গুরুচাঁদ ঠাকুর জাগরণী সভা শেষ করিয়া গণেশ মন্ডলের বাটি
হইতে বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, সেই সময়ে দুইজন যুবক
ছুটিতে ছুটিতে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইল । তাহারা হাত জোড় করিয়া
অতীব  বিনয়ের সহিত কহিল। "বড়কর্তা,  আমরা মিস্ত্রিডাঙার দুইটি
গ্রাম ওপাশের হিজলডাঙা থেকে এসেছি । আপনাকে ওখাকে যেতে হবে, ওখানে আগামীকাল জাগরণীসভা করতে হবে।" 
   যুবক দুইটির আগ্রহ দেখিয়া
ঠাকুর সদলবলে হিজলডাঙার উদ্দেশে যাত্রা করিলেন । 
…………………………………………………………………………………………………………..
     অতঃপর একজন যুবক কহিল, "আপনি
নমঃজাতির জন্য এত ভাবেন ?" 
         ঠাকুর কহিলেন, "এতে আর আশ্চর্যের কী আছে, আপনজনদের
জন্য তো সবাই ভাবে । আর আমাদের জন্য তো কেউ ভাবার নাই । আন্যান্যদের জন্য ভাবার
মত  বড় বড় অনেক হিন্দু নেতা ও ধর্মগুরু
রয়েছে । কিন্তু আমাদের ভাবনা তো আমাদের নিজেদেরি ভাবতে হচ্ছে ।"
   অন্য যুবক কহিল, শুধুমাত্র
নমঃদের উন্নতি হলেই তো আর বাংলার উন্নতি হবে না।"
  ঠাকুর কহিলেন, "বাংলার
বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হচ্ছে নমঃরা ।তাদের 
উন্নতি মানেই  তো বাংলার উন্নতি
।"
  যুবক কহিল, " তবুও
কথাটা খুব সংকীর্ণ শোনায় ।"
        ঠাকুর কহিলেন, "যারা সংকীর্ণ, তাদের কাছে
উদারতা  দেখাতে গেলে বিপদ বাড়ে । তুমি
উদার চিত্তে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরবে, তারা সুযোগ বুঝে তোমার বুকে ছুরি বসিয়ে
দেবে । তার চেয়ে নিজের নমঃজনগোষ্ঠী নিয়ে আগে ভাল জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা উচিত
নয় কি ?" 
                                                                                                   যুবক কহিল, আপনি কি তা হলে নমঃদের অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে রাখতে চান ?"
ঠাকুর কহিলেন, "আমি চাইব কি ! সে কাজটা তো ওরা আগেই করে রেখেছে । ওরা আমাদের
নিজস্ব ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সেই থেকে তো পতিত করেই রেখেছে । এখন
আমরা মতুয়াধর্মকে অবলম্বন করে একটি সংঘবদ্ধ 
শক্তিশালী জাতি গঠন করতে পারি তাতে সংকীর্ণতার কী আছে ?"
                      অন্য আর একটি যুবক কহিল, "শুনেছি অনেক নেতারা আপনার কাছে এসেছে ।আপনার লোকজন নিয়ে একসঙ্গে
তারা কাজ করতে চায় ।  তাতে মন্দ কী ?" 
  ঠাকুর তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া
কহিলেন, "ওরে পাগল, ওরা আমাদের কাছে
আসে আমাদের ব্যবহার করার জন্য । আমাদের মঙ্গল করার জন্য নয়,  
আমাদের হাতে ক্ষমতা দেবার জন্যও নয়। ওরা আমাদের সংখ্যাধিক্য আর
বল-বীর্যকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে আসে । ওদের থেকে সাবধান । ওরা
শত শত বছর ধরে আমাদের ব্যবহার করে চলেছে । সে সুযোগ আমরা আর ওদের দেব না । আমরা যা
পারি নিজেরাই করব ।"
   যুবকটি কহিল,
"অন্যান্য সকলকে না টানতে পারলে আমরা ক্ষমতাশালী হব কী করে ?"
   ঠাকুর
কহিলেন, "অন্যান্যদের আঁকড়ে ধরে ক্ষমতাশালী হতে গিয়ে আন্যান্যদের
তল্পিবাহক হতে হবে, বুঝেছ ? তার
চেয়ে নিজের মানুষগুলো নিয়ে আগেভাগে সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী জাতি গঠন কর । শিক্ষা,
সংস্কৃতি, খেলাধুলা- সর্ববিষয়ে অগ্রণী
হও । তা  হলেই দেখতে পাবে অন্যন্যরা
সুরক্ষা পাবার জন্য তোমার পিছনে এসে দাঁড়াবে, তোমার
তল্পিবাহক হবে ।"  
  অন্য আর এক যুবক কিঞ্চিৎ
তাচ্ছিল্য ভরে কহিল, "নমঃরা সংঘবদ্ধ হলে এত ক্ষমতার অধিকারী হইয়ে যাবে ?"
   ঠাকুর প্রশান্ত বদনে
কহিলেন, "সংঘবদ্ধ কথাটার অর্থ বোধ হয় তুমি সঠিকভাবে বুঝতে পারছ না । তাই
তোমার দুর্বলতা কাটছে না । ধরো, কোনও  গ্রামে পঞ্চাশটি পরিবার আছে । তার মধ্যে মাত্র
দশটি পরিবার এমন ভাবে চলে যেন এদের একটি মাত্র প্রাণ । এদের একজনের গায়ে কাঁটা
ফুঁটলে সকলে এমন ব্যথা অনুভব করে যেন সকলের পায়ে কাঁটা ফুঁটেছে । এরা সৎ এবং
নিষ্ঠাবান । কোনও অন্যায় করেও না, প্রশ্রয়ও দেয় না ।
এদের  নিজেদের মধ্য কোনও বিষয়ে অশান্তি হলে
অন্যেরা তা জানতেও পারে না, নিজেরা বসে তা মিটিয়ে নেয় ।
কারও মনে কোনও প্রকার গলদ জীইয়ে রাখে না । এবার প্রত্যেকে পরস্পরের জন্য ত্যাগ
স্বীকার করতে সব সময় প্রস্তুত থাকে । এবার ভেবে দেখ, গ্রামের
এলোমেলো অন্যান্য চল্লিশটি পরিবার কি এদের বিপন্ন করতে পারবে ? বরঞ্চ তারা নিরাপত্তার আশায় এক একজন করে এদের পিছনে এসে দাঁড়াবে । এই
রকম একটি সংঘবদ্ধ জাতি যদি আমরা গড়ে তুলতে পারি তা হলে কেমন হয় ?"  
  কথাগুলি কহিয়া ঠাকুর মিটিমিটি
করিয়া হাসিতে লাগিলেন । যুবকদের চক্ষুও প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল । তাহারা
উৎসাহের আতিশয্যে একসঙ্গে কহিয়া উঠিল, "সেটা কি সম্ভব বড়কর্তা !" 
ঠাকুর হাসিমাখা বদনে কহিলেন, "কেন সম্ভব নয়! এটা সম্ভব করার
জন্যই তো পিতা হরিচাঁদ ঠাকুর আমাদের মতুয়াধর্ম দিয়েছেন । এই ধর্মের মেলবন্ধনে আমরা
অনুরূপ একটি সংঘবদ্ধ জাতি গড়ে তুলব । তবে সাবধান, হিন্দুধর্মের
সঙ্গে কোনও রূপ যোগসূত্র রাখতে চেও না । হিন্দু হচ্ছে একটি
বিচ্ছিন্নতাবাদী ধর্ম । ওদের ছোঁয়ায় মতুয়াধর্মও বিচ্ছিন্নতার শিকার হতে পারে । তা
হলে আমাদের উত্থানের সম্ভাবনা চিরতরে হারিয়ে যাবে ।"
   একজন যুবক পুনশ্চ হতাশার
সুরে কহিল,"এটা কি সম্ভব হবে ?" 
                                                                                                     ঠাকুর উচ্ছাসের সহিত কহিলেন, কেন সম্ভব হবে না
। পিতার কাছে শুনেছি, আমাদের দেশে নাকি শিখ নামে
অল্পসংখ্যক মানুষের একটি ধর্ম আছে । তারা ধর্মীয় বন্ধনে এতটাই সংঘবদ্ধ  হয়েছে যে, মুসলমান  বাদশাহেরাও নাকি তাদের শক্তিকে হার মানাতে পারে
নাই । তা হলে আমরা মতুয়াধর্মকে নিয়ে শক্তিশালী হতে পারবো না কেন ? আর আমরা তো সংখ্যায় ওদের চেয়ে অনেক বেশি । আমার পিতা তো মতুয়াধর্মের
মাধ্যমে এমনই  একটি জাতি গঠন করতে
চেয়েছিলেন । তোমাদের এমন হতে হবে, কিছু মনে হলেও তা করতে
হবে । যে কোনও সময়ে যে কোনও পরিস্থিতিতে পরস্পরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে ।
একজনের বিপদকে সকলের বিপদ বলে মেনে নিতে হবে । নিজেদের মধ্যে অশান্তি তো হতেই পারে, কিন্তু কখনও যেন কোনও আত্মঘাতী ভাবনা মনে না আসে ।"
  এমত সময়ে গৃহকর্তা আসিয়া
করজোড়ে ঠাকুরকে আহারের কথা জানাইতে তিনি যুবকদের সমবিভ্যাহারে ভোজনালয়ে গমন করিলেন
।
(বিশেষ দ্রষ্ট্যব্যঃ 
এই কথোপকথনকে নাট্যাকারেও পরিবেশন করা যেতে পারে । হরি-গরুচাঁদ ঠাকুরের
বানী ও আদর্শকে প্রচার করার জন্য ) 
                          ___________________ 

Comments
Post a Comment