ধনঞ্জয় বিশ্বাস ঠাকুরের কথায় একটু আশ্চর্য
হইয়া কহিল, "বড়কর্তা, আপনার কথা তো আমি ঠিক বুঝতে
পারলাম না । মহোৎসব থেকে কী পাব ?"
     ঠাকুর হাসিয়া কহিলেন, "তা আমি
জানব কী করে ? সেটা তো তোমার জানার কথা । তা হলে তুমি কী
উদ্দেশ্যে  মহোৎসব কর ?"  
   ধনঞ্জয় কহিল, "সে কথা তো কোনও দিন ভেবে
দেখিনি । করতে হয় তাই করছি ।"
   ঠাকুর কহিলেন, "ধনঞ্জয়, এটা কিন্তু খুব সাধারণ মানের কথা হল । তোমার কাছ থেকে এ ধরণের কথা আশা
করি না । ঊদ্দেশ্য বিহীন ভাবে কোনও কর্ম কেউ করে না । এই উদ্দেশ্যকে
তুমি কামনাও বলতে পার । কামনা ছাড়া কোনও কর্ম নাই । যারা কামনাহীন কর্মের কথা বলে
অর্থাৎ নিষ্কাম নিষ্কাম বলে চেঁচায়, তারা ওই
মুহূর্তেই যে একটা মস্তবড় কামনার কথা বলছে- সেটা তারা হয়তঃ বুঝতেই পারে না।
কারণ  তারা যে দর্শনটার অনুশীলন করে সেটা
জ্ঞান বৃত্তির পরিপন্থী । তাই তারা সব সময় অসংগতিপূর্ণ কথা বলতে থাকে । কিন্তু
হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া দর্শন তো ভাবাবেগের দর্শন নয় । এখানে অসংগতির কোনও জায়গা
নাই । তাই মতুয়াদের যা কিছু করতে হবে তার পরিণাম এবং ফলাফল ভেবেই করতে হবে ।"  
  ধনঞ্জয় বিশ্বাস অপ্রতিভ হইয়া কহিল, "অনেকেই
মহোৎসব করে, তাই আমিও ভাবলাম যে এটা বুঝি ঠাকুরের কাজ ।
এই ভেবেই মহোৎসব করতে শুরু করলাম ।"
    ঠাকুর কহিলেন, "ধনঞ্জয়, মহোৎসব অনেকেই করছে । কিন্তু মহোৎসব তো নিছক আমোদ প্রমোদ ছাড়া আর কিছুই
নয় । আর একটা জিনিস এর পিছনে কাজ করে, তা হল যারা দরিদ্র,
তারা মহোৎসর করে নিজেকে হরিচাঁদ ঠাকুরের বড় ভক্ত বলে জাহির করতে
চায় । আর যারা সংগতিসম্পন্ন, তারা নিজেকে ভক্ত বলে জাহির
করার সঙ্গে বৈভবও জাহির করায় ব্যস্ত থাকে । কিন্তু তাতে লাভটা হচ্ছে কী, হরিচাঁদ ঠাকুরের কাজ তো কিছু হচ্ছে না ।"
   ধনঞ্জয় কহিল, "কিন্তু বড়কর্তা, হরিচাঁদ ঠাকুরের সময় থেকেই তো মহোৎসব শুরু হয়েছে । তিনি নিজেই তো
মহোৎসবে উপস্থিত থাকতেন ।"
    ঠাকুর কহিলেন, হ্যাঁ, বাবা মহোৎসবে উপস্থিত থাকতেন । তবে উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে নয় । তুমি
কি জান, বাবা কোনও মহোৎসবে একমাত্র হরিবোল নাম
ভিন্ন অন্য কোনও গান করতে দিতেন না । তারক সরকার মহোৎসবে গান করতে চেয়েছে, বাবা তাকে পর্যন্ত গান করতে দেননি । কারণ,
এদের গান সব বৈদিক ভাব মেশানো । মানে বাবার সব সময় উদ্দেশ্য থাকত আমাদের মানুষদের
বৈদিক ভাবনা থেকে বের করে এনে মতুয়াধর্মের অবৈদিক চেতনায় একটা সংঘবদ্ধ জাতি গঠন
করা । এই জন্যই তিনি মহোৎসবে উপস্থিত থাকতেন । কিন্তু
এখন মহোৎসব তো সেই উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে । জাতিকে সংঘবদ্ধ করার নামে
বিচ্ছিন্নতা ডেকে আনছে । তারক আর অশ্বিনীর গানের মাধ্যমে হিন্দুদের অবতার আর
দেবদেবীদের  টেনে এনে, অবৈদিক মতুয়াধর্মের ভিতরে বৈদিক ভাব ঢুকাচ্ছে । এই মহোৎসবের ফলাফল
মোটেই ভাল নয় । এসব তুমি আর করো না । তার চেয়ে তুমি
অন্যভাবে জাতি গঠনে ব্রতী হও ।"
    ধনঞ্জয় বিশ্বাস বিনীত ভাবে কহিল, "বড়কর্তা,
আপনার নির্দেশই আমার কাছে শেষ কথা । আপনি যা বলবেন তাই -ই হবে ।"  
        ঠাকুর কহিলেন, "তুমি
মহোৎসবের পরিবর্তে জাগরণী সভা কর । সেখানে জাতির উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করা হবে ।
হরিচাঁদ ঠাকুর যদি পতিত উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়ে থাকেন তা হলে সর্বাগ্রে জানতে হবে
কারা এই পতিত জাতি, এদের উদ্ধারের জন্য তিনি কী
উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন, তিনি কেন মতুয়াধর্মের সঙ্গে অন্য
কোনও ধর্মের মিল আছে কিনা এবং মতুয়াধর্মের মাধ্যমে কীভাবে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন
করা যায়-এই রকম নানা বিষয় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনার মাধ্যমে সকলকে তা বুঝে নিতে হবে
।" 
   গুরুচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশ মত ধনঞ্জয় বিশ্বাস
মহোৎসবের পরিবর্তে জাগরণী সভার আয়োজন করিল ----------।------------------
   উক্ত সভা সমাপ্তির পূর্বে গুরুচাঁদ ঠাকুর
নমঃসমাজের -----মানুষদের উপলক্ষ্যে এক যুগান্তকারী বক্তৃতা করিয়াছিলেন-"হে
আমার একান্ত আপনজনেরা,
--------মনে রাখতে হবে আগামী দিনে শিক্ষাহীন ব্যক্তিরা ব্যবসায়ী
হতে পারবে না বা ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না । তাই ব্যবসাকে পরম্পরায় এগিয়ে
নিয়ে যেতে হলে ছেলেমেয়েদের বাণীজ্যিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে । ধনবান হতে হলে
চাই উপার্জনমুখী শিক্ষা । অর্থের প্রাচুর্য না থাকলে অর্থের প্রাচুর্যও আসে না ।
অর্থাৎ শিক্ষা এবং ধন হাত ধরাধরি করে চলে । আমাদেরকে অনেকে অর্থবিমুখ করে রাখার জন্য
অনেক ভাবে অনেক কিছু বুঝায় । তারা অলৌকিক কাহিনি জুড়ে আমাদের চেতনাকে বিগড়ে দিতে
চেষ্টা করে বলে, 'অর্থই
অনর্থের মূল' । আমি গুরুচাঁদ ঠাকুর বলছি অর্থহীন
মানুষের জীবন অর্থহীনই বটে । অর্থ মানুষের মনোবল বাড়ায় । অর্থ
মানুষকে উৎসাহ উদ্দীপনা জোগায় । অর্থ ছাড়া কোনও মহৎ কাজ হয় না । তাই আমার আশা আমার
জাতির প্রতিটি মানুষ উপার্জনমুখী হোক । প্রতিটি পরিবার ধনবান হয়ে উঠুক । একজন আর
একজনের হাত ধরে টেনে তুলুক । সাগর পেরিয়ে মণিমুক্তা আহরণ করে তারা জাতিকে সমৃদ্ধ
করুক ।
          তবে একটি কথা, টাকা
উপার্জনের চেয়েও কঠিন কাজ টাকা খরচ করা । টাকাকে ব্যবহারের গুণে কেহ মহামানব হয়ে
যেতে পারে আবার কেহ হীন থেকে হীনতায় ডুবে যেতে পারে । তাই তোমাদের কষ্টে উপার্জিত
টাকা যেন সঠিক পথে ব্যয় হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । আমি বুঝি যারা ব্যবসা করে
বা দায়িত্বশীল পদে চাকরি করে, জাতির উন্নয়নের
বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের পক্ষে সময় দেওয়া কোনমতেই সম্ভব নয় । তাই বলে জাতির প্রতি
দায়বদ্ধতা  তো এড়িয়ে যেতে পারে না ।
তাদেরকে অর্থের জোগান দিয়ে জাতির উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং খোঁজখবর রাখতে হবে
যাতে তার উপার্জিত অর্থ জাতির উন্নয়নে সঠিকভাবে কাজে লাগে ।" 
   ---গুরুচাঁদ ঠাকুররে আবেগময় বক্তৃতায় প্রতিটি
নমঃর হৃদয়ে  স্বজাতি-প্রীতি উদ্বেলিত হইয়া
উঠিল । 
                                __________________________________________ 

Comments
Post a Comment