কোন মহা মানব/মানবী’র আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি কোন সমাজের উদ্ধারের কাজ কররে সেটা যেমন সামগ্রীক কল্যানের জন্য হয়, তেমনি তিনিও তখন আর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে রববেচিত হন না। তিনি দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সকলের হয়ে যান । বিশেস করে তাঁর কর্ম ও অদর্শকে যারা অনুসরণ করেন ,তাদের কাচে তিনি মহানরূপে বিবেচিত হন ।
গত কয়েক দিন ধরে Facebook এ দেখছি ,বাংলাদেশের পা্ঠ্য পুস্তকে “শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ” Subject এ যে বর্ননা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক । যেমন-(হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতা) যশোমন্ত ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ ।(হরিচাঁদ ঠাকুর) তিনি নতুন কোন ধর্ম প্রচার করেননি । তিনি মহাপ্রভু শ্রীচেতন্যের হরিনাম প্রচার করেছেন । ইত্যাদি ।
এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত,যুক্তি ও প্রমান দেওয়ার চেষ্টা করছি ।
মহাকবি তারক সরকার রচিত ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-এর বংশ তালিকায় দেখান হয়েছে যে, হরিচাঁদ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ মৈথিলী ব্রাহ্মণ ছিলেন । এটাকে প্রমান হিসাবে ধরলে আমরা বলতে পারি যে, হরিচাঁদ ঠাকুর নিজে এবং পরবর্তী বংশধররা ও স্বাভাবিক ভাবে ব্রাহ্মণ হবেন । তাহলে কোন বিবাদই থাকেনা, তাই নয় কি?
এবার আমার প্রশ্ন হচ্ছে-হরিচাদ ঠকুরের সুযোগ্য পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-(যেটা আমরা মহানন্দ হালদার রচিত ‘শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত’-এ পাই)
নমঃশূদ্র কুলে জন্ম হয়েছে আমার ।
তাই বলে আমি নহি নমোর একার ।।
এখানে গুরুচাঁদ ঠাকুর সুম্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে, তিনি নমঃশূদ্রের ঘরে জন্ম গ্রহন করেছেন ।তাই বলে আমি নহি নমোর একার ।।
এর পরে আমরা আরো দেখতে পাই যে, পি.আর. ঠাকুর ও মঞ্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর (যাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধর) ভারতে তফশীলিদের জন্য সংরক্ষিত কেন্দ্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন এবং আইন সভার সদস্য হয়েছেন। তাহলে ওটা প্রমান হিসাবে ধরে নেওয়া যায় যে, তাঁদের তফশীলি প্রমানপত্র আছে ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে হরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পূর্ব পুরুষ ব্রাহ্মণ হন কিভাবে ? আর এ প্রশ্ন মতুয়া সংঙ্গের কাছে ও রইল ।
(আমার কাছে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে শ্রীহরিবর সরকার কর্তৃক প্রকাশিত যে শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত আছে তাতে কিন্তু কোন বংশ তালিকা নেই।
এবার আসি হরিচাঁদ ঠাকুর বৈষ্ণব ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম বা ব্রাহ্মণ ধর্মের প্রচার করেচেন নাকি সত্যি সত্যি তাঁর মতবদীদের অন্য ধর্মের বাণী শুনিয়েছেন ? ,বাংলাদেশের পা্ঠ্য পুস্তকে লেখা হয়েছে-
‘(হরিচাঁদ ঠাকুর) তিনি নতুন কোন ধর্ম প্রচার করেননি । তিনি মহাপ্রভু শ্রীচেতন্যের হরিনাম প্রচার করেছেন।’
আমরা ‘শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত’-এ প্রথমেই দেখতে পাই যে,
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য ।
যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।।
বুদ্ধের কি কামনা ছিল ?বুদ্ধ চাইতেন সমাজ ,দেশ ও দশের কল্যান হোক,
মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ মিটে যাক। সব মানুষ সমান অধিকার অর্জন করুক এক কথায়
–সমতা,স্বতন্ত্রতা,বন্ধুতা ও ন্যায় ।এইকামনা কে পূর্ণ করার জন্যই হরিচাঁদ
ঠাকুরের আবির্ভাব ।আর তিনি এটাই করার চেষ্টা করেছেন ।যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।।
হরিচাঁদ ঠাকুরের বাবা যশোমন্ত বৈষ্ণব ভক্ত ছিলেন এটা নিঃসন্দেহ । কিস্তু বালক হরিচাঁদ বৈষ্ণবদের আচার আচরনকে একটুও পছন্দ করতেন না । তাই বৈষ্ণবরা স্নান করতে গেলে বালক হরিচাঁদ তাদের ঝোলা গুলো উল্টিয়ে দিত । এতে তার বাবা রেগে গিয়ে তাকে শাস্তি দিলে সে কিন্তু বলত বৈষ্ণবরা ভন্ড ওদের চলে যেতে বল ।
ঝোলা রাখি বৈষ্ণবরা স্নানে পানে যায়।
উজাড় করিয়া ঝোলা ঠাকুর ফেলায় ।।
দুরন্ত অশান্ত পুত্রে পিতা দেয় দন্ড ।
কেঁদে বলে হরিচাঁদ বৈরাগীরা ভন্ড ।।
পিতৃ-কোলে থাকি হরি ক্রোধ করি বলে ।
ভন্ডবেটা বৈরাগীরা দূরে যারে চলে ।।
হরিচাঁদ ঠাকুর তথা কথিত স্কুল শিক্ষা গ্রহন করতে না পারলেও সমাজের
ধর্মীয় কুসংস্কার তাঁকে ব্যথিত করে তোলে ।তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের
কুটিলতাকে ভালভাবে বুঝতে পারেন ।তাই তিনি ঘোষণা করেন-উজাড় করিয়া ঝোলা ঠাকুর ফেলায় ।।
দুরন্ত অশান্ত পুত্রে পিতা দেয় দন্ড ।
কেঁদে বলে হরিচাঁদ বৈরাগীরা ভন্ড ।।
পিতৃ-কোলে থাকি হরি ক্রোধ করি বলে ।
ভন্ডবেটা বৈরাগীরা দূরে যারে চলে ।।
ব্রাহ্মণ্ রচিত যত অভিনব গ্রন্থ।
ব্রাহ্মণ্ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র ।।
এখনে তিনি ব্রাহ্মণ্ দের রচিত গ্রন্থকে বিজ্ঞাপন যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন । তিনি আবার বলেছেন-ব্রাহ্মণ্ প্রধান মার্কা বিজ্ঞাপন যন্ত্র ।।
কুকুরের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ পেলে খাই ।
বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই ।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হইবেক যেই ।
না থাকুক ক্রিয়াকর্ম হরি তুল্য সেই ।।
এখানে তিনি বেদ অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের আকর গ্রন্থ ‘বেদ’কে মানতে চাননি । বেদে যে নিয়ম কানুন আছে তাকেও তিনি অস্বীকার করেছেন ।বেদ-বিধি শৌচাচার নাহি মানি তাই ।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হইবেক যেই ।
না থাকুক ক্রিয়াকর্ম হরি তুল্য সেই ।।
তিনি মানুষকে সত্যবাদী হ’তে বলেছেন । পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জয় করতে বলেছেন ।আর যিনি সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয় হবেন তিনি ও হরি তুল্য হবেন। তিনি কোন ক্রিয়া কর্ম না করলেও তাতে কোন অসুবিধা নেই বলেছেন ।
হরিচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণদের ও বৈষ্ণবদের দূরভী সন্ধিকে খুব ভাল ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তাই তিনি আবার স্পষ্ট ঘোষণা করলেন-
নামে প্রেমে মাতোয়ারা মতুয়ারা সব ।
কোথায় ব্রাহ্মণ লাগে কোথায় বৈষ্ণব ।।
কোথায় ব্রাহ্মণ কোথায় বৈষ্ণব ।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভন্ড সব ।।
এবার বলুন যিনি বৈষ্ণবদের তীব্র বিরোধীতা করেছেন ,তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক কি করে হন?কোথায় ব্রাহ্মণ লাগে কোথায় বৈষ্ণব ।।
কোথায় ব্রাহ্মণ কোথায় বৈষ্ণব ।
স্বার্থবশে অর্থলোভী যত ভন্ড সব ।।
যিনি বেদেকে অস্বীকার করেছেন ,তিনি তিনি হিন্দু ধর্মের প্রচারক কি করে হন?
যেখানে তিনি ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের ভন্ড বলেছেন , অর্থলোভী বলেছেন , সেখানে তাঁর উপর আমরা বৈষ্ণব ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের প্রচারকের তকমা কিভাবে লাগাতে পারি ? এটা তাঁর প্রতি ও তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি অবমাননা নয় কি?
সর্বপরি এটা মতুয়া ধর্ম ও মতুয়া অনুনায়ীদের প্রতি অবমাননা নয় কি?
ঐ পাঠ্যপুস্ককে আর একটি খথা বলা হয়েছে- “মতুয়া সম্প্রদায় তাঁকে(হরিচাঁদ ঠাকুরকে) বিষ্ণুর অবতার হিসাবে জ্ঞান করেন । তাই তারা বলেন-
রাম হরি কৃষ্ণ হরি হরি গোরাচাঁদ।
সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ ।।”
এ বিষয়ে আমি সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের লেখা ‘মতুয়া ধর্ম এক ধর্ম বিপ্লব’
বই-এর ৩৩ ও ৩৪ পৃ:থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি –‘লীলামৃত গ্রন্থে রাম,কৃষ্ণ
,শ্রীচৈতন্য সবার উল্লেখ আছে । তাদের অবতার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে ।
কিন্তু নানা কথার আড়ালে তারকচন্দ্র যখন লেখেন-সর্ব হরি মিলে এই পূর্ণ হরিচাঁদ ।।”
নিত্যানন্দ হরি কৃষ্ণ হরি গৌরহরি ।
হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি ।।
…………………………………
এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে ।
ব্রহ্মা,বিষ্ণু,শিব অতিক্ষুদ্র তার কাছে ।।
-এ কথায় আমরা কি বুঝি ?নকলকে নকল না বলেও হরিচাঁদের আগে ‘আসল’ শব্দটা
জুড়ে দিয়ে তারকচন্দ্র আমাদের নকল চিনিয়ে দেন ।পরম্পরা আর থাকে না । কারণ
আসল ও নকলে পরম্পরা হয় না,থাকে বৈপরিত্য । ভদ্রভাষায়, সৌজন্যতার সীমা
অতিক্রম না করে, অতীব সূক্ষভাবে রসরাজ তারক সরকার আমারদের যে গভীর শিক্ষা
দিয়েছেন, তা খুঁজে নিতে হবে ।হরিচাঁদ আসল হরি পূর্ণানন্দ হরি ।।
…………………………………
এই ওড়াকান্দি আজ যেবা আসিয়াছে ।
ব্রহ্মা,বিষ্ণু,শিব অতিক্ষুদ্র তার কাছে ।।
দুষ্কৃতি বিনাশ আর ধর্ম সংস্থাপণ ।
গৌরাঙ্গের প্রেমবাণে ধরা ডুবে যায় ।
সেই প্রেম শুষ্ক হলো কলির মায়ায় ।।
……………………………………..
দূরন্ত কলির মায়া প্রকৃতি সহায়ে ।
ভাঙ্গিল প্রেমের হাট ‘কুস্রোত’ বহায়ে ।।
অর্থাৎ তারক সরকারের সুস্পষ্ট অভিমত হল-শ্রীচৈতন্যের আন্দোলনের
চুড়ান্ত পরিনতি হল-তা সমাজের ক্ষেত্রে ,সমাজ প্রগতির ক্ষেত্রে খারাপ
প্রভাব ফেলেছে ।-যে মতবাদের পরিনতি ‘কুস্রোত’ বা মন্দের দিকে প্রবাহিত,
তাকে কখনও হরিচাঁদের মতবাদ বা মতুয়াধর্মের পাশাপাশি রাখা যায় না।”গৌরাঙ্গের প্রেমবাণে ধরা ডুবে যায় ।
সেই প্রেম শুষ্ক হলো কলির মায়ায় ।।
……………………………………..
দূরন্ত কলির মায়া প্রকৃতি সহায়ে ।
ভাঙ্গিল প্রেমের হাট ‘কুস্রোত’ বহায়ে ।।
Comments
Post a Comment