Skip to main content

নমঃশুদ্র নয়, নমঃ গুরুচাঁদের প্রত্যক্ষ শিক্ষা ডাঃ মণীন্দনাথ বিশ্বাস

ছোটলাট ফরিদপুরে আসিতেছেন এই সংবাদটি পাইবা মাত্র সি.এস.মিড ওরাকান্দি অভিমুখে রওনা হইলেন । তাঁহাকে যে অতি সত্বর গুরুচাঁদ ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে । তাঁহার সহিত আলোচনা করিয়া বিশেষ কর্মসূচি প্রস্তুত করিতে হইবে । তিনি এই দিনটির জন্য দীর্ঘদিন ধরিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন । তাই যথাশীঘ্র ওড়াকান্দিতে আসিয়া গুরুচাঁদ ঠাকুরের  সহিত মিলিত হইলেন । তিনি ঠাকুরকে বুঝাইয়া বলিলেন, ব্রিটিশ সরকার নমঃজনগোষ্ঠীকে যে হীনজাতি বলিয়া গণ্য করে এই দোষটি আসলে ব্রিটিশ সরকারের নহে । বৈদিক বর্ণধর্মের উচ্চস্থানীয় মানুষেরা ব্রিটিশ রাজপুরুষদের প্রতিনিয়ত বুঝাইয়া রাখিতেছে যে, নমঃরা আসলে চন্ডাল জাতি ।
     চন্ডাল নামটি কাটিয়া নমঃশুদ্র নামকরণ করা হইলেও ইহাদের সমাজজীবন হইতে চন্ডালের আচার আচারণ লুপ্ত হয় নাই । চন্ডালদের নিজস্ব কোন সভ্য সংস্কৃতি নাই । আদিম হিংস্র বন্য স্বভাব এখনও ইহারা পরিত্যাগ করিতে পারে নাই । এমনকী বৈবাহিক জীবন যাপন পর্যন্ত ইহারা জানে না, যথেচ্ছা বিচরণ করিয়া বেড়ায় । তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বারবার বুঝাইতে লাগিলেন যে, ব্রিটিশ রাজপুরুষদের মন হইতে এই ভ্রান্ত ধারণা নিরসন করিতে না পারিলে কোনদিনই তিনি তাঁহার নমঃজাতির জন্য কিছুই করিতে পারিবেন না । তাই এমন কিছু করা প্রয়োজন যাহাতে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করিতে পারে যে, নমঃজনগোষ্ঠী আসলে একটি সুসভ্য জাতি । ইহাদের সমাজ-সংস্কৃতি বর্ণধর্মী হিন্দুদের হইতে অনেক বেশি মানবিক । সি.এস.মিড আরও কহিলেন যে ছোটলাট বাহাদুর যখন ফরিদপুরে আগমন করিবেন তখন নমঃজাতির পক্ষ হইতে তাহার হস্তে একখানি অভিনন্দনপত্র অবশ্যই তুলিয়া দিতে হইবে । তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি পত্রিকার, যে পত্রিকার মাধ্যমে নমঃজাতি তাহাদের মানবিক চিন্তা-চেতনা এবং সমাজ সংস্কৃতির কথা মানুষের নিকটে তুলিয়া ধরিতে পারিবে । পৌঁছাইয়া দিতে পারিবে ব্রিটিশের রাজদরবারে তাঁহাদের বঞ্চনার কথা ।তবেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের নিকটে নমঃজাতির জন্য সুপারিশ করিতে পারিবেন ।
     মিড সাহেবের প্রস্তাবটি গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট খুবই যুক্তিযুক্ত বলিয়া  মনে হইল । তাই পত্রিকা প্রকাশের জন্য তিনিও তৎপর হইয়া উঠিলেন । এই উপলেক্ষ্যে অতি সত্বর একটি জরুরি সভার আয়োজন করিলেন । এই সভায় উপস্থিত ছিলেন রাধানাথ মন্ডল, ভীষ্মদেব দাস, মোহনলাল বিশ্বাস, কুমুদ মল্লিক, পূর্ণচন্দ্র মল্লিক, চন্ডিচরণ বৈরাগী, বিধু চৌধুরী, আদিত্য চৌধুরী, আরংচাঁদ বিশ্বাস, প্পুলিন পাল, রাসবিহারি গোলদার এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের দুই পুত্র শশিভূষণ ও সুরেন্দ্রনাথ । ওই সকল ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও উক্ত সভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন জাতির অসংখ্য বিদ্যোৎসাহী ও বিশিষ্ট সব জ্ঞানীগুণীজনেরা ।
     সভাটি অনুষ্ঠিত হইবার কিছুদিন পূর্বেই সরকারের সেন্সাস রিপোর্ট বাহির হইয়াছিল । সেইখানে হিন্দু আমলাদের কূটকৌশলে নমঃজাতির চন্ডাল নামের পরিবর্তে নমঃশুদ্র নামকরণ করিয়া অহিন্দু চিরস্বাধীন নমঃজাতিকে হিন্দুত্বের তলানিতে বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে । এই নিষ্ঠুর সত্যটিকে উপলব্ধি করিয়া অনেকেই সেদিন ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছিলেন । তথাপি সরকারি সিদ্ধান্তকে  মানিয়া লইয়া পত্রিকার নামকরণ করা হইয়াছিল "নমঃশূদ্র সুহৃদ" । পত্রিকাটির স্বত্বাধিকারী রহিলেন স্বয়ং গুরুচাঁদ ঠাকুর । সম্পাদনার দায়িত্বভার  দেওয়া হইল ওড়াকান্দি নিবাসী আদিত্য চৌধুরীকে এবং কর্মাধ্যক্ষ হইলেন গুরুচাঁদ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর । বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা  পৌঁছাইয়া দেওয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছিলেন এলাকা ভিত্তিক মানুষেরা ।
     সভায় পত্রিকাকে উপলক্ষ্য করিয়া অনেকেই অনেক কথা বলিয়াছিলেন ।
সুরগ্রাম নিবাসী আরংচাঁদ বিশ্বাস ছিলেন বয়সে গুরুচাঁদ ঠাকুরের চাইতে আট-দশ বৎসরের প্রবীণ । তিনি লেখাপড়া কিছুই জানিতেন না । তবে পরিণত বয়সে নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলা লেখা কোনক্রমে পড়িতে শিখিয়াছিলেন । তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের নিকট হইতে অনুমতি লইয়া সকলকে ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া তিনি বলিতে শুরু করিলেন, "আমরা সবাই ভারি আনন্দ পাচ্ছি যে, আমাগে নিজিগি একটা খবরের কাগজ বারচ্ছে । আমরা আমাগে কথা লাটবাহাদুরের কাছে ও দ্যাশের সগোলার কাছে লেখিয়া লেখিয়া জানাতি পারবো । কিন্তু আমি কিচ্ছু বুখ্যা উঠতি পারতেছি ন্যা যে, আমরা নিজিগি কী বল্যা পরিচয় দেবো ? নমঃশুদ্দুর বল্যা, না নমঃজাতি বল্যা, নাকি চন্ডাল বল্যা ? সরকারি খাতায় তো নাম ওঠছে নমঃশুদ্দুর বল্যা । কিন্তু আমরা যদি নিজিগি নমঃশুদ্দুর কোই তা হলি কর্তার মতুয়াধর্মের কী গতি হবে ? মতুয়াধর্ম কি আলাদা ধর্ম হিসাবে দাঁড়াতে পারবে ? শুদ্দুর কথাডা তো হিন্দুধর্মে ছাড়া থাকতি পারে না । শুদ্দুর নামডার সাথে হিন্দুধর্ম জড়ানো রইছে । তাই নিজিরি  নমঃশুদ্দুর বল্যা পরিচয় দিলি নিজিরি হিন্দুধর্মের মধ্যি আটকায় রাখা হয় । কর্তার মতুয়াধর্ম নইয়া আর দাঁড়ানোর সুযোগই থায়ে না । তা হলি আমরা মতুয়াধর্ম প্রতিষ্ঠা করবো কেম্বায় ? এইবার সগোলে ভাব্যা দ্যাহো যে কী নামে নিজিগি পরিচয় দেবা । নমঃশুদ্দুর নামে, না, কি নমঃজাতি নামে ? আমি কোই কি ঐ শুদ্দুর মুদ্দুর নিজিগিই বাদ দিয়া থুতি হবে । যেমোন কর‍্যা হোক সরকারি খাতার থেয়া শুদ্দুর নাম মুছ্যা দিতি হবে । কর্তা কোইছে- আমরা হলাম নমঃজাতি । আর কর্তা আমাগে মতুয়া নামে ধর্ম দেবার পরের থেয়া আমাগে ধর্ম হচ্ছে মতুয়াধর্ম । আর আমাগে মতুয়াধর্মে বায়োন শুদ্দুর বল্যা কোন কথা নাই তহোন আমাগে নামের সাথে ঐ শুদ্দুর কথাডা জুড়্যা থাকপে ক্যান ! আমি একজন মুখখু মানুষ কিছুই বুঝিনা । তবে ঐ শুদ্দুর কথাডা মোনের মধ্যি ভারি  জ্বালা ধরায়ে দেছে । এর চাইয়েয়া আমার চন্ডাল নামও ভালো ছেলো । তাই কথা কয়ডা না কোইয়া পারলাম না এইবার বড়কর্তা আর তোমরা সগোলা মিল্যা যা ভালো বোঝবা তাই করবা । যাতে জাতি মতুয়ার নিশান হাতে করেয়া জগোতের কাছে মাথা উঁচু কর‍্যা দাঁড়াতি পারবে তাই করবা । সগোলার চরণে আর একবার মাথা নোয়াইয়া আমার কথা শ্যাষ করলাম ।"

Comments