কিন্তু
এই কথাগুলোর আসল মানেটা বোঝা হয়ত অনেকের পক্ষেই সহজ হয়ে ওঠে না বা যারা
বোঝেন তারা এগুলো এড়িয়ে যান । আবার আমরা অনেকেই এই কথাগুলোর সাথে পরিচিত নই
– তাই বেশ অস্বস্তিতে ভুগি ।
বস্তুবাদীদের
কথা শুনলে আমাদের ভক্ত-মতুয়াদের যে অস্বস্তি হয় তার পেছনে অনেক কারণ
লুকিয়ে আছে । আসলে লুকিয়ে আছে বলছি কেন , এগুলো আমাদের সকলের সামনেই
প্রকাশিত । আর এর থেকে অনেক প্রশ্ন চলে আসে । উচিৎ অনুচিত ব্যাপারটা সময়ের
সাথে সাথে কতোটা পরিবর্তনশীল তাই আমরা অনেকে ঠিক করে বুঝতে পারি না ।
কিছু বাস্তব প্রশ্ন অতি কঠোরভাবে আমি উপস্থাপন করছি এখানে । এখানে ঐ অস্বস্তিকর ব্যাপারটিও আসবে ।
💠 সময় আমাদের চালনা করে । সময় অনেক কিছু আমাদের বলে দেয় । কি করতে হবে কি এড়িয়ে যেতে হবে ।
যখন
ঈশ্বর ভবনা আসে ও আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলি তখন শেষ কথায়
আমাদের নাস্তিক না হয়ে উপায় থাকে না । আমরা তো অনেকেই জানি যে কেউই ঈশ্বরকে
দেখাতে পারবে না । এটি একটি ভাবনা , যা মানুষকে অনেক কল্পনাপ্রবণ করে তোলে
। তাই আমরা বাংলা বাউল-জারি-সারি-পল্লী অনেক সাহিত্যে ঈশ্বর ভাবনা দেখতে
পাই । মতুয়া অশ্বিনী গোঁসাই যখন তার প্রাণের হরিকে নিয়ে গান করে তখন অমন
মধুর সঙ্গীতের অসাধারণ ভাবগাম্ভির্য ও সাহিত্য রসকে আমরা কি করে এড়িয়ে যাবো
? নাকি এটা ও এই রকম আর যতো প্রথা ও রুচি মতুয়াদের আছে তা গলা টিপে হত্যা
করতে হবে ?
মানলাম
এই ঈশ্বর ভাবনার ভাইরাসটি ব্রাহ্মণদের দ্বারাই আমদানিকৃত , কিন্তু তাই বলে
এই ব্যাপারটি খারাপ হয়ে গেলো ? আর খারাপ হলই বা কি করে তাও তো আমরা অনেকে
ঠিক করে জানি না । তবে আমার মনে হয় এভাবে এটা খারাপঃ
ব্রাহ্মণরা ঈশ্বর ভাবনায় আমাদের উৎসাহিত করেছে ।
তাদের দেব-দেবী , মন্ত্র-তন্ত্র ও অনেক আচার-অনুষ্ঠানের স্বরচিত ও আবোল-তাবোল নিয়ম শিখিয়েছে ।
আর তারা বর্নপ্রথা বানিয়ে ধর্মিয় প্যাঁচ কষে নিজেদের উচ্চস্থানে রেখে নিম্নবর্নের সর্বস্ব ভোগের সুদূর প্রসারি বন্দোবস্ত করেছে ।
💠
তাই যখুনি মতুয়ারা বাড়িতে বৈষ্ণব ডেকে হরি-প্রেমের বন্যা বইয়ে দেয় কিংবা
যখন ঐ হরি-প্রেম ব্যাপারটি সামনে নিয়ে এসে বন্ধুদের একটু ভাব রস দিয়ে
আবেগঘন করে দিতে চায় তখুনি আমরা বস্তুবাদিরা তাই নিয়ে উচিৎ-অনুচিতের প্রশ্ন
তুলতে ছাড়ি না । কারণ ঐ , ঐ ব্রাহ্মন্যবাদের Practice হচ্ছে কি-না এই কথা ।
ব্যাপারটা এমন যে ,
💠 বস্তুবাদীরা যেভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করেন তা হল,
যখনই
ঈশ্বর সম্বন্ধীয় যে কোনো সাহিত্য আমাদের মন কেড়ে আবেগকে নাড়া দেয় তখন আমরা
ব্রাহ্মণদের পথ অনুসরণ করছি ধরে নিতে হবে । কারণ ঐ ঈশ্বর ব্যাপারটি এখানে
উপস্থিত ।
আজ এক মতুয়া মনে করছে সে ব্রাহ্মন্যবাদ বা ব্রাহ্মণদের নিয়ম সমর্থন করে না । তাই সে মতুয়া ।
💠
সেই মতুয়া ব্যাক্তিটিই কি মনে করেন সেটা দেখা যাক :- ব্রাহ্মণরা ঈশ্বর
ভক্তিতে ও প্রাপ্তিতে তাদের অগ্রাধিকারের কথা আগে এনেছে অনেক গ্রন্থে ।
হরিচাঁদ এসে মনুষরূপী হরিকে সেবা করার পথ বলে দিলেন ও আমাদের শেখালেন এটাই
ঈশ্বর তুষ্টের সবচাইতে সম্মানের ও সহজ পথ । তাই আমাদের নিজস্ব পথ অবলম্বন
করে আমরা নিচু জাত হয়েও ঈশ্বর-সেবার অধিকার পেয়েছি । আমরা পূজা পার্বনে
বামুন বা ব্রাহ্মণ ডাকবো না । নিজেরাই পূজা করবো । কারণ আমরা সে অধিকার
পেয়েছি ।
—
মতুয়াদের এই ব্যাপার দেখে বস্তুবাদীরা মুচকি হেসে আপন মনে বলেন , এঁরা
এখনো ব্রাহ্মণদের কৌশলের থেকে বেরুতে পারে নি । যখন পূজা-পার্বন ও
হিন্দুজাতীয় নিয়মের অনুসরণ করা হয় তখন তো ব্রাহ্মণকেই সমর্থন করা হয় , নয়
কি ?
💠 ধরি , এগুলো ব্রাহ্মণদের শেখানো পথ ও আমাদের এগুলো থেকে সম্পূর্ন বেরিয়ে আসতে হবে । তাই ব্রাহ্মণদের সব কিছুই বর্জন করতে হবে ।
এই ভাবনা থেকে কি হয় দেখুনঃ ⤵⤵⤵
–
আমরা বলবো এটা পারলৌকিক ভাবনা থেকে আসা গানের কথা । এই পারলৌকিক ব্যাপারটা
সম্পূর্ন ব্রাহ্মণদের শেখানো পথ । আজ এই গান শুনে লোকে তা গাইতে থাকবে ,
আর কাল আমরা ইহলৌকিক কাজ ছেড়ে হরি-প্রেমে ভেসে কল্পনার স্বর্গে বিভোর হবো ।
আর তারপর এই ঈশ্বরের স্বরূপ খুঁজতে গ্রন্থের স্বাদ নিতে যাবো ব্রাহ্মণদের
রচিত সাহিত্যে ও পথে । ঈশ্বরে বিশ্বাস ও তাকে পাবার ও তাকে পাবার আনন্দের
তীব্র বাসনা যখন প্রখর হবে , তখন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে যুক্তিযুক্ত ও পরম সঠিক
পথে ঈশ্বরকে ভাবার ব্রাহ্মণদের পথ অনুসরণ করবো ।
কিন্তু এটা উচিৎ নয় । তাই অশ্বিনীর ঐ সাহিত্য রসের নামে ব্রাহ্মণদের ধ্বজা ওড়ানো বন্ধ করা উচিৎ । কারণ মতুয়ারা অমন নয় ।
⏩ তারপর দেখুন , পশ্চিমা দেশে সংস্কৃতি কি আছে তা আমরা অনুধাবন করতে পারি ।
এবার
যখন বিয়েটা হয় মতুয়া নিয়মে ও তাতে ঈশ্বর সম্পর্কিয় কোনো শ্লোক উচ্চারিত হয়
তখন তা আমাদের চিন্তাশীল ব্যাক্তিদের মনে ভাবনার উদ্রেক করে । বিশেষ করে
যখন কোনো সামান্য নিয়ম বা আচার-অনুষ্ঠানের কিছুটা কোনোভাবেও যদি
ব্রাহ্মণদের সাথে মেলে তাহলে তাকে ব্রাহ্মন্যবাদের প্রতিফলন বলতে আমরা
বস্তুবাদীরা দ্বিধা করি না । আমরা বস্তুবাদীরা তখন বলি , আজ এই হয়েছে কাল
এর কারন খুঁজতে যখন ঈশ্বরের সত্যতা ব্যাপারটি আধতাত্মিক জ্ঞানে ভাবা হবে
তখন ঈশ্বরকে পাবার পুস্তকীয় যুক্তি-যুক্ত পথ আমরা ব্রাহ্মণদের বইতেই পাবো ও
তা অনুসরণ করবো ।
এখন
বস্তুবাদীরা এটা কি করে ব্যাখ্যা করবেন যে , যদি এই ভাবে আমরা ইশ্বর
সম্বন্ধীয় ব্যাপারগুলোকে বাদ দেই তাহলে আমাদের নিজেদের রীতিনীতি , আচার ,
অনুষ্ঠান , সংস্কৃতি বলে কি রইলো ?
তারা কি বুঝাতে চাইছেন যে , পশ্চিমা দেশের সংস্কৃতিকে আমাদের মানা উচিৎ ?
উত্তরে হয়তো পাবো , ধান কাটার উৎসব ধর্মিয় নয় । এটা প্রাপ্তির আনন্দের এক প্রতিফলন । এমন করেই আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে পেতে পারি ।
এবার তবে মূল প্রশ্নের অবতারণা করতে হয় ,
আমরা
এই ভারতবর্ষের সকল জনগন যদি এক সাথে ঈশ্বর ব্যাপারটি থেকে মুক্ত হয়ে যাই
তাহলেও কি আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে ফিরে পাবো ঠিক তখুনি ? ঠিক সাথে সাথে ?
এর কি উত্তর আশা করা যায় ? এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন । কারণ সংস্কৃতি ও আচার , সামাজিক রীতিনীতি আমাদের সঠিক পথে চালনা করে ।
আর , এই রীতিনীতি-আচার-অনুষ্ঠান-সামাজিক
মনুষ
তার নিজের সুখ-দুঃখের অনুভূতি দিয়ে এইগুলো যাচাই করে তবে একে গ্রহণ করে
থাকে । নকশী কাঁথায় পল্লীবঁধু তার সুখদুঃখের সুতোর বুনন বোনে ।
হরিচাঁদ আমাদের সুখ-দুঃখের সাথে মিশে আছেন । আর তাকে আমরা মিশিয়েছি হরি নাম দিয়ে ।
এটা বাস্তব ও অস্বস্তিকর হলেও সত্যি যে , আমরা ব্রাহ্মণদের ঈশ্বরীয় পথেই হরিকে ভাবছি ।
দূরের
পথে যাত্রাকালে ছেলে যখন ঘর থেকে বের হয় তখন মা তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে
বলে , বাবা ভগবান তোমায় দেখে রাখুক । এই চেতনা কিসের চেতনা ? ব্রাহ্মণদের
দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই চেতনা কি কোনো অপরাধ করেছে ? হয়তো করেছে ।
আমার
মনে হয়, আমরা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হই নি । বিশেষ করে এই আমাদের , পিছিয়ে
পরা জনগণের , সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মন্যবাদের একটা স্রোত যোগ হয়েছে মাত্র । এর
থেকে মুক্ত হবার একটি যুক্তিযুক্ত ও সময়োপযোগী ভাবনার দরকার আছে । আমি এমন
একটি ভাবনার কথা বলছি যার সাথে সকলে একমত হবেন । সেটা এমনই এক ভাবনা যা
যেমন করে আমাদের মতুয়া ভক্তদের আবেগকে ও সাহিত্যরসকে লালন করবে , ঠিক সেই
সাথে আমাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । এটাই সবচাইতে
আকাঙ্ক্ষিত ।
২.
নাকি , অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী ও নিজেদের সংস্কৃতির উন্নতির কথা আগে ভেবে ও
তারপর ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য বিষয় থেকে বের হয়ে সার্বজনীন সমতার কথা ভাবা ?
💠 বলতে পারেন যে , ঐ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী ও নিজেদের সংস্কৃতির উন্নতির কথা আগে ভাবতে গেলেও ব্রাহ্মণদের কথা না ভেবে তো উপায়ই নেই ।
এখানে
আমি আপনাকে জানিয়ে রাখি , আমাদের গ্রাম-বাংলার মতুয়ারা তাদের আচার
অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের যে পথ অনুসরন করে তাতে ব্রাহ্মণদের পুঁজিবাদী হবার
কোনো ব্যাপার একদম থাকে না বললেই চলে । তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে — যেন
কোনো ব্রাহ্মণ কোনো ভাবেই আমাদের উপার্জিত অর্থের ভোগ না করতে পারে । কোনো
পুস্তকীয় যুক্তি-তক্কের ছল-চাতুরি এখানে গ্রহণযোগ্য নয় ।
আপনি
যদি আমার কথা ভেবে শঙ্কিত থাকেন তবে আবারো বলি , আগে আপনি কিসের কথা
ভাবছেন ? ব্রাহ্মণদের সংস্কৃতি থেকে মতুয়াদের মুক্ত হবার কথা ? নাকি,
মতুয়াদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা ? কোনটা ? — এই পূর্বের প্রশ্নটাই আবার
করলাম ।
💠
আসলে আমাদের ধীরে ধীরে এগুতে হবে । এমন ভাবে এগুতে হবে যেন সব ছিন্ন-ভিন্ন
না হয়ে যায় । আমরা বাংলার মাটির দরদিয়া আবেগের পল্লিসাহিত্যকে লালন করবো ।
লোকে যেন আমাদের সাথেই থাকে । আবার পরম মুক্তির পথে তাদের নিয়ে চলবো যেন
তারা অর্থনৈতিক ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে । স্থান-কাল-পাত্র আমাদের বলে
দেবে কি করতে হবে , কিভাবে এগুতে হবে । কাকে কখন কোন জায়গায় আঘাত করতে
কিংবা দরদ দিতে হবে তা বুঝতে হবে ।
তবে
তার আগে আমরা যারা বস্তুবাদী কিংবা সত্যানুসারী তাদের কিছু ব্যাপার ঠিক
করে নিতে হবে । আমাদের একটা Standard ধরে নিয়ে কথা বলা উচিৎ । সেটা
মতুয়াদের সামাজিকতা নিয়ে Standard . যা তাদের করা উচিৎ ।
আমাদের
জীবনের সার্থকতা কোথায় ও আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি — এই নিয়ে মতুয়া
ভক্ত ও হরিভক্তদের আঘাত দিয়ে কি কোনো কার্য সিদ্ধি হবে ?
তাই এই সকল পরম প্রশ্নের উত্তর ও সামাজিক আচার-রীতিনীতি ঠিক করে আমাদের কথা বলা উচিৎ ।
Comments
Post a Comment