মতুয়াধর্ম কি স্বাধীন-স্বনিয়ন্ত্রিত কোন স্বতন্ত্র ধর্ম, নাকি হিন্দুধর্মের কোন শাখা-প্রশাখা ?
অথবাহরিচাঁদের দর্শন কি অবৈদিক দর্শন , নাকি তিনি বৈদিক দর্শনের ধারক ছিলেন ?
বইঃ- প্রশ্নোত্তরে মতুয়া দর্শন; বইটির লেখকঃ- ডাঃ মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস(মনু)
এখানে এই বইয়ের নানান আলোচনার মধ্য থেকে একটি আলোচনাকে এই পোস্টে সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে ।
বইঃ- প্রশ্নত্তোরে মতুয়া দর্শন //
লেখকঃ- ডাঃ মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস(মনু)
বিষয় বা প্রশ্নঃ- মতুয়াধর্ম কি স্বাধীন-স্বনিয়ন্ত্রিত কোন স্বতন্ত্র ধর্ম, নাকি হিন্দুধর্মের কোন শাখা-প্রশাখা ? অথবাহরিচাঁদের দর্শন কি অবৈদিক দর্শন , নাকি তিনি বৈদিক দর্শনের ধারক ছিলেন ?
বৈদিক ধর্মই পরবরতীকালে হিন্দুধর্ম নামে আখ্যায়িত হয়েছে । আর ধর্ম ও দর্শন মূলত একই কথা । অতএব হরিচাঁদ যদি বৈদিক দর্শনের ধারক হন , তাহলে তাঁর প্রবর্তিত মতুয়াধর্মও বৈদিক ধর্ম বা হিন্দুধর্মের শাখা হবে । অপরপক্ষে হরিচাঁদ ঠাকুর যদি অবৈদিক দর্শনের ধারক হন তাহলে তাঁর প্রবর্তিত মতুয়াধর্মও হবে অবৈদিক ধর্ম । অর্থাৎ মতুয়াধর্ম বৈদিক বা হিন্দুধর্মের কোন শাখা-প্রশাখা নয় এটা প্রমাণিত হবে । অন্য কোন অবৈদিক ধর্মের প্রভাব সেখানে আছে কিনা সেটা পরের বিচার্য বিষয় । বৈদিক বা হিন্দুধর্মের প্রভাব যে মতুয়াধর্মে নেই সে সম্বন্ধে আমাদের কোন প্রকার সংশয় থাকবে না ।
—-মতুয়া ধর্ম যদি অবৈদিক ধর্ম বলে প্রমাণিত হয় , তবে দেখতে হবে তার
অন্য কোন অবৈদিক ধর্মের সঙ্গে সাদৃশ্য বা যোগসুত্র আছে কিনা । তা হলে
মতুয়াধর্ম বৈদিক ধর্ম কিনা সেটা বুঝতে হলে সর্বাগ্রে বৈদিক ধর্মের এমন কিছু
বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে যাঁদের উপর নির্ভর করে বৈদিক ধর্ম
দাঁড়িয়ে রয়েছে । এবং দেখতে হবে ওই সকল বিষয় সম্বন্ধে মতুয়াধর্মই বা কী
বলেছে । অর্থাৎ ওই সকল বিষয় সম্বন্ধে হরিচাঁদ ঠাকুর বৈদিক ধর্মের সঙ্গে
সহমত পোষণ করেছেন নাকি ভিন্নমত পোষণ করেছেন ।
যেমনঃ(ক) বৈদিক ধর্ম বেদকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে । তাই তার নামকরণও হয়েছে বৈদিক ধর্ম । এই বৈদিক ধর্মের মানুষেরা বেদকে অভ্রান্ত বা স্বতঃসিদ্ধ গ্রন্থ হিসাবে মনে করে । কেউ যদি সেই বেদকে মেনে না নেয় বা তাকে অস্বীকার করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় , সে কী কখনও বৈদিক ধর্মের ধারক হতে পারে । এইবার দেখা যাক বেদ সম্বন্ধে হরিচাঁদ ঠাকুর কেমন মন্তব্য করেছেন । লীলামৃতকার তার কী প্রমাণ রেখে গেছেন । হরিচাঁদ ঠাকুর বলতেন ,
” কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলেও খাই ।
বেদ বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই” ।।
অর্থাৎ ঠাকুর বেদের বিধানকে কুকুরের উচ্ছিষ্ট খাবারের চেয়েও নিকৃষ্টতর
মনে করতেন ।এবং তাঁর অনুগামীদের বেদকে বর্জনের নির্দেশ দিতেন । বেদকে
অস্বীকার করলে সে কখনও বৈদিক ধর্মের মানুষ হতে পারে না । অতএব মতুয়ারা
কিছুতেই বৈদিক ধর্মের মানুষ বা হিন্দু নয় ।(খ) বৈদিক ধর্মের পুরো নাম বৈদিক বর্ণধর্ম , তার মানে বৈদিক ধর্ম বর্ণব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত । বর্ণবাদের দাসানুদাস নরেন দত্ত তাই বলেছেন , ”বর্ণবাদই ভারতের মূল ঐশ্বর্য । বর্ণবাদ লুপ্ত হলে ভারত তলিয়ে যাবে ।” এবার দেখা যাক মতুয়াধর্ম বর্ণবাদকে স্বীকার করেছে নাকি অস্বীকার করেছে । ঠাকুর বলেছেন,
”নরাকারে ভূমন্ডলে যত জাতি আছে ।
একজাতি বলে মান্য পাবে মোর কাছে ।।”
অর্থাৎ বর্ণব্যস্থার কোন স্থান মতুয়াধর্মে নেই ।
(গ) বৈদিক বর্ণধর্মের বিধানে ব্রাহ্মণেরাই সর্বশ্রেষ্ঠ । সমাজের
সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রাধান্যই প্রতিষ্ঠিত থাকবে । তাই ব্রাহ্মণকে বেদের
গুরু হিসাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে । দেখা যাক এ সম্পর্কে হরিলীলামৃত কী
বলছে-
‘কোথায় ব্রাহ্মণ দেখ কোথায় বৈষ্ণব ।
আত্মসুখে স্বার্থবশে যত ভন্ড সব ।।’
(ঘ) বৈদিক ধর্ম হচ্ছে এমনই একটি গৃহ , যে গৃহে বাস করতে হলে ওই গৃহের
ভিতরেই জন্ম নিতে হয় । বাইরে থেকে ওই বৈদিক গৃহে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই ।
অর্থাৎ অন্য কোন ধর্মের মানুষ বৈদিক বা হিন্দুধর্মে প্রবেশ করতে পারে না বা
বৈদিক ধর্ম অন্য কোন ধর্মের মানুষদের নিজ ধর্মে গ্রহণ করে না । এই
সংকীর্ণ অমানবিক ধর্মের প্রতিবাদে মতুয়াধর্ম মানবধর্মের উপর জোর দিয়ে
বলেছে-
”এক ধর্ম ছাড়া দুই ধর্ম দেখ কোথা।
হিন্দুধর্ম খৃষ্টান ধর্ম বলা সবই বৃথা ।।”
(ঙ) ভগবান নিয়ে বৈদিক ধর্মে অলৌকিক ব্যাখ্যা এবং জল্পনা কল্পনার কোন
অন্ত নেই-ভগবান ক্ষীরোদেশ্বর , আবার কোথাও তিনি গোলকবিহারী । তবে যেখানেই
থাকুন না কেন তিনি সর্বশক্তিমান । বিশ্বের সব কিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন ।
তারই নির্দেশে পৃথিবীর মানুষ সহ সমস্ত প্রাণীকুল স্ব-স্ব স্থানে অবস্থান
করে আছে । তাদের কারুরই কোন কর্তৃত্ব নেই । সবই ঈশ্বর নির্ধারিত । হরিচাঁদ
ঠাকুর ভগবান নিয়ে এইসব অবাস্তব জল্পনা কল্পনা সকল নস্যাৎ করে দিয়ে ঘোষণা
করলেন-
”বিশ্ব জুড়ে এ নিয়ম দেখি পরস্পর ।
যে যাকে উদ্ধার করে সে তার ঈশ্বর ।।”
-অর্থাৎ কাল্পনিক ঈশ্বর বলে কেউ নেই । ঈশ্বর এই নৈসর্গিক জগতের হিত সাধনার্থে নিবেদিত কোন প্রাণ ।
(চ) বৈদিক ধর্মে আত্মার অবিনশ্বরতা নিয়ে নানা রকম গল্প গুজব প্রচলিত
আছে । বৈদিক গ্রন্থাদিতে সে সব যথেষ্ট আকর্ষণীয় করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।
বৈদিক মতে আত্মা হচ্ছে দেহ বহির্ভূত ভিন্ন কিছু , যা ঈশ্বরের নির্দেশে কোন
নির্ধারিত স্থান হতে নির্দিষ্ট মানুষের দেহে গিয়ে প্রবেশ করে । কিন্তু
হরিলীলামৃত গ্রন্থে এই তত্ত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে । সেখানে দেখতে পাই –
” তুমি স্থূল আমি সূক্ষ্ম উভয়ে অভিন্ন ।
দেহ আত্মা মোরা দোঁহে মূলে নহি ভিন্ন ।।”
(ছ) দীক্ষা সংস্করণ বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় জীবনের এক অচ্ছেদ্য
অঙ্গ । ব্রাহ্মণ কুলপুরোহিতদের নিকট থেকে এই দীক্ষাগ্রহণের নির্দেশ রয়েছে
বৈদিক ধর্মে । এই যৌক্তিক ক্রিয়ার অসারতা ঘোষণা করে হরিলীলামৃত বলেছে –
” গুরুরূপী ব্যবসায়ী কানে দিল মন্ত্র ।
প্রাণহীন দেহে যেন জুড়ে দিল যন্ত্র ।।
এ সব সামান্য কূপ সব ডুবে যাবে ।
হরিনাম মহামন্ত্রে জীব মুক্তি পাবে ।।”
(জ) বৈদিক ধর্মে ধর্মীয় সংস্কৃতি ভিতরে কাল্পনিক দেব- দেবীর মূর্তি গড়ে
পূজা করার এবং মৃত ব্যক্তির কর্ণে হরিনাম দিতে দিতে তাকে দাহন করানোর যে সব
নির্দেশাদি রয়েছে সে সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হরিচাঁদ নির্দেশ দিলেন-
”না মানিবে শিবদুর্গা কৃষ্ণপ্রেমে বাম।
না লইবে হরিনাম বলি মরা নাম ।।”
(ঝ) বৈদান্তিক মতে ধর্মীয় কর্মকান্ডের মধ্য মুখ্যই হচ্ছে তন্ত্রমন্ত্র
সহযোগে যাগযজ্ঞ হোম এই সকল ক্রিয়াদি । এই কারণে বৈদিক ধর্মীয় সংগঠনগুলি
যেমন শংকরমঠ , রামকৃষ্ণ মিশন , ভারত সেবাশ্রম সংঘ সহ বহু সংগঠন মন মন ঘি
এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি পুড়িয়ে প্রায়ই যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন
করতে থাকে । মতুয়াধর্মে এই সব যাগযজ্ঞের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হল-
”যাগযজ্ঞ তন্ত্রমন্ত্র কোন কিছুর নাহি প্রয়োজন ।
হরিনাম মহামন্ত্র জেন সর্বজন ।”
(ঞ) ঋগ্বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থাদিতে
নামসংকীর্তন বা নামযজ্ঞাদির উপর বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে এবং
বুঝাতে থাকে, হরিনাম করলে মানুষ তার কৃতকর্ম জনিত পাপ থেকে মুক্ত হতে পারে ।
হরিচাঁদ তার বিরুদ্ধেও গর্জে উঠে বলেছেন-
”ব্রহ্মত্ব সাযুজ্য মুক্তি কৃষ্ণভক্তে দন্ড ।
হরিনামে পাপক্ষয় কহে কোন ভন্ড ।।”
(ট) বৈদিক ধর্মে নির্দেশিত অলৌকিক স্বর্গীয় মুক্তিকে উপেক্ষা করে হরিচাঁদ বললেন –
”মুক্তি শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা যারা ভক্তি নাহি চিনে ।
হরিনামে পাপক্ষয় তারা ইহা ভণে ।।”
( ঠ) বৈদিক মতে প্রাণীর জন্ম এবং আত্মা নিয়ে এমন আজগুবি সব গল্প
ফাঁদানো হয়েছে যেখানে প্রাণ সৃষ্টির মূল উৎস মাতাপিতাকেই গৌণ করে দেখান
হয়েছে । লীলামৃত গ্রন্থে এই যুক্তিহীন আলোচনার প্রতিবাদে লেখা হয়েছে-
মাতাপিতা বৃক্ষের গোড়া হরি বৃক্ষের ফল ।”
(ড) বৈদিক তত্ত্বে লৌকিক জগৎকে উপেক্ষা করে অলৌকিক কাল্পনিক ঈশ্বরের
প্রতি আত্মদান করা এবং তার সান্নিধ্য বা দর্শন লাভের প্রচেষ্টাকে প্রেম বলে
আখ্যায়িত করা হয়েছে । এই তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিনিয়ত
পার্থিব চাক্ষুষ জগতের সব কিছু ভোগ করা সত্ত্বেও সেই জগতের প্রতি যারা
সর্বদা তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে এবং কাল্পনিক ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের
আনান্দ এবং পারলৌকিক সুখ ভোগকে জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে তারা হচ্ছে
আত্মসুখসর্বস্ব চরম ভোগাকাঙ্ক্ষী মানুষ । এদের ভ্রান্তি নিরসনে মতুয়া
দর্শন বলছে-
”আত্মসুখে কার্য করে তারে বলে কাম।
পরহিতে কর্ম যত ধরে প্রেম নাম ।।”
———এতক্ষণের বৈদিক এবং মতুয়াধর্মের তুলনামূলক
আলোচনা থেকে বৈদিক বা হিন্দুধর্মের সঙ্গে মতুয়াধর্মের পার্থক্যটা নিশ্চয়ই
বোঝা গেল । এবং মূল পার্থক্যগুলো তারক সরকার তাঁর গ্রন্থের ভিতরে অতীব
দক্ষতার সাথে নির্দিষ্ট করে রেখে গেছেন ।
Comments
Post a Comment