হবে মরুভুমির মরিচিকা।
            ----------------------------------------------------------







Comments

  1. বেশ ভালো লেখা । অতীতের অবস্থান , প্রেক্ষাপট আর বর্তমানের পরিণতি , সেই সাথে কিছুটা আক্ষেপ মেশানো ভালো লেখা ।

    ReplyDelete

Post a Comment